সিরিয়াল কিলার শেষ পর্ব

0
757

সিরিয়াল কিলার
©মারুফ হুসাইন
#পর্ব_৩_ও_শেষ_পর্ব

৭.
তৃতীয় খুনের পর মাসখানেক পার হয়ে গেছে। রিজভিকে কেস থেকে সড়িয়ে দেয়া হয়েছে৷ উপর মহল থেকে তাকে আর সময় দিতে চাচ্ছে না৷ এমন একটা কেসে এতো সময় দিতে তারা রাজি নয়৷ যেভাবেই হোক এই খুনিকে থামাতেই হবে। তাই তারা অভিজ্ঞ আর নতুন কাউকে কেস দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ কেস থেকে বরখাস্ত হওয়ার পর পরই রিজভি মাসখানেকের ছুটি নিয়ে নিয়েছে৷ তার একটু বিশ্রাম দরকার। লম্বা বিশ্রাম। মাথা থেকে বিশাল বোঝাটা এখন নামানো দরকার৷ অথৈকেও সব কিছু ক্লিয়ার করা দরকার। অথৈয়ের সাথে তার সম্পর্ক জমে উঠেছে। সে বুঝতে পারে অথৈ তার প্রেমে পরেছে। সে যে অথৈর প্রেমে পরেনি, তাও নয়৷ কিন্তু অথৈ হয়তো উপরের ভদ্র, সুখি রিজভিটাকে ভালোবেসেছে। ভিতরের বিধ্বস্ত রিজভিটাকে সে চিনে না৷ তাকে সব কিছু খুলে বলা দরকার।
‘অথৈ! তোমার সাথে একবার দেখা করা দরকার!’ রিজভি অথৈকে মেসেজ করলো।
‘কখন?’ মিনিট দশেক পর অথৈ রিপ্লে করলো।
‘এখনি।’
‘এখন একটু ব্যস্ত আছি। বিকেলে করি?’
‘না। এখনি করা দরকার৷ জরূরী কথা আছে৷
‘আচ্ছা আসছি।’

আধ ঘন্টার মধ্যে অথৈ কাপ-ক্যাফেতে চলে এসেছে। কর্ণারের একটা টেবিলে রিজভি বসে আছে৷ অথৈ কফির অর্ডার দিয়ে রিজভির পাশে গিয়ে বসে বলল, ‘তোমার মন খারাপ নাকি?’
‘না তা নয়।’
‘মিথ্যা বলছো কেনো? তোমাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে তোমার মন খারাপ। কেস থেকে বরখাস্ত হয়েছো বলে মন খারাপ?’
অথৈর কথা শুনে রিজভি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো, ‘তুমি জানো কিভাবে?’
অথৈ মুচকি হেঁসে বলল, ‘আমি তোমার ব্যাপারে সবই জানি৷ কিন্তু কখনো জিজ্ঞাসা করেনি৷ চেয়েছিলাম তুমি নিজে থেকেই বলো।’
‘কিভাবে জানলে?’
‘তুমি সিআইডিতে আছো৷ একটা সিরিয়াল কিলিং কেসের দায়িত্বে ছিলে। কিন্তু সলভ করতে পারছো না বলে গতকাল তোমাকে স্যাক করা হয়েছে৷ এগুলা বলার জন্যই তো তুমি আমাকে ডেকেছো’
‘কিন্তু এগুলো তুমি কিভাবে জানলে?’
‘তোমার ডিপার্টমেন্টে আমার এক বন্ধু আছে৷ তোমার সাথে আমাকে একবার আমাকে দেখে জিজ্ঞাসা করেছিলো তুমি আমাকে কিভাবে চিনো। তারপর ওর থেকেই জেনেছি।’
‘আমার আরো কিছু বলতে চাই..’
‘রিজভি! তোমার হয়তো বাজে কোনো অতীত আছে। তা নিয়ে আমার কোনো মাথা নেই। আমরা মানুষ। আমাদের অতীত থাকবেই। তা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে বর্তমানটাকে অসুন্দর করার তো কোনো মানে হয় না। আমার তোমাকে ভালো লাগে। তুমি এখন যেমন আছো তেমনি ভালো লাগে। অতীতে তোমার কি ছিলো বা ভবিষ্যতে কি থাকবে না থাকবে তা নিয়ে আমার কোনো মাথা ব্যথা নেই। আমি বর্তমানে বিশ্বাসী। অতীত বা ভবিষ্যতে নয়৷’
রিজভি কিছু একটা বলতে গিয়েও বলল না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘অথৈ আমি আজ উঠি। আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না।’
সে উঠে চলে গেলো। অথৈ বুঝতে পারছে না, রিজভির কি হয়েছে? সে এমন কেনো করছে? একটা কেসের জন্য কেউ এতোটা আপসেট হতে পারে না। আর যদি এই কেসের জন্য হয় তাহলে হয়তো সে তাকে হেল্প করতে পারবে। এই ব্যর্থতা থেকে হয়তো সেই টেনে তুলতে পারে। সেটা সে করবে। শুধু সময়ের অপেক্ষা। সঠিক সময় হলেই রিজভিকে ব্যর্থতার গন্ডি থেকে বের করে নিয়ে আসবে।

