শ্রাবনসন্ধ্যা পর্ব:-১০

0
2319

শ্রাবনসন্ধ্যা পর্ব:-১০
#আমিনা আফরোজ

শ্রাবণ ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে ওর মা ওর জন্য খাবার নিয়ে বসে আছে। শ্রাবণ মুচকি হেসে ওর মায়ের সামনে এগিয়ে গেল। শ্রাবনকে হাসতে দেখে রাবেয়া বেগম বললেন,

–“কিরে তুই এভাবে হাসছিস কেন?”

–“এমনিতেই।”

–“চুপ করে বসতো আমি তোকে খাইয়ে দিই।”

শ্রাবণ ওর মায়ের কথা মতো চুপটি করে বসে রইল। রাবেয়া বেগম ছেলেকে পরম আদরে খাইয়ে দিলেন। খাওয়া শেষে রাবেয়া বেগম যখন বিছানা থেকে উঠতে নিলেন তখন শ্রাবণ বলে উঠলো,

–“আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে মা? কতদিন হল তুমি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দাও না।”

রাবিয়া বেগম ছেলের এমন আকুতি ভরা কণ্ঠ শুনে ছেলের শিউরে বসে পড়লেন তিনি। শ্রাবণ মাকে বসে দেখেই মায়ের কোলে মাথা রাখল। আর রাবেয়া বেগম রাবণের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। মায়ের হাতের পরশ পেয়ে শ্রাবনের দুচোখে যেন শান্তির নীড় নেমে আসলো। শ্রাবণ চোখ বন্ধ করে পরম শান্তিতে চলে গেল গভীর ঘুমের রাজ্যে।এদিকে রাবেয়া বেগম চুলে বিলি কাটতে কাটতে শ্রাবণের পাশেই খাটের সাথে হেলান দিয়ে নিজের অজান্তেই পাড়ি জমালেন ঘুমের রাজ্যে।

এদিকে রশিদ সাহেব থেকে খুঁজতে এসে মা-ছেলের এমন দৃশ্য দেখে ওনার চোখে পানি এসে গেল। তাই ওদের আর বিরক্ত না করে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন।

ভোরে আজানের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল রাবেয়া বেগমের। ঘুম ভাঙলে বুঝতে পারলেন তিনি ছেলের শিউরের কাছে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। সারারাত বৃষ্টির ফলে শেষ রাতের দিকে একটু ঠান্ডা পড়েছে। রাবেয়া বেগম ছেলেকে নামাজের জন্য ডাক দিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন।

শ্রাবণের ঘরের বিপরীত দিকেই সন্ধ্যার রুম। তার পাশের রুমটা রোদের জন্য বরাদ্দ। তবে এখন অবশ্য রোদ সন্ধ্যার সাথেই ঘুমায়। রাবেয়া বেগম যাওয়ার সময় দেখলেন সন্ধ্যার ঘরে বাতি জালানো। তিনি এগিয়ে গেলেন সেদিকে।ভাবলেন হয়তো সন্ধ্যার কোন অসুবিধা হয়েছে।দরজা আলতো করে ফাঁক করে ঘরের ভিতরে মুখ ঢুকালেন তিনি। ঘরের ভিতরের দৃশ্য দেখে মিসেস রাবেয়া বেগম অবাক হয়ে গেলেন। তিনি দেখলেন সন্ধ্যা সাদা রঙের ওড়না দু-প্যাচ দিয়ে মাথায় বেঁধে জায়নামাজে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ছে। সাথে অবশ্য রোদ কেও দেখতে পেলেন তিনি। রোদকে নামাজ পড়তে দেখে বেশ অবাক হলেন রাবেয়া বেগম। দ্রুত দরজা লাগিয়ে দিয়ে স্বামীর কাছে চলে গেলেন তিনি।

