শ্রাবনসন্ধ্যা পর্ব:-১১

0
2274

শ্রাবনসন্ধ্যা পর্ব:-১১
#আমিনা আফরোজ

দেখতে দেখতে কেটে গেছে বেশ কিছুদিন ‌।বর্ষা ঋতুকে বিদায় জানিয়ে সাদা মেঘের ভেলায় চড়ে আগমন ঘটেছে শরতের। শরতের ঝকঝকে নীল আকাশ, মৃদুমন্দ বাতাস দোলা দিয়ে যাচ্ছে কাশফুলের নরম পাপড়িতে। শিশির ভেজা সবুজ ঘাসের বিছানায় রাশি রাশি শিউলি ফুল। দূর থেকে দেখলে মনে হয় যেন আকাশ থেকে খসে পড়ছে রাতের ঝলমলে তারারা। মাটির সাথে মিশে রয়েছে তার মিষ্টি গন্ধ। জাফরানি বোঁটার দুধসাদা ছয় পাপড়ির এ ফুল রাতে ফোটে এবং সকালেই তা ঝড়ে যায়। বেলি ফুলের গন্ধে মৌ মৌ করে রাতের আকাশ। শরতের আকাশ, শরতের নদী, শরতের ফুল সবকিছুই কেমন যেন শান্ত- মায়াময়। বিলের শাপলা, নদীর তীরের কাশফুল, আঙিনার শিউলি সবই কমল ও পবিত্র। কাশবনে দলবেঁধে আসে চড়ুই পাখিরা। নদীতে দু-কুল ছাপানো ঢেউয়ের বদলে দৃশ্যমান হয় কাশবনের ছোট ছোট রুপালি ঢেউ।

এ দু-মাসে শ্রাবনদের সবার সাথে বেশ ভালো সম্পর্ক হয়েছে সন্ধ্যার।সব থেকে ভালো সম্পর্ক হয়েছে রোদের সাথে। দুজনেরই সমবয়সী বিধায় দুজনের বন্ডিংটা আরো ভালো জমেছে।রোদ কলেজে ভর্তি হলেও সন্ধ্যার বাবার মুখে নেহালের কথা শোনার পর রশিদ সাহেব সন্ধ্যাকে ওনার এক পরিচিত পুরোনো বন্ধুর কলেজে ভর্তি করে দিলেও কলেজে যেতে দিচ্ছেন না তিনি। সন্ধ্যা আপাতত শ্রাবণের কাছেই পড়াশোনা করে। সারাদিন তো আলে-ডালেই কেটে যায় ওর পড়া যেটুকু হয় তা ঐ শ্রাবনের কাছেই হয়।

এদিকে রোদ আজ কলেজ যেতে লেট করেছে। দেরি হওয়ার মূল কারণ গতকাল প্রায় মধ্যরাত পর্যন্ত ও আর সদ্ধ্যা দুজনে মিলে আড্ডা দিয়েছে আর মুভি দেখেছে। এরকম ঘটনা অবশ্য আজ নতুন না। মাস দুয়েক হল এমন ঘটনা প্রায় প্রায়ই ঘটে আসছে। এ নিয়ে অবশ্য মা আর ভাইয়ের কাছে বেশ বোকা খেয়েছে ও। তবুও এই অভ্যাসটা বদলাইনি ওদের।রোদ যখন তাড়াহুড়ো করে কলেজে যাওয়ার জন্য বের হচ্ছিল ঠিক তখনই মিসেস রাবেয়া বেগম বলে উঠলেন,

–“কিরে না খেয়ে এমন তাড়াহুড়ো করে কই যাচ্ছিস ?”

–“কলেজ যাচ্ছি আম্মু।”

–“সে তো আমিও দেখতে পাচ্ছি। আমার কথা হচ্ছে তুই না খেয়ে কই যাচ্ছিস?”

মায়ের কথা শুনে করুন দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকিয়ে রোদ বলে উঠলো,

–“আজ একটুও খাওয়ার সময় নেই আম্মু। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে তার ওপর আজ নাকি কলেজে নতুন ইংলিশ টিচার আসবে।”

মিসেস রাবেয়া বেগম ভাবলেশহীন ভাবে উত্তর দিলেন,

–“তো?”

