শুকতারা (দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ) পর্ব ১৮

0
205

#শুকতারা (দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
#পর্ব-১৮
#হালিমা রহমান

মায়ের আদেশ-অনুরোধ-কাকুতি-মিনতি ও বড় ভাইয়ের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে আবারও কাজী বাড়ি ছেড়েছে কাজী ফয়সাল।গাল ভর্তি গোঁফ-দাড়ি,হাড় বেরোনো হাত-পা, উসকো-খুসকো ময়লা এক মাথা কোঁকড়া চুল দেখে কিছুতেই বোঝার উপায় নেই এ সেই ফয়সাল।এই সূচির প্রথম প্রেম।একেই অন্তু বলেছিল কাজী বাড়ির সবচেয়ে সুদর্শন ছেলে। আশ্চর্য! এই ছেলের সাথে চোখ ধাধানো সুদর্শন শব্দটা যায় না।নিজের প্রতি অযত্ন ও অবহেলায় ফয়সাল এখন বিশ্বসেরা।আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ঘেটে যাওয়া গোটা অবয়বটাকে আর দেখে না ফয়সাল।ভালো লাগে না।নিজের এমন দশা দেখতে কার ভালো লাগে?
বাড়ি থেকে বেরিয়েছে দু’দিন আগে। ঝামেলা হয়নি কোনো।এমনিই বেরিয়েছে। ঘরে ওর ভালো লাগে না।রুমের চারটে দেয়াল অসহ্য লাগে।ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখে দেয়ালগুলো দানবের মতো বুকের উপরে চেপে বসেছে।ইটগুলো বিশাল বিশাল। ওর গলা চেপে ধরছে।দুঃস্বপ্ন কেটে গেলে শিউরে উঠে লাফ দিয়ে বসে। চোখ যায় গোটা ঘরের দিকে।সদ্য ঘুম ভাঙা চোখে লক্ষ করে ড্রেসিং টেবিলের উপরের মেয়েলী জিনিসগুলো ওর দিকেই তাক করা।যেন ওর দিকে চেয়েই ভয়ংকরভাবে খ্যাক খ্যাক করে হাসছে।গলা শুকিয়ে আসে ফয়সালের। তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নেয় এ ঘরে নিজের জিনিসগুলো রেখে বাকি সব পুড়িয়ে ফেলবে।সবকিছু।প্রাক্তনের শাড়ি,গয়না,গামছা– সব।কিন্তু সিদ্ধান্তটা সেই ভাবনাতেই সীমাবদ্ধ। তা আর বাস্তবায়ন হয় না।মস্তিষ্কের এলোমেলো চিন্তাগুলো স্থির হতেই ক্লান্ত পথিকের মতো আবারও গা এলিয়ে দেয় ফয়সাল।ওমনি বেঁচে যায় সূচির শাড়ি,চুড়ি,পাউডার,স্নো,কাজল থেকে শুরু করে চিরুনিতে প্যাচানো গোটা কয়েক ছেঁড়া চুল।অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি এরা এখনো নিজ নিজ জায়গায় বহাল।কেন যে এরা এখনো এখানে তা আজ অবধি মূর্তিমান রহস্য।
বাড়ি ছাড়ার আগে আফজালের রক্তচক্ষু নজরে এসেছে।থমথমে মুখটাতে কেমন একটা ভিনদেশী ভাব চলে এসেছে। মা কান্নাকাটি করেছে।হাতে ধরে থামাতে চেয়েছে।কান্না চাপা বিকৃত কন্ঠে গমগম করে ঘোষণা করেছে, ” আমার কসম তুই বাড়ির বাইরে এক পাও রাখবি না ফয়সাল।রাখলে আমার মরা মুখ দেখবি।”
মাতৃ আজ্ঞার আগল ভেঙে সত্যি সত্যিই ফয়সাল বেরিয়ে এসেছে।ঐ কাজী বাড়িতে ও শ্বাস নিতে পারে না।অক্সিজেনের প্রবল সংকট অনুভব করে।প্রাণ ভরে বাঁচার তাগিদ অনুভব করে বাইরে।উদয়পুরের বাজারে,খামারে অথবা ধুলোমলিন কাঁচা রাস্তায়।নিজের একটা অদ্ভুত রোগ ধরা পড়েছে।মায়ের প্রতি এখন আর কোনোরকম ভয় কাজ করে না ফয়সালের।বরং এখন যেন তাকে কষ্টে রাখলেই বাঁচে।রোমেলা বানুকে ভেঙে পড়তে দেখলে ছেলেটা যে পৈশাচিক আনন্দ পায় তার খবর স্বয়ং খোদা ছাড়া আর কেউ জানে না।দিনে দিনে প্রবল কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে উঠছে ও নিজেও।সবকিছুতে নিজের কর্তৃত্ব খাটাতে চায়।মনমতো কিছু না হলেই রক্ত উঠে যায় মাথায়।রক্তে নাচন ধরে।রাগে কাঁপে ভিতর-বাহির।আজকের এই একটা ফয়সালের ভিতর দিয়ে আগের সেই মুখচোরা, ভীতু, ভদ্র,নম্র,কর্মঠ,মিনমিনে,মা ভক্ত একশোটা ফয়সাল অনায়াসে আসা-যাওয়া করতে পারবে।আজ ও বেপরোয়া,ভীষণ সাহসী ক্ষেত্রবিশেষে আস্ত এক বেয়াদব।পরিস্থিতি মানুষকে কতটা বদলে দিতে পারে তা ভাবলে অবাক হতে হয়।
বাড়ি ছেড়ে দু’দিন আগে ফয়সাল এসেছে তপুদের বাড়ি।ওর আসলে যাওয়ার আর জায়গা নেই।মামাবাড়িতে ভালো লাগে না।এবার আর খামারে গেল না।খামারটাও আজকাল অসহ্য ঠেকে।আগের থেকেই কাজের বাইরে আকাশ কথা বলে না খুব একটা।খামারে মাটির কাছাকাছি থাকলে ভাবুক হয়ে উঠে ফয়সাল। মাঝে মাঝে ভাবে ওর জীবনটা এই মাটির মতোই মাটি হয়ে আছে। ওর একটা সঙ্গী দরকার ভীষণভাবে।একটা কথা বলার সঙ্গী। এক্ষেত্রে তপু একদম পার্ফেক্ট।প্রাইমারি স্কুলে পাতানো বন্ধুত্বের জের কাটিয়ে দুজনে কবে বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে উঠেছে তা খুঁজে দেখার সময় হয়নি।সময়ে সময়ে ফয়সালের কাছে মনে হয় তপু আসলে বন্ধু না,ও ভাই।মায়ের পেটের আপন ভাই।তাই তো ফয়সালের ব্যাপারগুলো খুব সুন্দর করে বুঝে যায়।বুঝিয়ে দেওয়া লাগে না,ওর মেজাজও তপুর মুখস্থ। ভালোবাসা,মায়া,মমতার দিক দিয়ে ওকে আফজালের চেয়েও আপন লাগে।