৮.
রুনা কবির কেসটা প্রায় সলভ করে ফেলেছে৷ সেদিন পত্রিকার কাটিংটায় মাসুম আহমেদের নামটা দেখতে পেয়েছিলো। একটা ধর্ষণ মামলার আসামি হিসেবে। যা চট্টগ্রামে ঘটেছে৷ তারপর তার অফিসের পুরানো পত্রিকা খুঁজে নিউজটা বের করতে সপ্তাহখানেক সময় লেগে গেছে। এই মামলা নিয়ে টানা বেশ কিছুদিন পত্রিকায় লেখালেখিও হয়েছে। সেই ধর্ষণ মামলার আসামীরা হলো মাসুম আহমেদ, রেজাউল করিম, নিশাত হাসান। তিনজন একই এলাকার বাসিন্দা ছিলো। চতুর্থ জনের নাম জানা যায়নি৷ তবে এউটুকু নিশ্চিত হওয়া গেছে যে চতুর্থজন উক্ত এলাকার দায়িত্বরত পুলিশ অফিসার ছিলো। চারজন মিলে অত্র এলাকার মেয়ে অর্চনাকে ধর্ষণ করে হত্যা করে৷ অর্চনার বাবা তাদের এই চারজনকে আসামী করে মামলা করে। মামলার কয়েকদিন পরই আর্চনার মা-বাবা রোড এক্সিডেন্টে মারা যায়। বাদি,স্বাক্ষী-প্রমাণ অভাব এবং উক্ত পুলিশ অফিসারের ধূর্ততায় মামলাটাও বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এলাকার জণগণ খুব ক্ষেপে গিয়েছিল। তখন স্থানীয় এক নেতার সহযোগিতায় তারা চারজন পালিয়ে যায়। পরবর্তীতে স্থানীয় নেতা নিজ বাস ভবনে খুন হয়।

এখন রাত ১১টা বাজে। রুনা কবির পুরো কেসটা ভালোমতো স্টাডি করে নিজ চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে। সে চট্টগ্রামের তার এক সহকারীকে বলেছে খোঁজ নিয়ে তাকে যেনো জানানো হয়,এই চতুর্থ ব্যক্তিটা কে যে কিনা পুলিশ অফিসার ছিলো? আর অর্চনার মা-বাবা ছাড়া তার আর কোনো আত্নীয়-স্বজন কেউ ছিলো কি না?
কিছুক্ষণ আগে তার ঐ সহকারী ফোন দিয়ে জানিয়েছে, চতুর্থ ব্যক্তির ডিটেইলস পেয়েছে৷ আর অর্চনার মা-বাবা ছাড়াও এক কাজিন ছিলো। যে তাদের সাথেই থাকতো। ঘটনার মাসখানেক আগে সে কোথায় চলে গেছে। অর্চনা ও তার মা-বাবা মারা যাওয়ার পর আর তাকে কখনো কেউ দেখেনি। তার ব্যাপারেও সমস্ত ডিটেইলস জানা গিয়েছে৷ দুইজনের ডিটেইলস সে ইমেইল করে দিবে বলে ফোন রেখে দিয়েছে। রুনা কবির ইমেইল চেক করলো। এখনো কোনো মেইল আসেনি। রুনা কবির চেয়ারে হেলান দিয়ে কিছু একটা ভাবছে।

