শুকতারা (দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ) পর্ব ১২

0
188

#শুকতারা (দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
#পর্ব-১২
#হালিমা রহমান

ভূমির ছেলের নাম ইভান।লম্বা-চওড়া আরেকটা নাম আছে বটে তবে তা এখন পর্যন্ত অব্যবহৃত। শেষমেশ সূচির দেওয়া নামটাই ধোপে টিকলো।উদয়পুর ছাড়ার আগে যে চিঠিটা লিখেছিল মেয়েটা তার শেষদিকে এই নামটা উল্লেখ করেছিল।আগে-পিছে কিছু ভাবেনি ইশতিয়াক।সাত দিনের দিন আরেকটা লম্বা নাম জুড়ে ছেলের নাম রেখে দিল ইভান।
এই মাত্র কয়েকদিন বয়সেই ইভান হয়েছে মহা ত্যাদড়।দিনভর ঘুমায়,রাতভর জেগে থাকে।সাথে জাগিয়ে রাখে মাকেও।জন্মের আগের ধারাবাহিকতা এখনো বজায় রেখেছে।সূচিকে হারিয়ে অবধি ভূমি ভেবেছিল তার দিন কাটবে না।অন্তত যেই ভিটে থেকে আদুরে বোনকে জোর করে নিয়ে ওরা মেরেছে সেই ঘর-দুয়ারে ওর মন কিছুতেই কাটবে না।কিন্তু সেই জো আছে? শোক কোথায় পালিয়েছে! ইভানটা বাঁশের মতো দাঁড় করিয়ে রাখে অষ্টপ্রহর।সারাদিন ভ্যা ভ্যা করে কাঁদে।আর দিনের ব্যস্ততা শেষে যেই না বিছানায় পিঠ ঠেকায় ভূমি,ওমনি চোখ মেলে জেগে থাকে ছেলেটা।এর যন্ত্রণায় আর বাঁচা গেল না।
সময়টা মাঝ রাত।ঘড়ির কাঁটায় ঠিক রাত দেড়টা।নিঝুম, নিস্তব্ধ রাতে আশপাশে সবাই ঘুমে মশগুল।ঘুম নেই শুধু ভূমির ঘরে।ছেলেকে পায়ে নিয়ে এক ঘন্টা অবধি দোলনার মতো দোলাচ্ছে।মেরুদন্ড বাঁকানো,চোখ দুটো ঘুমে ঢুলুঢুলু।চোখের সাথে সাথে পিঠের হাড়গুলোও ঝিমাচ্ছে। লম্বা একটা হাই তুলে চোখ রগড়ে সোজা হয়ে বসলো ভূমি।আজ সন্ধ্যা থেকেই খুব কাঁদছে ইভান।খাচ্ছে না,ঘুমাচ্ছে না,শুধু থেমে থেমে কাঁদছে।রাতের খাবার শেষে বিছানায় নিয়ে শোয়ার সময় শুরু হলো আরেক যন্ত্রণা।ছেলে কাঁদছে দ্বিগুণ তেজে।কী কারণে কাঁদছে তা জানা নেই ওদের।বিরক্তিতে তামা তামা হয়ে এলো ভূমির মেজাজ।ইশতিয়াকের নজর বাঁচিয়ে আলতো হাতে চাপড় বসিয়ে দিলো ছেলের ছোট্ট পিঠে।ফলাফল আরো খারাপ।আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে চিৎকার করতেই উঠে বসলো মেয়েটা।সেই থেকেই চলছে দোলদোলানি খেলা।দুলতে দুলতে প্রায় ঘুমিয়ে যায় ইভান।পা দুটো থামালেই আবার জেগে যায়।চোখ মেলেই আবার চিৎকার।অসহ্য!