শরতের পেজা তুলোর বিচরণ আকাশে।সূর্যের তাপ গায়ে লাগে না।রসুইঘর থেকে ভেসে আসছে তালের পিঠার সুঘ্রাণ। গাছপাকা তাল দিয়ে পিঠা বানাচ্ছে তপুর মা।ফয়সাল বোঝে ভদ্রমহিলা ওকে খুব একটা পছন্দ করে না এখন।ফয়সালের এই আসা-যাওয়াটা ওনার বিশ্রি লাগে।কিন্তু হয়তো ছেলের বন্ধু হওয়ায় এখনো কিছু বলেন না।কখনো কখনো ভদ্রতা পছন্দ-অপছন্দের চেয়েও বড় হয়ে দাঁড়ায়।
ঘরের সামনের একফালি ছোট্ট উঠোনের বুক চিড়ে বেরিয়ে যাওয়া মেটো রাস্তাটা বাড়ির সামনের রাস্তায় মিশেছে।বাড়ির মুখেই খানাখন্দ, এখানে-ওখানে এক আধলা ইটের টুকরা।এদিক-সেদিকে ঝরা পাতাগুলো পড়ে আছে।তাই উবু হয়ে উঠোন ঝাঁট দিচ্ছে তনু।ওড়নাটা খুব সুন্দর করে মেলে দেওয়া গায়ের উপরে।তপুর এই বোনটা ভয়ংকর সুন্দরী।একদম মন টলিয়ে দেওয়া সুন্দরী বলতে যেমন হয় ঠিক তেমন।সৌন্দর্য ঠিকরে পড়া তনুকে ভালো লাগতো ফয়সালের।শুধু তনু কেন? দুনিয়ার সব সুন্দরীদের দেখলেই ওর অন্যরকম লাগতো।বসন্ত বাতাসে নাচতো মনটা।চোরা চোখে চেয়ে থাকার আনন্দটা ছিল ঠিক হিমালয় জয় করার মতো।কিন্তু এখন আর এসব হয় না।কেন যেন ভালো লাগে না।আগের কোনো স্বভাবই বজায় নেই।আগে যা ভালো লাগতো তাই এখন অসহ্য লাগে।বয়স যখন পঁচিশের মুখে, রক্তে যখন উন্মাদনা,গায়ে-গতরে যখন ও তাগড়া যুবক; তখনই নতুন করে আবিষ্কার করলো ফয়সাল।ও দিন দিন ঝিমিয়ে যাচ্ছে।না,না ঝিমিয়ে নয়।কে যেন যাওয়ার আগে ভেঙে দিয়ে গেছে মাঝ বরাবর। ঘা খাওয়া ফয়সাল আবার তৈরি হচ্ছে ঠিকই।একদম নতুনভাবে,নতুন ছাঁচে।বিষয়টা নবজন্মের মতোই নতুন।
সকাল সাড়ে নয়টা।উঠোনে পিঁড়ি পেতে এক মগ চায়ে মুড়ি ভিজিয়ে খাচ্ছিলো ফয়সাল।তপু এসে পাশে মাটিতে লেপ্টে বসলো।

