শ্যামাঙ্গণা-২০

0
393

শ্যামাঙ্গণা-২০
————-

জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছে শাওমি। বাহিরে মুশল ধারে বৃষ্টি হচ্ছে। জানালা খোলা থাকায় বড় বড় বৃষ্টির ছেটা শাওমির গায়ে পরছে। বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে পড়তেই মনে হচ্ছে শরীর জুড়ে ঠান্ডা হাওয়া হুটোপুটি খেলছে। শাওমি চোখ বন্ধ করে আছে। প্রকৃতির শীতলতা অনুভব করছে সে। হয়তো ঋতু পরিবর্তন হবে বলেই বৃষ্টির আগমন।

আজ ঝুমুরের বিয়েটা হয়েই গেছে তার স্বপ্ন পুরুষের সঙ্গে। ভালোবাসার মানুষটার উপর এখন অন্য কারোর সিল মোহর জানার পর শাওমির খুশি হওয়ার কথা নয় তবে তবুও সে খুশি। অন্তত ছোটবেলার সখীর খুশির কারণ তো হতে পেরেছে। শাওমি ছিনিয়ে নেওয়াতে নয় ফিরিয়ে দেওয়াতে বিশ্বাসী। ফাহমান ও ঝুমুরকে একসঙ্গে দেখলে তার হৃদয় যেমন অসহনশীল যন্ত্রণায় কাতরায় তেমনই প্রিয় সখীর সুখের কথা ভেবে সুখ সুখ অনুভূতিও হয়।

নারী জাতি সহজাতবশত হিংসুটে প্রকৃতির। নিজেদের জিনিস তারা কখনও বিলিয়ে দিতে চায় না। দরকার পড়ে সেচ্ছায় মৃত্যু গ্রহণ করবে কিন্তু স্বামী কিংবা ভালোবাসার মানুষটাকে কখনো ভাগ করবে না। এমনই তারা। কিন্তু শাওমি অন্যরকম। সে কোনোদিনই যা তার নয় তা নিজের করার চেষ্টা করেনি। বরং যেটা যার তাকেই ফিরিয়ে দিয়েছে।

আজ শাওমির মন উচাটন। নিজের জন্য খারাপও লাগছে আবার সখীর জন্য ভালোও লাগছে। আপাতত নিজের কষ্টের কথা সাইডে সরিয়ে রাখলে সে নিজের একমাত্র সখীর জন্য খুবই খুশি। তার খুশির কোনো অন্তত নেই। সে তো জানে ঝুমুর ফাহমানকে কত ভালবাসে। কাজেই ঝুমুরের জন্য সে বেজায় খুশি।

—-

খাওয়া দাওয়া শেষে রান্নাঘরে বাসন কোসন গ্লাভস হাতে ধুচ্ছে ঝুমুর। সবার খাওয়া ইতিমধ্যে শেষ। মনোয়ারা বেগম মিস মারিয়ামের সঙ্গে বসার ঘরে কথা বলছেন। শাওমি রান্নাঘরে ঝুমুরকে সাহায্য করছে। খাবার ঘর থেকে একে একে সব প্লেট, বাটি এনে দিয়েছে সে। সেই সঙ্গে ঝুমুর যা ধুচ্ছে সেগুলো পানি ঝরতে দিচ্ছে। ঝুমুর থালা বাসন ধুতে ধুতেই খেয়াল করলো মিস মারিয়ামের গলা পাওয়া যাচ্ছে। উনি বলছেন এখন উঠবেন।

ঝুমুর সঙ্গে সঙ্গে গ্লাভস পড়া সাবান ভরা হাতে এগিয়ে গেলো। মিস মারিয়াম বেরিয়ে যাওয়ার জন্য রান্নাঘরের কাছে এসেই দাড়িয়েছিলেন। তিনি ঝুমুরকে দেখা মাত্র এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলেন। ঝুমুরের হাতে থাকা গ্লাভস সাবান ভরা হলেও সে তার কব্জি মিস মারিয়ামের পিঠে রেখে বললো ‘ কাল দেখা হবে মণি। আমি বিকেলে যাবো তিন তলায়। তারপর দুজন মিলে ক্রইসান্ট বানাবো। তুমি আমাকে শিখিয়ে দিও কিন্তু। ‘