খাটের বরাবরে দাঁড়িয়ে থাকা খুঁটিতে আঁটকে আছে দু’বছরের পুরোনো ঘড়িটা।পঁচিশ ওয়াটের এনার্জি সেভিংস বাল্বের ঝকঝকে আলো উপচে পড়ছে ওখানে।চোখ সওয়া আলোতে ঘুম জড়ানো চোখে চেয়ে রইলো ভূমি,রাত একটা বাজে।ইশতিয়াকের জন্য পাতা পাশের বালিশটা খালি।বেচারা এখনো জেগেই আছে।সারাদিন অফিসের ধকল শেষ করে আজ আর ঘুমাতে পারেনি।বউ-ছেলেকে সঙ্গ দিচ্ছিলো,মাত্র কয়েক মিনিট আগেই একটা কল আসায় উঠে গেল।রুমের বাইরেই হয়তো কথা বলছে।

ইভান ঘুমিয়েছে মাত্র।দু’পা ফাঁক করে ছেলেকে শুইয়ে নিজেও সবে কাত হয়ে শুয়েছিলো,ওমনি হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলো ইশতিয়াক।মাত্র কয়েক মিনিটেই আমূল পরিবর্তন। চোখে-মুখে আগের থেকেই ছিল ক্লান্তির ছাপ। তার সাথে এখন আবার যোগ হয়েছে উদভ্রান্তের ভাব।চরম অস্থিরতায় চুলগুলো শক্ত মুঠোতে পুরে উপরের দিকে টানছে।অজানা আশঙ্কায় ভয় পেয়ে ভূমি উঠে বসলো।

” কী হয়েছে?”

” রেডি হও।”

” মানে!”

কাঠের আলনা থেকে দ্রুত গতিতে ভূমির বোরকাটা নিয়ে খাটের উপরে ছুঁড়ে মারলো ইশতিয়াক।মানিব্যাগ চেক করে তা পুরে নিলো ট্রাউজারের পকেটে।

” কে ফোন দিয়েছিল ইশতি?”

” তুমি চিনবে না।”

” চিনব না মানে? না চিনলে রেডি হব কেন? কই যাব? কিছু তো বলো।”

উত্তর না দিয়ে ঘুমন্ত ছেলেকে কাঁথায় প্যাঁচিয়ে কোলে তুলে নিলো ইশতিয়াক।বুকের সাথে শক্ত করে ধরে রাখলো যেন পড়ে না যায়।পাশ থেকে আরেকবার ভেসে এলো ভূমির চিন্তিত কন্ঠ,
” এতো রাতে কই যাচ্ছি আমরা? কিছু তো বলো।আশ্চর্য এরকম চুপ…

” একটু চুপ করতে পারো তুমি? সবসময় এতো কথা বলো কেন।বলছি রেডি হতে তা না করে ঘ্যানঘ্যান করছো।আমার সাথে যেতে সমস্যা আছে তোমার? তাহলে এতো কথা বলছো কেন? সমসময় কৈফিয়ত দিতে অসহ্য লাগে ভূমি।চুপচাপ রেডি হও।— সহসা খ্যাঁকিয়ে উঠে চটপট ঘরের তালাটা ভূমির হাতে গুজে দিলো।তারপরে কী যেন ভেবে কপাল কুঁচকে বললো — ” থাক গে এখন আর বোরকা পরার দরকার নেই।সময় কম, চলো তাড়াতাড়ি।”

মিনিট খানেকের মধ্যে ফোনের আলো জ্বেলে তা বউয়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে পথে বেরিয়ে পড়লো ইশতিয়াক।বাম হাতের শক্ত মুঠোয় পুরে রাখা হাতের মালিক হতবুদ্ধি ভূমি। কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না।তবে অন্ধকারের বুক চিড়ে এগিয়ে যাওয়ার সময় খেয়াল করলো পা দুটো বেজায় ভারী।টেনে নেওয়া মুশকিল।কিছু না বুঝলেও চোখ দুটো আচমকা ঝাপসা হয়ে আসে।মনে হয় যেন পথের আঁধার কিছুই না।সামনে আরো হাজারটা অন্ধকার হা করে আছে ওকে গিলে খাওয়ার জন্য।
____________________________
বহু বছর পরে আবার সেই পুরোনো পথ।দর্জি বাড়ির ঘাট ভাঙা পুকুরের কাছে যেতেই ভূমি বুঝলো আর হাঁটা সম্ভব না।হাঁটু ভেঙে আসছে।অজানা আশঙ্কায় টালমাটাল ভূমি স্বামীর সাথে তাল মিলাতে না পেরে বার কয়েক হোঁচট খায়।আলগোছে সামলে নেয় ইশতিয়াক।উৎকন্ঠা নিয়ে প্রশ্ন করে,
” ঠিক আছো?”

