শুকতারা (দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ) পর্ব ১১

0
190

#শুকতারা (দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
#পর্ব-১১
#হালিমা রহমান

ঠিক আসরের সময় বাড়ি ফিরলেন মমিন শেখ।পায়ের ছন্দে অদ্ভুত এক চনমনে ভাব,মুখে দারুন অস্থিরতা।দু-হাতের হাড়-মাংসে বিরাজমান চরম কাঁপুনির সাথে মিলেমিশে একাকার অদ্ভুত ইতস্ততবোধ।চেনা-জানা মানুষের চোখে খট করে বাজে তার ভাব-ভঙ্গি।বাড়িতে এসে দু’বার টয়লেটে ছুটলেন।তারপরে ওযু করলেন, তারপরে কিছুক্ষণ চললো পায়চারি। সহসা হাঁটা থামিয়ে আবার পা চালালেন মাঝের ঘরের দিকে। খাটের তলা থেকে গোটা তিনেক ডাব বের করে বসার ঘরে কাটতে বসলেন।নির্জীব একটা ডাবের গায়ে ঘা দিয়ে দিয়ে পানি বের করে গ্লাসে ঢালার বদলে মেঝেতে ফেলে দিলেন।সবশেষে বিরক্ত হয়ে বাকি দুটো ডাব একে একে ছুঁড়ে মারলেন উঠোন তাক করে দুয়ারের বাইরে।লক্ষ্যভ্রষ্ট! উঠোনে না পড়ে ওগুলো উড়ে যেয়ে পড়লো মোরগঝুঁটি ফুলের গাছের উপরে।বাতাসহীন ভ্যাপসা গরমের দিনে হতচ্ছাড়া দুটো ঘেটে দিলো উপরের ডালের সুন্দর চারটে লাল ফুলকে।

” আপনের কী হইছে?”

প্রশ্ন করবে না করবে না ভেবেও শেষে করেই ফেললেন সাহিদা বেগম।কিছুক্ষণ ধরেই স্বামীর চলন-বলন চোখে লাগছিলো।সচরাচর মমিন শেখের এমন অস্থিরতা দেখা যায় না।আজ কী হলো?

” কী হইছে? কথা কন না ক্যান?”

বিরসমুখে জবাব দেন মমিন শেখ,
” কিছু না।”

” কিছু না হইলে এমন করতাছেন ক্যান?”

” এমনেই।”

“অসুখ হইছে?”

” না।”

” কিছু নিয়া টেনশন করতাছেন?”

” এতো প্রশ্ন করো ক্যান? আমার ঘরে আমি যেমনে ইচ্ছা ওমনে থাকুম।এতো গোয়েন্দাগিরি ক্যান করো?চোখের সামনে থেকা যাও তুমি।অসিভ্য মাইয়ালোক।”

হুট করেই অকারণে রেগে যাওয়া স্বামীর দিকে স্থির চোখে চেয়ে রইলেন সাহিদা বেগম।কয়েক সেকেন্ড পরে ঘর ছাড়ার আগে বিরবির করে বললেন, ” আমার ঠেকা পড়ে নাই আপনের লগে কথা কওয়ার।খালি দেখলাম অস্থিরতা করতাছেন,তাই জিগাইলাম।নইলে আপনের দিকে তাকাইতেও ইচ্ছা করে না।গা গিরগির করে।”

মাঝের ঘরের পথে অদৃশ্য হয়ে গেলেন সাহিদা বেগম।শূন্য ঘরে মাথা নিচু বসে রইলেন মমিন শেখ।আগের দিনগুলো হলে হয়তো স্ত্রীর এতোবড় কথায় চটে যেয়ে তার মুখ ভেঙে দিতেন।তবে আজ বিশেষ হেলদোল দেখা গেল না।আগের মতো রক্তে রাগ নেই,উত্তেজনা নেই,শরীরে শক্তি নেই।একটু উল্টো-পাল্টা কথা অথবা ভিন্নমতে টগবগিয়ে ফুটে না গায়ের রক্ত।এখন সবকিছুই চামড়ায় সয়।গায়ের চামড়া হয়ে গেছে গন্ডারের চামড়ার মতো মোটা।আগের মমিন শেখ আর আজকের মমিন শেখের মাঝে দিগন্তসম তফাৎ। সময় বদলায়,পরিস্থিতি বদলায়,মানুষ বদলায়।
সারা কপাল জুড়ে ফুটে ওঠা বিন্দু বিন্দু ঘামের কনাগুলোকে ডান হাতের উল্টোপিঠে মুছে ফেললেন মমিন শেখ।শরীরটা গরম গরম লাগছে। হয়তো জ্বর আসবে। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে অনেক সময় নিয়ে নামাজ পড়লেন।ধীরে-সুস্থে নামাজ শেষ করে লেপ্টে বসলেন মাটির মেঝেতে।গলা বাড়িয়ে বাঁশির মতো সরু কন্ঠে ডাকলেন স্ত্রীকে,

