হলদে প্রজাপতি পর্ব-৪

0
371

#হলদে_প্রজাপতি
(প্রাপ্তমনস্কদের জন্য )
— অমৃতা শংকর ব্যানার্জি ©®

চার

( আগের অধ্যায় গুলোর লিংক অধ্যায়ের শেষে দেওয়া হল)

আমার বাংলোটা ভারী পছন্দ হয়েছে। ছোটখাটো, ছিমছাম , সাজানো-গোছানো । প্রকৃতির কোলে । বাউন্ডারি ওয়াল বলে সেভাবে কিছু নেই । কিছুটা ফেন্সিং করা রয়েছে। তবে বাউন্ডারি ওয়াল নয়। একতলা বাংলো । লম্বাটে । ঢুকেই একটা লম্বা বারান্দা । বারান্দার ডান পাশে ডাইনিং রুম । তারপর দুটো বেডরুম । দুটো টয়লেট । ওপেন কিচেন ডাইনিং স্পেস এর মধ্যে। ভেতরটা যে খুব সাজানো , তেমন নয় । তবে ছিমছাম এবং মিনিমাম যা কিছু আসবাবপত্র লাগে সবই রয়েছে । চেয়ারগুলো সব বেতের । ডাইনিং টেবিলের সাথে চারটে চেয়ার । তাছাড়াও এক্সট্রা দুটো চেয়ার রয়েছে । দুটো আলমারি রয়েছে দুটো বেড রুমে , কাঠের । এছাড়া ওয়াল আলমারি রয়েছে একটা। এলইডি টিভি রয়েছে । কিন্তু দুঃখের কথা, সেটা আমার খুব একটা কাজে লাগে না । শুধুমাত্র সারাদিনের কাজ সেরে এসে টুকটাক নিউজ চ্যানেলগুলো ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখি এই আর কি। আমি সাথে করে বেশ কিছু গল্পের বই নিয়ে এসেছি । সেগুলোই পড়ে সময় কাটাবো বলে । তবে , এখনো পর্যন্ত সময় কাটানোর মত সময় পাইনি। এস্টেটের কাজকর্ম বুঝে নিতে বাংলোয় ফিরে এসো প্রতিদিন অফিসের ফাইল পত্র নিয়ে বসতে হয়েছে । তাছাড়া যেটুকু সময় ফ্রি থেকেছি, টগর উন্মুখ হয়ে বসে থেকেছে গল্প করার জন্য । ও খুব গল্প করতে ভালোবাসে । অথচ আমি সারাদিন বিজি থাকি ।ওর একটু অসুবিধা হচ্ছে বটে ।

