হলদে প্রজাপতি পর্ব-৫

0
371

#হলদে_প্রজাপতি
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য )
— অমৃতা শংকর ব্যানার্জি ©®

পাঁচ

( আগের অধ্যায় গুলোর লিংক অধ্যায়ের শেষে দেওয়া হল)

সেই একেবারে প্রথম দিনের কথা মনে পড়ল। যেদিন অজিত কাকু এসেছিলেন সেই অদ্ভূত আর্জিটা নিয়ে আমাদের বাড়িতে । আমাদের পুরুলিয়ার বাড়িটা ছিল বাগমুন্ডি ব্লকে মুখোশ গ্রাম চড়িদার কাছাকাছি । আমাদের গ্রামেও মুখোশ বানানোর একটা চল আছে । গরিব মানুষজন , চাষাবাদ করে, মুখোশ বানায় । পাশের গ্রামে গিয়ে দোকান দেয়। পুরুলিয়ার মাটিতে যেমন রুক্ষতা আছে , তেমন আবার বসন্তের রাঙা মেঠো রাস্তায় দুধার রাঙানো পলাশ আছে। রুক্ষতার মধ্যেও প্রকৃতির আমেজ আছে । জঙ্গল আছে। শান্তি আছে । সবচেয়ে বড়ো কথা, সারা দিন-রাত ছুটে বেড়ানোর কোলাহল নেই । যারা প্রকৃতির কোলে বেড়ে ওঠে , তাদের জীবন ধারার মধ্যে নিজস্ব কিছু জীবনমুখী শৈলীও গড়ে ওঠে । তারা আর ভবিষ্যতে ইঁট-কাঠ-পাথরের জঙ্গলে গিয়ে ভালো থাকতে পারে না, কখনোই না । আমাদের গ্রামের ছোট একটা প্রাইমারি স্কুলে আমি আমার শিক্ষাজীবন শুরু করি । তারপর জুনিয়র হাই স্কুলের পরে, ক্লাস নাইন থেকে এইচএস পর্যন্ত কাছাকাছি ছোট মফস্বল শহর বলরামপুরের স্কুলে পড়েছি । বাবা ছোট একটা প্রাইমারি স্কুলের টিচার ছিল । আমাদের গ্রামের বাড়ির কাছেই স্কুলটা । বাবা সামান্য একটা গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের একজন শিক্ষক হয়েও শিক্ষাদিক্ষা, জীবনের ছন্দ এবং তার বিভিন্ন দিকগুলো এত সুন্দর করে নিজের ভেতর পুষে রাখতে এবং তার প্রয়োগ করতে পেরেছিল, যা সত্যিই এক বিরল দৃষ্টান্ত। কথাবার্তা, আচার আচরন, জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, পোশাক-পরিচ্ছদ , সবই ছিল অদ্ভুত ধরনের শিষ্ট এবং শিক্ষনীয় । কিভাবে যে বাবা ছোটবেলা থেকে ঐরকম এক প্রত্যন্ত গ্রামে মানুষ হয়ে , মফস্বল থেকে পড়াশুনা করেও, এতখানি শিষ্ট এবং সৌম্য জীবন দর্শন গড়ে তুলতে পেরেছিল, তা যারা না বাবার সংস্পর্শে এসেছে তারা বিশ্বাস করতে পারবে না। অতি বড় শিক্ষিত মানুষের মধ্যেও এত মার্জিত , শিক্ষিত কথাবার্তা এবং আচার-আচরণে তার প্রতিফলন পাওয়া যায় না। ফলে আমার মধ্যেও ছোটবেলা থেকে যে জীবনবোধ এবং শিক্ষা গড়ে উঠেছিল, তা বাবার কাছ থেকেই পাওয়া ।