ঝুমুরের কথা শুনে হাসলেন মিস মারিয়াম। ঝুমুরকে নিজের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ঝুমুরের ললাটে চুমু খেয়ে বললেন ‘ আচ্ছা, শিখাবো তোকে। ঠিক মতো পড়াশুনা করিস আর ভালো মতো পরীক্ষা দিবি। তোকে যে আমার বাড়ি নিয়ে যাওয়ার অনেক তাড়া। ‘

ঝুমুর উত্তরে কিছু বললো না। আড়চোখে আশেপাশে তাকাল কিন্তু যাকে খুঁজছে সেই নেই। হয়তো সে আগেভাগেই সিড়ি দিয়ে উঠে গেছে। ফাহমান বেরিয়ে গেছে ভাবতেই ঝুমুরের মন খারাপ হলো। মানুষটা এমন কেন ? যাওয়ার আগে একবার বলেও গেলো না। বলে গেলে কি এমন ক্ষতি হতো ? হঠাৎ হঠাৎ কেন যে এমন অদ্ভুত ব্যবহার করে কে জানে। যেন ঝুমুর তার পাকা ধানে মই দিয়েছে।

ঝুমুর মন খারাপ নিয়েই কাজগুলো শেষ করলো। কাজ শেষে রান্নাঘরের সবকিছু গুছিয়ে পরিষ্কার করলো এবং শাওমিকে ঘরে আসতে বলে নিজে এগিয়ে গেলো। শাওমি তখন ফোন দেখতে ব্যস্ত। সোফায় বসে সে। ঝুমুরের কথায় হা না কিছু উত্তর দিলো না কারণ সে জানে ঝুমুর নিজের রুমে ফিরে আর ওকে নিজের ঘরে চাইবে না। আজ আর ওই ঘরে শাওমির প্রয়োজন নেই।

—-

ওড়নায় হাত মুছতে মুছতে ঘরে ঢুকলো ঝুমুর। ঘর জুড়ে অন্ধকারেরা হুটোপুটি করছে। ঝুমুর সুইচ বোর্ডের গায়ে হাত চালিয়ে রুমের টিমটিমে হলুদ ছোট ছোট বাতিগুলো জ্বালিয়ে দিল। বাতি জ্বলে উঠতেই আবছা আলোতে ঝুমুর দেখলো তার ঘরের জানালার কাছে কেউ দাড়িয়ে আছে। অবয়ব তার লম্বাটে এবং আবছা আলোতে তমসায় ঘেরা। অবয়বের চেহারা দেখা না গেলেও ঝুমুর তার দৈহিক গড়ন দেখেই বুঝতে পারলো ওটা ফাহমান।

ফাহমানকে নিজের ঘরে আশা করেনি ঝুমুর। ভেবেছিল ও হয়তো সবার আগেই উপরে চলে গেছে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে সে উপরেই যায়নি উল্টো দরজা দিয়ে ওর ঘরেতেই বসেছিল। ঝুমুর ভাবলো ওর আর ফাহমানের একান্তে একটু সময় কাটানো দরকার। এই রাত নিয়ে তার কত স্বপ্ন ছিল। ফাহমানের সঙ্গে গল্প করবে, নিজের অনেক পুরনো স্মৃতি চারণ করবে।

এই রাত প্রত্যেকের জীবনে একবারই আসে অথচ ঝুমুর কিনা আজকের রাতটা বিবাহিত হয়েও স্বামীহীন কাটাতে হবে ভেবেছিল। তারমানে এই জন্যই শাওমি ঘরের বাইরে বসেছিল। নাহলে শাওমি বরাবরই ঝুমুরের ঘর ছাড়া আর কোনো ঘরে বসে না।
কিন্তু ফাহমানই বা কেন বৃষ্টির মধ্যে জানালা খুলে দাড়িয়ে আছে ? জানালা তো লাগানো দরকার নাহলে বৃষ্টির ফোঁটা ফাহমানের গায়ে পড়ে ঠান্ডা লাগবে।

‘ ডাক্তার সাহেব!! এভাবে যে জানালা খুলে দাড়িয়ে আছেন কোনো খবর আছে ? বৃষ্টি তো সব গায়েই পড়ছে। ঠান্ডা বেধে গেলে কি বিচ্ছিরি কান্ড হবে ভাবেন তো। দেখি সরেন, আমি জানালা লাগাচ্ছি। ‘

