সিরিয়াল কিলার পর্ব ২

0
719

সিরিয়াল কিলার
©মারুফ হুসাইন
#পর্ব_২

৪.
একে একে তিনটা খুন হয়ে গেলো। রিজভি কপালে চিন্তার ভাজ পরে গেছে৷ রিজভির সামনেই আদনান বসে আছে৷
‘স্যার! উপর মহল থেকে চাপ আসতেসে। কিন্তু আমরা তো কিছুই করতে পারলাম না৷ একে একে তিনটা খুন হয়ে গেলো। শুনলাম, উপর মহলে কথাবার্তা চলছে। কেস থেকে আমাদের সড়িয়ে দিবে!’
‘হুম। গতকাল ডিআইজি স্যার আমাকে ডেকেছিলো। বলল, সলভ করতে না পারলে কেস ছেড়ে দিতে। আমি সময় চেয়েছি৷’
‘কিন্তু স্যার! আমরা তো কোনো সুবিধেই করতে পারতেসি না।’
‘আমার মনে হচ্ছে আমরা খুব শীঘ্রই কেস সলভ করে ফেলবো।’
‘কিন্তু স্যার! আমরা কোনো একটা প্যাটার্নও তো মিলাতে পারিনি।’
‘আদনান! খেলা তো মাত্র শুরু হইলো।’ বলেই রিজবি খিলখিল করে হেঁসে উঠলো।
‘বুঝলাম না স্যার!’
‘কালকের ঘটনাটাকে কইন্সিডেন্স বলতে পারো!’
‘কোন ঘটনাটা?’
‘আমি ভিকটিমকে চিনতাম৷’
‘কিভাবে স্যার?’ আদনান অবাক হয়ে গেলো।
‘গতকাল লোকাল বাসে একটা মেয়েকে সেক্সুয়ালি হ্যারেজ করছিলো। তখন গণধোলাই দিয়ে বাস থেকে নামিয়ে দেয়া হয়েছে৷’
‘কিন্তু স্যার এর থেকে কি প্রমাণ হয়?’
‘খুনি পুরুষাঙ্গ কেটে নিয়ে যায়। চোখ উপরে ফেলে। হাত কেটে ফেলে। মানে নিশ্চিত বলা যায় ভিক্টিমগুলা সেক্সুয়াল হ্যারাজার৷ অথবা এর চেয়ে বড় কোনো ক্রিমিনাল।’ রিজভি একটু থেমে একটা কাগজ নিয়ে তাতে কিছু লিখে আদনানের হাতে দিলো, ‘ভিক্টিমের ছবি নিয়ে এই অফিসে যাও! সম্ভবত ভিক্টিম এই অফিসেই চাকরী করে। কাল তার বুক পকেটে আইডি কার্ড ছিলো। গণপিটুনিতে পকেট ছিড়ে বের হয়ে গিয়েছিলো। তখন দেখেছি।’
‘জ্বী স্যার!’ আদনান কিছু দূর এগিয়ে আবার ফিরে আসলো, ‘কিন্তু স্যার! খুনি অব্দি আমরা কিভাবে পৌছাবো?’
‘ঐ মুহূর্তে বাসে কারা কারা ছিলো, জানতে পারলে হয়তো খুনি অব্দি আমরা সহজে পৌছুতে পারতাম। আমার মনে খুনি তখন বাসেই ছিলো।’
‘কিন্তু স্যার লোকাল বাসের যাত্রীদের খোঁজ পাওয়া তো মুশকিল।’
‘তা মুশকিল। কিন্তু অসম্ভব নয়। বাংলামটর মোড়ে সিসি ক্যামেরা আছে৷ ফ্লাইওভারের পরে সেটাই প্রথম স্টোপেজ। সেখানের সিসিটিভি ফুটেজ ম্যানেজ করো। পরের স্টপেজ কাওরান বাজার৷ সোনারগাঁও হোটেলের সাথেই। সোনারগাঁও হোটেলের রোড সাইডের সিসিটিভির ফুটেজগুলা লাগবে। পরের স্টপেজ ফার্মগেট। ঠিক এপেক্সের সামনেই। এপেক্সের সিসিটিভি ফুটেজও পাওয়া যাবে৷ বিকেল চারতা থেকে ছয়টার সিসিটিভি ফুটেজ আনবে।’
‘ওকে স্যার!’
‘আগে ভিক্টিমের অফিসে গিয়ে তার আইডেন্টিটি করো।’
‘ওকে স্যার!’ আদনান চলে গেলো।