গ্রামের দিকে তো বটেই, শহরের দিকেও আজও যে কোনো বাবা-মা সন্তান হওয়ার সময় পুত্রসন্তানই কামনা করেন । আমার জন্মের সাথে সাথে আমার এক যমজ দাদাও জন্মেছিল । কিন্তু গর্ভকালীন সময়ে মায়ের শরীরের কোনো এক বিশেষ সমস্যা জনিত কারণে একটি সন্তান বৃদ্ধির সময় কম পুস্টি পেয়েছিল। আমার সেখানে নরমাল গ্রোথ হয়েছিল। ফলে দু’জনের জন্ম প্রায় একই সময়ে, দাদার কিছুক্ষণ আগে এবং আমার কিছুক্ষণ পরে হলেও, জন্মের পরেই ডাক্তাররা জানিয়েছিল দাদার অবস্থা খুবই ক্রিটিক্যাল। হয়তো সে বেশিদিন নাও বাঁচতে পারে । ব্যাস্, আরম্ভ হলো বাড়ির প্রত্যেকের, আমার দাদু ঠাকুমা , মা-বাবা, প্রত্যেকের আমার দাদাকে নিয়ে লড়াই । বেশিরভাগ যত্নআত্তি সমস্তই দাদারই প্রাপ্য ছিল, স্বাভাবিক কারণেই। একে তো তার জীবনীশক্তি কম, তার ওপরে আবার পুত্রসন্তান। কিন্তু, এত যত্নআত্তি পরিচর্যাতেও দাদা এক বছরও বেঁচে থাকেনি। তার আগেই মারা যায়। সকলেই অসম্ভব দুঃখ পেয়েছিল । তবে , শুনেছি মা নাকি পুত্রসন্তান হারিয়ে প্রায় পাগলের মতো হয়ে গেছিল । ডাক্তার বলে দিয়েছিল , মায়ের রিপ্রোডাক্টিভ সিস্টেমে কিছু কম্প্লেক্সিটির কারণে আবারো সন্তান ধারণ সম্ভব নয় । মা এতটাই ভেঙে পড়েছিল যে আমার দেখভাল প্রায় করতই না । সেই সময় থেকে আমাকে প্রায় কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে আমার বাবা । এত বছরের জীবনে তার ধ্যান জ্ঞান ছিল শুধু মেয়েকে মনের মতন করে মানুষ করা। পারেনি সে কথা আলাদা । আমি তো নিজের মনের মতন করেই মানুষ হতে পারিনি । তাহলে আর সন্তান হিসেবে বাবা-মায়ের মনের মতো কি করে হবো? তবে বাবার চেষ্টার কোন ত্রুটি ছিল না । নিজের গ্রামের স্কুলের চাকরির জন্য অন্য কোথাও যেতে পারেনি। আমাকে ছোট বেলায় গ্রামের স্কুলেই পড়িয়েছে। তবে বাবার নিজস্ব যা শিক্ষা দীক্ষা সমস্ত আমাকে আপ্রাণ সারাটা জীবন ধরেই দেওয়ার চেষ্টা করেছে । তাই আমি যখন ক্লাস নাইনে বড়ো স্কুলে এসে ভর্তি হলাম, তখন বাবা, মাকে নিয়ে আমার স্কুলের কাছে একটা ছোট ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতে আরম্ভ করেছিল । সেখান থেকে প্রতিদিন নিজে জার্নি করে যেত গ্রামের স্কুলে। আমি ছোট স্কুলে পড়তাম সে কথা ঠিক, তবে সেখানে প্রতিবছর ফার্স্ট হতাম। তারপরে এসে যখন বড় এইচএস স্কুলে ভর্তি হলাম, তখনও কিন্তু আমার পজিশনের কোন নড়চড় হলো না । সেখানেও আমি ফার্স্ট পজিশন ধরে রেখেছিলাম। ফলে, আমার এইচএস পরীক্ষা হয়ে যাওয়ার পরে বাবা দ্বিগুণ উৎসাহের সঙ্গে ভাবতে আরম্ভ করেছিল আমাকে ভালো কোনো কলেজে পড়িয়ে গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করানোর কথা। কিন্তু আমি গ্রামের মেয়ে। আমার পক্ষে হঠাৎ করে পড়াশোনার জন্য শহরে বাড়ি ভাড়া করে একা থেকে পড়াশোনা করার ক্ষেত্রে রিস্ক ফ্যাক্টর প্রচুর ছিল। বিশেষ করে মা মেয়েকে একা রেখে কোথাও পড়াশোনা করানোর কথা ভাবতেই পারত না । যে কারণে বাবা আমার এইচএস রেজাল্ট বেরোনোর আগের সময়টাতে খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল । সাইন্স নিয়ে পড়েছিলাম আমি এইচএস-এ । সাইন্স এর কোন একটা সাবজেক্টে অনার্স পড়ি , তারপর মাস্টার্স, এই ছিল বাবার ইচ্ছে । ইচ্ছে ছিল আমাকে কলকাতায় রেখে ভালো কোন কলেজ থেকে পড়ানোর । কিন্তু ছোট থেকে একেবারে গ্রামে বেড়ে ওঠা একটা মেয়ে কলকাতায় ওভাবে দুম করে বাড়ি ভাড়া করে থেকে সমস্ত কিছু আ্যডজাস্ট করে কলেজে পড়াশোনা করতে পারবে , এটা বাবাও বিশ্বাস করে উঠতে পারত না । ফলে খুবই দুশ্চিন্তার মধ্যে ছিল ।