” আফজাল ভাই ফোন দিয়েছিল।”

” কেন?”

” বাড়ি যেতে বললো তোকে।খালাম্মা কান্নাকাটি করে।”

মুখ দিয়ে ঘোৎ করে বিশ্রি একটা শব্দ করলো ফয়সাল।মগের শেষ চা’টুকু দূরে ছুঁড়ে ফেলে বললো, ” আদর বেয়ে বেয়ে পড়ছে।আমি কি বাচ্চা? এতো ঢং সহ্য হয় না আমার।যত্তসব আদিখ্যেতা।”

” এখন অসহ্যই লাগবে।যেদিন বাপ হবি সেদিন বুঝবি।খালাম্মা যে তোকে নিয়ে ভয়ে থাকে তা তো অমূলক না।কত বড় একটা ফাঁড়া গেল। আমার মা হলে আমার পা ভেঙে ঘরে বসিয়ে রাখতো।কিছুতেই বাইরে যেতে দিতো না।”

” আমার গোটা জীবনটা ফাঁড়ার উপর দিয়েই গেল রে।এখানে অঘটনের আর শেষ নেই।তাই তো এখন আর ভয় করে না।”

” বাদ দে তো ভাই।চা শেষ? চল বাজার থেকে ঘুরে আসি।”

” বাজারে না।চল পূবের বিলে যাই।বাজারের মানুষগুলো আমাকে চোখ দিয়ে গিলে খায়।মনে হয় যেন সুন্দর ছেলে আর দেখেনি।”

” সুন্দর ছেলে! নিজেকে তাই ভাবিস নাকি? ছিঃ! গায়ের গন্ধে ভূত পালায়।কয়দিন গোসল করিসনি বল তো? গায়ে ঘষা দিলে তিন কেজি ময়লা উঠবে।শালা খচ্চর।”

