শ্যামাঙ্গণা-১৯

0
369

শ্যামাঙ্গণা-১৯
————-

ঘুমের ঘোরে ঝুমুরের মনে হলো পরিচিত কোনো সুগন্ধি পাচ্ছে। কিন্তু কার সুগন্ধি এটা ?মনে হচ্ছে এই সুগন্ধি ঝুমুরের চেনা অথচ মনে করতে পারছে না। কৌতূহল চেপে ঝুমুর ভাবলো এটা তার ভুল কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো এই সুগন্ধি তো সে ব্যবহার করেনা তাহলে তার ভুল কি করে হবে। সে শুধু হাতে তৈরি ন্যাচারাল লেমন ফ্রেগ্র্যান্স ব্যবহার করে। তাই বাধ্য হয়েই চোখ জোড়া খুলে ফেললো ঝুমুর।

চোখ জোড়া খুলতেই প্রথমে অন্ধকারে তার থেকে খানিকটা দূরে বসে থাকা অবয়বকে অস্পষ্ট দেখলো ঝুমুর। কিছুক্ষণ পর অন্ধকার চোখে সয়ে আসতেই ঝুমুর ভালো করে চোখ মেললো। সামনে বসে থাকা অবয়বকে দেখে ঝুমুরের চোখ দুটো আপনিতেই বড় হয়ে গেলো। মনে হচ্ছে যে তার সামনে বসে আছে সে তার ডাক্তার সাহেব। তার বহু আকাঙ্ক্ষিত মানুষটা।

ঝুমুর চট জলদি বিছানার পাশে টেবিলে থাকা বাতি জ্বালালো। মৃদু আলোয় ঠোঁটের কোণে হাসি টেনে রাখা ফাহমানকে আবছা দেখা যাচ্ছে। স্তব্ধ ঝুমুর এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ঝুমুরকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফাহমান বললো ‘ এভাবেই কি তাকিয়ে থাকবে নাকি কিছু বলবে ? ‘

হতবাক ঝুমুর বলল ‘ আপনি!! আপনি এখানে কেন ? কিভাবে এলেন ? কেউ দেখেনি ? কি ভাবলো সবাই ? ‘
‘ কি আর ভাববে ? বিয়ে করে বউ অজ্ঞান হয়ে গেছে তাই জ্ঞান ফেরাতেই এসেছি। এটাই ভাবছে ওরা। ‘
ফাহমানের কথায় হতবাক ঝুমুরের চোয়াল ঝুলে পড়লো। ও বড় বড় চোখে বললো ‘ আপনি কি মজা করছেন ? আর বিয়ে, বউ এসব কি ? কার বিয়ে ? কোন বিয়ে ? ‘

ঝুমুরের কথা শুনে ফাহমান অবাক হওয়ার ভান করে বললো ‘ একি তোমার মনে নেই ? একটু আগেই তো আমাদের বিয়ে হলো। বিয়ে না হলে আমি তোমার ঘরে ঢুকলাম কি করে ? তোমার মনে হয় তোমার উপর কোনো অধিকার অর্জন না করেই তোমার এতটা কাছে আসব ? ‘

ফাহমানের সঙ্গে তার বিয়ের কথা শুনে ঝুমুর যেন আকাশ থেকে পড়লো। তার ছোট মনে বজ্রাঘাত ঘটেছে। সে আর কথা বলার সাহস পেলো না। শুধু বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইলো ফাহমানের দিকে। ফাহমান ওর সেই দৃষ্টি দেখে বুকে হাত রেখে বলল ‘ এভাবে তাকিও না বউ। তোমার ঐ ডাগর ডাগর চোখের চাহনী দেখলে মনে হয় কলিজাটা কেউ ভিতর থেকে চেপে ধরেছে। ‘

‘ আমি আপনার বউ ? আমাদের বিয়ে হয়েছে ? কখন,কিভাবে ? আর বিয়ে হয়ে থাকলে আমার মনে নেই কেন ?’

