শুকতারা (দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ) পর্ব-১০

0
184

#শুকতারা ( দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
#পর্ব-১০
#হালিমা রহমান

সেদিন মায়ের সাথে ফয়সালের খুব একটা বাড়াবাড়ি রকমের ঝামেলা হয়ে গেল।ও বাড়ির টুটুলের মায়ের সামনে ক্রোধের যে নগ্ন প্রতিচ্ছবি মেলে ধরেছিল ছেলটা তাতে বেশ লজ্জাই পেয়েছেন রোমেলা বানু।ফয়সালের অদ্ভুত আচরণের বিস্ময় কাটিয়ে পুরোনো সইয়ের ঠোঁট যখন চাপা হাসিতে ভরে উঠলো, তখন মনে মনে মাটি দুই ভাগ হওয়ার জন্যে প্রার্থনা করেছেন তিনি। সেদিন মাটি দু’ভাগ হলে হয়তো সত্যিই মুখ বাঁচাতে টুপ করে লুকিয়ে পড়তেন।
শত হলেও মায়ের মন, শোকে আচ্ছন্ন আধ-পাগলা ছেলেকে শাসন করার ইচ্ছা জাগলো না।একটু প্রশ্রয় দিতে মন চাইলো।তাই ছেলের মন-মানসিকতা পুরোদস্তুর হজম করে জোর করে হেসে শান্ত করলেন ক্ষ্যাপা ষাঁড়কে।অপ্রস্তুত হেসে ভীষণ আদুরে গলায় বললেন, ” রাগ করে না বাপ।আমি কি জানি তুই বাসি-টাসি খাইতে পারবি না? জানলে কি আর দিতাম? আমি এহন রাঁইন্ধা দিতাছি।রাইতে কী খাইবা? মাছ নাকি গোশত?”

বুনো ছেলে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে অমার্জনীয় এক অপরাধ করলো।ভাতের থালায় সজোরে এক লাথি মেরে আঙুল উঁচিয়ে মাকে শাসায়,
” ঐ জানোয়ার মেয়েটা থাকতে রান্না-বান্না যেমন হতো এখনো যেন তেমনই হয়।নইলে খুব খারাপ হবে।”

ফয়সাল বেরিয়ে যেতেই শোনা গেল টুটুলের মায়ের গা জ্বালানি কন্ঠ,
” কিরে বউয়ের শোকে পোলা দেহি পাগল হয়া যাইতাছে।পাবনায় ভর্তি করাইতে হইব নাকি?”

বিদ্রুপটুকু গায়ে বাজলেও দিন কয়েক বেশ চুপচাপ রইলেন রোমেলা বানু।ছেলে যাই করে তাই চুপ মেরে দেখেন।ব্যাঁকা-ত্যাড়া কথা মুখ টিপে শুনে নেন।সবকিছুতে কিছুটা আহ্লাদি প্রশ্রয়।ফয়সালের মায়ের মনে একটাই ইচ্ছে,একটু চোটপাট করে ছেলে যদি ভালো থাকে তো থাকুক।নয়া শোকের ধাক্কা এতো তাড়াতাড়ি প্রাণে সইবে না।শত হলেও সেই অমানুষ মেয়েটা ঘরের বউ ছিল।একসাথে এই ঘরেই ছিল কয়েক মাস।স্বয়ং রোমেলা বানুই ভুলতে পারেন না সূচিকে।এখনো ঠিক চোখে ভাসে।মনে হয় যেন সূচি এখনো এখানেই আছে।রান্নাঘরে চুপচাপ বসে রান্না করছে।মাঝে কয়েকটা দিন তো ঘুম ভেঙে ভুল করে ঐ মেয়েটাকেই ডাকতেন।শেষ রাতে গরু দুটো ক্ষুধায় রাক্ষস হয়ে যখন বাড়ি কাঁপিয়ে আওয়াজ তুলতো, তখন ঘুম ঘুম চটকা ভেঙে যেত।বিরক্তিতে আচ্ছন্ন গলায় হাঁক ছাড়তেন, ” সূচি,গরুরে খাওন দাও।এহনো উঠো নাই?”