ফাহমান যখন জানালার ধারে দাঁড়িয়ে দাড়িয়েই বাইরের দৃশ্য দেখছিল তখনই পাশ থেকে ঝুমুরের গলা পেলো। ঝুমুরকে নিজের কাছে পেয়ে আর সামলে রাখতে পারল না। সহসা জড়িয়ে ধরলো ঝুমুরকে। এমন জড়িয়ে ধরাতে ঝুমুর চমকে উঠলো। তার ছোট্ট শরীর পিষে যাচ্ছে ফাহমানের পেশি বহুল বলিষ্ঠ শরীরে। ঝুমুরের দম ফেলতে কেমন কষ্ট হচ্ছে।

তবে শারীরিক কষ্টের থেকেও বিস্মিত ভাবটা প্রকট ঝুমুরের মধ্যে। ফাহমান হঠাৎ কেমন অদ্ভুত ভঙ্গিতে জড়িয়ে ধরেছে তাকে। ফাহমানের চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়া নোনা অশ্রু ঝুমুরের কাধের কাছটা ভিজিয়ে দিচ্ছে। ঝুমুর বুঝতে পড়ছে ফাহমান কাদঁছে। কিন্তু কেন ? ঝুমুর শুনেছিল ছেলেরা সহজে কাদে না। সে নিজেও প্রত্যক্ষ সাক্ষী এই ঘটনার। ওর অমনির মৃত্যুতে মোতালেব সাহেব কাদেননি, শুধু ঠায় বসেছিলেন।

‘ ডাক্তার সাহেব!! আপনি কি কাদছেন ? কিন্তু কেন ? কি হয়েছে ? আমাকে বলুন কি হয়েছে ? এমনও হতে পারে আমি আপনার সমস্যার সমাধান করে দিলাম। ‘

ফাহমানের পিঠে আলতো হাতে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে ঝুমুর। যদিও ফাহমান তাকে জড়িয়ে ধরে আছে ভাবতে লজ্জা লাগছে কিন্তু ফাহমানের কষ্টের কাছে সেই লজ্জা কিছু না। এখন ফাহমানের কষ্টের সময় সে তো আর লজ্জায় দোহাই দিয়ে দূরে সরে যেতে পারে না। কাজেই ও ফাহমানকে শান্ত করার সর্বাত্মক চেষ্টা করলো।

‘ কি হয়েছে ডাক্তার সাহেব ? কিছু বলবেন তো ? কেউ কি কিছু বলেছে ? কষ্ট হচ্ছে আপনার ? না বললে কি করে বুঝবো ? ‘

ঝুমুরের কথার জবাবে কিছুই বললো না ফাহমান। সে নিঃশব্দে কেঁদে যাচ্ছে। সত্যি বলতে এত আনন্দের দিন, তার জীবনের স্মরণীয় দিনে তার সুখের হাতছানি পেয়ে ভীষন আবেগী হয়ে পড়েছে সে। আনন্দের এই অশ্রু আর আটকে রাখতে পারেনি। শ্রাবণের বর্ষণ রুপে নেমে এসেছে তারা।

কাদতে কাদতে একসময় ফাহমান নিজেই ঝুমুরকে আগলে ধরে বললো ‘ এগুলো কষ্টের কান্না নয় অঙ্গণা। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর তোমাকে নিজের করতে পারার সুখের অশ্রু এগুলো। আজ আমার আনন্দের শেষ নেই। তোমাকে পেয়ে জগতের সবথেকে সুখী ব্যক্তি আমি। ‘

ফাহমানের কথা শুনে ঝুমুর বললো ‘ আপনি আমাদের বিয়ে হয়েছে বলে কাদছেন ? শুনে ছিলাম বিয়ের পরে বিদায়ের সময় মেয়েরা কাদে। কিন্তু আমার বিয়েতে তো দেখি সবই অদ্ভুত। আমার বিয়ে হয়ে যায় আমি জানতে পারিনা। আমার পিছন পিছন লাভ ম্যারেজকে অ্যারেঞ্জ ম্যারেজে রুপও দিয়ে ফেলে অথচ আমি জানি না। বিয়ের পরে আমার জায়গায় আমার বর কাদে। এসব হচ্ছে কি ? এভাবে কেউ কাদে ? জানেন আমি কত ভয় পেয়ে গেছিলাম ? ‘