দেখতে দেখতে সাতটা দিন এখানে কাটিয়েও ফেললাম । মোটামুটি প্রতিদিনের একই রুটিন। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে টয়লেটের কাজকর্ম সেরে কিছুক্ষণ সামনের লনে ঘুরে বেড়াই। ইচ্ছে হলে একটা চেয়ার নিয়ে গিয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকি । তখন আবার মালি আসে বাগানের পরিচর্যা করতে । হারান দা খুব কম কথা বলেন। মন দিয়ে কাজ করেন । ঘন্টাখানেক ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রতিটা গাছ দেখা , জল দেওয়া, আগাছা পরিষ্কার করা , গাছের গোড়া মাটি কুপিয়ে আলগা করা , যেখানে যতটুকু সার প্রয়োজন দেওয়া । তাছাড়া, সমস্ত বাগান পরিষ্কার করা তো আছেই । ওনার কাজ দেখলে বোঝা যায়, উনি শুধু কাজ হিসেবে সেগুলো করছেন না , গাছগুলোকে ভালোবেসে করছেন । বেঁটেখাটো , রোগাসোগা মানুষটি কিন্তু বড়ই হাসিখুশি । কম কথা বললেও , যেটুকু বলেন ভারি হাসিমুখে বলেন। সকাল-সকাল ওনার সাথে খানিক গল্প করে দিনের আরম্ভটা মন্দ হয় না । আমি জোর করেই ওনাকে এক কাপ করে চা খাওয়াই প্রতিদিন । আমার সঙ্গে বসে খান । অবশ্য এতে আমার স্বার্থ যথেষ্ট । ওনার সাথে গল্প করতে করতে আশেপাশের কিছু খবরা-খবর নেওয়াও হয় , আবার বিভিন্ন গাছের সম্পর্কে , পরিচর্যা করার পদ্ধতি সম্পর্কে জানাও হয় । আমার এই বাংলোর লনে রাস্তার দু’পাশে রয়েছে কিছু জারবেরা , জিনিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, কসমস। সবুজ ঘাসের লনে বেশ কিছু কিছু জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে রয়েছে নাইন ও ক্লক । আর লনের ওপাশে ঠিক ফেন্সিং এর কাছাকাছি জায়গাটায় সার দিয়ে বেশকিছু চন্দ্রমল্লিকা । ঠিক বাংলোয় ঢোকার রাস্তাটা যেখান থেকে শুরু হয়েছে, সেখানে রাস্তার দুপাশে দুটো কাঠচাঁপা গাছ । পশ্চিম দিকে অর্থাৎ যেটা আমার বাংলোর পিছনের দিক হচ্ছে ,সেখানে একটা জারুল গাছ । সেটার ডালপালার কিছুটা অংশ বাংলোর ছাদে গিয়ে পড়েছে । এছাড়াও পিছনের দিকে একটা আতা গাছ, একটা পেয়ারা গাছ, বেশকিছু বেলি ফুল আর নয়ন তারা ফুলের গাছ রয়েছে । একটা গন্ধরাজ ফুলের গাছও রয়েছে । অবশ্য সেটায় এখনো ফুল ফোটার সময় আসেনি । দেখা যাক সে ফুলের গন্ধ কেমন। এখন আবার অনেক ফুলেই ঠিক তেমন মনকেমন করা বন্ধ আর হচ্ছেনা। সর্বত্রই হাইব্রিড আর ভেজালের যুগ । ফুল ফল সবজিও তার থেকে রেহাই পায়নি ।