পরমুহূর্তেই মনে পড়তো মেয়েটা নেই।এলোমেলো পায়ে রোমেলা বানু নিজে উঠেই খাবার দিতেন।গামলায় ভুসি গোলাতে গোলাতে ভাবুক হয়ে পড়তেন।যেই মেয়েটাকে তিনি কখনো ভালো চোখে দেখেননি সেই মেয়েটাই এখনো মগজে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।তারই এই অবস্থা তাহলে ছেলেটার দশা কী? চার মাস একসাথে থাকার পরে এখন সেই একই ঘরে ছেলেটা যখন একা থাকে তখন কেমন লাগে তার? এদিকে তো আবার পোয়া বারো।বউয়ের আত্মহত্যার দায় ফয়সালের ঘাড়েই।এই দায় ভূতের মতো ঘাড়ে চেপে থাকার পরেও ছেলেটা বেঁচে আছে কী করে? তার দম বন্ধ হয়ে আসে না?
ছেলের বন্ধ দরজার দিকে চেয়ে সহসা দু-চোখ ছলছলিয়ে আসে রোমেলা বানুর।মনের আনাচে-কানাচে থেকে সাবান ফেনার মতো গলগলিয়ে উতলে আসে ছেলের প্রতি মায়া,মমতা,ভালোবাসা আর খুব কোমল করুণা।একটা সিদ্ধান্ত নেন মনে মনে। ছেলেটাকে মন খুলে বাঁচতে দেবেন।তার এই আদরের ধনের চেয়ে হতভাগা বোধহয় পৃথিবীতে আর কেউ নেই।মাথার উপরে বাপ-ভাই নেই।সাহায্য করার মতো আত্মীয় নেই।থাকার মধ্যে এক আছেন তিনি।এখন থেকে তিনিই পাশে দাঁড়াবেন ছেলের।ছায়া হবেন,বন্ধু হবেন,দিনশেষে মা হবেন।সব পাগলামি সহ্য করবেন।মায়েরাই তো সব সহ্য করে।