ভিক্টিমের পরিচয় পাওয়া গেছে৷ নাম, মাসুম আহমেদ। মিরপুরে পরিবার নিয়ে বসবাস করে। বছর দুয়েক আগে বিয়ে করেছে৷ পরিবারে স্ত্রী আর সাত মাসের একটা বাচ্চা আছে। স্ত্রীকে লাশ সনাক্ত করার জন্য খবর দেয়া হয়েছে।

পরদিন আদনান সিসিটিবি ফুটেজগুলো নিয়ে আসলো। কিন্তু একটা সিসিটিভি ফুটেজও স্পষ্ট নয়৷ মানে বাস থেকে নামছে, উঠছে। বোঝা যাচ্ছে না৷ তাই এইগুলার আশা ছেড়ে দিলো। ভিক্টিমদের মধ্যে কি যোগসূত্র আছে, মেলানোর চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু তেমন কিছুই পাচ্ছে না।

৫.
রুনা কবির ভেবে পাচ্ছে না, প্রতিটা খুনের মধ্যে কানেকশন কি! তবে পরশু দিন খুন হওয়া মাসুম আহমেদের নামটা তার কাছে পরিচিত মনে হলো। সে নামটা কোথাও শুনেছে। কিন্তু মনে করতে পারছে না। কোথায় শুনেছে৷ অনেক ভেবেচিন্তেও যখন মনে করতে পারল না। তখন সে ভেবে নিলো, কত সময় কত মানুষের সাথেই তো দেখা হয়৷ হয়তো তাদের মধ্যে কারোর নাম ছিলো, মাসুম আহমেদ। কিন্তু ব্যপারটা তার মন মেনে নিতে পারছে না। তার মনে হচ্ছে, লোকটাকে সে আগেও কোথাও দেখেছে৷

রুনা কবির। একজন ক্রাইম রিপোর্টার। স্বনামধন্য নিউজ পেপারে কাজ করে। সে আবার শখের গোয়েন্দাও৷ শখের বসেই এই কেসটা তদন্ত করা শুরু করেছে৷