” সাহিদা,সাহিদা।”

সাহিদা বেগম যেন অপেক্ষাতেই ছিলেন।মমিন শেখের গলা মিইয়ে যাওয়ার আগেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন, “কী?”

” এইখানে আসো।”

” না।”

” আসো না।”

” না,আপনে আমারে মারবেন জানি।তহন ইচ্ছা কইরা কই নাই।মুখ দিয়া বাইরায়া গেছে।”

” মারুম না।”

সাহিদা বেগমের ভয় তবু কাটে না।স্বামীর হাত নাড়ার স্বভাবের সাথে পরিচিত বলেই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে পুরোনো পর্দার আড়ালে।

” আল্লাহর কসম মারুম না।এদিকে আইসা বসো।”

প্রতিজ্ঞার জোরে কাছে আসলেন সাহিদা বেগম।মোড়ায় বসার আগেই ওপাশ থেকে এলো স্বামীর ফরমায়েশ, ” দরজাটা লাগায়া বসো।”

দরজা আটকে দুই হাত দূরে বসলেন সাহিদা বেগম।মাটির দিকে চেয়ে ক্ষীণ গলায় প্রশ্ন করলেন, ” ডাকছেন ক্যান?”

” এমনেই।”

” কিছু কইবেন?”

” হ।খবর শুনছো? ভূমির একটা পোলা হইছে।”

” জানি,বিশ দিন হইছে বাচ্চার বয়স।”

” তুমি কি গেছিলা ওগো বাসায়?”

” না,রায়হানে কইছে।”

” নানি হিসাবে তোমার একটা দায়িত্ব আছে না? যাও নাই ক্যান?”

শীতল চোখে চেয়ে রইলেন সাহিদা বেগম।দৃষ্টির চেয়ে মাত্রাতিরিক্ত শীতল গলায় বললেন, ” আপনে জানেন না ক্যান যাই নাই? আপনে আমারে আস্তা রাখতেন গেলে?”

” তুমি এখনো আমারে এতো ভয় পাও ক্যান? আর কেউ তো পায় না।”

” আর কেউ তো আপনের সংসার করে না। যে মরে সে জানে। আমি মরছি তাই আমি জানি।”

কাট কাট উত্তর সাহিদা বেগমের। মমিন শেখের গৃহিণীর আজ বেজায় সাহস।দৃশ্যটা নতুন।আগে কখনো এরকম হয়নি।

মমিন শেখ চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ।কয়েক সেকেন্ডের নীরবতা ভেঙে বেশ নরম গলায় বললেন, “কালকের পর থেকা যায়ো।
কিছু কমু না।মন চাইলে ওগো কাছেই থাইক্কা যায়ো।তোমার এখন সঙ্গী দরকার।ঐ বাড়িতে ভূমির কাছে থাকলে ভালো থাকবা।”

কপাল কুঁচকে আসে সাহিদা বেগমের।এ আবার কেমন কথা?

” আর আপনে?”

” আমি! আগে বাঁইচ্চা নেই কালকে পর্যন্ত।”

” বাঁচবেন না? আপনেও মইরা যাইবেন?”

” কি জানি! আমি ক্যামনে কমু? হায়াৎ-মওতের মালিক আল্লাহ।একটা কথা জিগাই সাহিদা?”

” জিগান।”

” আমি না থাকলে তুমি ক্যামনে থাকবা? এই বুড়া বয়সে একা একা থাকতে পারবা?”

ছ্যাৎ করে উঠলো বুকের ভিতরটা।ধরাস ধরাস করে লাফাচ্ছে হৃৎপিণ্ড।গলার ভিতর হাত ঢুকিয়ে দিয়েছে অজানা এক ভয়।কোন এক অশুভ ইশারায় তটস্থ হয়ে রইলেন সাহিদা বেগম।স্বামীর গলার স্বরটাও আজ অচেনা।

” কি গো, কও না যে।”

” আপনের সমস্যা কী? কী কন এইগুলি?”