কিন্তু এ তো গেল একদিকের কথা।মা-ছেলের জটিল সম্পর্কে মায়ের ভাবনাই সব নয়, ইচ্ছাও সব নয়।অথবা শেষরাতের আধো আলো-আঁধারিতে মনের যে কোমল ভাব থাকে সারাদিনে তা বজায় থাকে না।জন্মগত পাগলকে সহ্য করা যায় কিন্তু ভবের পাগলকে কতটুকু সহ্য হয়? ফয়সাল হয়ে গেছে সেয়ানা।খামারে যাওয়ার নাম-গন্ধ নেই,বাইরে যাওয়ার বালাই নেই,সারাদিন শুধু ঘরেই পড়ে থাকে।প্রথমদিকে বেশ খুশিই হয়েছিলেন রোমেলা বানু।এমনিতেও ইদানিং ছেলেকে খুব একটা বাইরে যেতে দিতে মন চাইতো না।কেমন যেন ভয় জাগতো মনে।ফয়সালের অপরাধের কথা এখনো চায়ের কাপের গরম খবর।মমিন শেখের বন্ধু-বান্ধবের তো আর অভাব নেই।বাইরে বেরোলেই কেউ হয়তো একটা বাজে কথা বলে ফেলবে।শত্রু চারদিকে ভরা।কে জানে আক্রমণটা কোনদিক থেকে আসে।একটা চাপা ভয়ে দিন-রাত এক হয়ে আসে।তাই ঘরবন্দী ছেলের পাগলামি আরো বেশি বেশি সহ্য করতেন তিনি।কিন্তু ছাড় পেয়ে পেয়ে ছেলেটা মনে হচ্ছে বিগড়ে যাচ্ছে। ফয়সালটা যেন একটু বেশিই বেয়াদব হয়ে উঠছে দিন দিন।দিনের অর্ধেক সময় ঘুমোয়।ঘুম থেকে উঠে দুটো রাঙা চোখ নিয়ে।উঠে চোখ-মুখে কোনমতে পানি ছিটায় শুধু।তারপরেই শুরু হয় চোটপাট।এটা হয়নি কেন,ওটা করোনি কেন,ঘরটা ময়লা কেন,উঠোনটা নোংরা কেন,রান্না হয়নি কেন,গরু দুটো ক্ষুধায় ডাকছে কেন–হাবিজাবি হাজারটা অভিযোগ।ছেলে কি শুধু অভিযোগই করে? না, সে করে বাড়াবাড়ি।মায়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দাঁত খিচায়,চোখ রাঙায়,আঙুল তুলে যা তা বলে।যখন বেশি রাগ উঠে তখন পায়ের কাছে যা পায় তাতেই কষিয়ে এক লাথি বসায়।কখনো খাটে,কখনো সোফার পায়ায়,কখনো ভাতের থালে,কখনো দেওয়ালে আবার কখনো বা মায়ের পানদানিতে।সহ্য করব বলা সহজ হলেও করাটা কঠিন।রোমেলা বানুর কাজ করার অভ্যাস নেই সেই হুমায়রার আমল থেকে।বড় ছেলেকে আলাদা করে দেওয়ার পরেও কাজ করেছেন তবে তা টুকটাক।এখনকার মতো এতো চাপ ছিল না,চোখ রাঙানোর মতো মানুষ ছিল না।সংসারের ছোট-বড় কাজগুলো ঘাড়ে এসে পড়তেই মনটাও কেমন খিঁচড়ে গেল। প্রথম কয়েকদিন নিজের ছেলের সাথে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন বটে তবে দিন কয়েক গড়াতেই পরিবর্তনে চিড় ধরলো।ছেলেটা দিন দিন চূড়ান্ত পর্যায়ের অসহ্য হয়ে উঠছে।সবকিছুতে তার খবরদারি।মায়ের দুঃখ বোঝার নাম-গন্ধ নেই খালি গলাবাজি।দিন দিন অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেন রোমেলা বানু।একদিকে সূচির সব কাজ আরেকদিকে ছেলের যন্ত্রণা– মানিয়ে নেওয়ার যে চেষ্টা চলছিলো তার আড়ালে আবডালে ফুঁসে উঠতো তার চির কর্তৃত্ববাদী আদিপত্যবাদি মন।এ তার স্বভাব নয়,এ তার এতো বছরের অস্তিত্ব। মাঝে মাঝে ছেলের আচরণে শরীরের সব রক্ত একজোট হয়ে মাথায় উঠে যেত। ঠাস ঠাস করে চড় মেরে ফয়সালের সদ্য চোয়াল ভাঙা, অল্প অল্প দাড়ি গজানো ফর্সা গাল দুটো ফাটিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করতো।বহু কষ্টে ইচ্ছাকে খুন করেছেন তিনি।নিজেকে সান্ত্বনা দিয়েছেন,শোক সামলে ছেলে ঠিক আগের মতো হবে।আর কয়েকটা দিন মাত্র।সবুর তো করতেই হবে।মা হয়ে সহ্য না করলে আর কে করবে?

সেদিন ছিল মঙ্গলবার।রোমেলা বানুর ধৈর্য ফুরানোর দিবস।আজকাল খুব গরম পড়েছে এদিকটায়।বৈশাখী হাওয়ার অস্তিত্ব নেই। পাতাগুলো অবধি নড়ে চড়ে না।ঠা ঠা রোদ্দুরে বিস্তীর্ণ আকাশটা অবধি সন্ত্রস্ত থাকে সবসময়। সূচির অন্তর্ধানের পর থেকে ঘরের চাদরগুলো ধোয়া হয়নি।চাদরের রঙের উপর কয়েক পোচ ময়লার ছাপ পড়তেই টনক নড়লো রোমেলা বানুর।না,এবার একটু ধোয়া দরকার।রান্নাটা চুলায় চাপিয়ে বেলা বারোটা নাগাদ এক বালতি কাপড় ধুয়ে মেলে দিচ্ছিলেন উঠোনের টানটান দড়িতে,অমনি কাজী বাড়ির সদর দরজা দিয়ে অলক্ষুণে ভূতের মতো এক ব্যাগ কাঁচা বাজার নিয়ে বাড়ি ঢুকলো হুমায়রা।নেকাব খুলতেই নজরে এলো তার থমথমে মুখ,ফোলা ফোলা দুটো চোখ।হয়তো আসার ইচ্ছা ছিল না,স্বামীর জোরজবরদস্তিতেই এসেছে।
হুমায়রাকে কোনোকালেই সহ্য হয় না রোমেলা বানুর।সূচির দুর্ঘটনার পর থেকে এতোদিন বাড়ি ছিল না বাড়ির বড় বউ।এতে আরো চটে আছেন ঘরের বউয়ের উপর।বিপদে-আপদে যদি পাশেই না পাওয়া যায় তো এসব জ্ঞান-বুদ্ধিহীন স্বার্থপর বউয়ের দরকার কী? হুমায়রাকে দেখতেই নাকের পাটা ফুলে উঠলো।ধারালো জ্বিভটা টানটান হয়ে উঠলো উঠোনে টাঙানো দড়ির মতো।