এদিকে সন্ধ্যা নামাজ পড়ে উঠে কুরআন হাতে নিল আর রোদ বিছানায় শুয়ে আবারো ঘুমিয়ে পড়ল। প্রায় বেশ কিছুক্ষণ কোরআন তেলাওয়াত করলো সন্ধ্যা। কোরআন তেলাওয়াত করা ওর প্রতিদিনের অভ্যাস। কুরআন পড়া শেষ করে কুরআন বন্ধ করে তুলে রেখে বারান্দার গিয়ে দাঁড়ালো ও।

ততক্ষণে রাতের আঁধার কেটে দিনের আলো ফুটতে শুরু করেছে। ঝিরঝির বৃষ্টি আর মৃদু-মন্দ বাতাসও বইছে তখন। তবুও সন্ধ্যা ঠাই গ্রিলের পাশে দাঁড়িয়ে বৃষ্টির পানে তাকিয়ে আছে। আজ খুব বাড়ির কথা মনে পড়ছে ওর। সেদিনের পর থেকে বাড়ির আর কোন খবর জানেনা ও। সন্ধ্যা এখন ভাবছে নেহালকে বিয়ে করে নিলেই বোধহয় ভালো হতো তাহলেই এতো ঝামেলা হতো না আজ।

এদিকে গ্রামে আশরাফ সাহেবের পরিবারের তখন করুণ অবস্থা। গ্রামের চেয়ারম্যান সামাদ মিয়া সেদিনের পর থেকে সন্ধ্যাদের পরিবারকে একঘরে করে দিয়েছে। নেহাল অবশ্য ওর বাবাকে বাধা দিয়েছিল কিন্তু সামাদ মিয়া নেহালের কোন কথাই শুনেন নি। গ্রামের কেউ আর আশরাফ সাহেবের বাড়ির দিকে ফিরেও তাকায় না। এতে অবশ্য আসরাফ সাহেবের কোনো জায় আসে না। তিনি তার মেয়েকে সুরক্ষিত জায়গায় পাঠাতে পেরেছেন এতেই সন্তুষ্ট তিনি। আশরাফ সাহেব যখন এসব কথা ভাবছিল ঠিক তখনই নেহাল ওর কিছু ছেলে মেয়ে আশরাফ সাহেবের বাড়ীতে প্রবেশ করল। আশরাফ সাহেব নেহালকে দেখে এগিয়ে গিয়ে বলে উঠলেন,

–“তুমি এখানে কেন এসেছো?”

নেহাল আশরাফ সাহেবের কথা শুনে মৃদু হেসে বলল,

–“আরে শ্বশুর মশাই এত রেগে যাচ্ছেন কেন? রাগলে তো আবার আপনার শরীর খারাপ করবে।”

–“তুমি আমাকে শ্বশুরমশাই বলে ডাকছো কেন?”

নিহাল এবার সন্ধ্যার মায়ের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,

–“শাশুড়ি মা আপনিই বলুন তো শ্বশুর মশাইকে শ্বশুর মশাই বলে ডাকবো নাতো কি বলে ডাকবো?”

–“এসব ফালতু কথা বন্ধ করে বল তুমি কি চাও?”

–“আমি যা চাই তা তো আপনিই দিতে চাচ্ছেন না শ্বশুর মশাই।”

–“এসব হেয়ালির মানে কি?”

নেহাল মুচকি হেসে বলল,

–“একটু পরেই বুঝতে পারবেন শ্বশুরমশাই।”

নেহাল এগিয়ে গিয়ে জারার সামনে দাঁড়ালো তারপর বললো,

–“আমাকে মাফ করো জারা এছাড়া আর কোনো পথ নেই আমার।”

এই কথা বলে নেহাল জারার হাত ধরে আশরাফ সাহেবের সামনে গিয়ে বলল,

–“শ্বশুর মশাই আপনার জন্য একটা দুঃসংবাদ আছে।”

আশরাফ সাহেব নিহালের কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলেন,

–“মানে? কিসের দুঃসংবাদ?”