পূবের বিলটা সবসময়ের মতো নিরিবিলি।এখানে অযথা শব্দের বালাই নেই।আছে মধুর নিস্তব্ধতা।সাড়ি সাড়ি গাছের পাতাগুলো যখন বাতাসে দোল খায় তখন দেখতে বেশ লাগে।উত্তর-পশ্চিম কোণ ধরে বিশ মিনিট হাঁটলেই উত্তাল মেঘনা পড়বে সামনে।এখন লঞ্চের সময় নয় বলেই সেই কান ফাটানো শব্দটা আসছে না।সময় হলে দূর থেকে ভেসে আসা শব্দে জায়গাটাকে সদরঘাটের মতোই লাগে।
হাঁটতে হাঁটতে গাঢ় নিস্তব্ধতা ভেদ করে প্রথম প্রশ্নটাই ছুঁড়ে মারলো তপু, ” এভাবে আর কতদিন ফয়সাল?”

” মানে?”

” বুঝতে পারছিস না? নাকি বুঝেও না বোঝার ভান করছিস?”

” জ্ঞান বিলাতে আসবি না তপু।এসব বা*-ছা*র কথা-বার্তা বিরক্ত লাগে আমার।”

” শালা আমার সাথে মেজাজ মারাবি না।আমি তোকে ডরাই না।ক্ষ্যাপা ষাঁড় একটা।পাগল হয়ে যাচ্ছিস দিন দিন।”

উদাস হয় ফয়সাল।হাঁটা থামিয়ে উঁচু একটা ঢিবির উপরে বসে পড়ে।পায়ের বুড়ো আঙুলের নখ দিয়ে মাটি তোলে।

” তোরা খালি পাগলাটাকেই দেখিস। কিন্তু কেন এরকম সৃষ্টিছাড়া হচ্ছি,তা তো বোঝার চেষ্টা করিস না।”

” অবশ্যই আমরা চেষ্টা করি।কিন্তু দিন দিন তুই যেমন হয়ে যাচ্ছিস তাতে মানুষের করুণা আসা কঠিন।”

” আমি কারো করুণা চাচ্ছি না তপু।তুই বাদে সবাইকে আমার বিরক্ত লাগে।”

” মুখ ফুটে ওরকম সবাই বলে কিন্তু মন তলিয়ে দেখ।তুই কি চাস না তোর মতো করে কেউ তোকে নিয়ে ভাবুক? তুইও চাস সবাই বলুক যত ঘটনা ঘটেছে সেখানে ফয়সালের কোনো দোষ ছিল না।সব দোষ ছিল ওর মা আর বউয়ের।ঐ দুটো মহিলার জন্য ছেলেটার জীবন নষ্ট হয়ে গেল।সবাই এরকমটাই বলুক,তুই এটা চাস না ফয়সাল?মিথ্যা বলবি না।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফয়সাল।সত্যি ও চায়।এরকমটাই মাঝে মাঝে ভাবে।ও নিজেও চায় সবাই ওকে ওর মতো করে ভাবুক।নিজেকে ও ভাবে নিষ্পাপ, পরিস্থিতির স্বীকার।সবাই এরকমটাই ভাবুক।কিন্তু কেউ ভাবে না আসলে।বাজারের মানুষ থেকে শুরু করে তপু, সবাই ওর কোনো না কোনো দোষ ধরে বসেই আছে।অদ্ভুত।

” তুই কড়া ডিপ্রেশনে আছিস।তোর মেন্টাল হেলথ খুবই খারাপ। এটা কি জানিস ফয়সাল?”

” মেন্টাল হেলথ ফেলথ কিছুই না।আমি ভালো আছি।”

মানতে নারাজ তপু।
” একদম ঠিক নেই।তুই নিজেও জানিস তুই ঠিক নেই।তুই এক কাজ কর।ঢাকায় যা।একটা ভালো সাইকিয়াট্রিস্ট দেখা।এ ছাড়া আর গতি দেখছি না।”

চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলে ফয়সাল।হালকা চালে বিস্ময় প্রকাশ করে, ” পাগল হয়েছিস! আমি কি পাগল হয়ে গেছি রে?খামোখা পাগলের ডাক্তারের কাছে কেন যাব?”