” আইছো ক্যা এহন? বা* ফালাইতে?আর ফালান লাগব না।যট্টুক ফালানের হেট্টুক আমরা মা-পোলাই ফালাইছি।যাও তোমার মার আচঁলের তলে যায়া বয়া থাকো।আর ফোন কইরা বিদেশের বউ ভাউড়ারে কয়ো।হেইডা তো আর মাইনষের জন্মের না আর আমার…

” আম্মা সাবধান।এখনো আপনের মুখে লাগাম না আসলে আর কবে আসব? মাইনষের লজ্জা বলতেও একটা শব্দ আছে।কাজী বাড়িতে আইসা আমি এই শব্দটার দেখাই পাইলাম না।কোন পাপের জেরে এই বাড়িতেই আমার ভাগ্য পড়লো?এরচেয়ে যাযাবর ফ্যামিলি ভালো।”

ভোজভাজির মতো কী একটা যেন হয়ে গেল।রোমেলা বানুর মুখে কথা জোগায় না।যেই মেয়ে কখনো চোখ তুলে কথা বলে না সে আজ এতো কথা বললো! আশ্চর্য, এই সেই হুমায়রা!
মেয়েটার বজ্রকন্ঠ,প্রত্যেকটা কথা ছুরির মতো ধারালো।বুলেটের মতো কথাগুলো একে একে উগড়ে দিয়ে মুখ ঝামটা দিয়ে ঘরে চলে গেল হুমায়রা।রোমেলা বানু ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন।কিছুক্ষণ পরে দেখা মিললো তার সবসময়ের চিরচেনা সেই চিনচিনে রাগ।কপালের রগগুলো ফুলে উঠলো।নগ্ন আকাশের নিচে তাওয়া গরম তাপের স্পর্শে অদৃশ্য আগুন জ্বলে উঠলো সারা শরীরে।রাগ, ক্ষোভ আর হতাশার সংমিশ্রণ। হুমায়রা সামনে দাঁড়িয়ে কথা শুনিয়ে গেছে,এর চেয়ে বড় হতাশা আর কী হতে পারে? খুব একটা কথা ফুটলো না মুখে।শুধু হতভম্ব সুরে বিস্মিত গলায় বিরবির করলেন,
” বা*র বাচ্চার কত সাহস!”

কাজী বাড়ির কর্ত্রীর মেজাজটা তার পর থেকেই খারাপ।কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছেন না।কেউ কথা শুনছে না।তিনি কথা বলবেন,সবাই চুপ থাকবে।মাথা নিচু করে শুনবে,ভালো না লাগলেও মেনে নেবে।এই তো হওয়ার কথা,এই তো হয়ে এসেছে এতোকাল।স্বামীর আমল থেকে এই রেওয়াজ শুরু।আজ হঠাৎ পরিবর্তনে মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে তার।কিছুই মাথায় ঢুকছে না।পরোক্ষ রাগটা কোথাও না কোথাও সেই সূচির উপরেই বর্তায়।অপয়াটা মরার পরে সবার সাহস বাড়িয়ে দিয়ে গেছে।
আকাশ-পাতাল ভাবনায় থই পান না রোমেলা বানু।কর্তৃত্বে ঘা পড়েছে বলেই হয়তো গোটা মন-প্রাণ থমকে আসে ক্ষণে ক্ষণে।হাতে কাজ উঠে না,রান্নায়ও মনোযোগটা আর এলো না।মনোযোগের মা- মাসি খুন করে এক পাতিল ভাত চুলার উপরে চূড়ান্ত নরম করার পরে ও বেগুনের তরকারিতে একমুঠো ডাল ছেড়ে দিয়েই বিরক্তিতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেন।না,আজ আর কাজ করা সম্ভব না।সবার এতো সাহস বাড়ার কারণ না জানা অবধি হাতে শক্তি আসবে না।