ঝুমুরের প্রশ্নের জবাবে ফাহমান ধীরে ধীরে সব খুলে বলল তাদের বিয়ের ঘটনা। ফাহমানের কথা শুনে ঝুমুরের মনে পড়লো সে যখন দরজা চাপিয়ে শুয়ে পরেছিল তখনই তানিয়া শাহজাহান তার ঘরে আসেন এবং বলে যান ঝুমুরকে পাত্র পক্ষ দেখতে এসেছে এবং তারা বিয়ে পড়িয়ে যাবে। সেই কথা শুনে বিদ্ধস্ত ঝুমুর সেই যে রেগে গেলো তারপর ঘরের সবকিছু ছুঁড়ে ফেলে উলটপালট করে ফেললো।

ঝুমুরের বিদ্ধস্ত অবস্থা দেখে মনোয়ারা বেগম ঘাবড়ে গেলেও তানিয়া শাহজাহান সবটা শক্ত হাতে সামলালেন। পাত্র পক্ষ আসার পর ঝুমুরকে নিয়েও গেলেন। এত চেঁচামেচি, ছোড়াছুড়ি করার পর ঝুমুর তখন বেহুঁশ প্রায়। যার কারণে সে ঢুলতে ঢুলতেই এক প্রকার বাধ্য হয়ে কবুল বললো। বিয়ে শেষে তাকে যখন তার স্বামীর সঙ্গে ঘরে দেওয়া হলো তখন রাগে দুঃখেই সে তার নব বিবাহিত স্বামীর হাতে আঁচড়ের পর আঁচড় কাটলো। তাকে কামড়েও দিলো এবং সবশেষে আবার ঘুমের ঘোরে ঢুলে পড়লো।

এবার বুঝল ঝুমুর এই জন্যই তার জ্বরের ঘোরে ফাহমানের গায়ের সুগন্ধি চেনা চেনা লাগছিল। কারণ বিয়েটা তার ফাহমানের সঙ্গেই হয়েছে। রাগে,দুঃখে ঝুমুরের কান্না পেলো। এতকিছু হতে গেলো অথচ সে কিছু ধরতেই পারল না। তার যে বিয়েটা তার ভালোবাসার মানুষের সঙ্গেই হয়েছে সেটাও কেউ বললো না।

ঝুমুরকে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রাখতে দেখে ফাহমান হাত বাড়িয়ে ঝুমুরের গালে হাত রেখে ঝুমুরকে নিজের দিকে ফিরাতে চাইলো। কিন্তু অভিমানী ঝুমুর ফাহমানের হাতটা ঝটকা দিয়ে সরিয়ে দিলো। সঙ্গে সঙ্গে ব্যথায় মৃদু আর্তনাদ করে উঠলো ফাহমান। ঝুমুর ফাহমানের আর্তনাদ শোনা মাত্র ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ফাহমানের হাতটা নিজের কোলে রেখে খুঁটিয়ে দেখলো সে। তার নখের আঁচড় এবং দাতের কামড়ের চিহ্ন পড়ে গেছে।

ফাহমানের আর্তনাদের কারণ সে জানতে পেরে ঝুমুরের অপরাধ বোধ জেগে উঠলো। অভিমানী ঝুমুর নিমেষেই হারিয়ে গেলো আর হাজির হলো অপরাধী বেশে। ঝুমুর অপরাধী মুখে বললো ‘ ক্ষমা করবেন ডাক্তার সাহেব। আমি ভাবতে পারিনি আপনার এতটা লেগে যাবে। আমি যে সত্যি বলতে কখন এসব করেছি আমি সেটাই টের পাইনি। আমাকে ক্ষমা করবেন। ‘

শেষের কথাগুলো ঝুমুর হাত জড়ো করে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে বলল। ওকে ক্ষমা চাইতে দেখে ফাহমান ওর হাত টেনে ওকে নিজের কাছে টেনে নিল। ওর মাথাটা নিজের বুকে আগলে ধরে বললো ‘ ক্ষমা চেও না অঙ্গণা। তুমি এতদিন ঠিক কি পরিস্থিতিতে ছিলে আমি জানিনা কিন্তু খুব একটা সুখে যে ছিলে না সেটা তোমার চোখ মুখের হালই বলে দিচ্ছে। বিশ্বাস করো এই এক সপ্তাহ আমারও মৃত্যু সম কেটেছে। তোমাকে দেখতে না পারার ব্যর্থতায় প্রতি নিয়ত পুড়েছি।

