সিরিয়াল কিলার পর্ব ১

0
1194

১.
চলন্ত বাসে রিজভি হঠাৎ দাঁড়িয়ে তার পাশে বসা লোকটাকে কষিয়ে এক থাপ্পড় দিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলো, ‘ড্রাইভার সাব! বাস থামান!’
বাসের সবাই রিজভির দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। রিজভির কোনো দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই৷ পাশের লোকটাকে একের পর এক থাপ্পড় দিচ্ছে আর বলছে, ‘নাম! বাস থেকে এখনি নাম।’
লোকটা কিছু বলতে চাচ্ছে, কিন্তু বলার সুযোগ পাচ্ছে না।

রিজভি বাসের দরজা থেকে দুয়েকটা সীট পরেই জানালার পাশের সীটে বসেছে৷ তার পাশের সীটটায় মধ্য বয়সী একটা লোক বসেছে। পরনে পরিষ্কার সাদা শার্ট। প্যান্টে ইন করা। গলায় টাই ঝুলানো। পোশাক-আশাকে লোকটাকে ভদ্র মনে হলেও চেহারায় পিশাচ পিশাচ একটা ভাব আছে। লোকটার ঠিক সামনের সীটেই একটা মেয়ে বসেছে।
বাসে পা ফালানোর জায়গা নেই৷ চারিদিকে মানুষ গিজগিজ করছে৷ এক পা এদিক-সেদিক করার জায়গাটুকুও নেই৷ এরই মধ্যে লোকাল বাসটা চল্লিশ স্পিডে ফ্লাই ওভার পার হচ্ছিল। রিজবির পাশে বসা লোকটা এই ভিড়ের সুযোগটাই নিচ্ছিলো। সামনের সীট ধরে বসার নাম করে মেয়েটার পিঠ ছুয়ে দিচ্ছিলো। তার সীটের এবং পাশে চাপাচাপি করে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোর মাঝ দিয়ে হাত দিয়ে মেয়েটার বাহু, থাই, হিপও স্পর্শ করছিলো। মেয়েটা ব্যপারটা বুঝতে পেরে বারবার পিছনে তাকাচ্ছে। ঘৃণায় মেয়েটার চোখ-মুখ ছোট হয়ে যাচ্ছিলো৷ কিন্তু কিছু বলার সাহস করে উঠতে পারছে না৷
রিজভি ব্যপারটা খেয়াল করে লোকটা থাপড়ানো শুরু করেছে৷ বাসের অন্যান্য যাত্রীরা এমন একটা ভদ্র লোককে এভাবে মার খেতে দেখে অবাক হয়ে গেলো৷ একজন জিজ্ঞাসা করে বসলো, ‘আপনি লোকটাকে শুধু শুধু এভাবে মারছেন কেনো?’
রিজবি মার থামিয়ে বলল, ‘এমনি এমনি মারতেসি!’ সামনের মেয়েটার দিকে ইঙ্গিত করে বলল, ‘উনারে জিজ্ঞাসা করেন, এমনি এমনি মারছি কি না?’
রিজবি লোকটাকে কেনো মারছে কারো আর বুঝার বাকি রইলো৷ লোকটাকে মারার জন্য আরো কয়েক জন এগিয়ে আসলো।
মারামারি দেখে ড্রাইভার বেশ কিছুক্ষণ আগেই বাস সাইড করে থামিয়েছে। সামনে থেকে ড্রাইবারও চেচিয়ে উঠলো, ‘মিন্টু! এই শুয়োরের বাচ্চারে বাস থেইকা নামা!’
লোকটাকে মারতে মারতে ফ্লাই ওভারের মাঝেই ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দেয়া হলো। হেল্পার দেরী না করে লোকটার মুখের উপর বাসের দরজা লাগিয়ে দিলো৷ ড্রাইভার বাসের গতি ধীরে ধীরে বাড়িয়ে লোকটার পাশ কেটে চলে গেলো। লোকটা অসহায়ের মতো বাসের দিকে তাকিয়ে রইলো।