” সাইকিয়াট্রিস্ট মানে যে পাগলের ডাক্তার না তা বোঝার মতো বয়স এবং জ্ঞান দুটোই তোর আছে।আমার সাথে ভাব নিবি না।আর কত নিজেকে অবুঝ ভাববি ভাই? গোটা জীবনটাই পড়ে আছে।মানছি শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছিস।তুই একটা পরিস্থিতির স্বীকার তাও জানি।তবে দোষ যে তোরও ছিল এটা তো অস্বীকার করা যায় না।তুই নিজেও সাধু পুরুষ না।তবুও যেহেতু আমরা মানুষ,সৃষ্টির সেরা জীব;সেহেতু তোকে একটা চান্স দেওয়াই যায়।তোকে সব ভুলে একবার ক্ষমা করাই যায়।”

ফয়সাল চুপ মেরে থাকে।তপুর দিকে মনোযোগ আছে কি না তা বোঝা যায় না।অমনোযোগী চোখে বাম হাতের আধা কড়ে আঙুলটা দেখে আর পায়ের বুড়ো আঙুলে মাটি তোলে।তপু বোঝে ফয়সাল ভাবছে।তাই অতি সন্তর্পণে পরের প্রশ্নটা ছাড়ে।

” তোর কি অনুশোচনা হয় ফয়সাল?”

এ নিয়ে আরেকদিন কথা হয়েছিল।ফয়সাল আহত হওয়ার আগে খামারে এই প্রসঙ্গেই কথা তুলেছিল তপু।কিন্তু সেদিন কোনো মীমাংসা হয়নি।আজও চোখ তুলে চায় না ছেলেটা,মাটির দিকে চেয়ে থাকে।তপু তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে থাকে।মনে হয় যেন আজ কিছু একটা বলবে ফয়সাল।বন্ধুর বিভ্রান্তিতে ভরা মুখটা নজরে আসে।অবশ্য ওর আশঙ্কা সত্যি হয়।উত্তরটা দেওয়ার জন্য ঠিক মিনিট ছয়েক সময় নেয় ফয়সাল।

” আমি জানি না তপু।কিন্তু বিশ্বাস কর,আমার কেমন যেন লাগে।তোকে বোঝাতে পারব না,তুই হয়তো বুঝতেও পারবি না।আমার খুব অসহায় লাগে মাঝে মাঝে।যখনই ওকে মনে পড়ে তখনই খুব পাগলামি করতে ইচ্ছা করে।মনে হয় যেন কাজী বাড়িটা আমার জন্য না।মাকে সহ্য হয় না,কখনো কখনো নিজেকেও সহ্য হয় না।একে অনুশোচনা বলে? আমি জানি না তপু।”

ফয়সালের কন্ঠে অস্থিরতা, দৃষ্টিতে উন্মাদনা,নিশ্বাসে জড়ানো দ্বিধা।বন্ধুর বিচলিত চোখ দুটো দেখে অনেক কিছুই বোঝে তপু।তাই মাখনের মতো নরম স্বরে পরের প্রশ্ন করে, ” খুব ভালোবাসতি ভাবীকে?”

” আমিই সূচিকে!কখনোই না।”

” তোকে আমি জোর করব না অথবা আমাদের দুজনের মাঝখানের কথাগুলো তৃতীয় কোনো ব্যাক্তিকে বলব না।তুই রিল্যাক্সে বল।যা ইচ্ছা হয় বল।”

” সত্যি ভালোবাসতাম না।সূচিকে আমি ভালোবাসতে পারলেও বেঁচে যেতাম,ঘৃণা করতে পারলেও বেঁচে যেতাম।ওকে ভালোবাসিনি ঠিকই কিন্তু খুব কঠিনভাবে ঘৃণাও করিনি কখনো।ওকে আমার ঠিক আগুনের মতো লাগতো।কাছে এলে সহ্য হতো না, দূরে গেলে ভালো লাগতো না।একটা কথা বললে তুই হয়তো এখন বিশ্বাস করবি না।কিন্তু আমি আর আমার খোদা জানে এই কথাটা একশ ভাগ সত্য।”

” আমি তোর সব কথা বিশ্বাস করব।”

” না, করবি না।কারণ কথাটা বিশ্বাস করার মতো না।”

” সত্যি বিশ্বাস করব। তুই বল।”