বিপত্তি বাঁধলো বেলা তিনটায়।নিত্যদিনের মতো ঘুম থেকে উঠে সবে ভাত খেতে বসেছে ফয়সাল।রান্নাঘরের এক কোণে ঢেকে রাখা থালা সামনে আনতেই চড়চড় করে মেজাজটা চটে গেল।এমনিতেই আজকাল বাবুর মেজাজের হদিশ পাওয়া যায় না।থালা ভর্তি নরম আঠালো ভাত আর পাতে ডাল-বেগুনের জগা খিচুরি দেখেই কপাল কুঁচকে গেল।কালো মেঘের মতো গর্জন করে উঠলো রান্নাঘরে বসেই,
” আম্মা,কী এগুলা? মানুষের মুখে যাওয়ার যোগ্য এরা? তোমার কি মনে হয় না যে আমি একটা মানুষ? এগুলা খাওয়ার যোগ্য? ছিঃ!”

সবসময়ের মতো রান্নাঘর থেকে ভেসে এলো থালা-বাটি ছুঁড়ে ফেলার ঝনঝনে শব্দ।তবে আজ আর ছেলের হম্বিতম্বিতে পড়িমরি করে ছুটলেন না রোমেলা বানু।তিনিও অভুক্ত।রাগে ফুটছে মগজ।শান্ত ভঙ্গিতে খাটের তলা থেকে কাজী বাড়ির বহু পুরোনো চোর মারার নাতিদীর্ঘ লাঠিটা বের করলেন।এ তার শ্বশুরের লাঠি,তখন চোরের উৎপাত বেশি ছিল বলে এর যত্ন ছিল।এখন আর খুব একটা ব্যবহার হয় না।তবে আজ হবে।আজ ফয়সাল বাড়াবাড়ি না করলেও পারতো।

রান্নাঘরের দরজার দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়ে ফুঁসছিল ফয়সাল।আক্রমণটা এলো পিছন থেকে।শরীরের সব শক্তি খাটিয়ে ছেলের পিঠে ধাম করে লাঠিটা বসিয়ে দিলেন রোমেলা বানু।এরপরে বার কয়েক ঝড়ের গতিতে উপরে নিচে উঠলো তার লাঠি,সঙ্গে ছুটলো তার জিহ্বা।

” বা** বাচ্চা,তোর এতো সাহস? আমার উপরে চোখ তুলোছ? কে তুই? তোর এতো সাহস কে দিল? বউয়ের ভেড়া জানোয়ার, এতোই যহন দরদ তহন বউরে মারলি ক্যান? আমি কইছিলাম মারতে? আমি কইছিলাম আরেক মাইয়ারে খুন করতে? এহন আবার আমার উপরে চোটপাট করোছ! এইডা হয় নাই ক্যা,ঐডা হয় নাই ক্যা,রান্ধা ভালো হয় নাই ক্যা– এতো চাহিদা তোর থাকব ক্যান? জমিদারের বাচ্চা,আমি কি তোর চাকর লাগি?খালি কয়দিন কিছু কই নাই দেইক্ষা মাথায় উইঠা গেছোছ না? ভাবছোছ আমার হাতের জোর কইম্মা গেছে।কথা কছ না ক্যান এহন? ঐ আবার চায়া আছোছ যে? চোখ রাঙাছ কারে? গলায় পাড়া দিয়া কইলজাডা বাইর কইরা লামু।কু** বাচ্চা, তোর মতো পোলারে জবাই দিয়া দুইদিন শোক পালন করা ভালো।বা*-ছা*র জাত কতগুলি।”

ফয়সালের মুখ দিয়ে কথা ফুটে না।বড় হওয়ার পরে মার খেয়েছে সে।এসএসসির সময়েও একবার মেরেছিল মা।কিন্তু তখনকার ফয়সাল আর আজকের ফয়সালের মাঝে আকাশ-পাতাল তফাৎ। আগের ফয়সাল হলে হয়তো চুপচাপ মেনে নিয়ে মাটির দিকে চেয়ে থাকতো।কিন্তু আজ আর পারলো না।মায়ের চেয়ে দ্বিগুণ গলা চড়িয়ে প্রশ্ন করলো, ” তুমি আমাকে মারলে?”