কিন্তু আজ থেকে আর তোমাকে দেখার জন্য তড়পাতে হবে না। আজ থেকে আর আমাদের দেখা শুধু বাগানে কিংবা কলেজে যাওয়ার রাস্তায় হবে না। যখন ইচ্ছা করবে তখনই দেখা করতে পারবো। ‘

ফাহমানের কথা শুনে কান্নার মাঝেও ঝুমুর হেসে দিল। ফাহমানকে আরেকটু নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে তার বুকে মুখ গুজে রইলো। ফাহমান আদুরে ভঙ্গিতে ঝুমুরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু হঠাৎই কি মনে করে ঝুমুর ফাহমানের কাছ থেকে সরে গেলো। অবাক চোখে তাকিয়ে বললো ‘ আচ্ছা আমাদের বিয়েটা হলো কি করে ? আমি যতটুকু জানি ইমো তো আপনাকে আর আমাকে একসঙ্গে দেখে ফেলেছিল আর অনেক রেগে গিয়েছিল। তাহলে ? ‘

‘ কথা ঠিক। কিন্তু আমাদের বিয়েটা উনিই দিয়েছেন। আমাদের ব্যাপারটা উনি আমাদের প্রথম দিন দেখেই বুঝেছিলেন। আগে পরিকল্পনা অন্য ছিল কিন্তু তোমার এহেন দেবদাস রূপ দেখে দ্রুত বিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন। অবশ্য আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারটা উনি ছাড়া কেউ জানেন না। আমাদের বিয়ে নিয়ে এক সপ্তাহ ধরেই কথা হচ্ছে। কথাবার্তা শেষে এখন বিয়ে হলো। সবাই জানে আমাদের সম্বন্ধ করে বিয়ে হয়েছে। ‘

ঝুমুর হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছে না। এতকিছু ঘটে গেলো আর ও জানেই না। এক সপ্তাহ ধরে কথা চলে তাদের বিয়ের। অথচ সে আজ জানলো তাও আবার বিয়ের পরে। এই কি ছিল কপালে ? বিয়ে হয়ে গেলো আর সে জানতেই পারেনি। একটা প্রবাদ আছে বাংলায়। যার বিয়ে তার হুশ নেই, পাড়া পড়শীর ঘুম নেই। ঝুমুরের ক্ষেত্রেও এটাই ঘটেছে। তার অগোচরে এতকিছু হয়ে গেছে আর সে খবর পেলো বিয়ের পর।

‘ আমার অজান্তে এতকিছু হয়ে গেলো অথচ কেউ বললোই না আমাকে। এক সপ্তাহ ধরে বিয়ের কথা চলছে। আপনি তো অন্তত বলতে পারতেন এই কথাটা। ‘

ঝুমুরের অভিমানী গলা শুনে ফাহমান হকচকিয়ে গেল। দ্রুত ঝুমুরকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে মাথায় হাত রেখে বলল ‘ আঃ কি মুশকিল!! কাদছ কেন ? আরে বাবা ইমো চেয়েছিলেন তোমাকে চমকে দিবেন। তাই আমাকে বলতে নিষেধ করেছিলেন। তোমার খুশির জন্যই তো এতকিছু করলাম। আমার যে উপায় ছিল না। তোমার মুখে হাসি ফোটানোর জন্য আমি সব করতে পারি। ‘

ফাহমানের কথা শুনে ওকে গভীর আলিঙ্গন করলো ঝুমুর। দুজনের নিঃশ্বাস মিশে গেছে একসঙ্গে। একে অপরকে জড়িয়ে তখন মুহূর্তগুলো অনুভব করতে ব্যস্ত। এমন সময় ঝুমুরের ঘরের দরজায় শব্দ হলো। ঝুমুরকে ছেড়ে সরে দাড়ালো ফাহমান। ঝুমুর এগিয়ে গিয়ে দরজা খুললো। দরজার বাইরে নিঝুম দাড়িয়ে আছে।