” আম্মার কিছু হয়েছে ইশতি? আমরা কি বাড়িতে যাচ্ছি?”

উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।হনহন করে হাঁটতে হাঁটতে ওরা তখন বাড়ির দোরগোড়ায়।সূচিদের বাড়ির সদর দরজার সীমানা হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকা বুড়ো খেজুর গাছের সামনে আসতেই কানে এলো সম্মলিত স্বরের চাপা চিৎকার।বাড়ির ভিতরে হুলস্থূল কান্ড ঘটে গেছে হয়তো।সবার কন্ঠ ছাপিয়ে কানে আসে আলেয়া বানুর গলার স্বর।বিলাপ করছে চিৎকার করে।এমনই এক গভীর রাতে ঘরের পিছনের সুপারি বাগান পেরিয়ে ইশতিয়াকের হাত ধরে ঘর ছেড়েছিল ভূমি।আজ আবার তার হাত ধরেই বাড়ি ফিরলো।উঠোনের মাঝে পা রাখতেই চোখে পড়লো মানুষের জটলা।আশপাশের বাড়ির ছেলে-বুড়ো-মেয়েরা ঘুম জড়ানো চোখে দাঁড়িয়ে আছে।ছোট-বড় মাথার আড়ালে নজর গলাতেই চোখ আঁটকে যায় ঘরের সিঁড়ির মাথায়।সাহিদা বেগম বসে আছেন ঠেস দিয়ে।মাথায় আঁচল নেই, আলুথালু চুলগুলো পিঠের এক কোণে ফেলে রাখা।নীরব,নিশ্চল,স্থির দৃষ্টি সামনের অন্ধকারে নিবদ্ধ।দৃষ্টিতে প্রাণের ছোঁয়া নেই। মাছের চোখের মতো ঘোলা,ঝাপসা সে চোখ।পেটে মোচড় দিয়ে ততোক্ষণে হতভম্ব ভাবটা কেটে গেছে ভূমির। ইশতিয়াকের হাত ছাড়িয়ে ভীড় ঠেলে একছুটে পৌঁছে গেল সিঁড়ির কাছে।ধপ করে বসে পড়লো মাটিতে।

” আম্মা,আম্মা! কী হয়েছে? তুমি এমন করছো কেন? আম্মা, ও আম্মা! আব্বা কই? ঘরে? কথা বলো না কেন?”

মেয়ের দু’হাতের আজলায় মুখ রেখে আগের মতোই চুপ করে বসে থাকেন সাহিদা বেগম।আদৌ তার কানে কিছু ঢুকছে কি না তা বোঝা মুশকিল।প্রাণটা কোনোমতে এই দুনিয়াতে ঝুলে আছে হয়তো।নড়ন-চড়ন নয়।ভূমির কাছে মনে হয় তার আম্মা এই রাতদুপুরে জ্যান্ত লাশ হয়ে গেছে।

” ও আম্মা!”

” ডাকিছ না বুবু।হারামজাদীরে চুপ কইরা থাকতে দে।এমন খারাপ ভাগ্য শত্রুরও না হোক।হতভাগীর কপালই খারাপ।নাইলে ওরে ছাইড়া সব যায় ক্যান? কতখানি আর বয়স হইছে ওর? এই বয়সে কেউ জামাই, পোলাপাইন হারায়?আল্লাহ এবার ওরেও নিয়া যাক।বুড়া বয়সে আর চোখে সয় না রে বুবু।”

গাক গাক করে একটানা কথা বলে থামে আলেয়া বানু।আঁচলের খুটে আরেকবার চোখ দুটো মুছে নেয়।মায়ের ভাবলেশহীন মুখের উপরে দৃষ্টি পেতে নির্বাক হয়ে বসে থাকে ভূমি।এরপরেও কথা আছে?

ইশতিয়াককে কাছাকাছি এসে দাঁড়াতে দেখেই মাথার আঁচলটা আরেকটু টেনে দিলো জয়া।বিকৃত ভেজা কন্ঠে প্রশ্ন করলো, ” কিছু কইবা ভাই?”

” ইভানকে একটু ধরুন ভাবি।ঘুমাচ্ছে ছেলেটা।ভূমির কাছে দিয়েন না এখন।”

” আচ্ছা।তুমি কই যাও?”