নেহাল মুচকি হেসে বলল,

–“যতদিন অব্দি আপনি আপনার বড় মেয়ের ঠিকানা আমাকে না দেবেন ততদিন অব্দি আপনার ছোট মেয়ে আমার কাছে থাকবে।”

আশরাফ সাহেব নেহালের কথা শুনে রেগে বললেন,

–“এসবের মানে কি? মগের মুল্লুক পেয়েছ নাকি?”

–“মগের মুল্লুক কিনা জানি না তবে এটাই হবে। এখন আপনার ছোট মেয়ের ভবিষ্যৎ সম্পন্ন আপনার হাতে।”

–” দেখ তুমি কিন্তু ভুল করছ?”

–“ঠিক ভুল কিছু বুঝিনা আমি । আমি শুধু সন্ধ্যার ঠিকানা চাই।”

–“আমি জানিনা সন্ধ্যা কোথায় আছে?”

–“বুঝেছি আপনি আসলে চাচ্ছেন যে আপনার ছোট মেয়ের কোন ক্ষতি হোক তাই তো? ঠিক আছে আপনার যা ইচ্ছে।”

নেহাল কথাটি বলেই জারার হাত ধরে চলে যেতে নিলে সন্ধ্যার মা পিছন থেকে চিৎকার করে বলে,

–“দাঁড়াও আমার মেয়েকে কথা নিয়ে যাচ্ছ তুমি?”

নেহাল পিছন ফিরে তাকিয়ে বলে,

–“আপাতত আমার বাগান বাড়িতে। তারপর দেখি কি করা যায়।”

–“না, তুমি দয়া করে আমার মেয়ের এত বড় ক্ষতি
কইরো না।”

–“আমার কি দোষ বলুন তো শাশুড়ি মা? শ্বশুর মশাই তো আমার কথা শুনছেনই না।”

–” ওগো তুমি ওকে ঠিকানা দিয়ে দাও।”

–“তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি?”

–“দেখো আমি এত কিছু বুঝিনা। আমি আমার মেয়ের কোন ক্ষতি হতে দিব না।”

নেহাল হেসে বলল,

–“শ্বশুরমশাই বলে দিন তো। এত ঝামেলা আর কিন্তু ভালো লাগছে না আমার।”

শেষ পর্যন্ত স্ত্রীর আকুতি-মিনতি জন্য ছোট মেয়ের জীবন বাঁচাতে বড় মেয়ের জীবন সংকটের মধ্যে ফেললেন আশরাফ সাহেব। নেহালের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন,

–“সন্ধ্যা ঢাকায় আছে। তবে ঢাকার কোথায় আছে তা জানি না আমি। তুমি তোমার ঠিকানা পেয়ে গেছো , এবার আমার মেয়েকে ফিরিয়ে দাও।”

নেহাল বাঁকা হেসে বলল,

–“ঠিকানাটা আগে দিলে আর এতকিছু করতে হত না আমায়। সে যাই হোক শ্বশুরমশাই আমাকে দোয়া করবেন আমি যেন আপনার মেয়ে সমেত ফিরে আসতে পারি।”

এই কথা বলে নেহাল ওর দলবল নিয়ে চলে গেল। নেহারা চলে যাওয়ার পর আশরাফ সাহেব ওনার স্ত্রী আনোয়ারা বেগমের দিকে তাকিয়ে বললেন,

–“সন্ধ্যা আমাদের মেয়ে না বইলাই তো তুমি এমনডা করলা তাই না? আপন মেয়ে হলে এমনডা করতে পারতা তুমি?”

আনোয়ারা বেগম স্বামীর কথা শুনে অবাক হয়ে বললেন,

–“এমন কথা কইতে পারলা তুমি? তুমি তো জানো আমি সন্ধ্যারে কতটা ভালোবাসি। ছোটবেলা থাইকা এই হাতে সন্ধ্যাকে মানুষ করেছি আমি। সন্ধ্যা আমার মেয়ে।”

–“তাহলে এমন কেন করলা তুমি?”