এমন সময়েই হঠাৎ করে ‘মেঘ না চাইতে জলে’র মত অজিত কাকুর সেই অদ্ভুত আর্জি নিয়ে আমাদের গ্রামের বাড়ীতে আগমন । বাবা আর অজিত কাকু দুজনে একেবারে ছেলেবেলার বন্ধু। হরিহর আত্মা । দুজনে একসাথে স্কুলে পড়াশোনা করেছে । অজিত কাকু’দের বাড়ির অবস্থা খুবই ভালো ছিল। বর্ধিষ্ণু পরিবার । সেকেন্ডারি লেভেল এর পড়াশোনা হয়ে যাওয়ার পরে অজিত কাকুকে তার বাড়ি থেকে কলকাতার স্কুলে ভর্তি করে। তারপর সেখান থেকেই কলেজ। গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট হতে অজিত কাকু ব্যবসা শুরু করেন । তাদের পরিবারের রক্তে ছিল ব্যবসা। কয়েক বছরের মধ্যেই ব্যবসায় কাকু বেশ উন্নতি করেন এবং লভ্যাংশ প্রচুর হয়। তা থেকেই অজিত কাকু ছোট একটা টি এস্টেট এর প্রপার্টি কিনে নেয় । নর্থ বেঙ্গলে। সেই প্রপার্টি তখন দশগুণ হয়েছে । বিশাল এরিয়া জুড়ে টী এস্টেট এর মালিক তখন অজিত কাকু। যদিও ম্যানেজার আছে, তবুও অজিত কাকু শুধু ম্যানেজারের ওপর ভরসা করে অত বড় ব্যবসা ফেলে রাখতেন না । কলকাতার সল্টলেকে বড় বাড়ি, তাছাড়াও ভবানীপুরের বিশাল বড় একটা অ্যাপার্টমেন্ট। সমস্ত কিছু থাকতেও অজিত কাকু তার ফ্যামিলি নিয়ে ওই চা বাগানের বাংলোতে থাকতেন । একটি ছেলে , একটি মেয়ে, আর স্ত্রী , এই নিয়ে ছোট সুখের সংসার । তবে ছেলেমেয়ের পড়াশোনার ক্ষেত্রে তিনি কোনো রকম আপোষ করেননি। নিজেও পড়াশুনা ভালোবাসতেন এবং কখনই চাইতেন না নিজে ব্যবসায় এসেছেন বলে ছেলে বা মেয়ে ব্যবসা করুক। তিনি সব সময় চাইতেন ছেলে মেয়ে দুজনেই যেন মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করে এবং যত দূর যেতে পারে তারা যেন যায়। আমি যখন এইচএস দিয়েছি, তখন ওনার মেয়ে পড়ে ক্লাস এইটে। টিনেজ বয়েস, বছর চোদ্দো হবে । ছেলে বড়। ছেলের সঙ্গে মেয়ের বয়সের ডিফারেন্স অনেকটা, প্রায় বারো বছরের এজ ডিফারেন্স । ছেলে তাদের কাছে থাকেনা । পড়াশোনা করছে। রিসার্চ করছে সে তখন । ব্যাঙ্গালোরে থাকে । মেয়ে বান্টি, ভালো নাম শ্রীপর্ণা । সে বাবা-মায়ের সাথেই থাকে । নর্থ বেঙ্গলে তাদের যে বাংলোটা আছে সেখানে । সেখানে ভালো ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াশুনো করে । স্কুলটা শিলিগুড়িতে । তাদের নিজস্ব গাড়ি আছে। তাতেই প্রতিদিন যাতায়াত করে । শিলিগুড়ি সেখান থেকে বেশ কিছুটা দূরে হলেও গাড়িতে ঘণ্টাখানেকের বেশি সময় লাগে না।