ঝুমুরের কথায় ফাহমান এবার একটু দূরে সরে দাঁড়ালো। চোখ মুছে ঝুমুরের হাত দুটো নিজের হাতে তুলে নিয়ে বললো ‘ এসবের জন্য দায়ী আপনি মিসেস ফাহমান। আপনাকে পাওয়ার জন্য যে কত দীর্ঘ প্রতিক্ষা করেছি জানেন ? সাত দিন কোনো দেখা নেই, কথা নেই, চোখাচোখি নেই। আমিই জানি আমি কিভাবে ছিলাম। ‘

‘ বুঝেছি আপনি অনেক কষ্ট পেয়েছেন। এটা ঠিক আমাদের এক হতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। যদিও সব কষ্ট আপনি করেছেন কিন্তু আপনাকে না দেখে এতদিন থাকা আমার জন্যও কঠিন ছিল। কিন্তু আই হোপ আমাদের ভবিষ্যৎ জীবন এতটাই সুন্দর হবে যে পিছন ফিরে অতীতের কথা আর ভাবতে হবে না। ‘

ঝুমুরের মায়া ভরা নাক টানা হাসি দেখে ফাহমানের সুখ সুখ অনুভূতি হলো। ও লক্ষ্য করেছে ঝুমুর যখন হাসে তখন নাক টেনে টেনে নাকে শব্দ করে হাসে। আবার রেগে গেলেও নাক টেনে শব্দ করে তা প্রকাশ করে। ঝুমুরের এই নাক টানা হাসি শুনলেই আগে ফাহমানের মনে হতো এই হাসি যদি সে সারাজীবন পেত। অথচ এখন তার ইচ্ছা পূরণ হয়েছে।

ঝুমুরকে নিজের করে পাওয়া অনেক দিনের পুরনো ইচ্ছা ফাহমানের। আজ সেই ইচ্ছা পূরণ করতে পেরে সে যেন সাত আসমানে ভাসছে। ঝুমুরকে এখন থেকে রোজ দেখতে পারবে, ইচ্ছে করলে ছুঁয়েও দিতে পারবে ভাবলেই কেমন এক মিশ্র অনুভূতি হয়। যেমন এখনও হচ্ছে। ঝুমুরকে একবারের জন্য ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছা করছে। একেবারে নিজের করে নিতে ইচ্ছা করছে।

ফাহমান বরাবরই তার মনের ইচ্ছাকে সর্বাগ্রে প্রাধান্য দেয়। তাই এবারও তার নড়চড় হলো না। আলতো হাতে ঝুমুরকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরলো সে। ঝুমুরের লম্বা, পাতলা চুলের খোঁপা ছেড়ে দিল। চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মৃদু গলায় ধীর স্বরে বললো ‘ আই লাভ ইউ অঙ্গণা ‘

ফাহমানের এহেন হাবভাবে ঝুমুরের লজ্জায় পড়ি কি মরি অবস্থা। আগে কোনওদিন এমন কিছু হয়নি তার সঙ্গে। কোনওদিন কোনো ছেলের সংস্পর্শে আসার প্রয়োজন পড়েনি। অথচ আজ তার বিয়ে হয়েছে তার ভালোবাসার মানুষটার সঙ্গে এবং তাদের বাসর রাত। ঝুমুর জানে তার ডাক্তার সাহেব তাকে অনেক ভালোবাসে। সেও অনেক ভালোবাসে ফাহমানকে কিন্তু কোনওদিন প্রকাশ করার সুযোগ পায়নি। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে নিজের অনুভূতিগুলো মেলে ধরতে। যেমন আজ করছে তাই সেও ফাহমানকে জড়িয়ে ধরে বলল ‘ আই লাভ ইউ টু ডাক্তার সাহেব। ‘

ঝুমুরের কথা শুনে ফাহমান তাকে আরও নিবিড় ভাবে জড়িয়ে ধরলো। ঘর জুড়ে লেবু ফলের গন্ধ আর বাগানে ফুটে ওঠা শিউলি ফুলের কুঁড়ি নতুন এক জীবনের সংকেত। ফাহমান ভাসিয়ে নিয়েছে ঝুমুরকে তার আগ্রাসী ভালোবাসার দাপটে।

চলবে…
মিফতা তিমু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here