টগর ছাড়াও বাংলায় আর একজন এসেছে আজ দুদিন হল। শিশির , ছেলেটি আমার বয়সীই হবে । সে অবশ্য আমার বাংলায় থাকেনা। বাংলোর পিছন দিকে একটা ঘর রয়েছে । ছোট একটা ঘর, একটা টয়লেট, ব্যাস এইটুকু। সামনে শুধু একটা দুহাত ছোট বারান্দা । সেখানেই সে রান্না করে নেয় । সে হলো আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট । ম্যানেজারের বিভিন্ন রকম দায় দায়িত্ব থাকে । সবসময় আমি সব জায়গায় উপস্থিত হয়ে উঠতে না পারলেও যেন কোনো রকম ভাবেই কোনো কাজ থমকে না থাকে , সেই জন্য সে আমার বাংলোর চৌহদ্দির মধ্যেই থাকে। আমি যখন অফিসে যাই, আমার সঙ্গেই সেও যায় । অবশ্য অফিসে শুধু একটি বার করে হাজিরা দেওয়াই কাজ । তাছাড়া অফিসে তেমন কোনো কাজ থাকে না । অফিস থেকে কিছুটা দূরে স্টোর হাউসে চা পাতাগুলো প্যাক হয়ে ডেসপ্যাচ হওয়ার জন্য জমা থাকে । তাছাড়া শুকনো কিছু চা পাতাও গুদামে স্টোর করা থাকে । প্রসেসিং এর আগে । সেই স্টোরহাউসে গিয়ে কিছু দেখাশুনা করে রাখতে হয় । এছাড়া টি এস্টেটে ঘুরে ঘুরে কাজ । আর বাকি কাজ পাশের টি এস্টেট এর টি ফার্মে। সেখানে সমস্ত দেখেশুনে প্রসেসিং করিয়ে নিয়ে আসতে হয় । সুপারভাইজ না করলে কোত্থেকে কি হয়ে যাবে, হয়ত যত পরিমাণ চা পাতা পাঠানো হয়েছে, আনুপাতিক প্রসেসড টি তার হাফও পাবো না। মোটামুটি সারাদিন ঘুরে বেড়ানোটাই আসল কাজ । সারাদিনের এত ছোটাছুটির মধ্যেও একটাই শান্তি । বেশিরভাগ কাজই প্রকৃতির কোলে, সবুজ চা বাগানের মধ্যে। ইঁট , কাঠ , সিমেন্টের জঙ্গলে নয় । ক্লান্তি তো শারীরিকভাবে যা আসে, তার শতগুণ আসে মানসিকভাবে । এখানে মানসিক ক্লান্তি অনেক কম আসে। তবে একটা ব্যাপার আমি খুব ভাল করেই বুঝতে পারছি, চা বাগানের শ্রমিকদের মধ্যে, তা সে পুরুষ হোক বা মহিলা, তাছাড়াও এস্টেট এর বিভিন্ন কর্মচারীদের মধ্যেও আমাকে নিয়ে একটা বিরূপ মনোভাবের সৃষ্টি হয়েছে । আমার যে এটা সৃষ্টির পেছনে বিন্দুমাত্র দায় রয়েছে তা কিন্তু নয় । আগে থেকেই হয়েছিল । যখন থেকেই ওরা শুনেছে একজন মহিলা আসছেন, ওদের ম্যানেজার হয়ে। ম্যানেজার মানেই তার কথা সব সময় শুনে চলতে হবে, তিনি নির্ধারণ করবেন সমস্ত কাজকর্ম, সেখান থেকে একজন পুরুষের অর্ডার পেতে এবং সেটা তালিম করতে ওরা যতটা স্বচ্ছন্দ, মোটেও একজন মহিলার ক্ষেত্রে ততটা নয় । পুরুষদের কথা ছেড়েই দিলাম । চা-বাগানে মহিলা শ্রমিকই বেশি । তাদের মধ্যেও সেই বিরূপ মনোভাবটা কিন্তু যথেষ্ট রয়েছে । এমনকি বেশি রয়েছে, তবু কম নয় । এটাই আশ্চর্যের । আমাদের সমাজে পুরুষতন্ত্রের শিকর এতটা গভীর পর্যন্ত বিস্তৃত যে, নারীদের মানসিকতাও সেই পুরুষতন্ত্রের ছাঁচে ঢালা । অথচ পুরুষতন্ত্রের যাঁতাকলে থাকতে তাদের কিন্তু কোন অসুবিধা নেই । তবুও একটা আপাত সুবিধার আড়ালে থাকতে থাকতে তারা অভ্যস্ত । তাদের বোঝানো হয়েছে, পুরুষরা ভালো পারে যেকোনো ম্যানেজমেন্ট বা অফিশিয়াল কাজকর্ম । নারীদের যত ম্যানেজমেন্ট সমস্ত কিছু সেই হাতা-খুন্তি নাড়ানাড়ির মধ্যে । হাজার হাজার বছরের অচলায়তনের দ্বারা গড়ে ওঠা এই ঘুণ ধরা মানসিকতা এমনভাবে পেয়ে বসেছে যে, কি পুরুষ, কি নারি , প্রত্যেকেই তাতেই স্বচ্ছন্দ।