গোয়েন্দা অফিসার রিজভি তার উর্ধতন অফিসার আলাউদ্দিন খায়ের বাসায় বসে আছে। আলাউদ্দিন খায়ের সামনে বসে আছে, ‘কি ব্যাপার রিজভি? হঠাৎ এতো রাতে আমার সাথে দেখা করতে চাইলে? সিরিয়াল কিলিং কেসটা থেকে তোমাকে হটিয়ে দেয়ায় আমার কিছুই করার ছিলো না। এইটা হেড অফিসের সিদ্ধান্ত। এখন আমি কিছুই করতে পারবো না। শুনেছি, একটা মহিলা অফিসারকে কেসটা দেয়া হবে। অবশ্য সে এতোদিন আন্ডারকভার গোয়েন্দা হিসেবে এই কেসটা নিয়ে কাজ করেছে৷ তার ছদ্মবেশী আইডেন্টি সম্ভবত সাংবাদিক। কিন্তু মূলত সে আন্ডারকভার গোয়েন্দা অফিসার। আমি এই ব্যাপারে কিছুই জানতাম না৷ তোমাকে বরখাস্ত করার পরই জেনেছি।’ আলাউদ্দিন খা একটু থেমে কিছু একটা ভেবে বলল, ‘তুমি বসো! তোমার জন্য চা নিয়ে আসছি।’
মিনিট পাঁচেক পর সে দুই কাপ চা নিয়ে ফিরে আসলো। রিজভির হাতে এক কাপ চা দিয়ে নিজে বসতে যাবে তখনি আরেক রুম থেকে মোবাইলের রিংটোন ভেসে আসলো। চায়ের কাপটা টেবিলের উপর রেখে বলল, ‘বসো! দেখি কে ফোন দিয়েছে। মোবাইলটা ঐ রুমে রেখে এসেছি।’
আলাউদ্দিন খা ঐ রুমে গিয়ে ফোন ধরে ‘হেলো কে?’ কিন্তু ঐ পাশ থেকে কোনো শব্দ আসলো না। আবার জিজ্ঞাসা করলো, ‘কে?’ কিন্তু ওপাশ থেকে কোনো সাড়া আসলো না। সে ড্রয়িং রুমে ফিরে এসে বলল, ‘আননোন নাম্বার থেকে কল এসেছে। কোনো কথা বলছে না। মানুষ খেয়ে-দেয়ে কাজ না থাকলেই এমন করে।’ একটু থেমে বলতে লাগলো, ‘তোমাকে কি জানি বলছিলাম? ওহ মনে পরেছে। তোমার কেসটা একটা মহিলা অফিসারকে দেয়া হয়েছে। যার ছদ্মবেশ সাংবাদিকতা। নামটা মনে হয় রুনা কবির। ওহ দুঃখিত। সাংবাদিকতায় নাম রুনা কবির। কিন্তু ডিপার্টমেন্টে বা আসল নাম হলো, অথৈ আলম।’

রুনা কবির চেয়ারে হেলান দিয়ে ভাবছে, সে আন্ডারকভার অফিসার অথৈ। আন্ডারকভার অফিসার হিসেবেই থাকবে। রিজভির কাছে সব সত্য বলে দেয়ার সময় এসে গেছে। কেসটা তদন্তের স্বার্থে সে রিজভির সাথে খাতির করলেও এখন সত্যি সত্যি ভালোবেসে ফেলেছে। রিজভির কথা-বার্তা, ব্যাক্তিত্ব সব কিছুই তার ভালো লাগে। এই কেস সলভ করার ক্রেডিট পুরোটাই সে রিজবিকে দিয়ে তার ব্যর্থতার ডিপ্রেশন দূর করে দিবে। তবে সে যে আন্ডারকভার অফিসার রিজভিকে এখনি বলা যাবে না। কেসটা সমাধানটা রিজভির কাছে এমনভাবে দিতে হবে সে যেন বুঝতে না পারে৷ অথৈই দিয়েছে। কেসটার ক্রেডিট পেয়ে গেলে তাকে জানাতে হবে যে সে আন্ডারকভার অফিসার।
মেইল আসার টুং শব্দে অথৈর ভাবনায় ছেদ পরলো। সে কম্পিউটারের দিকে ঘুরে বসলো।