” আহা,কও না।”

” এতো আজাইরা প্যাচাল আমি পারতে পারুম না।আমার রাঁন্দা-বাড়ার কাজ আছে।আপনের মাথার তাড় ছিঁড়া গেছে।এর লেগা উল্টা-পাল্টা কইতাছেন।থাকেন আপনে,আমি গেলাম।”

নাকের পাটা ফুলিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলেও মনটা কেমন করছিলো সাহিদা বেগমের।মমিন শেখের কথা-বার্তায় ভয় জাগছে মনে।তাকে আজ অন্যরকম লাগছে।এটাই ভয়ের মূল কারণ।অস্থিরতা এক ছোঁয়াচে রোগ।স্বামীর অস্থিরতা এখন নিজের মাঝেও টের পাচ্ছেন তিনি।রান্নাঘরে রান্নার উদ্দেশ্যে গেলেও চুলায় আগুন দিলেন না।অথবা বলা যায় দিতে পারলেন না।পিঁড়ি পেতে বসে রইলেন চুপ করে।একটা ছোট চ্যালাকাঠের পিঠে আরেকটা কাঠ দিয়ে অদ্ভুত শব্দ করলেন কিছুক্ষণ।যৌবনের সেই শুরু থেকে স্বামীই তার কাছে সবকিছু। স্বামীর মতই তার মত,স্বামীর আদেশই তার অস্তিত্ব। এতোটা স্বামী ভক্তির কিছুটা এসেছে ভয় থেকে,কিছুটা এসেছে এতো বছরের সংসারে একসাথে থাকার কারণে।আজ বিষন্ন বেলায় নিরালায়
বসে ভেবে দেখলেন।মমিন শেখ যেমনই হোক,তাকে ছাড়া তার চলবে না।হারাতে হারাতে তিনি ক্লান্ত।বড় মেয়ে থেকেও নেই,ছোট মেয়ে ভাবনার অতীত। বিয়ের পর থেকে দরিদ্র বাবার বাড়ির সাথে ততোটা সম্পর্ক নেই। সবাই ব্যস্ত।ভাইয়েরা যে যার মতো চলছে,বোন নিজের সংসারের আদর্শ গৃহিণী।সবাই সবাইকে ভুলে থাকার চেষ্টায় মত্ত।বিশেষ কোনো অনুষ্ঠান ছাড়া দেখাই হয় না।ভাবনার মাঝেও স্বামী ছাড়া আর কাউকে নিজের পাশে পেলেন না সাহিদা বেগম।হাজারটা ঝামেলার পরেও মমিন শেখকে থাকতেই হবে। এ শুধু চাহিদা নয়,এ এক ঘরকুনো নারীর প্রয়োজন।

পনেরো-বিশ মিনিট পরে অশরীরির মতো বসার ঘরে ঘুরে এলেন সাহিদা বেগম।কেউ নেই,ঘর খালি।শোবার ঘরে ঢু মেরেও কাউকে পেলেন না।সূচির ঘর ও মাঝের ঘরের দৃশ্যও একই।দ্রুত পায়ে পিছনের বারান্দায় একবার ঘুরে এলেন তিনি।লম্বা বারান্দার এক কোণে ছোট্ট একটা চৌকি পাতা।গরমের দিনে মাঝে মাঝে তারা ঘুমায়।ঘরের পিছনেই সুপারির বাগান।পিছনের দরজাটা খুলে দিলে এদিকে হাওয়া আসে খুব।
মমিন শেখ ঘুমিয়ে আছেন পুরোনো কাঠের চৌকিতে।আলো জ্বেলে একটু কাছে যেয়ে দেখলেন সাহিদা বেগম।বেঘোরে ঘুমাচ্ছেন।কপালে ফুটে আছে বিন্দু বিন্দু ঘামের কনা।হাত দিয়ে মুছে দেওয়ার সময় টের পেলেন মমিন শেখের গায়ে জ্বর।খুব বেশি না,সামান্য।দুশ্চিন্তা কিছুটা কমলো।জ্বরের জন্যেই হয়তো এতোক্ষণ এতো অস্থিরতা করছিলো লোকটা।জানালা আটকে ফ্যান বন্ধ করে ঘর ছাড়লেন তিনি।যাওয়ার আগে বিরবিরিয়ে প্রার্থনা করলেন দয়াময়ের কাছে, ” তারে তাড়াতাড়ি সুস্থ কইরা দাও খোদা।”

রতন পাটোয়ারী বন্ধুকে দেখতে আসলেন মাগরিবের পরে।মসজিদ থেকে সরাসরি ছুটে এলেন।মাথায় শ্বেতশুভ্র টুপি,মুখের রেখায় বন্ধুর জন্যে প্রবল চিন্তার ছাপ-ছোপ।সাহিদা বেগমের দিকে চেয়ে চিন্তিত গলায় বললেন, ” মমিনে কই ভাবি?”