তাই আমি যখনই এস্টেটের বিভিন্ন জায়গায় কাজকর্ম দেখাশুনার জন্য ঘুরে বেড়াই, প্রত্যেকে সময় পেলেই সুযোগমতো আমার দিকে আড়চোখে কৌতুহলবশে তাকিয়ে নেয় । কৌতুহলের কিছুই নেই । তবুও এদের কৌতুহল। আমি যখনই যেখানে ভিজিট করি , দেখেছি এদের মধ্যে বেশ একটা গা’ছাড়া ভাব । সেটা আমি যখন একেবারে সামনে উপস্থিত থাকি তখনও কিন্তু থাকে । তরল একটা উপহাস মাখা চোখে। যেন ভাবটা এইরকম, মেয়েছেলে আবার ম্যানেজারির কি বোঝে? আমরা কাজ করি না করি, যেভাবে করি, সেভাবেই চলবে । আমি যখন আবার কিছুটা এগিয়ে যাই , তখন পিছন থেকে খুব হালকা একটা সম্মিলিত হাসির রেশ ভেসে আসে । চা বাগানের শ্রমিকদের যে সবসময় কলুর বলদের মত খাটতে হবে , এমন কোনো কথাই নেই । কিন্তু ম্যানেজার হিসেবে আমি যদি এদের ম্যানেজ না করতে পারি , সেটা কিন্তু আমার জন্য অসুবিধার হয়ে দাঁড়াবে। রাশ প্রথম থেকে ধরতে না পারলে একটা সময়ে গিয়ে একেবারেই হাতের বাইরে চলে যায় । এক সপ্তাহ হয়ে গেল অথচ এদের চোখে মুখে কোথাও আমাকে ঠিক ম্যানেজার হিসেবে অ্যাকসেপ্ট করে নেওয়ার মতো বডি ল্যাঙ্গুয়েজ আমি দেখতে পাইনি।
আজকে ভাবলাম, এভাবে দূরে দূরে থেকে শুধু তদারকি না করে, ওদের সাথে একটু মিলেমিশে কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। যদি ওদের সাথে কথাবার্তা বলে বন্ধুর মতো মিশতে পারি, তাহলে হয়তো এই প্রবলেমটার একটা সলিউশন হতে পারে। গিয়েছিলাম এস্টেটের পূর্ব দিকের বাগানে । সেখানে তখন মোটামুটি জনা কুড়ি মহিলা আর ছ’ কি সাতজন পুরুষ কাজ করছিল। মহিলারা পিঠে সেই লম্বাটে ঝুড়িটা নিয়ে চা’পাতা তুলছিলো, আর পুরুষরা রাস্তার অন্য সাইডের গাছগুলোর প্রুনিং করছিল, ছাঁটাই । আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের কাজ দেখলাম। তারপর আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলাম তাদের দিকে । আমি যতক্ষণ দূরে দাঁড়িয়েছিলাম , তারা হালকা মেজাজে কাজ করছিল। একবারও তাদের কাজের ধারা দেখে মনে হচ্ছিল না যে তাদের কাজ স্বয়ং চা বাগানের ম্যানেজার এসে পর্যবেক্ষণ করছে। কিন্তু যখন আমি ওদের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম, তখন ওদের মধ্যে একটা চাপা অস্বস্তি কাজ করতে আরম্ভ করলো যে সেটা বুঝতে পারলাম । একেবারে ওদের সামনাসামনি গিয়ে দাঁড়ালাম । সামনে গিয়ে দাঁড়াতে ওরা আর কোনরকম কৌতুহল বা কৌতুক মিশ্রিত দেহভঙ্গি এক্সপ্রেস করার সাহস পেল না । যতই হোক এই টি এস্টেট এর ম্যানেজার তো আমি । চোখ নামিয়ে যে যার মত কাজ করতে লাগল । আমি পুরুষদের দিকটাতে এসেছিলাম । ওরা লম্বাটে হালকা ধরনের একধরনের কাস্তে নিয়ে গাছগুলোর সার্ফেসের ওপর দিয়ে নিপুণ হাতে চালিয়ে ওপরের দিকের ইঞ্চিখানেক করে ছাঁটাই করে দিচ্ছে। টি প্লান্ট প্রুনিংয়ের জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রুনার মেশিন পাওয়া যায় । কোনোটার সামনে চাকতির মত লাগানো, কোনোটা আবার লম্বাটে পাতের মত । কিন্তু আমাদের এস্টেটে এখনো ওসমস্ত কেনা হয়ে ওঠেনি । ওরা সেই কনভেনশনাল প্রসেসে কাস্তে দিয়েই কাজটা করছিল ।
আমি কিছুক্ষণ ওদের কাজ পর্যবেক্ষণ করে নিয়ে একজনের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম । বললাম , তোমার নাম কি ?
একবার আড়চোখে চকিতে আমার দিকে তাকিয়ে নিয়ে চোখ নামিয়ে ফেলল সে । বলল, চন্দন ।
— কত দূরে বাড়ি তোমার?
— আইজ্ঞা, ইখান থিকা পাঁচ কি ছ’ মায়েল আউগুইয়া।
— কিসে করে আসো তুমি?
— সাইকেল, হুই , হুইখানে খাড়া করায় আছে ।
সে হাতে করে কিছুটা দূরে চা-বাগানের ফাঁকে একটা শেড-ট্রীর গায়ে হেলান দেওয়া তার জরাজীর্ণ রংচটা একখানা সাইকেল দেখালো।
সেটা দেখে আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, কত সময় লাগে তোমার আসতে?
— তা নাগে আধা ঘন্টা খানেকের , মেম। খুব জোরে চালায় কিনা।
— কতদিন কাজ করছো চা বাগানে?
— হামের আগিলা দুই পিড়ির ইটাই কাম কাজ ।
— তুমি এই চা বাগানে কতদিন কাজ করছো?
— বচ্ছর খান।
— হুঁ বুঝলাম।
তার পাশে একখানা তেলচিটে ছোপ লাগা কাপড়ে বাঁধা একটা পুঁটলি ছিল । ছাঁটাই করা চা’ গাছগুলোর ওপরে সে রেখেছে সেটা।
দেখিয়ে বললাম, এটা কি তোমার দুপুরের খাবার ?
— হিঁ।
— খাওয়া হয় নি এখনও?
— হাতের কাম কখান সারা হইলে খায় লিব ।