–” আম্মু প্লিজ আমাকে এখনি বের হতে হবে।”

এরপর রোদ আর কোন কথা না বলে দ্রুত কলেজের পথে রওনা দেয়। রোদ জানে এখন ওর মায়ের সামনে থাকলে আজ আর কলেজ যাওয়া হবে না ওর।

রোদ যখন গেট দিয়ে ভার্সিটির ভিতরে ঢুকে যাবে ঠিক তখনই একজনের সাথে ধাক্কা খেল ও। এমনিতেই আজ কলেজ আসতে রোদের দেরি হয়েছে বিধায় ওর মেজাজটা খারাপ ছিল তার ওপর এই অচেনা ছেলের সাথে ধাক্কা লেগে আরও বেশি রেগে গেল ও। মাথা উঁচু করে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তির উদ্দেশ্যে বলল,

–“কি ব্যপার দেখে চলতে পারেন না নাকি চোখে ছানি পড়েছে?”

রোদের সামনে দাঁড়ানো ব্যক্তিটি এবার বলে ওঠল,

–“দেখুন ধাক্কা‌ কিন্তু আমি দেই নি বরং আপনিই ইচ্ছা করে আমার সাথে ধাক্কা খেয়েছেন।এখানে আমার কোন দোষ আছে বলে তো মনে হচ্ছে না আমার।”

আসলে ধাক্কাটা রোদের থেকেই লেগেছে তবুও তা মানতে নারাজ ও। একরকম জোর গলায় বলে উঠলো,

–“মোটেও আমি আপনাকে ধাক্কা দেয় নি বরং আপনিই আমাকে ধাক্কা দেয়েছেন।আর এখন আমাকে মিথ্যা কথা বলছেন।”

–“আপনাকে মিথ্যা কথা বলে আমার কি লাভ?”

–“লাভ ক্ষতি আমি এত কিছু বুঝি না।”

সামনে থাকা ব্যক্তিটির মুখে এবার বিরক্তি প্রকাশ পাচ্ছে।একে তো আজ তার কলেজের প্রথম ক্লাস আর আজকেই কি না ওকে এমন তার ছেঁড়া মেয়ের পাল্লায় পড়তে হলো। কলেজের প্রথম দিনই যদি ও দেরিতে যায় তবে তা খুব বাজে দেখাবে। আপাতত এই পাগলের হাত থেকে বাঁচতে হবে পরে একে দেখা যাবে।তাই বিরক্তি মাখা মুখেই বলে উঠলো,

–“সরি।”

তারপর আর কোনদিকে না তাকিয়ে সোজা প্রিন্সিপালের রুমের দিকে চলে গেল।এদিকে রোদ বেশ অবাক হয়ে আগুন্তক ব্যক্তিটির চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। হঠাৎ ক্লাসের কথা মনে হওয়ায় দ্রুত ক্লাসের দিকে চলে গেল ও।

রোদ ক্লাসে আসার কিছুক্ষণ পরেই আগমন ঘটলো প্রিন্সিপাল স্যার আর লম্বা গৌরবর্ণের সুদর্শন এক ব্যাক্তির । রোদ ছেলেটিকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে পারল ছেলেটি আর কেউ নয় কিছুক্ষণ আগে রোদ যার সাথে ধাক্কা খেয়েছিল সে। রোদ একবার প্রিন্সিপাল স্যারের দিকে তাকিয়ে আবারো ছেলেটির দিকে তাকিয়ে ভয় ঢোক গিলতে লাগলো। এইটা যদি ওদের নতুন স্যার হয় তবে আজ রোদের কপালে খুব খারাপ কিছু লেখা আছে।

প্রিন্সিপাল সকল শিক্ষার্থীর দিকে তাকিয়ে বললেন,

–“ইনি তোমাদের নতুন ইংলিশ টিচার। আশা করি ওনার ক্লাস তোমাদের ভালো লাগবে।”

কথাগুলো বলে পাশে থাকা ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে বললেন,

–“তুমি তাহলে তোমার ক্লাস শুরু করো। আমি তাহলে এখন আসি।”

লোকটি স্মিত হেসে বলল,

–“ঠিক আছে স্যার।”