–“দেখো আজ যদি আমি তোমাকে জোর না করতাম তাইলে নেহাল জারার ক্ষতি করত।আর তাছাড়া ঢাকা শহরের মতো এত বড় শহরে নেহাল সন্ধ্যারে কিছুতেই খুজে পাইবো না। তুমি বরং তোমার বন্ধুরে ফোন দিয়ে সতর্ক করে দিও।”

–“এইডা তুমি ভালো বুদ্ধি দিছো। তবে এহন কিছু করন যাইবো না, নেহাল বুঝতে পারব। যা করণ রাতে করতে হইবো।”

–“হুম। চলো ঘরে চলো।”

এদিকে নেহাল বাড়ি এসে সোজা ওর বাবা সামাদ মিয়ার ঘরে চলে গেল। সামাদ মিয়ার তখন চেয়ারে বসে ওনার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলছিলেন। ছেলেকে ঘরে ঢুকতে দেখে অবাক হয়ে গেলেন তিনি। সে রাতের পর থেকে নেহাল ওর বাবার ঘরে আসো তো দূরের কথা ওর বাবার সাথেও কথা বলত না। সারা দিন-রাত শুধু নেশা করে পড়ে থাকতো। আজ হঠাৎ ছেলেকে এই ঘরে দেখে ভ্রু কুচকিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকালেন তিনি।

নেহাল ওর বাবাকে বললো,

–“বাবা আমি আজ ঢাকা যাব। আপাতত ঢাকাতেই থাকব কিছুদিন। পড়াশোনা তো শেষ করেছি এখন একটা চাকরি বাকরি করতে হবে।”

ছেলের কথা শুনে সামাজ মে অবাক হয়ে বললেন,

–“এসব আপনি কি কইতাছেন আব্বা?”

–“আমি যা বলছি ভেবে-চিন্তেই বলেছি বাবা। দয়া করে আমাকে আর আটকাবেন না।”

–“কিন্তু……..

–“কোন কিন্তু নয় আমি ঢাকা যাব এটাই শেষ কথা।”

তুই কথা বলে নেহাল ঘর থেকে বের হয়ে চলে গেল। সামাদ মিয়া ও তার স্ত্রী অসহায়ের মত চুপ করে বসে রইলেন। ছেলের রাগ আর জেদ সম্পর্কে অবগত তারা। এখন সবটা সময়ের হাতে ছেড়ে দেওয়া ছাড়া আর কিছু করার নেই।

দুপুরের পর নেহাল হাতে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়ল স্টেশনের উদ্দেশ্যে। টিকিট কেটে বসে রইল প্ল্যাটফর্মে। ট্রেন আসতে একটু লেট হবে। নেহাল প্লাটফর্মে বসে হাতে থাকা টিকিটের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে মনে মনে বলল,

–“আর কিছুদিন নিজের মতো চলো শ্যামলতা। কারণ আমি আসছি তোমার জীবনে ঝড় হয়ে। একবার তোমাকে খুজে পাই তারপর দেখো তোমাকে কি করি আমি। আমাকে ছেড়ে যাওয়ার শাস্তি তো তোমাকে পেতেই হবে। তোমার সাইকো দিওয়ানা আসছে তোমার কাছে। তৈরি থেকো তুমি।”

কথাগুলো বলার বেশ কিছুক্ষণ পর ট্রেন এসে থামল স্টেশনে। নেহাল ওর ব্যাগ হাতে করে উঠে পড়ল স্টেশনে। আজকের আকাশে ঘন কালো মেঘে ঢাকা। ভাগ্যের লিখনে নেহালও পাড়ি জমাচ্ছে অজানা গন্তব্যের পথে।

(কেমন হয়েছে জানাবেন আর ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। দেখা যাক সন্ধ্যার জীবনের নেহাল আবার কি করতে চলেছে? আমার পরীক্ষা শুরু হওয়ার কারণে “শ্রাবনসন্ধ্যা “গল্পের পরবর্তী পর্ব 12 তারিখে পাবেন। ভাল থাকবেন সবাই। হ্যাপি রিডিং ??)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here