আলাউদ্দিন খায়ের মুখে অথৈ এর নাম শুনে রিজভি বড় ধরণের একটা শক খেলো। এতোদিন সে যাকে সাধারণ মেয়ে মনে করে আসতো। সে আসলে সাধারণ কোনো মেয়ে নয়৷ ব্যাপারটা রিজভি মানতে পারছিলো না৷ তবুও সে নিজেকে স্বাভাবিক, শান্ত-শিষ্ঠ রাখলো। এই মুহূর্তে কোনো রকম উত্তেজিত হওয়া ঠিক নয়। মাথা খুব ঠান্ডা রাখতে হবে, ‘স্যার! আসলে আমি আপনার কাছে এই কেসের ব্যপারটা নিয়ে আসিনি। অন্য একটা কাজে এসেছি।’
‘কি কাজ?’
‘কাজের কথা বলার আগে আপনাকে একটা গল্প বলি। আমার জীবনের গল্প।’
‘হুম বলো!’
‘স্যার! আমি আমার জন্মের পর আমার মা-বাবাকে দেখিনি। ছোট বেলা থেকে মামা-মামির সাথে থেকে বড় হয়েছি। তারাই আমাকে পড়ালেখা করিয়ে এই পর্যন্ত পাঠিয়েছেন৷ যে গল্পটা বলবো, সেটা বছর পাঁচেক আগের। আমি মাত্র পুলিশে জয়েন করেছি। জয়েন করেছি বলতে তখনো পোস্ট করফার্ম হয়নাই। মাত্র ট্রেইনিং এ যোগ দিয়েছি। দেশের বাইরে ট্রেনিং এ পাঠিয়েছে। দেশে টোটালি, যোগাযোগ অফ। ট্রেইনিং শেষে দেশে এসে দেখি আমার সব শেষ হয়ে গেছে।’
‘মানে? কি হয়েছিলো?’
‘বলছি স্যার! আমাকে আগে এক গ্লাস পানি খাওয়ান!’ রিজভির কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে।

অথৈ মেইলটা খুলে হা করে তাকিয়ে আছে। সে নড়াচড়া করার শক্তিটাও হারিয়ে ফেলেছে৷ কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। মেইলের দুইটা লোককেই সে চিনে। একজনকে খুব ভালো করে চিনে। তার খুব আপনজন। সে ব্যাপারটা মানতে পারছে না। একবার উঠে দাড়ায়, কি ভেবে আবার বসে পরে। মোবাইল হাতে নেয়। আবার রেখে দেয়। সে কি করবে না করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। তার কি করা উচিৎ ভেবে পাচ্ছে না। সে চতুর্থ ব্যাক্তি বর্তমান সিআইডির উর্ধতন কর্মকর্তা আলাউদ্দিন খাকে বাঁচাবে নাকি তার প্রিয় মানুষ রিজভিকে তার প্রতিশোধ নিতে দিবে? সে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। সে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে মাথা ঠান্ডা করার চেষ্টা করে।