ছেড়ে ছেড়ে দম নেয় ফয়সাল।হাসফাস লাগে ওর।মাথার এলোমেলো চুলগুলোকে মুঠোতে পুরে মিনমিন করে বলে, ” আমি জানতাম আমার সংসারটা টিকবে না।আজ হোক বা কাল, ওকে আমার ছাড়তেই হবে।ওকে আমি জেনে-বুঝে তালাক দিয়েছি। কিন্তু বিশ্বাস কর, ওকে আমি সজ্ঞানে মারিনি।তুই জানিস ক্ষুধা লাগলে আমি পাগল হয়ে যাই।সেদিন সারাদিন কামলার মতো খেটেছি খামারে।একটা দানাও ছিল না পেটে।এর মাঝেই ওর সিনক্রিয়েট। ধাক্কাটা সামলাতে পারিনি তপু।মাথা কাজ করছিল না।তুই বিশ্বাস কর,মাথাটা বিন্দুমাত্র কাজ করলে ওকে আমি ভূমির বাড়ি থেকেই আনতাম না।ওখানেই তালাক দিতাম।কিন্তু কী থেকে কী হয়ে গেল,কিছুই নিতে পারছিলাম না।শুধু মাথায় ছিল ওকে কঠিন কোনো শাস্তি দিতে হবে।নিজের হাতেই দেব।তাই মেরেছি।কিন্তু আল্লাহর কসম,বিয়ের পরে ঐ একদিন ছাড়া আর কোনোদিন আমি ওর গায়ে হাত তুলিনি।একটা টোকা অবধি দেইনি।বেশি বাড়াবাড়ি হলে শুধু ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বলতাম।”

মনোযোগ দিয়ে শুনছিল তপু।এ পর্যায়ে এসে পিঠ টান করে বসলো।কপাল কুঁচকে বললো, ” কী বলতি?”

” বলতাম, বেরিয়ে যাও।এতো সমস্যা থাকলে ঘর থেকে চলে যাও।”

” সিরিয়াসলি!”

” আরে এটা তো কথার কথা।”

” আমাদের এখানেই ভুল হয় রে ফয়সাল।মানুষকে হাতে মারার চেয়ে মুখে মারা সহজ।তুই আমার বাড়িতে আছিস।এখন আমি তোকে যেকোনো কারণেই হোক বললাম, বেরিয়ে যা।তোর ভালো লাগবে ফয়সাল? কখনোই ভালো লাগবে না।সমস্যা সমাধানের জন্য এটা ভালো কথা না।বাড়িটা যেমন তোর তেমনি ভাবীর নিজেরও।অন্তত বিয়ের পরে তো যা থাকে তা দুজনেরই হয়।এখন তুই যদি এই জিনিসটা না মানিস তাহলে তো হবে না।খালাম্মাকে আমি চিনি,তিনি যে কত দাঁতে কাটতে পারে তা আমার অজানা না।কত আর বয়স ছিল মেয়েটার! খালাম্মার কাছে যখন একবিন্দু ছাড় পায়নি তখন তোর উচিত ছিল ওকে মেন্টাল সাপোর্ট করা।মাকে মায়ের মতো হ্যান্ডেল করা,বউকে বউয়ের মতো।শক্ত হাতে সংসারটা ধরার দরকার ছিল।তুই বলছিস সেদিন সিনক্রিয়েট করেছিল বলে তোর রাগ উঠেছিল।কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে, সিনক্রিয়েট কেন হলো? নিশ্চয়ই নিজের কথাগুলো, সমস্যাগুলো শেয়ার করার মতো স্পেস তুই তৈরি করিসনি।নয়তো তোর বউ কেন ভরা উঠোনে বোনের কাছে নালিশ করে? তুই তো মরে যাসনি।সমস্যাগুলো আগে তোর কাছে আসার কথা ছিল।সেটা কেন হয়নি? আমাকে বলতে হবে না তুই নিজেই ভাব।নিজের সংসারের অলি-গলি তুই ভালো জানিস ফয়সাল। বুক চিতিয়ে বলতে পারবি, দোষ তোর একবিন্দুও ছিল না? সব দোষ একা ভাবীর ছিল? একবেলার রাগে যদি তুই বউয়ের গায়ে হাত তুলতে পারিস তো চার মাসের সংসারে তোর অপরাধে তোর গায়ে কতখানি হাত তোলা উচিত, তা তুই নিজেই হিসাব কর।”