” হাসপাতালে।”

” রায়হানরা তো বাইরায়া গেছে।এই রাইতে ক্যামনে যাইবা?”

” বাজারের গ্যারেজে আমার পরিচিত সিএনজি আছে।ফোন করলেই বেরোবে।”

দু’ পা এগিয়েও আবার পিছিয়ে এলো ইশতিয়াক।ব্যস্ত কন্ঠে বললো, ” আপনার বোনকে একটু দেখে রাখবেন ভাবি।সিজারের বয়স তো আর বেশি না।সেলাইয়ের মাঝে নাকি এখনো ব্যাথা।”

” আচ্ছা,তুমি চিন্তা কইরো না।সাবধানে যাও।”
____________________________

নিঝুম রাতে রাস্তা খালিই ছিল।ভোলা সদর হাসপাতালে পৌঁছাতে খুব বেশি সময় লাগলো না ইশতিয়াকের।ব্যস্ত পায়ে লম্বা করিডর পেরিয়ে ইমার্জেন্সি ইউনিটের সামনে যেতেই হাসপাতালের গন্ধটা বেমক্কা জোরে ধাক্কা দিলো নাকের ভিতরে।হাসপাতাল থেকে একটা বিশ্রি গন্ধ পায় ও।একদম ধাতে সয় না ওটা।পৃথিবীতে এই একটা জায়গাকে ইশতিয়াক সবচেয়ে বেশি ভয় পায়।
করিডরের পশ্চিম দিকে পুরুষ ওয়ার্ড।লম্বা ওয়ার্ডের হাতের বাম পাশে যে সারি সারি বেডগুলো আছে সেখানেই চার নম্বর বেডের কাছাকাছি এসে থমকে দাঁড়ালো ইশতিয়াক।শ্বশুরের সাথে গলাগলির সম্পর্ক না থাকলেও মানুষটাকে ও বিশেষ ঘৃণা করে না।আগেও করতো না,এখনো করে না।সূচির ঘটনাটা ঘটার সময় কিছুটা অশ্রদ্ধাবোধ মনে এলেও সময়ের সাথে সাথে তা কেটে গেছে আরো আগেই।ছেলেটা এমনই।কারো উপরে কখনো খুব বেশি রাগ করে থাকতে পারে না।তাই হাসপাতালের একটুখানি একটা বেডে সাদা চাদরের উপরে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকা নির্জীব শ্বশুরকে দেখে বাস্তবিকই ওর কান্নাই পাচ্ছিলো।

” আসতে সমস্যা হয়নি তো ইশতিয়াক?”

” না।আব্বার অবস্থা এখন কেমন? ডাক্তার কী বললো? টেস্ট দিয়েছে কোনো?”

” সিটি স্ক্যান শেষ।ডাক্তার বললো একটু পরে আসবে।”

” এমনিতে বলেনি কিছু?”

” ব্রেন স্ট্রোকের আশঙ্কা করছে সবাই।আমিও এরকমই ভাবছি। হাত-পা নাড়তে পারে না।পুরো প্যারালাইজড।”

মমিন শেখের বেঁকে যাওয়া মুখের দিকে নজর বুলায় ইশতিয়াক।এই একবেলায়ই কেমন যেন দেখাচ্ছে লোকটাকে।চেহারা বিকৃত। মুখের মাঝে গেয়ো গেয়ো ভাবটা নেই।মনে হয় যেন গালের হাড়গুলো কেউ হাতুরি দিয়ে পিটিয়ে গর্ত করে দিয়েছে।আচমকা শ্বশুরের চেনা মুখটাই বড্ড বিভৎস ঠেকে ইশতিয়াকের চোখে।

” তুমি বেরিয়েছো কখন?”

” আপনি ফোন দেওয়ার পরেই রায়হান ভাই।ভূমিকে ঐ বাড়িতে রেখে সিএনজি নিয়ে চলে এলাম।”

” ভূমিরে বলছো কিছু?”

” না।আব্বা কথা বলতে পারে না?”

” উঁহু, মুখ দিয়ে উ আ শব্দ করে কিন্তু কথা আসে না।”

বেডের একপাশে বসে আলগোছে মমিন শেখের চুলে হাত বুলিয়ে দেয় ইশতিয়াক।ধরা গলায় প্রশ্ন করে, ” কীভাবে কী হলো?”