” না, আদর করছি।ত্যাজ্য করুম তোরে।তোগোরে সয়-সম্পত্তি দেওয়ার চেয়ে এতিমখানায় দান করা ভালো।যা,আমার চোখের সামনে থেকা বাইরা।অমানুষ, তোরে যেন আমার বাড়ির ত্রিসীমানায় আর না দেহি।খোদার কসম ফয়সাল,বাড়িতে ঢুকার চেষ্টা করলে তোরে আমি পায়ের তলায় ফালায়া জবাই দিমু।”

” তোমার বাড়ির কপালে আগুন আর তোমার সংসারের কপালে ঝাড়ু।এর চেয়ে জঙ্গল ভালো।আমিও এই অপেক্ষাতেই ছিলাম।আমার মরা মুখও যেন আল্লাহ তোমারে আর না দেখায়।”

রান্নাঘরের দেওয়ালে সজোরে এক লাথি বসিয়ে বেরিয়ে গেছে ফয়সাল।পিছনে ফিরেও তাকায়নি,রোমেলা বানুও আর ছেলেকে ডাকেননি।শুধু রাগের মাথায় পিছন থেকে চেঁচিয়ে বলেছেন,
” শুনছি মায়ের দোয়া আল্লাহ সাথে সাথে কবুল করে।আমি খাস দিলে দোয়া করতাছি, আল্লাহ যেন তোরে আর এই বাড়িতে ফিরায়া না আনে।পরেরবার আমি যেন তোর মরা খবর পাই।রাস্তায় এতো মানুষ পইড়া মরে, তুই মরতে পারোছ না?”

সবকিছু ছাপিয়ে ছেলের বেয়াদবিটাই প্রাণে বেজেছে রোমেলা বানুর।রাগের বশেই হয়তো সেদিন এই ভয়ংকর দোয়া করেছিলেন তিনি।বিন্দুমাত্র জ্ঞান থাকলেও এসব বলতেন না নিজ মুখে। এখন যে ফাঁকা ঘরে আফসোস হয় না তা নয়।মুখে খাবার রোচে না।রান্নাঘরে হাঁড়ি চড়ে না।তিনি যে হেঁটে-চলে বেঁচে আছেন তাই এক বিরাট আশ্চর্যের বিষয়।আজ চারদিন যাবৎ ফয়সাল বাড়ি ফিরছে না!
____________________

মমিন শেখের মতি-গতি বোঝা যায় না।সূচিকে হারানোর পরে বেশ কিছুদিন ঘর ছাড়েননি তিনি।একপ্রকারে ঘরবন্দী ছিলেন।টিনের ঘরে বসে বসে সাহিদা বেগমের বুক ফাটা আর্তনাদ শুনতেন।রাতের পর রাত ঘুম হারিয়ে চুপচাপ বিছানায় পড়ে থাকতেন।চোখের নিচের গাঢ় এক আঙুল কালি আর ভাঙা চোয়ালের নরম-চরম ক্লান্ত মুখখানি দেখে মনে হতো এই কয়েকদিনে তার বয়স তিনগুণ বেড়ে গেছে।ইদানিং এই দৃশ্য চোখে পড়ে না।অবশ্য চেহারা সেই আগের মতোই আছে।তবে আজকাল তাকে আর ঘরেই পাওয়া যায় না। সকালে কোনোমতে খেয়ে-দেয়ে বেরিয়ে পড়েন।দুপুরের তিনটে-চারটের সময় আবার বাড়ি আসেন।খাওয়ার পরে দশ মিনিট জিরিয়ে আবার চম্পট।ঘরের চৌকাঠে তাকে আবার পাওয়া যায় একেবারে সাড়ে দশটা বা এগারোটার দিকে। তার এই নতুন রুটিনে বাড়ির সবার চোখ টাটায়।রায়হান অবাক হয়।তার ফার্মেসী বাজারেই।মমিন শেখকে সারাদিন বাজারে দেখা যায় না।তাহলে ঘন্টার ঘর ঘন্টা কোথায় উধাও হয় লোকটা?
জয়া,চম্পা,মনি অন্দরমহলে হানা দেয়।ভালো-মন্দ দু-চারটে কথা বলার পর সাহিদা বেগমকে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করে, ” কই যায় কাকায়? ভূমির বাসায় থাকে নাকি?”