‘ বিয়ে হতে না হতেই ঘরের দরজা দিয়ে বসে আছিস। অথচ আপি আর ইমোকে দেখ। তোর চিন্তায় পাগল ওরা। যা কেরামতি দেখালি আজ। অথচ এখন বর পেয়ে ওদের ভুলেই গেছিস। ‘

নিঝুমের কথায় অসস্তিতে পড়লো ঝুমুর। বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইলো। অন্যদিকে নিঝুমের কথা শুনে ফাহমান হুট করে হেসে দিয়েছে। হাসি আটকে রাখা তার জন্য দায় হয়েছে। সে এগিয়ে গিয়ে নিঝুমের সামনে দাড়িয়ে বললো ‘ তোমার বোন একটা জংলী বিড়াল বুঝলে। এই বিড়ালের সঙ্গে আমার সংসার করতে হবে ভাবলেই নিজের জন্য মায়া হয়। ‘

ফাহমানের কথায় নিঝুম হো হো করে হেসে দিয়েছে। ফাহমানও হাসছে কিন্তু ঝুমুর ওর দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছে। বোনের এহেন দৃষ্টি দেখে নিঝুম বললো ‘ মাথা ঠিক হয়ে থাকলে ঘর ছেড়ে বাইরে আয় বইনা। আপি আর ইমো রাতের খাবারের জন্য ডাকছে তোদের। মারিয়াম আন্টি আর হৈমন্তী আপু তোর সঙ্গে কথা বলার জন্য অপেক্ষা করছে। ‘

বোনের কথা শুনে ওড়না ঠিক করে তখনই বেরিয়ে গেলো ঝুমুর। কিন্তু বেরোনোর আগে ফাহমানের দিকে কটমট চাহনী ছুঁড়ে দিয়ে গেলো। ঘর থেকে বেরিয়ে বসার ঘরে গেলো ঝুমুর। ঝুমুরকে ঢুকতে দেখে মিস মারিয়াম ইশারায় কাছে ডাকলেন। ঝুমুর উনার ইশারায় এগিয়ে গেলো। ঝুমুরকে নিজের পাশে বসিয়ে মিস মারিয়াম ওর থুতনিতে হাত রেখে বললেন ‘ এখন কেমন লাগছে তোর শরীর ? জ্বর কমেছে তোর ? ‘

‘ এখন অনেকটা ভালো লাগছে মণি। আমাকে ক্ষমা করে দিও। আসলে জ্বর উঠেছিল তাই মাথা ঠিক ছিল না। ‘

হাতের কাজ সেরে মনোয়ারা বেগম বসার ঘরেই ঢুকলেন। ঝুমুরের সামনে বসে বললেন ‘ হয়েছে ? ঘুমিয়ে মাথা ঠিক হয়েছে ? বিয়ে যে হয়েছে মনে আছে তো ? ‘
মনোয়ারা বেগমের কথার জবাবে কিছু বললো না ঝুমুর। সত্যি বলতে সে অসস্তিতে পড়ে গেছে যে তার বিয়ে অথচ তারই মনে ছিল না। যদিও এখন মনে পড়েছে কিন্তু বিয়ের সময় কত কিছুই না করেছে। ফাহমানকে কামড়েছে পর্যন্ত। না জানি সে কি ভাবছে। ঝুমুর তাকে এখন মুখ দেখাবে কি করে ?

‘ মনে পড়ে থাকলে এখন চল। খাওয়া তো দরকার নাকি ? সেই বিকাল থেকে বিছানায় পড়ে আছে। পেটে কিছুই পড়েনি। ওইদিকে বোন মেরেছে এই দুঃখে আরেকজন সেই যে রুমে ঢুকেছে আর বের হয়নি। নতুন করে আরেক দুঃখ হয়েছে তার। বোন নাকি এবার তাকে ছেড়ে চলে যাবে। ‘

মনোয়ারা বেগমের কথায় ঝুমুরের এতক্ষণে মনে পড়লো আজ কলেজ থেকে ফেরার পর অত হাউকাউ দেখে তার ধৈর্য্য হয়নি। সেই সঙ্গে অনামিকা যখন আঞ্জুম আরার মুখে মুখে তর্ক করছিলো তখন তার মাথার রক্ত পায়ে উঠে গিয়েছিল। ঝুমুর বরাবরই কোমল স্বভাবের সেই সঙ্গে নম্র, ভদ্রও। কাজেই অনামিকার অভদ্রতা সহ্য করতে না পেরে চড় মেরে বসেছে।