” আর বলো না।বিকাল থেকেই নাকি কাকার জ্বর। আমি ফার্মেসী থেকে আসার পরে কাকি বললো একটু মেপে দেখতে।মাপলাম, মাত্র একশ ডিগ্রি।খুব অসুস্থ ছিল না।আমার সামনেই কাকা উঠে বাথরুমে গেল,হাত-মুখ ধুয়ে দুধ-রুটি খেয়ে পিছনের বারান্দায় শুয়ে পড়লো।এরপরে আমি ঘরে চলে এলাম।পরের ঘটনা আর জানি না।আমাদের ঘুমাতে ঘুমাতে সাড়ে বারোটা,একটা বাজে। সাড়ে বারোটার দিকে মাত্র আমি আর চম্পা বিছানায় যাব ওমনি শুনি কাকির চিৎকার।সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে আমাদেরকে ডাকছে। দৌড়ে ঘরে যেয়ে দেখি খাটের কাছে কাকা মাটিতে পড়ে আছে।অলরেডি মুখ বেঁকে মুখ দিয়ে লালা বেরিয়ে গেছে।লতিফ ভাইকে ডেকে তাড়াতাড়ি করে ধরাধরি করে তুললাম।রতন কাকার পরিচিত গাড়ি আছে তাই তাকে ফোন করলাম।গাড়ি আসতে যতোক্ষণ,এরপরেই বেরিয়ে গেছি।”

” আল্লাহ রক্ষা করুক।তবুও ভাগ্য ভালো।শুনেছি স্ট্রোকের পরে পড়ে গেলে নাকি মানুষ বাঁচে না।সেখানে আব্বার তো এখনো দম আছে। বমি করেছিল?”

” সিটি স্ক্যানের জন্য নিয়ে যাওয়ার আগে করেছে।”

ডিউটি ডাক্তারটা কম বয়সী।হাতে,পায়ে,চেহারায় একদম ইয়ং।রতন পাটোয়ারীর ঠিক পছন্দ হয় না ডাক্তারকে।লিলির বাবার হাত টিপে দিয়ে বলে,
” এই চ্যাংড়া পোলায় কী চিকিৎসা করব?”

” দেখি তো বাবা চোখ খুলুন।আস্তে আস্তে,এই তো।জ্বিভটা দেখি একবার।হাতে কী হয়েছে?নাড়তে পারছেন না?পায়েরও একই অবস্থা? কাঁদছেন কেন? কাঁদবেন না।আরো অসুস্থ মানুষ সুস্থ হয়। সেখানে আপনার তো কিছুই হয়নি।হাতটা দেখি একটু।”

চট করে একটা ইনজেকশন পুশ করে ইশতিয়াকদের দিকে ফিরলো ডাক্তার।গম্ভীর গলায় বললো, ” পেশেন্টের বাড়ির লোক কে আছেন? আসুন আমার সাথে।”

রতন পাটোয়ারীর ইচ্ছা ছিল যাওয়ার।কিন্তু তাকে রেখে রায়হান আর ইশতিয়াকই এগিয়ে গেল আগে।একটু দূরে সরে উৎকন্ঠিত স্বরে প্রশ্ন করল ইশতিয়াক, ” এনিথিং সিরিয়াস স্যার?”

” ব্রেন স্ট্রোক।আপনাদের কাছ থেকে লুকিয়ে লাভ নেই।ব্যাপারটা সিরিয়াস।ওনার দুই সাইডই পুরোপুরি প্যারালাইজড।এর আগে মিনি স্ট্রোক করেছিলো?”

উত্তরটা রায়হান দেয়।মাথা নেড়ে বলে, ” কখনো না।”

” স্ট্রেঞ্জ! নরমালি এতো বড় স্ট্রোক প্রথমবারই হয় না।আগে মিনি স্ট্রোক হয়।ওনার ডায়াবেটিস,হাইপ্রেশার আছে?”