” ঘুমায়।”

” এই বেলায়!”

” হ।জ্বর আইছে তাই শুইয়া আছে।”

” কখন আসলো?”

” বিকালে।”

” বেশি নাকি?”

” না,সামান্য। চিন্তার কারণ নাই।”

যাওয়ার আগে বন্ধুর কাছে গেলেন রতন পাটোয়ারী। কাছে বসে কপালে হাত চেপে আলগোছে মৃদু সুরে ডাকলেন, ” মমিন, এই মমিন।এই, উঠবি না?”

নড়ন-চড়ন নেই।বুকের ওঠা-নামার গতি ধীর।শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কিছুটা গরম।আরেকবার তাকে ডাকার উদ্যোগ নিতেই থামিয়ে দিলেন সাহিদা বেগম।হাত নেড়ে নরম গলায় বললেন, ” থাক,আর ডাইকেন না ভাই।বেচারায় অনেকদিন পরে একটু শান্তিতে ঘুমাইছে।”।
________________________
এ গ্রামটায় বোধহয় বেলা ফুরায় একটু তাড়াতাড়ি। সূয্যিমামার পিঠেই অপ্রশস্ত পথের মতো ঝুপ করে নামে একফালি আঁধার।সেই কখন খামারের পুকুর পাড়ে মিইয়ে যাওয়া আলো গায়ে মাখতে বসেছিল ফয়সাল!ঘন্টার পিছে ঘন্টা গেছে। সে এখনো বসেই আছে।ভাবখানা এই,বসে থাকা ছাড়া ওর এখন আর কোনো কাজ নেই।
স্নিগ্ধ আলো ফুরিয়ে চলছে অন্ধকার। একটু দূরে গোয়ালঘরের সামনে একটা বাতি জ্বলছে।পুকুর পাড়ে খুব একটা আলো আসে না।ছেলেটার একটু কাছাকাছি এসে থেমে গেছে আলো।এক ছটাক আলোর আবছা অবয়ব ঠিকরে পড়েছে পুকুরে। আলো-আঁধারির মেশামিশিতে এ এক স্বপ্নের জগৎ।সন্ধ্যাবতীর আকাশ কোলে জেগেছে শুকতারা।মাটিতে ফয়সাল।সামনের দিকটায় আবছা অন্ধকার।এ এক প্রতীক,ফয়সাল ও তার ভবিষ্যতের। আজকাল ফয়সাল এমনটাই ভাবে।ভবিষ্যতের অন্ধকার ছাড়া ওর চোখে ইদানিং কিছু পড়েই না।

” ভাই,খালাম্মা আমারে আবার ফোন দিছে।”

আকাশের ঢুলুঢুলু চোখ,কথা অস্পষ্ট। চোখে-মুখে সদ্য ঘুম ভাঙার ছাপ।চোখে-মুখে খানিকটা বিরক্তি।ঘুম ভেঙে উঠে আসতে হয়েছে বলে সে হয়তো বিরক্ত।

” কী বললো?”

” জিগাইলো আপনে কি খামারে আসেন নাকি।”

” তুমি কী বললে?”

” বলছি আসেন নাই।আজকে চারদিন ধইরা আপনার সাথে আমার দেখা নাই।”

” ভেরি গুড।যাও,এখন।”

” তপু ভাইরে দেখলাম আসতাছে।”

” আসুক।”