এই প্রথম ভাই বোনদের উপর হাত তুলেছে ঝুমুর। ভাই বোনকে মারামারি তার পছন্দ নয় তাই কোনওদিন মারেনি। কিন্তু আজ অনামিকাকে মেরে অপরাধ বোধ তাকে কুড়ে করে খাচ্ছে। অপরাধ বোধে জর্জরিত ঝুমুর বললো ‘ আপনারা খেতে যান। আমি দেখছি অনা কি করছে। ‘

—-

ঘরের দরজা চাপিয়ে রেখে রুমে ঘাপটি মেরে বিছানায় বসে আছে অনামিকা। হাঁটুতে মুখ দিয়ে রেখেছে। তার ঘর জুড়ে অন্ধকার বিরাজ করছে। কোথাও এক রত্তি আলোও নেই। অন্ধকার ঘরে থাকতে তার বড্ড ভালো লাগে। বিশেষ করে সেটা যদি হয় মন খারাপের সময় তাহলে কথাই নেই। আজ অনামিকার মন অনেক খারাপ। এই প্রথম তার বড় আপি তাকে মেরেছে যেটা সে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি।

তানিয়া শাহজাহানের পর অনামিকা সবথেকে বেশি ঝুমুরকেই শ্রদ্ধা করে। ঝুমুরের মাকে অনামিকা কখনও স্বচক্ষে দেখেনি। সে জানে ঝুমুরের মা নেই। তাই সে চেষ্টা করে সবসময় ঝুমুরের সব কথা মেনে,ঝুমুরের ইচ্ছা মতো চলতে যাতে ঝুমুরের কখনও মনে না হয় তার মা নেই বলে কেউ তার মূল্য বুঝে না। তাছাড়া অনামিকা এমনিতেও ঝুমুরকে অনেক বেশি ভালোবাসে। ওর এই ভালোবাসার প্রতিদান ঝুমুরও খুব ভালোভাবেই দেয়। সবসময় আগলে রাখে।

অথচ আজ কি হলো ? হুট করেই বাইরে থেকে এসে ঝুমুর ওকে চড় মেরে বসলো। হ্যাঁ ওর দোষ ছিল সেটা ও জানে। ও এটাও জানে ঝুমুর বড়দের সঙ্গে বেয়াদবি, অসভ্যতামি পছন্দ করেনা। তাই বলে ঝুমুর ওকে মারবে এটা ও আশা করেনি। ঝুমুর ওকে বোঝাতে পারতো কিন্তু সে সরাসরি আঘাত করেছে ওকে। এই ব্যাপারটা ওর যেন এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। তার উপরে হুট করেই ঝুমুরের বিয়েও হয়ে গেলো। অনামিকা তো আর সুযোগই পেলো না ঝুমুরের সঙ্গে কথা বলার।

এখন তো ঝুমুরকে তার শশুর বাড়ি পাঠিয়ে দিবে। অনামিকা জানে বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর মেয়েরা শশুর বাড়ি চলে যায়। এমনটাই হয়েছে অনামিকার চাচাতো বোন রিমির বিয়ের সময়। রিমিও বিয়ের পর শশুর বাড়ি চলে গেছে। যদিও রিমির বিয়ে তার ফুপাতো ভাই মানে অনামিকাদের ফুপাতো ভাইয়ের সঙ্গেই হয়েছে কিন্তু তবুও তো গেছে সে শশুর বাড়ি। এখন নিশ্চই ঝুমুরও চলে যাবে। অনামিকা আর কথা বলার সুযোগই পাবে না। ঝুমুরকে তার আর সরি বলাই হবে না।