রুনা নিজের ফ্ল্যাটের একটা রুম অফিস রুম হিসেবে ব্যববার করে। সে অফিস রুমে গিয়ে মার্কার নিয়ে হোয়াইট বোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে গেলো। আগের দুই ভিক্টিমের পাশে মাসুম আহমেদের ছবি লাগিয়ে দেয়া দিলো। বোর্ডের ঠিক উপরে প্রশ্নবোধোক চিহ্ন দেয়া৷ তার পাশেই লেখা খুনি। সে চিহ্নটার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো, ‘কে খুনি? আর এই খুনগুলো কেনই বা করছে? খুনের পিছনে মোটিভ কি? নাকি খুনি শুধুই একজন সিরিয়াল কিলার? আর ভিক্টিমদের ভিতরে কানেকশন কি?
হঠাৎ প্রথম ভিক্টিমের উপর তার নজর পরলো। নাম রেজাউল করীম। পেশায় ব্যবসায়ী। বছর পাঁচেক আগে চট্রগ্রাম থেকে পরিবার নিয়ে ঢাকায় চলে এসেছে৷
দ্বিতীয় ভিক্টিমের দিকে তাকিয়ে দেখলো, হ্যা। সেও ঢাকার বাসিন্দা নয়। বছরখানেক আগে ঢাকা এসেছে৷ এর আগে চট্রগ্রামে থাকতো। ঢাকা এসে রাজনীতিতে জড়িয়ে গেছে৷ এখনো বিয়ে করেনি। বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা আছে৷
রুনা কবির ভিক্টিমদের পূর্বের লোকেশনগুলা লাল কালিতে মার্ক করে রাখলো। সে নিজের মাথা চাপড়ালো। আগে কেনো ব্যাপারটা খেয়া করেনি। প্রথম দুই ভিক্টিমই চট্রগ্রাম থাকতো। কয়েক বছর আগে ঢাকা এসেছে। কিন্তু চট্রগ্রাম ছেড়ে তারা ঢাকায় কেন এসেছে? কথাটা জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন মনে করেনি। তার মনে হতে লাগলো, তাদের ঢাকার আসার পিছনে হয়তো কোনো গল্প আছে। যা তাদের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাড়াচ্ছে। কিন্তু সেই গল্পটা কি? রক্তের খেলা কি এখানেই শেষ না আরো আছে? শেষ না হলে পরবর্তী ভিক্টিম কে?
হরেক রকম প্রশ্ন তার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো। সে বুঝে উঠতে পারছে না, কিভাবে তার আগানো উচিৎ। তার মনে হচ্ছে তাকে গাইড করার জন্য একজন গুরু থাকা দরকার ছিলো। তার থেকে কাজ শিখতে পারলে হয়তো কেসগুল আরো সুন্দর করে গুছিয়ে এগোতে পারতো। সে বুঝতে পারছে না তার পরবর্তী পদক্ষেপ কি হওয়া উচিৎ!
সে তার ডায়েরী বের করে তার পরবর্তী পদক্ষেপগুলো লিখতে লাগলো,
১. ভিক্টিম তিন জনের মধ্যে লিংক খুঁজে বের করা
২. মোটিভ অফ মার্ডার
৩. পরবর্তী ভিক্টিম কে হতে পারে খুঁজে বের করা।
সে ডায়েরী বন্ধ করে ভাবলো, ভিক্টিমদের মধ্যে কানেকশন খুঁজে বের করতে হলে তাদের সম্মন্ধে আরো জানতে হবে। তার জন্য ভিক্টিমের পরিবারের সাথে দেখা করা দরকার।

রুনা কবীর বাসা থেকে বের হয়ে গেলো। উদ্দেশ্য রেজাউল করিমের ছোট ভাই। তাকে ফোন করে একটা কফি শপে আসতে বলা হয়েছে৷
ঢাকার জ্যামে বসে থেকে সে বিরক্ত হয়ে উঠছে। বাসে বাদামওয়ালা উঠেছে৷ দশ টাকার বাদাম কিনে নিলো। খাওয়া শেষে বাদামের ঠোংগাটা দেখতে লাগলো৷ একটা পত্রিকার কাটপিস। অভ্যাসমত লেখাগুলো পড়তে লাগলো৷ একটা নিউজের অংশে তার চোখ আটকে গেলো। কিন্তু নিউজ সম্পূর্ণ নেই। পত্রিকাটা কবের সেটাও বুঝা যাচ্ছে না৷ তবে সে এই নিউজটা আগেও পড়েছে৷ বিশ্ববিদ্যালয় পড়াকালিন সময়ে সে নিউজটা পড়েছিলো। সে ধারণা করছে নিউজটা হয়তো তিন-চার বছর আগের৷ সে বাস থেকে নেমে গেলো। আরেকটা বাসে উঠে, নিজের পত্রিকার অফিসের দিকে রওনা দিলো। হয়তো পুরানো পত্রিকা খুঁজে কিছু পাওয়া যাবে৷
তার মন বলছে, সে এই কেসটার গুরুত্বপূর্ণ কিছু পেতে যাচ্ছে৷