প্রিন্সিপাল চলে যাওয়ার পরে লোকটি শিক্ষার্থীদের দিকে স্মিত হেসে বলল,

–“আমি অভ্র আহমেদ নেহাল। আজ থেকে তোমাদের নতুন ইংলিশ টিচার আমি। ক্লাসের প্রথম দিন আমি সবার সাথে পরিচয় হতে চাই। আমরা বরং আগামীকাল থেকে পড়া শুরু করব।”

নেহালের বলা কথাগুলো অন্য শিক্ষার্থীদের ভালো লাগলেও রোদের মোটেও ভাল লাগলো না। বরং ওর বেশ অস্বস্তি বোধ হচ্ছিল সাথে অবশ্য ভয় ও হচ্ছিল। কিছুক্ষণ আগে ও যে ঘটনা ঘটিয়েছে তাতে ভয় পাবারই কথা।ও কি আর জানত যে ঐ রগচটা ঘ্যাড়ত্যাড়া ওদের নতুন ইংলিশ টিচার।এখন এ নিয়ে বেশ আফসোস হচ্ছে রোদের। কিন্তু আফসোস হলেও এখন কিছুই করার নেই ওর।

সবার পরিচয় পর্ব শেষ হওয়ার পর রোদের পালা এলো। রোদ ভয়ে শুকনো ঢক গিলে ওঠে দাঁড়ালো। রোদকে এভাবে দাঁড়াতে দেখে ভ্রু কুঁচকে গেল নেহালের। হঠাৎই সকালের ঘটনা মনে পড়ল ওর সেই সাথে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল। নেহাল রোদের সামনে এসে গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞাসা করল,

–“নাম কি তোমার?”

রোদ ক্ষীন স্বরে বলল,

–“নৌশিন আহমেদ রোদেলা। তবে সবাই রোদ বলে ডাকে।”

–“নৌশিন আহমেদ রোদেলা বেশ বড় নাম এর থেকে রোদ নামটাই বেটার।”

রোদ কিছু না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। রোদকে চুপ থাকতে দেখে নেহাল এগিয়ে এসে আস্তে করে বলল,

–“সকালের ঘটনার শোধ তো আমি তুলবই মিস রোদ তাও আমার স্টাইলে।”

নেহালের বলা এটুকু কথাটাই যথেষ্ট ছিল রোদের জন্য। এমনিতেই নেহালকে নিয়ে ভয়ে ছিল তার ওপর নেহালের বলা কথা শুনে আরো বেশি ভয় পেয়ে গেল রোদ।রোদের চোখে পানি চলে এসেছে যে কোন সময়েই বিনা নোটিশে ঝড়তে পারে তারা। এদিকে রোদকে এমন ভয় পেতে দেখে বেশ হাসি পেল নেহালের। রোদকে ভয় দেখানোর জন্যই তখন কথাটা বলেছিল ও। পরিচয় পর্ব শেষে আরো কিছুক্ষন ক্লাস নিয়ে চলে গেল নেহাল। আর এদিকে রোদ ভাবল নেহালকে ছুটির পর সরি বলে দেবে ও।

অন্যদিকে গতকাল রোদের সাথে রাত জেগে মুভি দেখে আজ সারাদিন ঘুমিয়েই কাটিয়েছে সন্ধ্যা। ঘুম থেকে উঠেছে বিকেলবেলা। তখনো উঠতো না যদি না রোদ এসে ওকে ডাকত তো। বেচারী রোদ বিকেলে কলেজ থেকে ফিরেই সন্ধ্যাকে সারাদিনের কথা বলেই যাচ্ছে ও। আবার মাঝে মাঝেই রাগে অপমানে কান্না করে ফেলছে । বিশেষ করে বিকেলে নেহালের করা অপমান মানতে পারছে না ও। সন্ধ্যা রোদকে শান্ত করে আশস্ত করল যে ঐ নতুন স্যার রোদের কিছুই করতে পারবে না। সন্ধ্যার কথায় আশ্বস্ত হয়ে রোদ ফ্রেশ হতে গেল আর সন্ধ্যাও উঠে পড়ল। আপাতত ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়বে ও তারপর বাদ বাকি কাজ।