বিষয়টা অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি।আজ চারদিন যাবৎ ফয়সাল খামারেই আছে।সহজ বাংলায় বলা যায়,খামারবন্দী।রাগের মাথায় বাড়ি থেকে বেরোনোর সময়েও ভাবেনি এখানে লুকাতে হবে। রাস্তায় পা রেখেই আপনা-আপনি হাত চলে গেল পকেটে।কপর্দকশূন্য।একটা টাকাও নেই।বড় নোট তো দূরের কথা একটা খুচরা পয়সাও আঙুলে লাগে।না আছে টাকা আর না আছে ফোন। চাইলে পিছন ফিরে বাড়ি ঢুকে এক দৌড়ে নিয়ে আসতে পারতো,কিন্তু আনলো না।সর্বাঙ্গে ইগো জড়িয়ে ছুটে এলো খামারে।হাতের কাছে আকাশকে পেয়ে চরম আক্রোশে শব্দ করে শ্বাস ছেড়ে বললো,” আমি যে এখানে আছি তা যেন আম্মা না জানে।আম্মা ফোন করে জিজ্ঞেস করলে বলবা আমি এখানে আসি না।”

আকাশের একটা ঘর আছে এখানে।সর্বক্ষণ পাহারা দিতে হয় বলে কয়েক বছর আগে ফয়সাল নিজেই তুলেছিল ঘরটা।সেই ঘরেই দুজনে ভাগাভাগি করে থাকছে।আকাশের শার্ট-প্যান্ট ধার নিয়েছে ফয়সাল।সাইজে একটু ছোট তবে ব্যাপার না।বিপদের সময় সব গায়ে সয়।প্রতিদিন সকালে শাক-সবজি বাজারে সাপ্লাই দেয় আকাশ।আয় আসে,বেলায় বেলায় খাবার আসে হোটেল থেকে।ব্যস।একটি ডিভোর্সি ও ব্যাচেলর ছেলের দিন চলছে স্বচ্ছন্দে।

কাছে আসতেই বন্ধুর পিঠে হাতের উল্টোপিঠে দুম করে একটা কিল বসিয়ে দিলো তপু। ফয়সালের পাশে বসে ওর দেখাদেখি পুকুরের পানিতে পা ভিজিয়ে বসলো।

” শালা হা**,এখানে এসে গা ঢাকা দিয়েছিস! আর এদিকে খালাম্মা আমারে ফোন করে করে পাগল বানায়ে ফেলছে।”

” কয়বার ফোন করলো?”

” আজ সন্ধ্যা অবধি হাতে গুনে পঞ্চাশ বার।ভাবতে পারছিস তুই? শালা তুই একটা জঘন্য অমানুষ।এতো কাছে থেকে এতো ঢং করার মানে আছে কোনো?”

” কী বলে আম্মা?”

” অনুরোধ,খালি তোর একটা খবর খুঁজে দিতে হবে।বুড়ো মানুষটাকে অকারণেই টেনশনে ফেলছিস।”

” তুই আমার খবর কীভাবে জানলি?”

ফিঁচেল হাসে তপু।খ্যাক খ্যাক করে হেসে বলে, ” তোকে আমি চিনি না? খালাম্মার মুখে প্রথম দিন শুনেই বুঝেছি তুই গ্রাম ছাড়িসনি।ছাড়লে অন্তত আমাকে জানাতি।পরশুদিন দুপুরের দিকে হাঁটতে বেরোলাম,তখন দেখলাম।তুই খামার থেকে বেরিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছিলি।”

” এই সময়গুলোতেই বেরোই।চারদিক নীরব থাকে।তখন রাস্তা-ঘাটে লজ্জা দেওয়ার মতো কেউ থাকে না।”

বিরক্তির শ্বাস ফেললো তপু।চরম অতিষ্ঠ হয়ে যাওয়ার ভঙ্গি করে বললো, ” ভালো-খারাপ সময় আসেই ফয়সাল। খারাপ দিন এলেই যে তুই আটকে থাকবি,তা কিন্তু না।সময় বদলায়,দিন কারো জন্য পড়ে থাকে না।মানছি তুই পাপ করেছিস।কিন্তু পাপে আটকে থাকলেই তো আর চলবে না ভাই।যেটুকু অনুশোচনায় ভুগছিস সেটুকুর জন্য ক্ষমা চা খোদার কাছে।”

অন্ধকারে পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকালো ফয়সাল।ভীষণ উদাস হয়ে বললো,
” অনুশোচনা! সে আবার কী?”

” ভাব মারাবি না আমার সাথে। আমার সাথে তোর ওরকম সম্পর্ক নেই।আমি তোরে চিনি ভাই।ভাবির জন্যে যে তোর কলিজা পুড়ে তা তোরে দেখলেই বোঝা যায়।তাই তো দিন দিন ডিজিটাল দেবদাস হচ্ছিস।চেহারার দিকে তাকানো যায় না।বিরহে গোসল করিসনি কয়দিন বলতো? শালা পিশাচ।গায়ের গন্ধে ভূত পালায়।ছিঃ!”