৬.
প্রতি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় অফিস শেষে রিজভি কাপ-ক্যাফেতে বসে কফি খায়। এটা তার গত কয়েক বছরের রুটিন। অফিস শেষে সে কাপ-ক্যাফের উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেলো।
কাপ-ক্যাফেতে ঢুকতেই কর্ণারে টেবিলটায় তার চোখ পরলো। একটা মেয়ে বসে আছে৷ মেয়েটাকে সে চিনতে পারলো। গত সপ্তাহে দেখা হওয়া অথৈ। রিজভি দু-কাপ কফির অর্ডার দিয়ে কর্ণারের টেবিলটায় গিয়ে বসে পরলো, ‘আমার জন্য অপেক্ষা করছেন?’
অথৈ মাথা নেড়ে ‘হ্যা’ বলল।
‘বাহ! এই সাতদিনে আপনার অনেকটা সময় আমার জন্য নষ্ট হলো।’
‘মোটেও না৷ আমি শুধু আজই এসেছি।’
‘মানে আপনি জানতেন আমি আজ এখানে আসবো।’
‘হ্যাঁ।’
‘কিভাবে?’
‘গত বৃহস্পতিবার আপনি চলে যাওয়ার পর আমি ম্যানেজারকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম।’
‘তাই। কিন্তু আমি যে সবসময় এখানে আসি। এটা আপনার কেনো মনে হলো?’
‘আপনার বাসা পিছনের দিকে। কফি খেতে এদিকে আসার কোনো প্রয়োজন নেই। তবুও আপনি অনেকটা হেঁটে এখানেই আসেন। তাই মনে হলো এটার সাথে আপনার কোনো ইমোশমাল এটাচমেন্ট আছে।’
‘ওয়েট ওয়েট!’ রিজভি অথৈকে থামিয়ে জিজ্ঞাসা করলো, আমার বাসা পিছনের দিকে এইটা আপনি কিভাবে জানলেন?’
‘গত সপ্তাহ উঠার আগে আপনি বলেছিলেন যে চলুন উঠি! বাসায় যাওয়া দরকার। তারপর আপনি গলি থেকে বের হয়ে পিছনের দিকে হাঁটা দিয়েছিলেন৷ তাই মনে হয়েছে।’
‘আচ্ছা সেটা না হয় বুঝলাম। কিন্তু ম্যানেজারকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারবেন, আমি এখানে কবে আসি। তা কিভাবে নিশ্চিত ছিলেন?’
‘নিশ্চিত ছিলাম না। এটার সাথে আপনার ইমোশনাল এটাচমেন্ট আছে, মনে হওয়ায় জিজ্ঞাসা করেছিলাম। যদি সে বলতে পারে আর কি! জিজ্ঞাসায় করায় দুয়ে দুয়ে চার মিলে গেল।’
‘যদি সে না জানতো তখন কি করতেন?’
‘তা ভাবিনি৷ তখন অন্য কোনো উপায় বের করে নিতাম।’
‘আপনার বুদ্ধির প্রশংসা না করে পারা যাবে না৷’ রিজভির প্রশংসা করার ইচ্ছে ছিলো না৷ কিন্তু মুখ ফসকে বের হয়ে গেছে৷
‘থাক তা করতে হবে না। বেশী প্রশংসা করলে আবার বদ হজম হবে।’
ততক্ষণে কফিও এসে পরেছে৷ অথৈ কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলল, ‘কোথায় জব করছেন?’
‘জব করি না।’
‘তাহলে?’
‘ভবঘুরে বলতে পারেন।’
‘আমার মনে হয় না আপনি ভবঘুরে। নিশ্চই আমার সাথে মজা করছেন?’
‘মজা না করলে কি আমার সাথে কফি খাওয়া যাবে না?’
‘উহু! তা বলিনি। কেনো জানি আপনাকে দেখে ভবঘুরে মনে হয় না।’
‘ভবঘুরেদের কি আলাদা কোনো বৈশিষ্ট্য আছে?’
‘হ্যাঁ আছে।’
‘কি সেটা?’
‘তারা এতো গোছানো হয় না, মেপে মেপে কথা বলে না। কোনো মেয়ে নিজে থেকে কথা বললে এতোটা কেয়ারলেস থাকে না।’
‘এগুলা আপনার ভুল ধারণা। যাকগে এ আলাপ বাদ দিন। আমি ছোট খাটো একটা জব করছি। কি জব বলে লজ্জা পেতে চাই না।’
সময় গড়ায়, রিজভি আর অথৈ আর আড্ডা জমে উঠে। কফি ফুরিয়ে যায়। নতুন কফির কাপ এসে টেবিলে জমা হয়। কিন্তু তাদের গল্প আর ফুরোয় না।

চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here