এরপর মুখটা তার কানের কিছুটা কাছে নিয়ে গিয়ে বেশ আস্তে করে জিজ্ঞেস করলাম, তোমাদের আগের ম্যানেজার বাবু চলে গেছেন বলে তোমাদের কি ভালো লাগছেনা?
সে একখানা অদ্ভুত উত্তর দিল । কেমন ভাবে একটা আমার দিকে তাকিয়ে বলল , আইজ্ঞা মেম , হামেরা গরীব মানষি, দিন লায় দিন খায়, কিনা? মালিক যেমন নোক মানিজার করি থুইবে তারোই চাখিরি করিব ।
আমার প্রশ্নের উত্তর হিসেবে চন্দন যা বলল, সেটা ঠিক সেই প্রশ্নের উত্তর না হলেও, তাতে প্রচ্ছন্ন একটা কথা প্রকাশ পাচ্ছিল। সেটা হল, মালিকপক্ষ যাকে আনবে তার আন্ডারে কাজ করতে আমরা বাধ্য । সেখানে আবার আমাদের পছন্দ-অপছন্দের কি? এরপর আমি চন্দনের সঙ্গে আর কথা বাড়ালাম না । সেখান থেকে চলে এলাম ।
বলে এলাম, আর বেশি দেরি করো না । তুমি বরঞ্চ খেয়ে নাও । তারপরে হাতের কাজ সেরো।
শুনে ‘হ্যাঁ’ ‘ না’ কিছু বলল না, কাস্তে তুলে নিল হাতে ।
এরপর একবার মেয়েদের দিকটায় গেলাম । আমি যতক্ষণ চন্দনের সঙ্গে কথা বলছিলাম , ততক্ষণ তারা উৎসুক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে দেখছিল যে , সেটা আমি তাদের দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারছিলাম । সেখানে গিয়ে চুপচাপ কিছুক্ষণ তাদের আঙ্গুলের ভাঁজে ভাঁজে চা’ পাতা তুলে পিছনের ঝুড়িতে চালান করা দেখতে দেখতে একটি মেয়ের দিকে এগিয়ে গেলাম । মেয়েটির নাম সীমা । তার সাথে পাঁচ-দশটা কথা বলে বুঝতে পারলাম, তারা আমাকে অ্যাভয়েড করতে চাইছে। আমার উপস্থিতিটা তাদের মোটেও পছন্দের নয়। তবুও আমি ইন্ডিভিজুয়ালি তাদের প্রত্যেকের সাথে কথা বললাম। নাম , ধাম জিজ্ঞাসা করলাম । যেচে পড়ে কথা বলাতেও তারা বিরক্ত । মনটা একটু ভারাক্রান্ত হল বৈকি । সমস্ত কিছুই চলছে । তবে তাতে প্রাণের স্পর্শ নেই । সেটা কি আগেও ছিল ? নাকি আমি আসার জন্য এমনটা হয়েছে? ঠিক বুঝতে পারলাম না। এদের সঙ্গে আরও একটু সময় আমায় দিতে হবে । এত তাড়াতাড়ি বোঝা সম্ভব নয় ।
সেদিন ছিল শনিবার । সেদিনকার মত আমার কাজ মোটামুটি শেষ হয়ে গেছিল । পরের দিন ছুটি । কাজে জয়েন করার পর থেকে একটানা কাজ করে চলেছি । মাঝে একটা দিনেরও ব্রেক পাইনি । এই প্রথম একটা দিন ছুটি পাব। নিজের অজান্তেই মনটাকে একটু ফ্রি করার ইচ্ছা হল । জগন্নাথ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিল গাড়ি নিয়ে ।
ওর কাছে ফিরে গিয়ে বললাম , জগন্নাথ আজকে আমাকে নিয়ে লীস্ নদীর কাছ থেকে একবার ঘুরিয়ে আনবে ? আজকের মত কাজ কমপ্লিট । ঘন্টাখানেক ওখানে বসে থাকতে পারবো ।
— তা, চলুন দিদি। কিন্তু এখন নদীতে একদম জল নেই । শুকিয়ে কাঠ । আপনার ভালো লাগবে না ।
— জানি । তবুও চলো । ভালো লাগাতো মনের ব্যাপার । আমার ভালো লাগবে।
ও আর কিছু না বলে ড্রাইভারের সিটে গিয়ে বসলো । আমিও গাড়ির ভেতর ঢুকে বসলাম । চা বাগানের মধ্যে দিয়ে দুলতে দুলতে গাড়ি চলল। এখানে এসে থেকে চা বাগান প্রচুর দেখছি। অনবরত দেখছি। চোখের সামনে তো শুধুই সবুজের সমাহার। তবুও প্রকাশ্য দিবালোকে যখনই দেখেছি, তখনই আমি ভীষণ কাজের মধ্যে । সে কারণে, শুধু চোখই দেখছে, তা আর মাথা পর্যন্ত পৌঁছয়নি। কিংবা ঠিক মাথা নয় , হয়তো বা মন পর্যন্ত , কিংবা হৃদয়ে সে ছবির কোন প্রতিলিপি তৈরি হয় নি। তাই বলা যেতে পারে দেখেও দেখিনি । আজকে যখন আবার নিজের প্রথম যৌবনের স্মৃতিবিজড়িত নদীর ধারে চলেছি, তখন আচমকাই চারপাশের এই চা বাগানগুলো অন্য রূপে ধরা দিল আমার কাছে । আমি দেখতে পেলাম , দিগন্তবিস্তৃত চা বাগান জুড়ে বিভিন্ন ধরনের পাখি । তবে বী ঈটার বা বাঁশপাতি পাখি প্রচুর। ঠোঁট থেকে লেজ পর্যন্ত দৈর্ঘ্য ধরলে এক হাতের চেটোর পরিমাণ হবে কি হবে না। সবুজ রঙের চঞ্চল পাখিগুলো প্রচুর পরিমাণে শেড-ট্রীর ডালে ডালে বসে রয়েছে আর চঞ্চল ভাবে উড়ে গিয়ে পোকা ধরে খাচ্ছে বা খাওয়ার প্রয়াস করে চলেছে । অবিরত তাদের সেই ওড়াওড়ি, কিচিরমিচির । চা বাগান একটা বিশেষ ইকো সিস্টেম তৈরি করে । বিশাল অঞ্চল জুড়ে সেখানে বিভিন্ন ধরনের পোকা, মথ, প্রজাপতি থাকে। আর সে কারণেই বাঁশপাতি পাখি এত বেশি এখানে। চা বাগানের ওপর দৃষ্টি স্থির রেখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে দেখা যায়, ছোট ছোট হলুদ প্রজাপতি প্রচুর । সেই প্রজাপতিগুলো .. সেই .. সেই রকমই.. ! যেন ‘গায়ে হলুদ’ হয়েছে ! আজও সব তেমনই আছে। তবু কিছুই তেমনটা নেই আর ।