আলাউদ্দিন খা পানি এনে রিজভির হাতে দেয়। রিজভি এক ঢোকে এক গ্লাস পানি শেষ করে ফেলে, ‘স্যার! মনে আছে, এই কেসটা আমাকে দেয়ার জন্য আমিই আপনাকে রিকুয়েস্ট করেছিলাম?’
‘হ্যা মনে আছে।’
‘স্যার আপনি অর্চনাকে চিনেন?’
আলাউদ্দিন খা ঠিক মনে করতে পারলো না। ভাবতে লাগলো।
‘স্যার! আপনার মনে নেই। আমি মনে করিয়ে দিচ্ছি। এই যে যেইটা আপনারা সিরিয়াল কিলিং বলে আমাকে দিয়ে তদন্ত করাচ্ছেন। সেটা যে সিরিয়াল কিলিং না। আপনি ভালো করেই জানেন। কেউ প্রতিশোধ নিচ্ছে। ওরা আপনারই তো সঙ্গি ছিলো। আপনারা চারজন মিলেই তো একটা পরিবার শেষ করে দিয়েছিলেন। আমি সেই অর্চনার কথা বলছি। জানেন স্যার! এইটা কে ছিলো?’ রিজভি একটু থামলো, ‘এই অর্চনা আমার জীবনের অর্ধাংশ ছিলো।’ বলেই রিজভি বন্দুক উচিয়ে ধরলো, ‘স্যার! আপনি যখন ফোন ধরতে গিয়েছিলেন তখন আমি আপনার চায়ে নেশাদ্রব্য মিশিয়ে দিয়েছি৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই নেশাগ্রস্থ হয়ে যাবেন। তখন আপনাকে টাইট করে বাধবো। তারপর আপনার নেশা যখন কেটে যাবে। তখন আপনাকে ঐ তিনটার মতোই বিভৎসভাবে খুন করবো।’
আলাউদ্দিন খা ভয়ে কাপছে। তার কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে। কিছু একটা বলতে চাচ্ছে। কিন্তু বলতে পারছে না। তার কথা গলাতেই আটকে যাচ্ছে।

অথৈ অনেক ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নিলো, রিজভিকে শেষ খুনটা করতে দিবে না৷ বরং আইন অনুযায়ী আলাউদ্দিন খায়ের শাস্তি দিবে। দরকার হলে মার্ডারগুলোও আলাউদ্দিন খায়ের উপর চাপিয়ে দিবে। সে নিজের সার্ভিস পিস্তলটা ড্রয়ার থেকে বের করে ব্যাগে ভরে নিলো। রিজভিকে ফোন দিলো। কিন্তু ফোন ধরছে না। কেটে দিচ্ছে। কয়েকবাত ফোন দেয়ার পরও ধরলো না। কেটে দিলো। সে গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গেলো। উদ্দেশ্য রিজভির ভাষা। সেখানে গিয়ে তাকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে সব কিছু ম্যানেজ করতে হবে।

বারবার ফোন আসায় রিজভির ফোনের দিকে মনযোগ চলে যাচ্ছিলো। সে সুযোগে আলাউদ্দিন খা তাকে আক্রমণ করে বসলো। রিজভির পিস্তল দূরে ছিটকে পরলো।। দুই জনের হাতাহাতি শুরু হয়ে গেলো।