সবেমাত্র এইচএস পরীক্ষা শেষ হয়েছে আমার। দিন পনেরো কুড়ি কবে । তখনও রেজাল্ট বের হতে দেরী আছে । অজিত কাকু একদিন সকালে আমাদের গ্রামের বাড়িতে এসে হাজির হন । কিছুক্ষণ পরে পাশের ঘর থেকে আমার ডাক পড়ল ।
— তরু মা ! একবার আসবি এখানে ? তোর অজিত কাকু তোকে ডাকছেন।
বাবার ঘরে গেলাম । সেটাই ছিল বাবার স্টাডি রুম , বৈঠকখানা । আবার গ্রামের কিছু ছাত্রছাত্রীকে বাবা বরাবর বিনা পারিশ্রমিকে পড়িয়ে এসেছে , যতদিন সেই গ্রামের বাড়িতে থাকত, তাদের পড়ার ঘরও সেটাই ছিল । বইতে পুরো ঘর ভর্তি। পুরোনো ঘর, চুনকাম ওঠা দেওয়াল। কিন্তু ঘরের ডেকোরেশন জুড়ে ছিল বিভিন্ন ধরনের বই । ঘরে ঢুকে দেখলাম, অজিত কাকুকে লাস্ট যবে দেখেছি তার থেকে আরো অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে চেহারায়। বিশেষ করে গেটআপে আদ্যোপান্ত সাহেবি ব্যাপার-স্যাপার । যেন কস্মিনকালেও কোনদিন ভেতো বাঙালি ঘরাণার সঙ্গে কোন যোগাযোগ ছিল না । অথচ বাবার কাছে এই অজিত কাকুর কত গল্পই শুনেছি । বন্ধুত্বের গল্প । এই সমস্ত জঙ্গলের মধ্যে খেলাধুলোর গল্প । গ্রামের বিভিন্ন ছোট বড় ঘটনা। বাবার কাছে সে সমস্ত গল্প শুনতে শুনতে আমার মনে হয় যেন সেই গল্পগুলোর অজিত কাকুই আসল , এখন যাকে দেখি সেটা মিথ্যা । লাস্ট দেখেছিলাম তারও চার পাঁচ বছর আগে । কাকু গ্রামে নিজের দেশের বাড়িতে প্রায় আসেনই না । শেষ দেখেছিলাম যবে , তার থেকেও অনেকটা পরিবর্তন হয়ে গেছেন। আমি গিয়ে কাকু, বাবা দুজনকেই প্রণাম করলাম ।

কাকু মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করে আমার দিকে তাকিয়েই বাবার উদ্দেশ্যে বললেন , কিরে ভবো? তোর মেয়ে তো একেবারে বড় হয়ে গেল। চড়চড় করে বেড়ে গেছে তো ।
বাবা গর্বিত গলায় বলল , তা হবে না? কলেজে পড়বে এবার ।
— মেয়ে তো তোর পড়াশোনায় খুব ভালো। শুনেছি আমি।
বলে আমাকে বললেন, বোস মা এখানে । চেয়ারে বোস্ । তোর সঙ্গে কথা আছে দুটো ।
আমি পাশে রাখা একটা চেয়ারে বসে পড়লাম।
অজিত কাকু বাবাকে বললেন, হ্যাঁ আমি তো শুনেছি তোর মেয়ে খুব ভালো পড়াশোনা করছে । ওকে দেখে বোঝা যাচ্ছে । চোখ মুখ ব্রাইট । যা বলছি শোন, এখানে এইভাবে মফস্বলের কোনো জায়গায় শহরে নিয়ে গিয়ে ছোট কোনো কলেজে ভর্তি করিসনা । আর কলকাতায় ওভাবে ও একা একা থেকে পড়াশোনা করতে পারবে না । তোর চাকরি আছে । তুই বৌদির সঙ্গে গিয়ে থাকতেও পারবিনা । তোর মেয়ে কি আমার মেয়ে নয় ? তোর কি মনে হয় , ও আমাদের সঙ্গে আমাদের বাড়িতে গিয়ে কোনরকম অযত্নে থাকবে বা ওকে নিয়ে টেনশন করার মত তোর কিছু থাকবে? যা বলছি শোন, ওর দায়িত্ব আমার । আমি ওকে নিয়ে গিয়ে ওখানে শিলিগুড়ির সবচেয়ে ভালো কলেজে এডমিশন করিয়ে দেবো। আমার মেয়ের স্কুলও শিলিগুড়িতে। ও প্রতিদিন বাড়ির গাড়িতে যায় । তরুও আমার মেয়ের সঙ্গে একসঙ্গে থাকবে। গাড়িতে যাতায়াত করে কলেজ করবে। কোন অসুবিধা হবে না। তুই একদম চিন্তা করিসনা । নিশ্চিন্ত হয়ে ওকে তুই আমার দায়িত্বে ছেড়ে দে । আমার মেয়ে আমার কাছে যেমন, ও-ও ঠিক তেমনটা হয়ে থাকবে । ও যাতে হায়ার এডুকেশন ভালো রকম ভাবে পায় , সমস্তটা আমি দেখব ।
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কি রে মা? তোর কোনো আপত্তি নেই তো ? আমার বাড়িতে গিয়ে থাকতে ?

সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত প্রস্তাব শুনে আমার বুকের মধ্যে উথাল পাথাল আরম্ভ হলো । আমি জন্ম থেকে কখনো বাবা-মাকে ছেড়ে থাকি নি। মাকে ছেড়ে থাকার কথা যদি বা ভাবতে পারি , বাবাকে ছাড়া আমার একটা দিনও চলে না । সেখানে সম্পূর্ণ বাবা-মায়ের চোখের আড়ালে কত দূরে, সেই নর্থ বেঙ্গলে গিয়ে থাকব? প্রায় অপরিচিত কিছু মানুষ জনের সঙ্গে ? অজিত কাকুকে সারাজীবনে বারকয়েক দেখেছি । তাছাড়া ওদের আর কাউকেই আমি চিনিনা । এদিকে সত্যিই ভালো কলেজ থেকে পড়াশোনা করার ইচ্ছেটাও প্রবল। সেটাও একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো নয়। আমি ‘হ্যাঁ’ ‘না’ কিছুই বললাম না । বাবার মুখের দিকে তাকালাম । বাবার ভীষণ আত্মসম্মানবোধ । নিজের শিরদাঁড়ার ওপর জোর রেখে যতটুকু পারে, সেইটুকুই করে । কারোর কোনরকম সাহায্য নিয়ে তার মেয়ে পড়াশোনা করবে, এটা বাবার জন্য বড় লজ্জার । সেদিন সেই প্রস্তাবের কোন পজিটিভ উত্তর অজিত কাকু পেলেন না । না পেয়ে নিজের গ্রামের বাড়িতে সেদিনকার মতো ফিরে গেলেন । তবে সেবার কাকু নিজের কিছু প্রয়োজনে সম্পত্তি ঘটিত কোন ফয়সালার জন্য জ্ঞাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে কথা বলার কারণে এসেছিলেন। তাই কিছুদিন সেখানে থাকার ব্যাপার ছিল । যে কদিন থাকলেন, প্রতিদিনই বাবার সাথে গল্প করতে আসতেন এবং ওই একই প্রস্তাব ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে উত্থাপন করতেন । এখানে কাকুর নিজস্ব একটা স্বার্থ ছিল । স্বার্থটা যদিও সংকীর্ণ কোন স্বার্থ নয় । ঠিক কি কারণে তিনি আমাকে ভীষণভাবে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন সেটা আমি পরে বুঝতে পেরেছিলাম । তবে একই কথা বিভিন্নভাবে বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে প্রতিদিন উত্থাপন করে করে অজিত কাকু বাবাকে এর পজিটিভ দিকগুলো খুব ভালো ভাবে বোঝাতে পেরেছিলেন । বাবা শেষমেষ রাজি হয়েছিল । কিন্তু সেই সঙ্গে আমার সেখানে থাকা, পড়াশোনা বাবদ যা কিছু খরচ হবে, সমস্তটাই বাবা দিতে চেয়েছিল। তাতে করে অজিত কাকু এতটাই অভিমান করেছিলেন যে , এত বছরের দুজনের বন্ধুত্ব প্রায় শেষ হতে বসেছিল । অগত্যা বাবাকে বুঝিয়ে সুজিয়ে আমাকে নিজের মেয়ের মতো করে নিজের কাছে রেখে কলেজের পড়ানো ব্যাপারে বাবা-মা দুজনের কাছেই অনুমতি আদায় করে নিয়েছিলেন অজিত কাকু ।