প্রায় একঘন্টার কাছাকাছি সময় ধরে চা বাগানের বুক চিরে হেলতে-দুলতে উঁচু-নিচু রাস্তার ওপর দিয়ে চলার পর , গাড়ি পৌঁছলো লীস্ নদীর পাড়ে । বিস্তীর্ণ জায়গা । পাথুরে জমির মত ছোট-বড়-মাঝারি পাথরে ভর্তি হয়ে রয়েছে। বালির মাটি আর পাথর । বর্ষাকালে এই সমস্ত জায়গাই নদীর জলের তলায় চলে যায় । কিন্তু এখন শুকনো খটখট করছে । নদী প্রায় একটা নালার আকৃতি নিয়ে কুলকুল শব্দ করে একেবারে বাঁ পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে। বসন্তকাল। ওয়েদার ভালো। বিকেল হয়ে গেছে। পশ্চিমে হেলে পড়া সূর্যের আলো গায়ে লাগেনা । সবমিলিয়ে বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা রোমান্টিক পরিবেশ। উত্তরের দিকে তাকালে চোখে পড়ে ছোট ছোট পাহাড় চূড়ো । এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলটা পাহাড়ের সানুদেশ । সোজা উত্তরমুখো অনেকখানি চলে গেলে পড়বে মূর্তি। তারপর শুরু হয়ে যাবে ভুটানের পাহাড়ি অংশ । একটা বড় পাথরের ওপর বসে পড়লাম নদীর জলে পা ভিজিয়ে । ঐ পাশটা কিছুটা দূর থেকে নদীর পাড় শুরু হয়েছে, কিছুটা উঁচু। সেখানে ছোট বড় জঙ্গল । আমার ডান পাশে দূরে চোখ মেললে নীলচে পাহাড়ের ছবি ।