” তুই বেশি বেশি ভাবছিস।”

” বেশি বেশি! হুহ! পুরুষ চেনে পুরুষকে।আমার তো মনে হচ্ছে ভাবি মরার পর তোর ভালোবাসা উতলে পড়ছে।এতোদিন বোধহয় ভাবিসনি যে তুই ওর প্রতি এতো…

” মেজাজ খারাপ করাবি না তপু।মিথ্যা কথার একটা সীমা থাকে।আমি ঐ অমানুষ মেয়েটাকে কখনো ভালোবাসিনি।”–সহসা খুব উত্তেজিত হয়ে উঠলো ফয়সাল।কাঁধ ঝাকিয়ে এই কথাটাই ঘুরে-ফিরে কয়েকবার বিরবির করে আওড়ালো।যেন তপুকে নয় নিজেকেই শোনাচ্ছে।

” ডিপ্রেশন কবে কাটবে?”

” ডিপ্রেশন শব্দটা আমার জন্য না।”

” না,এই শব্দটা তো আমার জন্য সৃষ্টি হয়েছে।শালা বেকুব।”

চরম বিরক্ত হলো ফয়সাল।পানি থেকে পা তুলে নিতম্বের উপর ভর করে উবু হয়ে বসলো।খ্যানখ্যানে গলায় বিরক্তির ছাপ মেরে বললো,
” তুই কি এই ফাউল একটা বিষয় নিয়ে আলাপ করতে এসেছিস?”

” কেন?”

” এমনিই বলছি।শোন তপু,আমার এখন আর এসব নিয়ে কথা বলতে ভালো লাগে না।তোর যদি মনে হয় লেকচার দিয়ে তুই আমার মাথাটা খারাপ করতে পারবি তাহলে বলব তুই ভুল ভাবছিস।আমি এখন নতুন করে নিজের মতো বাঁচতে শিখেছি।নিজেকে ছাড়া এখন আর কাউকে কেয়ার করব না।এতোগুলো বছর অন্যের কথার পুতুল ছিলাম।পুতুল জীবনের যন্ত্রণা যে কত,তা তুই বুঝবি না।জীবনের চব্বিশটা বছর নষ্ট করার পরে আজ স্বাধীনতার স্বাদ বুঝেছি।আগের ফয়সাল আর এই ফয়সালের মাঝে কোনো মিল পাবি না।তাই বলছি উল্টো-পাল্টা কিছু বলিস না ভাই।ইদানিং আমার রাগ বেশি।কখন কী করে ফেলি তা নিজেও বুঝি না।পরে দেখা যাবে তোর সাথেও হয়তো একটা বাজে কাজ করে ফেলব।আমাকে দিয়ে কোনো বিশ্বাস নেই।বাড়ি যা ভাই।তুই আমার বন্ধু কম ভাই বেশি।তোর সাথে সম্পর্ক নষ্ট করার কোনো ইচ্ছা নাই।”

সরাসরি বেরিয়ে যাওয়ার পরামর্শ। অন্যসময় হলে হয়তো তপুর গায়ে লাগতো।কিন্তু এখন লাগছে না।বন্ধুর দিকে চেয়ে নরম গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো, ” বাড়ি ফিরবি না?”

” না।ওটা আমার বাড়ি না,আম্মার বাড়ি।”

” তাহলে কী করবি? নেক্সট প্ল্যান কী?”

” কিছুদিনের মাঝে খামারটা বিক্রি করে দেব।তারপরে সেই টাকা নিয়ে চলে যাব উদয়পুরের বাইরের কোনো গ্রামে।কাজ করব,নিজের মতো চলব।”

” সন্ন্যাসীর মতো জীবন চলে?”