অথৈ রিজভির বাসার সামনে গিয়ে দেখে বাসা বাইরে থেকে লক করা। সে বুঝে উঠতে পারলো না, রিজভি কোথায় গিয়েছে। হঠাৎ তার মনে হলো, রিজভি হয়তো আলাউদ্দিন খায়ের বাসায় গিয়েছে। সে গাড়ি ঘুরিয়ে আলাউদ্দিন খায়ের বাসার দিকে রওনা দিয়ে দিলো।
আলাউদ্দিন খায়ের দরজার সামনে দাঁড়াতেই গুলির শব্দ পেলো। অথৈ বুকে ধুক করে উঠলো। সে বুঝতে পারলো, রিজভি এখানেই আছে। কিন্তু ভিতরে যে গুলিটা ছোড়া হয়েছে সেটা কার গায়ে লেগেছে বুঝে উঠতে পারলো না। সে পকেট থেকে পিন বের করে আলাউদ্দিন খায়ের ঘরের লক খুলে ফেলল। ভিতরে ঢুকতেই পুরো ঘর এলোমেল দেখলো। ঘরেত আসবাব-পত্র ভেঙ্গে-চুড়ে এদিক-সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। অথৈ আরেকটু ভিতরের দিকে যেতে রিজভিকে দেখতে পেলো। এক কোণে পরে আছে। বুক বেয়ে রক্ত ঝরছে। তার পাশেই আলাউদ্দিন খা তার দিকে পিস্তক তাক করে বসে আছে। ট্রিগারে আংগুল। এখনি বুঝি ট্রিগার চেপে দিবে। অথৈ সে সুযোগ দিলো না। নিজের পিস্তল চেপে গুলি ছুড়লো। আলাউদ্দিন খায়ের মাথার পিছনের দিকটা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেলো।
অথৈ পিস্তল ফেলে রিজভির কাছে গিয়ে বসলো। রিজভির মথা টেনে নিয়ে নিজের উরুর উপর রাখলো। রিজভির এখনো পুরাপুরি জ্ঞান আছে। অথৈ ফোন দিয়ে অ্যাম্বুলেন্স ডাকলো।
‘অথৈ! কোনো আমাকে হাসপাতালে নিয়ে কোনো লাভ হবে না। আমার সময় শেষ হয়ে এসেছে।’ রিজভি ভাঙ্গা গলায় বলল।
‘এমন কথা বলে না৷ রিজভি! তোমার কিচ্ছু হবে না।’ অথৈর চোখ বেয়ে পানি ঝরে পরলো।
‘জানো অথৈ! ছোটবেলা থেকেই অর্চনার সাথে সাথে ঝগড়া করে বড় হয়েছি। ধীরে ধীরে যত বড় হয়েছি৷ আমরা বুঝতে শুরু করলাম, একে অপরকে ছাড়া আমরা অপূর্ণ। আমাদের বিয়েও ঠিক হয়ে গিয়েছিলো। আমি দেশে ফিরে চাকরীতে জয়েন করলেই বিয়ে করে নিতাম৷ কিন্তু দেখো সব কিছু ধ্বংস হয়ে গেলো। আমাদের স্বপ্ন ভেংগে গেলো। এখন আমিও চলে চাচ্ছি। অর্চনা আমাকে ডাকছে। আমার যেতে হবে।’ অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণে রিজভির চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিলো।
‘এভাবে বলে না, রিজভি। তোমার কিচ্ছু হবে না।’ রক্ত ক্ষরণ বন্ধ করার জন্য অথৈ রিজভির বুকে চেপে ধরলো। রিজভির চোখ বন্ধ হয়ে আসছে৷ বাইরে থেকে এম্বুল্যান্সের সাইরেন ভেসে আসতে লাগলো।

পরিশিষ্ট.
রিজভিকে মেডেল দেয়ার ঘোষণা করা হয়েছে। এমন একটা কেস সলভ করার পুরষ্কারস্বরূপ প্রমোশন দেয়ার সিদ্ধান্তও নেয়া হয়েছে।
অথৈ হেডকোয়ার্টারে পুরো কেসটা বর্ণনা করলো। তারা বিশ্বাসই করতে পারেনি এমন একজন জঘন্য লোক তাদের ডিপার্টমেন্টের গুরুত্বপূর্ণ পোস্টে বসে আছে। কেস ক্লোজড করা দেয়া হয়েছে। অথৈ রিপোর্ট দিয়েছে, আলাউদ্দিন খা তার পূর্বের কর্মকান্ড ঢাকার জন্য খুনগুলো করছিলো। এমন বিভৎসভাবে করেছে যেনো দেখে মনে হয় এইটা কোনো সিরিয়াল কিলারের কাজ। সে যখন বুঝে গেছে রিজভি তার ব্যাপারে জেনে গেছে তখন রিজভিকে কেস থেকে বরখাস্ত করে দেয়ার আবেদন করেছে। রিজভিকে বরখাস্ত করে জোরপূর্বক এক মাসের ছুটিও দিয়ে দিয়েছে। এই সুযোগেই আলাউদ্দিন খা রিজভিকে খুন করতে চেয়েছিলো। রিজভিও একটা ভুল করে বসে। এই কেস থেকে বরখাস্ত হওয়ার পর কাউকে কিছু না বলেই আলাউদ্দিন খাকে ধরতে যায়। সে ভেবেছিলো প্রমাণ আরো শক্ত করে তাকে ধরে ফেলবে। কিন্তু ধূর্ত আলাউদ্দিন খা সে সুযোগ দিতে চায়নি৷ রিজভির উপর আক্রমণ করে বসে। সেখানেই দুইজনের হাতাহাতিতে আলাউদ্দিন খায়ের মাথায় গুলি লাগে। তার আগে অবশ্য রিজভির পাজরে গুলি লাগে। তখন সে অথৈকে ফোন দেয়। তার মনে হচ্ছিলো যে সে মারা যাবে। তাই প্রিয় মানুষের সাথে শেষবারের মতো কথা বলার জন্য ফোন দেয়৷ তখন অথৈ সেখানে গিয়ে তাকে উদ্ধার করে।
হেড কোয়ার্টার আগে থেকেই জানতো তদন্তের স্বার্থে অথৈ ছদ্মবেশে রিজভির সাথে মিশছে। তাই অথৈর কোনো কথাই তারা অবিশ্বাস করেনি।