২.
রিজভি ফার্মগেট পৌছে বাস থেকে নেমে পরলো। কিছুদূর এগিয়ে যেতেই পিছন থেকে ‘এই যে মিস্টার!’ বলে কেউ ডাকছে। সে পিছনে তাকিয়ে দেখে একটা মেয়ে দ্রুত তার দিকে হেঁটে আসছে৷ রিজভি মেয়েটাকে চেনার চেষ্টা করলো। কিন্তু পরিচিত বলে মনে হলো না৷
‘আমাকে ডাকছেন?’ মেয়েটা সামনে আসতেই রিজভি জিজ্ঞাসা করলো।
‘হ্যা! আপনাকেই ডেকেছি।’
‘অহ আচ্ছা। কোনো দরকার?’
‘না।’
‘তাহলে আমাকে আগে থেকে চিনেন?’
‘ধুর মিয়া! চিনলে তো আপনার না ধরেই ডাকতাম৷ বাসে আপনার সহযাত্রী ছিলাম৷ একটা মেয়ের প্রতি আপনার রেস্পন্সিবলিটি দেখে আপনার সাথে কথা বলার ইচ্ছে হলো।’
‘অহ আচ্ছা।’
‘সব পুরুষের মানসিকতা যদি আপনার মতো হতো তাহলে আমরা মেয়েরা কোথাও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতাম না।’
‘হাতের পাঁচটা আঙ্গুল যেমন সমান নয়৷ তেমনি সব পুরুষ মানুষও সমান নয়। সবখানেই ভালো-মন্দ মিলিয়েই হয়।’
‘তা অবশ্য ঠিক বলেছেন।’ মেয়েটা একটু থেমে বলল, ‘কোথায় যাচ্ছেন?’
‘একটা কফি শপে।’
‘কেউ অপেক্ষা করছে?’
‘হ্যা’
‘আপনার সাথে এতোক্ষণ ধরে কথা বলছি৷ কিন্তু আপনার নামটাই জানা হলো না।’
‘রিজভি।’
‘আমার নাম অথৈ। একটা প্রাইভেট কম্পানিতে জব করছি।’
‘অহ আচ্ছা!’
‘আচ্ছা আপনি সব সময় এমন গম্ভীর হয়েই থাকেন? একটা মেয়ে সেধে সেধে কথা বলছে৷ কিন্তু আপনি কোনো পাত্তাই দিচ্ছেন না।’
‘আই এম সরি। কিছু মনে করবেন না। আসলে মনটা বেশী ভালো নেই। তাই বেশী কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।’
‘অহ সরি! তাহলে আমি মনে হয় আপনাকে বিরক্ত করছি।’
‘না, না বিরক্ত হচ্ছি না।’
অথৈ দাঁড়িয়ে গিয়ে একটা কফিশপের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, ‘আপনার কাপ-ক্যাফে এসে গেছে।’
রিজভি কিছুটা অবাক হলো। সে তো কোনো কফিশপের নাম বলেনি। মেয়েটা কিভাবে বুঝলো সে এই কফি শপেই আসবে।
রিজভির অবাক হওয়াটা অথৈ বুঝতে পারলো, ‘অবাক হওয়ার কিছু নেই। এই গলিতে এই একটাই কফিশপ। তাই বুঝেছি আপনি এই কফি শপেই আসবেন।’
রিজভি বুঝতেও পারেনি মেয়েটার সাথে কথা বলতে বলতে মেইন রোড ছেড়ে গলিতে ঢুকে গিয়েছে, ‘ব্যাপারটা আমি কখনো খেয়ালই করিনি।’
‘এখন করে নেন। আর আপনি চাইলে আজকে আপনাকে আমি কফি খাওয়াতে পারি। একা এক কফি খেতে বড্ড বোর লাগে। আমিও কম্পানি পাবো৷ আপনারও কম্পানি হয়ে যাবে। একা একা কফি খেতে হবে না।’
‘আমি একা একা কফি খাবো আপনাকে কে বলল?’
‘কেউ বলেনি। আপনার জন্য কেউ অপেক্ষা করলে আপনি এতো ধীর গতিতে হেঁটে আসতেন না। দ্রুত আসতেন। যেখানে আপনি স্বাভাবিকের চেয়েও ধীরে ধীরে এসেছেন। আর কেউ অপেক্ষা করছে, জিজ্ঞাসা করার পর আপনি বড় করে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে উত্তর দিয়েছেন। কোনো প্রশ্নের উত্তরে দীর্ঘ নিঃশ্বাস নেয়ার মানে হলো দুইটা। এক. উত্তরটা বানিয়ে নেয়া। দুই. কোনো ব্যাপারে আফসোস বা আক্ষেপ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে আফসোস বা আক্ষেপটা নিঃশ্বাসের সাথে বের করে দেয়া।’
মেয়েটার জ্ঞানের প্রশংসা করতে ইচ্ছে করলেও রিজভি নিজেকে বিরত রাখলো। মুচকি হেঁসে বলল, ‘এখন চলুন! বাইরে দাঁড়িয়ে না থেকে কফি খেতে খেতে কথা বলা যাক।’
অথৈ মুচকি হেঁসে বলল, ‘চলুন!’
গল্পে গল্পে তাদের অনেকটা সময় কেটে গেলো। অথৈ মেয়েটা গল্প জমিয়ে তুলতে পারে। বছর পাঁচেক আগে ধাক্কাটা খাওয়ার পর থেকে রিজভি কখনোই কারো সাথে এতো কথা বলতে পারেনি। এমন জমিয়ে কথা বলতে পারেনি। রিজভি মেয়েটার কথায় গুণে ইম্প্রেসড না হয়ে পারছে না৷
‘এই নিন! নাম্বার লিখে দিন। না হয় তো আপনাকে আর খুঁজে পাবো না।’ যাওয়ার সময় অথৈ নিজের মোবাইলটা এগিয়ে দিয়ে বলল।
‘নাম্বার দিবো না ভাবছি।’
‘কেনো?’
‘ ইচ্ছা হলে এমনিই খুঁজে নিতে পারবেন।’
‘কিভাবে?’
‘এটাকে একটা খেলা বলা যেতে পারে। আপনার সাথে তো অনেক কথাই হলো। তার সূত্র ধরে খুঁজে নিবেন। আপনার কথাবার্তায় আপনাকে খুব বুদ্ধিমতি মনে হয়েছে। তাই আপনার সাথে খেলে মজা পাওয়া যাবে।’
‘আপনি বেশ ইন্টারিষ্টিং মানুষ তো। তবে আমি বুদ্ধিমতি নয়। তবে আপনি যেহেতু খেলতে চাইলেন। তাহলে অবশ্যই খেলবো।’ একটু থেমে সে আবার বলল, ‘আর যদি খুঁজে বের করতে না পারি?’
‘তাহলে আমাদের ভাগ্য খারাপ। শুরু হওয়ার আগেই বন্ধুত্বটা শেষ হয়ে যাবে।’
অথৈ খিলখিল করে হেঁসে উঠল, ‘আপনি খুব চতুর লোক।’
‘কি আবার কি করলাম।’
‘এই যে কি অভিনব কায়দায় বন্ধুত্বের অফার করে বসলেন। তবে আপনি যেহেতু গেম খেলতে চেয়েছেন। গেমটাই হবে।’ রিজভিকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই অথৈ নিজের গন্তব্যে হাঁটতে শুরু করলো।