ফয়সাল বলে না কিছুই।কিন্তু ওর চোখ দুটো লাল হয়ে আসে মুহূর্তেই।গলা ধরে যায়।শার্টের হাতার খুটে মুখের ঘামটুকু মুছে নেয়।

” আমার ওকে খুব মনে পড়ে তপু।”

” স্বাভাবিক।”

” ওর মরণটাই খুব বিঁধে আমাকে।আমার কাছ থেকে দূরে থেকে বেঁচে থাকতো।অন্য কোথাও বিয়ে করতো।কথা-বার্তায় ও চমৎকার মেয়ে।রূপে-গুনে তোর নজর কাড়বে না কিন্তু ঘন্টা দুয়েক আলাপ করলেই বুঝবি তোর ভালো লাগছে।ওকে দেখেই শিখেছি চামড়ার রূপের বাইরেও একটা রূপ থাকে।ওটা সূচির ছিল।চ্যাটাং চ্যাটাং করে কথা বলতো,মাঝে মাঝে খুব ভালো লাগতো শুনতে।”

দম নেওয়ার ফাঁকে থামে ফয়সাল।তপু লক্ষ করে বন্ধুর অস্থিরতা।মুখোমুখি বসেই বুঝতে পারে ওর বুকের কাঁপন।

” বিশ্বাস কর, আমি সত্যিই চাইনি ও মরে যাক।কিছুতেই চাইনি।এটাই সহ্য হয় না তপু।কিছু ভালো লাগে না।চুপচাপ মরার মতো পড়ে থাকতে ইচ্ছা করে।আমার মতো নিরীহ, গোবেচারা একটা ছেলের কারণে সূচি সুইসাইড করেছে! আমার ঘাড়ে এতো বিশাল একটা অপরাধ! এই কথাটা মাথায় এলেই পাগল হয়ে যাই।ঘরের দেয়ালগুলো অবধি আমাকে চেপে ধরে।উদয়পুরকে সহ্য হয় না।কোথাও পালিয়ে যেতে ইচ্ছা করে।”

” ভালো একটা ডাক্তার দেখা।”

” ডাক্তারকে খেয়ে নিলেও কিছু হবে না।অনেক ভেবেছি।আমি এখন জানি আমাকে কী করতে হবে।”

” কী করবি?”

কথার খেই ধরতে পারে না ফয়সাল।পাগলের মতো মাথার চুল টেনে ধরে বলে, ” অনেক ভেবেছি এতোদিন।ভাবতে ভাবতে পাগল হয়ে গেছি।কিছু একটা তো করতেই হবে আমাকে।এই চব্বিশ বছরে অনেক কিছু হারিয়েছি।নিজেকেই হারিয়ে ফেলেছিলাম প্রায়।আর হারাব না।সেটাই করব যা আমার মন চায়।আমি যা ভালো বুঝি তাই করব।বেঁচে থাকতে হলে একটু ঝুঁকি তো নিতেই হবে।”

তপু অধৈর্য হয়।ফের প্রশ্ন করে, ” কী করবি সেটা তো বল।”

” শীঘ্রই জানতে পারবি।”

সহসা এক কাজ করলো ফয়সাল।শরীরের সম্পূর্ণ ভারটুকু ছেড়ে দিয়ে মাটির উপরে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লো।দৃষ্টি সটান আকাশে।এক হাঁটু আরেক হাঁটুর উপরে তুলে ভ্যাবলার মতো হাসলো।

” প্রেমহীন যে গল্পটা মানসিক অশান্তির মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল, তা আবার মানসিক অশান্তির মধ্যেই শেষ হবে রে তপু।এ একেবারে অবধারিত। আঙুলে গুনে হিসাব রাখ,সমাপ্তির খুব একটা দেরি নেই আর।”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here