অথৈ হেড কোয়ার্টার থেকে বের হয়ে হাসপাতালে চলে আসলো। রিজভির কেবিনে ঢুকে দেখে রিজভি বেডে শুয়ে আপেল খাচ্ছে। অথৈকে দেখতে পেয়ে রিজভি বলল, ‘আমার এরেস্ট ওয়ারেন্ট বের হয়ে গেছে?’
‘হুম।’
‘তাহলে সময় নিচ্ছেন কেনো? এরেস্ট করে ফেলুন?’
‘কিন্তু আপনার অনুমতি ছাড়া কিভাবে?’
‘মজা করছেন। আসামিকে এরেস্ট করতে তার অনুমতি নিতে হয় জানা ছিলো না।’
অথৈ রিজভির পাশে বসে রিজভির হাতটা নিয়ে নিজের উপর রেখে বললো, ‘এই ছোট্ট জেলে বন্দি হবেন?’
রিজভি হাত সরিয়ে নিয়ে বলল, ‘আমার বাকি জীবন সরকারি জেলে কাটবে।’
অথৈ উঠে দাঁড়িয়ে নিজের ব্যাগ থেকে দুইটা খাম বের করে রিজভির বুকের দিকে ছুড়ে মেরে বলল, ‘এই নিন আপনার মেডেল গ্রহণের ইনভাইটেশন। আর প্রমোশন লেটার।’
রিজভি অবাক হয়ে গেলো, ‘তাহলে আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন? এমন অপরাধীকে বাঁচানো উচিৎ হয়েছে? এমন একনন খুনির মুক্ত আকাশের নিচে ঘুরে বেড়ানোটা কি ঠিক হবে?’
অথৈ মুচকি হেসে বলল, ‘মিস্টার! এভরিথিং ফেয়ার ইন লাব এন্ড ওয়ার। তাই আপনার বা আমার কারোটাই আনফেয়ার হয়নি। আর আপনাকে মুক্ত আকাশের নিচে ঘুরতে দিবো কে বলেছে।’ অথৈ নিজের বুকের বাম পাশে হাত রাখলো, ‘বড় জেলখানা থেকে বাঁচিয়েছি, যেনো এই ছোট্ট জেলখানায় বন্দি করতে পারি। আপনার কোনো অসুবিধে আছে?’
‘হুম আছে৷ এই ছোট্ট জেলখানায় থাকতে পারবো না।’
‘কিন্তু আমার কিছু করার নেই৷ থাকতেই হবে।’ বলে অথৈ বেডের উপর বসে রিজভির বুকে মাথা রাখলো। রিজভি দুই হাত দিয়ে অথৈকে জড়িয়ে ধরতে গিয়ে ‘উহ’ করে উঠলো। স্যালাইনের নল লাগানো হাতটা সড়িয়ে এক হাতেই অথৈকে জড়িয়ে ধরলো।

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here