৩.
রিজভি অফিস থেকে একদিনের ছুটি নিয়েছিলো। প্রতি বছরই সে এই একটা দিন ছুটি নেয়। এই দিনটা তার জীবনের বিশেষ একটা দিন। এই দিনটা সে কারো সাথেই শেয়ার করতে চায় না। একা থাকতে চায়। বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসে দিনটা কাটিয়ে দিতে চায়৷ কিন্তু এবার আর তার একা থাকা হলো না। সকাল ৬টায় তার সহকারী ফোন দিয়ে তার ঘুম ভাংগিয়ে দিলো, ‘স্যার! একটা খারাপ খবর আছে।’
‘কি?’
‘কিছুক্ষণ আগে রমনা থানার ওসি ফোন দিয়ে বলল, আরো একটা লাশ পাওয়া গিয়েছে।’
‘কোথায়?’
‘রমনা পার্কে।’
‘এইটা কি আমাদের কেসের সাথে সম্পৃক্ত?’
‘হ্যা স্যার। ওসির মুখের বর্ণনায় তো মনে হলো ঠিক আগের দুইটা যেভাবে করা হয়েছিলো এটাও ঠিক সেভাবেই করা হয়েছে। পুরুষাঙ্গ, কান, হাতের কব্জি কেটে ফেলা হয়েছে। চোখ দুইটাও উঠিয়ে নিয়েছে।’
‘আচ্ছা তুমি টিম নিয়ে চলে যাও। আমি আসছি।’
‘স্যার! আপনি তো ছুটি নিয়েছেন আজ৷ তবুও আসবেন?’
‘তা ছাড়া আর উপায় কি! কেসটা তো সলভ করতে হবে।’