আমার রেজাল্ট বেরোলো কিছুদিন পর । আমি স্টার না পেলেও, ভালোভাবে ফার্স্ট ডিভিসনএ এইচএস পাস করলাম । অজিত কাকু নিজে এসে আমাকে নিয়ে গেলেন। শিলিগুড়ির ভালো কলেজে ভর্তি করে দিলেন। বোটানি অনার্স নিলাম।

তারপর সে এক অদ্ভুত ধরনের অন্যরকম জীবন যাত্রা শুরু হলো আমার । অজিত কাকুর স্ত্রী ভামিনী কাকিমা ভীষণ স্ট্রিক্ট একজন মহিলা। তাঁর সংসারে সমস্ত কিছু মেপে মেপে চলে। কোন একটা জিনিসে হাত দিলে সেটা সেই জায়গাতেই আবার রাখতে হয় ।এক ইঞ্চি সরিয়ে রাখলেও বিপদ। সকাল সাতটায় ব্রেকফাস্ট। সাড়ে নটায় লাঞ্চ । ঠিক দশটা বাজতে দশে আমি আর বান্টি দুজনে গাড়িতে চেপে বসি, কলেজ আর স্কুলে যাওয়ার জন্য। সন্ধে ছটায় টি। সাড়ে নটায় ডিনার । এরপর যার যা পড়াশুনো বা কিছু কাজ বাকি আছে, সেরে নিয়ে স্ট্রিক্টলি রাত এগারোটার মধ্যে বাংলোর সমস্ত লাইট বন্ধ হয়ে যাবে। আর এই যে সময়গুলো, ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনার , বা শুতে যাওয়ার সেই সময়ের কখনো দুমিনিট এদিক-ওদিক হয়না । পাক্কা ন’টা পঁচিশ মিনিটে রাত্রিবেলা আমাদের ডিনার টেবিলে হাজির থাকতে হতো। সাড়ে নটায় ডিনার সার্ভ হত । কুক খাবার সার্ভ করে দিত। সার্ভ করার সময় তাকে অ্যাপ্রন এবং ক্যাপ অবশ্যই পড়ে থাকতে হতো । একদিন সে ক্যাপ পরতে ভুলে গেছিল বলে কাকিমার সেকি বকুনি । প্রতিটা ক্ষেত্রেই এই রকম । কেউ একটু এদিক ওদিক করে ফেললে ঘোরতর বিপদ । শুধু সময়ের পাংটুয়ালিটি বলেই নয়, টাওয়েলটা আলনায় ঠিক কোথায় কিভাবে থাকবে, কতটা ঝুলবে ; বুক শেলফ থেকে বই নিলে তা কোথায় বসে কিভাবে পড়তে হবে, তারপর বইটা কিরকম ভাবে সেলফে আবার ঢুকিয়ে রাখতে হবে; বিকেলে কলেজ থেকে ফিরে একটু চারপাশটা ঘুরতে বেড়োলে ঠিক কটার মধ্যে ফিরে আসতে হবে ; অজিত কাকু দিনে কতবার চা খাবেন; বান্টি সকালের ব্রেকফাস্ট এর সঙ্গে ঠিক কতটা ফ্রুটজুস খাবে ; বাথরুমে স্নান করতে গেলে কোন কোন কল বা শাওয়ার কিভাবে খুলতে হবে , কে কোন বাথরুমটা কখন ব্যবহার করবে ; সমস্তটাই ভীষণ ভাবে নির্দিষ্ট ছিল। আমার জন্য সম্পূর্ণ একটা আলাদা বাথরুমের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছিল । আমার বাথরুমে ভুলেও কখনো কাউকে ঢুকতে দেওয়া হতো না । সপ্তাহের কোন দিন কি কি ফুল কোন কোন ঘরের ফ্লাওয়ার ভাস এ কত ঘন্টা করে রাখা হবে , -এই সমস্ত কিছুই সেখানে নির্দিষ্ট । তার আর কোন নড়চড় হওয়ার উপায় নেই । যেন সবাই দম দেওয়া পুতুল । প্রত্যেকের দম দেওয়ার নভ অপারেট করছেন কাকিমা ।