ভীষণ অবাক হলো ফয়সাল।আবছা অন্ধকারেও বোঝা গেল বড় বড় হয়ে গেছে গর্তে বসে যাওয়া দুটো চোখ।

” সন্ন্যাসী! আমি থাকব সন্ন্যাসীর মতো! ছিঃ,কি বাজে কথা! কাজ করে হাতে টাকা জমলেই একটা বিয়ে করব।লাল টুকুটুকে মিষ্টি একটা বউ আনব যাতে সারাদিনের ক্লান্তি ওর মুখের দিকে তাকালেই ঘুচে যায়।আগেরটার মুখের দিকেও তো চাইতে ইচ্ছা করতো না আমার।এমনই বিশ্রি ছিল দেখতে।এবার আর সেই ভুল করব না।এমন মেয়েকেই বিয়ে করব যাকে আমার পাশে মানায়।একটা নতুন সংসার পাতব যেখানে অভিযোগ,অনু্যোগ,কথা কাটাকাটি কিছুই থাকবে না।আমি কর্তা হব আর বউ হবে কর্ত্রী। একটা সুন্দর সংসার আমারো থাকবে তপু।”

অবাক হয়ে চেয়ে থাকে তপু।মুখের বিস্ময়ের রেশ কাটে না।

” তুই এখনি এসব ভাবছিস ফয়সাল?”

” হ্যাঁ। আমি না ভাবলে আর কে ভাববে বল? তবে একদিকে সুবিধা আছে।মেয়ে খুঁজে পেতে খুব একটা কষ্ট হবে না।আমার কী নেই? সব আছে।রূপ,সম্পদ,বংশ মর্যাদা–সব।যেকোনো মেয়েই আমার প্রেমে পড়তে বাধ্য।”

এতোক্ষণ সহ্য হলেও এবার আর সহ্য হলো না তপুর।বন্ধুর হামবড়িয়া কথায় গা-পিত্তি জ্বলে গেল।তাই ফয়সালের অহংকারে আঘাত করার সুযোগটুকু ছাড়লো না।

” কিছু বেকুব আছে যারা সবসময় ফালতু জিনিসকে প্রেমের মানদন্ড মনে করে।মনে করে রূপ,সম্পদ,বংশ মর্যাদা থাকলেই মানুষ তাদের পিছে পিছে ঘুরবে।এই ধারণা নিয়ে বেঁচে থাকা মানুষগুলো মানুষ না, এরা চূড়ান্ত পর্যায়ের বলদ। শোন ভাই, একটা অকাট্য সত্য বলি।ফ্যান্টাসি কেটে গেলে মেয়েরা আর রূপ খোঁজে না,খোঁজে একটা সুন্দর পার্সোনালিটি।এবার তুই ভাব আকর্ষন করার মতো কতটা ব্যক্তিত্ব তোর আছে। পেট ভরা অহংকার দিয়েই যদি জীবন চলতো তাহলে পৃথিবীতে ঝামেলা থাকতো না।যাক গে,উলুবনে মুক্তো ছড়িয়ে লাভ নেই।তুই চলিস নিজের মতো।আমি যাচ্ছি।”

উঠে দাঁড়িয়ে গোড়ালির দিকে প্যান্ট নামিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নেওয়ার আগেই থেমে গেল তপু।

” ওহ আরেকটা কথা,তোর জন্য আর মিথ্যা বলতে পারব না আমি।খালাম্মা যদি আবার ফোন দেয় তাহলে সত্যি কথা বলে দেব।বলে দেব তুই খামারেই আছিস।আসছি,ভালো থাকিস।”
__________________________
রাত এগারোটার একটু এদিক-ওদিক। এদিকে সন্ধ্যার মতোই রাত নামে তাড়াতাড়ি। আটটা-সাড়ে আটটার পরেই নেমে আসে গভীর রাত।সেই পুরোনো দিন থেকে গ্রামে এই রেওয়াজটা আছে।এশারের পরপরই রাতের খাবার খেয়ে নেয় সবাই।তারপরে দশটার আগেই বিছানা।এক ঘুমে রাত পার করে বিছানা ছাড়ে ভোরে।
আজও এর ব্যতিক্রম নেই।চারদিক শান্ত।এমনিতেই এদিকে খুব বাড়ি-ঘর নেই।হাতে গোনা দু-তিনটে যা আছে তাদেরকেও এখন পাতালপুরীর প্রাসাদ মনে হচ্ছে।নিস্তব্ধ পরিবেশে অতন্দ্র প্রহরীর মতো পাহারা দিচ্ছে উদয়পুরকে।
ফয়সাল হাঁটছে।পকেটে হাত গুজে ছোট ছোট পদক্ষেপে বিরক্ত করছে অবসন্ন রাস্তাটাকে।সে হাঁটছে উদ্দেশ্যহীনভাবে।নিরালা দুপুর ছাড়া দিনে খুব বেশি বেরোয় না খামার থেকে।বেরোয় রাতের বেলা।সারাদিন এক জায়গায় বসে থাকতে বিরক্ত লাগে বলেই আকাশ ঘুমানোর পরে বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়।নিশ্চুপ পরিবেশে হাঁটতে বেশ ভালোই লাগে।কেউ থাকে না চারপাশে।মানুষ তো দূরে থাক ভূতেও বোধহয় তখন ঘুমাতে শোয়।