রিজভি ফ্রেশ হয়ে রমনা পার্কের উদ্দেশ্য বের হয়ে গেলো। সে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে কর্মরত আছে। এতো দিন সে সহযোগি হিসেবে অনেক কেস সলভ করলেও এটাই তার প্রথম কেস। যেখানে সে লিড দিচ্ছে৷ তার বয়স আটাশ কি উনত্রিশ হবে৷ এই অল্প বয়সে কোনো সিরিয়াল কিলিং মামলার তদন্তের ভার পাওয়াটা কম বড় এচিভমেন্ট নয়। সে এতো বড় মামলা হাতে খুশিই হয়েছিলো। কিন্তু এখন পর্যন্ত সে বাজেভাবে ব্যর্থ। একের পর এক খুন হয়ে যাচ্ছে৷ কিন্তু সে কোনো কুল-কিনারা করে উঠতে পারছে না। এই নিয়া গত চার মাসে তিনটা খুন হয়ে গেলো। কিন্তু সে কিছুই করতে পারেনি। তবে বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যগুলো বলে দিচ্ছে এইটা কোনো সিরিয়াল কিলারের কাজ। প্রতিটা খুনের ধরণ একই। হাত মুখ বেধে লিঙ্গ, হাত কাটা হচ্ছে৷ চোখ তুলে ফেলা হচ্ছে। তারপর শ্বাস নালি কেটে মেরে হচ্ছে। কি অসহ্য যন্ত্রণা দিয়ে মারা হচ্ছে। লাশের সাথে সব কিছু ফেলে রেখে গেলেও খুনি পুরুষাঙ্গ নিয়ে যাচ্ছে৷

রিজভি রমনায় ঢুকেই তার সহকারী আদনানকে দেখতে পেলো। তাকে দেখে আদনান তার সামনে এসে বলল, ‘স্যার! এবারো খুনি ভিক্টিমের পুরুষাঙ্গ নিয়ে গেছে।’
‘খুনির কোনো ক্লু পেলে?’
‘না স্যার! কিছুই পাওয়া যায়নি৷’
‘মার্ডার ওয়েপন?’
‘না স্যার তাও পাওয়া যায়নি।’
‘ভালো করে সার্চ করো। কোনো ক্লু পাওয়া যায় কি না। দরকার হলে ফরেন্সিক টিমকে নিয়ে আসো। কোনো ফিঙ্গার বা ফুট প্রিন্ট পাওয়া যায় কি না দেখো!’
রিজভি আর আদনান কথা বলতে বলতে লাশের কাছে চলে আসছে। লাশটার চারিটিকের নির্দিষ্ট একটা জায়গা টেপ মেরে সিল করে দেয়া হয়েছে। সে জায়গাটুকুতে সাধারণের প্রবেশ নিষেধ। লাশটা সাদা কাপড়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। রিজভি লাশটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘লাশটা পোস্টমর্টেমের জন্য পাঠানোর ব্যবস্থা করো!’ সে লাশটার কাছাকাছি গিয়ে বসলো। মাথার দিকের কাপড়টা সড়াতেই সে বাজেভাবে শক খেলো। সে লোকটাকে চিনে। গতকাল যাকে মেরে বস থেকে নামিয়ে দিয়েছিলো। সে লোকটাই। কিন্তু এই লোকটাকে কেনো খুন করা হলো তার বুঝে আসছে না। অবশ্য আগের দুইটা খুনও কেন করা হয়েছে তার বুঝে আসেনি। কিন্তু এই খুনটা তার মনে নাড়া দিয়েছে। আগের লোক দুইটা তার কাছে অজ্ঞাত ছিলো। কিন্তু এই লোকটাকে সে চিনে। হয়তো বাজে লোক হিসেবে চিনে। তবুও চিনে তো। অপরিচিত কারো কিছু হলে মানব মনে তেমন প্রভাব ফেলে না৷ কিন্তু পরিচিত মানুষের কিছু হলে সেটা মানব মনে প্রভাব ফেলে। হোক সে বন্ধু অথবা শত্রু।

চলবে…..

#সিরিয়াল কিলার
©মারুফ হুসাইন
#পর্ব_১

(এই গল্পের সমস্ত চরিত্র, কাল এবং স্থান কাল্পনিক। বাস্তবতার সাথে এর কোনো মিল নেই।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here