একটা মেয়ে, যে পুরুলিয়ার গ্রামে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াতো , খেলাধুলা করত, ছুটোছুটি করত, সমবয়সী বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে মিশতো, সম্পূর্ণ স্বাধীন একটা জীবনযাত্রা , সে এমন এক জায়গায় এসে পড়ল , যেখানে সারাদিনের মধ্যে এক মিনিটের স্বাধীনতা ভোগ করা যায় না । বাংলোয় যতক্ষন আছি। শুধু কলেজ আওয়ার্স টুকু একটু নিজের মত থাকা যায় । তাও আবার সম্পূর্ণ নতুন জায়গা, নতুন এনভারমেন্ট , নতুন কলেজ। তার ওপর আমি পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়ে । কথা , আচার আচরণের মধ্যে প্রচুর অসঙ্গতি প্রত্যেকের নজরে পড়তো। গ্রাম্য ভাব ।

ভামিনী কাকিমা তো আমার তেল মাখা জবজবে চুল , দুটো বিনুনি , কথা বলার পুরুলিয়া ঘেঁষা গ্রাম্য একটা টান , চলাফেরা, বসা, শোয়া , কোন কিছুর মধ্যেই কোন শিষ্টতা বা সফিস্টিকেশনের তিলমাত্র ছোঁয়া দেখতে পেতেন না । আমাকে মানুষ গোত্রের মধ্যে ফেলতেই তাঁর আপত্তি ছিল। অজিত কাকুর ওপর তিনি ভীষণ রকম ক্ষুব্ধ ছিলেন। কোথাকার একটা গেঁও ভূতকে এভাবে তাঁর সাজানো গোছানো সংসার, টিপটপ চোখ ধাঁধানো বাংলোর মধ্যে হঠাৎ করে এনে ফেলার জন্য । আমাকে নিয়ে তাঁর অভিযোগের কোন অন্ত ছিল না। ভীষণ রকম হীনমন্যতায় ভুগতে আরম্ভ করলাম । নিজেকে মানুষ বলেই মনে হতো না। কতখানি যে নিকৃষ্ট প্রাণী বলে মনে হতো নিজেকে, তা বলে বোঝাতে পারবো না । মনে হতো, আমি কিছুতেই ভদ্র সমাজের উপযুক্ত নই। কোন শিক্ষা-দীক্ষা শিষ্টাচার, সৌজন্যবোধ কিছুই আমার নেই। রাত্রিবেলা শুয়ে শুয়ে সেই হীনমন্যতার কারণে প্রতিদিন টুপ টুপ করে ঝরে পড়ত চোখের জল । বালিশ ভিজে যেত ।

কোথায় গেল সেই খোলা প্রান্তর ,স্বাধীনতার আকাশ, নিজের মনের মত ছুটে বেড়ানো, বাবা-মায়ের কাছে যখন যা খুশি আবদার…কোথায় গেলো বাবা মায়ের চোখের মণি করে রাখা সেই তরু । হারিয়ে গেল । একটা নতুন মেয়ে জন্ম নিল । যে সর্বক্ষণ ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে । অসম্ভব রকম হীনমন্যতায় ভোগে। একটা বাড়িতে রয়েছি , অথচ তার কোনো কিছুই নিজের নয় । যেকোনো জায়গায় হাত ছোঁয়াতে ভয় পেতাম । মনটা ঠিক যেন শামুকের খোলসের ভেতর ঢুকে সমস্ত দরজা-জানলা বন্ধ করে দিল নিজে থেকে। চারিদিকে অত সুন্দর পরিবেশ , চা বাগান , অথচ সে কোনো কিছুই আপন করে নেওয়ার মতো মনটা অবশিষ্ট রইল না । সে কেন্নোর মতো গুটিয়ে গেল । ঠিক খোলা আকাশের নিচে একটা পাখিকে দাঁড়ের ওপর শিকল বেঁধে রেখে দিলে যেমন হয় । চোখের সামনে খোলা আকাশ , অথচ উড়ে যাওয়ার উপায় নেই।

ক্রমশ..

©®copyright protected

এক-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/978775899579141/

দুই-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/980083989448332/

তিন-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/981378992652165/

চার-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/983543179102413/

ছবি : সংগৃহীত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here