আকাশে কাস্তের মতো একফালি ছোট একটা চাঁদ।চাঁদের গা চুইয়ে খুব বেশি আলো গড়ায়নি মাটির পৃথিবীতে।ভালোভাবে তাকালে সামনের দৃশ্য দেখা যায়।এদিকে ল্যাম্পপোস্টের বালাই নেই।অন্ধকারে কাঁটাগাছ পেরোনোর সময়ে অজান্তেই গা’টা কেমন শিউরে উঠলো ফয়সালের।অস্বস্তি হচ্ছে খুব।মনে হচ্ছে ওকে কেউ দেখছে পিছন থেকে।মনোযোগ দিয়ে খুটিয়ে খুটিয়ে নজর রাখছে ওর প্রতিটি পায়ের ছাপে।খামার থেকে বেরিয়ে দশ-পনেরো পা চলার পরেই অস্বস্তির শুরু।এতোদিনও তো হাঁটলো।অন্ধকারে কিছুটা গা শিরশির করেছে
বটে তবে এতো অস্থিরতা কাজ করেনি।প্যান্টের ভিতর হাতটাকে গুজে দিয়ে গা শক্ত করলো ফয়সাল।নিজেকে সান্ত্বনা দিলো,অকারণেই ভয় পাচ্ছে ও।
হুট করেই দূর থেকে আসা নাইট গার্ডের বাঁশির শব্দে আঁতকে উঠে আধ হাত লাফিয়ে উঠলো ছেলেটা।থর‍থর করে কাঁপছে বুকের ভেতরটা।হৃৎপিন্ড বুঝি লাফাতে লাফাতে বেরিয়েই আসবে।নাইট গার্ডের ব্যাপারটা এদিকে নতুন।চোর দমাতেই এদেরকে নিয়োগ দিয়েছে গ্রামবাসী।আরেকবার শোনা গেল বাঁশির শব্দ।এবার আর ততোটা ভয় পায়নি ফয়সাল।বুকে একদলা থু থু ছিটিয়ে শান্ত করলো নিজেকে।না, দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে হাঁটার কোনো মানে হয় না।এরচেয়ে খামারে যেয়ে একটা ঘুম দেওয়া ভালো।যেই ভাবা সেই কাজ।আর এগিয়ে গেল না সামনে।পিছনে ফিরে হাঁটা শুরু করার আগেই ভোজভাজির মতো কী যেন একটা হয়ে গেল।ঘটনা ঘটতে সময় লাগলো না।সেকেন্ডের মাঝে ছেলেটার মনে হলো কয়েক মন ওজনের কিছু একটা পড়েছে মাথার উপরে।মাথাটা বোধহয় থেতলেই গেছে।জ্ঞান হারায়নি,কিছুটা বোধ আছে এখনো তার।বাম হাতের তালুতে মাথা চেপে ধরে মুখ বিকৃত করে বসে পড়লো ফয়সাল।জমানো আঁধারে আধবোজা ঝাপসা চোখে দেখার চেষ্টা করলো সামনের দিকটা।মনে হলো সামনে কীসের যেন একটা অবয়ব।অবয়বের হাত উঠছে উপরে।আসন্ন বিপদের আশঙ্কায় মাথায় চেপে রাখা হাতটাই সামনে বাড়িয়ে দিল সে।সেকেন্ডের মাথায় মনে হলো কবজির মাংসটা চিড়ে ফেলছে কেউ।কনিষ্ঠ আঙুলটা বুঝি পড়েই গেছে গোড়া থেকে।গলগলিয়ে পড়ছে রক্ত।হঠাৎ আক্রমণে চিৎকার করার শক্তি নেই।মাথা ঝিমঝিম করছে।অজ্ঞান হতে সময় লাগলো না।জ্ঞান হারানোর আগে বার দুয়েক মাকে ডাকলো।
নাইটগার্ডের বাঁশির শব্দ শোনা যাচ্ছে আবার।উদয়পুরের কেউ জানলো না রাতের আঁধারে ফয়সালের খামার থেকে উত্তরে মাত্র চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ পা দূরে এক ভয়ংকর কান্ড ঘটে গেছে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here