রোদের সাথে আড্ডা দিতে দিতেই সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো।চারিদিকের আলোকে ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিতে লাগল রাতের নিরবচ্ছিন্ন অন্ধকার। চারিদিক ঢেকে গেল নিকষ কালো অন্ধকারে। থাই গ্লাসের পাশে দাঁড়িয়ে দূরের অন্ধকারের দিকেই তাকিয়ে ছিল সন্ধ্যা। আজ তেমন কিছু ভালো লাগছে না ওর। অজানা এক আতঙ্ক ভর করেছে সন্ধ্যার মনে।অসহ্য লাগছে সব কিছু ওর। এভাবে কেটে গেছে বেশ কিছু সময়। রোদের ডাকে হঠাৎ ঘোর কাটল সন্ধ্যার।

–“আপু ভাইয়া তোমাকে পড়ার জন্য ডাকছে।”

রোদের কথা শুনে এতক্ষণে শ্রাবণের কাছে পড়ার কথা মনে পড়ল ওর। গতকাল শ্রাবণের দেওয়া পড়াগুলো এখন অব্দি পড়া হয়নি ওর। পড়বে কিভাবে সারাদিন তো গেল ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই। ভয় দু-ঢোক গেলে রোদ কে বলল,

–“আজ তো আমি কিছুই পড়িনি।কি হবে আজ আমার?”

সন্ধ্যার কথা শুনে রোদ নিজেও ভয় পেয়ে গেল ও। ওর ভাই আর যাই হোক পড়ার ক্ষেত্রে কাউকে ছাড় দেয় না তবুও সন্ধ্যাকে আশ্বস্ত দিয়ে বলল,

–“আরে কিছুই হবে না। তুমি স্টাডি রুমে যাও তো।”

সন্ধ্যা আর কিছু না বলে বই হাতে নিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে চলল স্টাডি রুম এর দিকে। কপালে যে আজ ওর শনি আছে তা বেশ বুঝতে পারছে ও। স্টাডি রুমের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো সন্ধ্যা। তারপর নির্দিষ্ট চেয়ারে গিয়ে বসে পড়ল। প্রায় বেশ কিছুক্ষণ পর শ্রাবণ আসলো স্টাডি রুমে। সন্ধ্যাকে বসে থাকতে দেখে বলে উঠলো,

–“সরি আজ একটু দেরি হয়ে গেল। আসলে অফিস থেকে এসে ফ্রেশ হলাম তো এজন্য একটু দেরি হয়ে গেল।”

–“না না ঠিক আছে। আপনি যে এত ব্যস্ততার মাঝে আমাকে পড়াচ্ছেন এটাই তো অনেক।”

–“থাক থাক তোমাকে আর ভারী ভারী কথা বলতে হবে না তুমি বরং তোমার বই বের করো।”

শ্রাবণ সন্ধ্যাকে পড়া ধরলে একটার ও উওর দিতে পারল না ও। সন্ধ্যা পড়া না পারায় রেগে গেলে শ্রাবন। সন্ধ্যাকে শাস্তি স্বরূপ মার দেওয়ার পরেও দশ বার কান ধরে উঠবস করতে বলেছে ওকে। শুধু কান ধরে উঠবস করে ক্ষান্ত হয়নি শ্রাবণ সন্ধ্যাকে আরো বলেছে ,

–“যতক্ষণ অব্দি না ওর পড়া হবে ততক্ষণ অব্দি সন্ধ্যা নিজের ঘরে যেতে পারবেনা। এখানে বসেই সন্ধ্যাকে ওর পড়া কমপ্লিট করে শ্রাবণকে দিতে হবে।নাহলে আজ না ও খেতে পারবে আর না ঘুমতে পারবে সন্ধ্যা।”

চলবে

(কেমন হয়েছে জানাবেন আর ভুলত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।আজ কিন্তু গল্প বেশ বড় করেই দিয়েছি।গল্পে কেমন যেন সাড়া কম পাচ্ছি। আপনাদের সাড়া না পেলে লেখার আগ্রহ কমে যায়। তাই নিরব পাঠকরা দয়া করে সাড়া দিবেন।গল্প নিয়ে আপনাদের কোন অভিযোগ বা মন্তব্য থাকলে কমেন্টে জানাতে পারেন।ভালো থাকবেন সবাই।হ্যাপি রিডিং ??)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here