‘ অনা ‘

অনামিকা তখন কাদতে ব্যস্ত ছিল কিন্তু ঝুমুরের গলা পেয়ে নড়েচড়ে বসলো। মুখ তুলে দেখলো অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছে না। অনামিকা টেবিল হাতড়ে টেবিল লাইট জ্বালালো। সঙ্গে সঙ্গে ঝুমুরের শ্যামা মুখশ্রী দৃশ্যমান হলো। ঝুমুরকে দেখা মাত্র অনামিকার কান্না আরও বেড়ে গেলো। ও এবার হু হু করে কাদছে।

অনামিকাকে কাদতে দেখে ঝুমুর ওকে জড়িয়ে ধরলো। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো ‘ কাদিস না বোন। আমাকে ক্ষমা করে দে। আমি চাইনি তোকে মারতে। কিন্তু সত্যি বলতে মেজাজ এতই খারাপ ছিল যে মামীর সঙ্গে তোকে বেয়াদবি করতে দেখে সামলে রাখতে পারিনি নিজেকে। তুই তো জানিস আমি তোদের ভুলগুলো শাসন না করলে মামী সেগুলো মামাকে বলে দেয় আর ঘরে ঝামেলা হয়। তুই কি চাস এসবে আমি আবারও কথা শুনি ? ‘

ক্রন্দনরত অনামিকা মাথা নেড়ে বললো ‘ না বড় আপি। আমি চাই না। তুমি যখন মেরেছিলে তখন আমি সত্যি বলতে কিছুক্ষণ বুঝতেই পারিনি কি ঘটে গেছে। কিন্তু যখন বুঝলাম তখন দেখলাম সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সবার সামনে মেরেছিলে বলে আমার খারাপ লেগেছে। ‘

‘ ইচ্ছা করেই সবার সামনে মেরেছি যাতে কেউ প্রশ্ন তুলতে না পারে। তুই জানিস তো এরপর আমি কিছু না বললে মামী সেগুলো মামা আর তাফিমের কানে তুলবে। আমি চাই না আমার কোনো ভাই বোন আমাকে ভুল বুঝুক। তাই তোকে মেরেছি। ‘ ঝুমুর আক্ষেপের সুরে বলল।

‘ তুমি আর কষ্ট পেও না আপি। আমি কিছু মনে করিনি। আমি জানি তুমি আমার ভালোর জন্যই মেরেছ আমাকে। ‘ ঝুমুরের চোখের পানি দুই হাতে মুছে দিয়ে কথাটা বললো অনামিকা।

‘ তাহলে পুরনো কথা ভুলে যা আর এখন খেতে চল। সবাই তোর জন্য বসে আছে। ‘ বোনের চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো ঝুমুর।

‘ তুমি..তুমি কি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে আপি ? ‘

অনামিকার কথায় চমকে উঠলো ঝুমুর। অবাক গলায় বললো ‘ ওমা আমি তোকে ছেড়ে কোথায় যাবো আর কেনই বা যাবো ? ‘
উত্তরে অনামিকা বললো ‘ ফাহমান ভাইয়ার কাছে চলে যাবে। তোমার শশুর বাড়িতে যাবে তাইনা ? যেমনটা রিমি আপু চলে গেছে ? ‘

অনামিকার কথায় ঝুমুর হাসলো। অনামিকার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো ‘ ধুর পাগলী এখনই যাবো কে বলেছে ? আমি যেতে আরও দেরি আছে। হ্যাঁ তোর ফাহমান ভাইয়ের কাছে যাবো ঠিকই কিন্তু দেরি আছে। তাছাড়া বিয়ে করলে শশুর বাড়ি তো যেতেই হবে। তবে আমার যেতে দেরি আছে। এখন এত কথা না বলে চল। সবাই তোর জন্য অপেক্ষা করছে। ‘

ঝুমুরের কথা মেনে অনামিকা ওর চোখের পানিগুলো মুছে বিছানা ছাড়লো। ঝুমুর টেবিল লাইট নিভিয়ে দিয়ে অনামিকাকে নিয়ে ঘর ছেড়ে বের হলো। দুজন এগিয়ে যাচ্ছে খাবার ঘরের দিকে। খাবার ঘর থেকে কথাবার্তার শব্দ আসছে। সবাই নিশ্চই কথা বলতে ব্যস্ত।

চলবে…
মিফতা তিমু

( সকলের মন্তব্য আশা করছি। )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here