” না।কখনো কাকাকে আহামরি অসুস্থ হতে দেখিনি।”

” তাহলে প্রথমবারই এতো বড় একটা স্ট্রোক!উনি কি রিসেন্টলি কিছু নিয়ে খুব টেনশন করতেন?অনেক সময় মাত্রাতিরিক্ত টেনশন থেকে এরকম হয়।”

” টেনশনে ছিল।মাত্র বিশ দিন আগে ওনার ছোট মেয়ে মারা গেছে।তা নিয়েই কিছুটা টেনশন ছিল।”

ভীষণ চিন্তিত দেখায় ডাক্তারকে।কয়েক সেকেন্ড ভেবে বললো, ” উনি হয়তো এর আগে মিনি স্ট্রোক করেছে কিন্তু আপনারা বলতে পারেন না।”

” কোনো আলামত তো দেখিনি কখনো।”

” অনেক সময় এটা ঘুমের মাঝে হয়ে যায়।টের পাওয়া যায় না।স্ট্রোক হলে সবসময় যে মুখ বেঁকে যাবে,হাত-পা প্যারালাইজড হয়ে যাবে, তা আসলে না।কিছু মিনি স্ট্রোক আছে একদম বোঝা যায় না।
ঘুমের মাঝেই মৃদুভাবে হয়।ওনার হয়তো ওরকম কিছু হয়েছে কিন্তু আপনারা বুঝতে পারেননি।রোগীর দিকে খেয়াল রাখবেন।যদি দেখেন যে খিঁচুনি উঠছে তাহলে সাথে সাথে ইনফর্ম করবেন।আর কিছু টেস্ট দিচ্ছি করিয়ে ফেলুন।”

” স্যার আমার পনেরো নং বেডের পেশেন্টের জ্ঞান তো এখনো ফিরছে না।”– ডাক্তারের পিছনে এসে দাঁড়ানো লোকটার দিকে চেয়ে কয়েক সেকেন্ডের জন্য কপাল কুঁচকে গেল রায়হানের।লোকটা পরিচিত।কোথায় যেন দেখেছে কিন্তু মনে পড়ছে না।ভাবতে ভাবতেই লোকটার পিছু পিছু চলে গেল ডাক্তার।খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেও মনের অলিগলি থেকে কিছুতেই উঁকি দিলো না প্রবীণ লোকটা।

পনেরো নং বেডের কাছে এসে থমকে দাঁড়ালো ডাক্তার।জোয়ান মর্দ ছেলেটা মিশে আছে একদম সাদা চাদরের সাথে।শরীরের উজ্জ্বল ক্ষতগুলো ঢাকা ব্যান্ডেজে।নাকের উপরে লাগানো অক্সিজেন মাস্কের বাইরেও চেহারাটা বেশ চোখে পড়ে।সচরাচর এমন পুরুষালি সৌন্দর্য চোখে পড়ে না।বেডের কাছাকাছি আসতেই কম বয়সী বউটা উঠে দাঁড়িয়ে একপাশে চেপে গেল।তাকে লক্ষ্য করেই প্রবীণ লোকটা নরম গলায় আদেশ ছুঁড়লেন, ” বুবুর স্যালাইনটা শেষ হয়েছে নাকি তা একবার দেখে এসো তো মা।আমি ফয়সালের কাছে আছি।”

” আচ্ছা মামা।”– তড়িৎ গতিতে মহিলা ওয়ার্ডের দিকে ছুটে গেল হুমায়রা।করিডরের পূর্ব দিকেই মহিলা ওয়ার্ড।মিনিটের মাঝেই সে পথে অদৃশ্য হয়ে গেল মেয়েটা।

” স্যালাইনটা চলুক।শেষ হলে আমাকে ডাকবেন।এছাড়া এখন আর কিছুর দরকার নেই।”

” এরকমই চলবে স্যার?”

” সকাল পর্যন্ত দেখুন।অবস্থার উন্নতি না হলে প্রয়োজনে বরিশাল রেফার করতে হবে।”

নার্সের ডাকে আরেক বেডের দিকে ডাক্তার চলে গেলে করুণ চোখে ভাগ্নের দিকে চুপচাপ চেয়ে রইলো রমিজ শিকদার।আদুরে ভাগ্নের দিকে চেয়ে ছলছলিয়ে আসে তার চোখ।এই মাত্র কয়েকদিন আগেই বোনের সাথে সব আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিঁড়ে ফেলা রমিজ শিকদারই আজ মাঝ রাত্রে ভাগ্নের মরন খবর শুনে ছুটে এসেছেন হাসপাতালে।ভাগ্যিস নাইট গার্ড ছেলেটাকে রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়ে থাকতে দেখেছিলো।নয়তো কী হতো আজ?