বসে আছি । আজ কত বছর পর আবার এখানে এই নদীর জলে পা ডুবিয়ে বসে আছি ! সত্যি, ভাবতে অদ্ভুত লাগে। একা । আজকে দেড়’ যুগ বয়স বাড়িয়ে আমি আবার যখন এখানে ফিরে এসেছি, তখন আমি একা । সে আর আমার পাশে আজকে বসে নেই । ‘সে’ না থাকুক , আগে কখনো , ‘সে’ না থাকলেও একা আসিনি । আ্যটলিস্ট বিন্টি থাকতোই সঙ্গে । তিড়িংবিড়িং করে ছুটে বেড়াতো, খেলতো। নদীর জলে পাথর ছুঁড়তো। এভাবে একা বসে বসে নুড়িপাথর কখনো গুনি নি । আমার আজকে হঠাৎই আবার ভীষণ ভাবে অতীতের সেই দিনগুলোতে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে। বাস্তবে সম্ভব নয় তো কি হয়েছে? স্মৃতির অতলে তো সমস্তই রয়েছে । কি জানি কখন চুপচাপ সেখানে বসে সেই একটা অষ্টাদশী মেয়ের কথা মনে পড়ে গেল । দুটো বিনুনি দুলতো তার বুকের ওপরে । ঘের ঘের চুরিদার পরতো মেয়েটা ,হাঁটুর নিচে ঝুল । ভীরু স্বভাবের । যতটা না স্বভাব জনিত ভীরুতা, তারচেয়ে অনেকগুণ ভীরু তাকে করে দিয়েছিল পরিবেশ-পরিস্থিতি । তন্বী দেহ না হলেও শরীরে মেদের আধিক্য নেই । মুখখানা সুশ্রী কি? তা হবে । সুশ্রী কি নয় , তার চেয়ে বড় কথা লাবণ্য যথেষ্ট । ওই বয়সের মেয়েরা তো লাবণ্যময়ীই হয় । তরুণী , কলেজে পড়া মেয়ে তখন আমি । মনের মধ্যে কত প্রজাপতি । লাল, নীল, হলুদ , সবুজ, রামধনু রং এর । একটা মেয়ে ছিল। রূপকথার রাজ্যে তার আনাগোনা। আজকে আবার বড় জমিয়ে, যুত করে, আমি সেই অতীতের স্মৃতি রোমন্থনে ফিরে গেলাম । এই আমি আর সেই আমি.. ? এখনকার নয়.. এ সেই .. সেই মেয়েটা.. !

যেন কোন তেপান্তরের মাঠ থেকে আওয়াজ ভেসে এলো,
— তরু মা ! শোন, দেখ কে এসেছেন তোর সঙ্গে দেখা করতে।
আমি তখন সবেমাত্র এইচএস দিয়েছি । লম্বা লম্বা দুটো বিনুনি দুলিয়ে ছুটতে ছুটতে বাবার বৈঠকখানা ঘরে গিয়ে হাজির হলাম। পুরুলিয়ায়। আমাদের সেই ছোট্ট বাড়িটায়।

ক্রমশ..

©®copyright protected

এক-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/978775899579141/

দুই-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/980083989448332/

তিন-
https://www.facebook.com/248680819255323/posts/981378992652165/

ছবি : সংগৃহীত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here