” আসসালামু আলাইকুম কাকা।এটা আমাদের ফয়সাল না?”

সামনে দাঁড়ানো দুটো ছেলেকে ঠিক চিনলেন না রমিজ শিকদার।তাই সরল গলায় প্রশ্ন করলেন,
” তোমরা চেনো ওকে?”

” হ্যাঁ। আমরা উদয়পুরের বাসিন্দা।ভালো ভাবেই চিনি ওকে।কাজী বাড়ির ছোট ছেলেকে কে না চিনে? কী হয়েছে ওর?”

” কোন অমানুষ যেন কুপিয়ে খুন করার চেষ্টা করেছে।দেখেছো অবস্থা কী হয়েছে? এক হাতের কড়ে আঙুলের মাথাটা পড়েই গেছে।”

” জ্ঞান ফিরছে না এখনো?”

” না।মনে হয় এখানে রাখবে না।বরিশাল ছাড়া গতি নেই।”

” আহারে!! ওনার মা আসে নাই?”

বোনের কথা বলার সময় গলা ধরে আসে রমিজ শিকদারের।ধরা গলায় বলেন, ” সে আরেক ট্রাজেডি।ছেলের এই অবস্থা কি মায়ের প্রাণে সয়? অসুস্থ হয়ে গেছে।প্রেশার কমে টমে এক অবস্থা।সে এখন আরেক রোগী।মহিলা ইউনিটে ভর্তি।স্যালাইন চলছে।”

ছেলে দুটোর প্রশ্ন যেন থামেই না।রমিজ শিকদার থামতেই আবার প্রশ্ন ভেসে এলো ওদের দিক থেকে।
“পুলিশ কেস হয়েছে? আপনারা কাউকে সন্দেহ করেন?”

” সন্দেহ! “—এক মুহূর্ত ভাবেন রমিজ শিকদার।তারপর বেশ ভাবুকের মতো বলেন, ” একটা পারিবারিক দ্বন্দ্ব অবশ্য আছে।কেস করলে হয়তো ওদের নামেই হবে।ফয়সালের শ্বশুরকে চেনো? বুবু হয়তো ওনার নামেই কেস করবে।অবশ্য ফয়সালের জ্ঞান না ফেরা অবধি কিছুই বলা যায় না।আমি এসবের কিছুই জানি না বাবা।”

আর কোনো তথ্য সংগ্রহের দরকার নেই।তাই রমিজ শিকদারের সামনে থেকে মানে মানে কেটে পড়লো রায়হান ও ইশতিয়াক।চার নম্বর বেডের কাছাকাছি পৌঁছানোর আগে প্রশ্নটা আর না করে থাকতে পারলো না ইশতিয়াক।

” ব্যাপারটা কী হলো রায়হান ভাই? অঘটন কি আর পিছু ছাড়বে না?”

” অঘটন বলছো কেন? বলো পাপের শাস্তি।কিন্তু একটা জিনিস খেয়াল করলে? আল্লাহ যা করে তা ভালোর জন্যেই করে।”

” কীরকম?”

” আজকে যদি কাকা স্ট্রোক না করতো তাহলে কালকেই তার কোমড়ে দড়ি বেঁধে থানায় ছুটতো পুলিশ।কুপিয়ে হত্যা চেষ্টার সন্দেহভাজন হিসেবে কাকা ছাড়া উপযুক্ত আর কে আছে বলো তো?মামলা আসলে তো তার নামেই আসতো।শেষে বুড়ো বয়সে স্রেফ সন্দেহের বশে একটা বিশ্রি ব্যাপার ঘটে যেতো।কাকা তো সত্যি আর কুপিয়ে মারতে যায়নি অমানুষটাকে।মারার ক্ষমতা কোথায় তার?একটা জোয়ান মর্দ ছেলের সাথে এরকম অসুস্থ একটা বুড়ো মানুষ পারে?কিন্তু এ কথা কি আর পুলিশ মানবে? ওদের সবকিছুতে বাড়াবাড়ি আর সন্দেহ।”

রায়হানের সাথে একমত না হয়ে পারে না ইশতিয়াক।সাদা চাদরের উপরে পড়ে থাকা মমিন শেখের দিকে চেয়ে বিশ্বাসটা আরো গাঢ় হয়,আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যেই করেন।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here