” জানি না।”

” আপনে জিগান নাই কাকি?”

” না।”
সাহিদা বেগমের সহজ উত্তর।কিছুক্ষণ চুপ থাকার পরে নিজেকে শুনিয়ে বলেন, ” মইরা যাক।আমার কী?দুইটা মাইয়ারে কাছ ছাড়া করার পরেও আমরা বাঁইচ্চা আছি!আমগো মতো অপদার্থ বাপ-মা দুনিয়াতে আর নাই।”

গম্ভীর হয়ে উঠে ওরা।না,দিন দিন এই সংসারটা কেমন যেন সৃষ্টিছাড়া অশান্তির আখড়া হয়ে যাচ্ছে।

মমিন শেখকে আজ বিকালের দিকে দেখা গেল রতন পাটোয়ারীর বাড়ির সামনের রাস্তায়।অন্যমনষ্ক হয়ে হাঁটছিলেন কাঁচা রাস্তার দিকে চেয়ে।দু-কাঁধের উপরে বিছানো দু’বছরের পুরোনো ফুটো গামছাটা।বন্ধুকে পিছন থেকে দেখেই চিনলেন রতন পাটোয়ারী। গলা উঁচিয়ে ডাকলেন হাত কয়েক দূর থেকে,
” এই মমিন,মমিন।যাস কই?”

পিছু ফিরে আলতো হাসলেন মমিন শেখ।কপালের কুঁচকানো চামড়া টানটান করে মেললেন।সবটাই বন্ধুর নজর থেকে নিজের চিন্তাক্লিষ্ট মুখ লুকানোর আয়োজন।রতন পাটোয়ারী কাছাকাছি আসতেই নরম গলায় উত্তর দিলেন, ” এমনেই একটু হাঁটতাছি।যাই না কোথাও।”

” তোরে তো ইদানিং দেহাই যায় না।”

কথা ঘুরিয়ে ফেলেন মমিন শেখ।বন্ধুর দিকে চেয়ে বলেন, ” তোরেও তো দেখি না।ব্যস্ত থাকোছ নাকি?”

” হ,তা একটু ব্যস্তই।রত্নার লেগা একটা বিয়ার সম্বন্ধ আইছে।ছেলে প্রবাসী, নাম রাতুল।আমগো ভোলার না,বাইরের ডিস্ট্রিক্ট।বাপ-মায়ের এক পোলা।ভালোই ট্যাকা-পয়সা আছে,বংশও বনেদি।আমি যেমন চাই তেমন।খুব আগ্রহ ওগো।রত্না আর ওর মায়ের লগে আলাপ কইরা মনে হইলো ওগোও সায় আছে এইখানে।তাই একটু একটু কইরা আগাইতাছি।এর লেগাই একটু ব্যস্ত।”

” বিয়ার দিন-তারিখ ঠিক হইছে?”

” আরে না।হইলে তুই জানতি না?”

” কবেকার রত্না, না রে? একটুখানি আছিলো।দেখতে দেখতে কেমন বড় হয়া গেল! এহন পরের ঘরেও যাইব গা।ভাবতেই আমার ক্যামন যেন খালি খালি লাগে। আমার সূচিটাও তো এমন আছিলো।পাষাণের মতো কত অল্প বয়সে পর কইরা দিছিলাম! সূচি না মরলে আমি জানতেও পারতাম না আমি ওর প্রতি এতো দুর্বল।”

প্রসঙ্গের মাঝে সূচি চলে আসতেই উশখুশ করেন রতন পাটোয়ারী।বন্ধুর মনটা খারাপ হয়ে যাবে আবার।দরকার কী? সহানুভূতির সুরে বলেন, ” বাদ দে এইসব।এহন এগুলা বললে হইব?খালি দোয়া কর মাইয়াটার লেগা।এর বাইরে আর কোনো উপায় নাই।”

” ঐডাই। দেখতে দেখতে ক্যামনে বিশ দিন গেল গা!

সহসা একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করলেন মমিন শেখ। বেশ ভাবুকের মতো বললেন, ” তোর না একটা ধার দাও আছিলো? ঘরে আছে এহন?”

” দাও! কী করবি দাও দিয়া?”

” ডাব জমছে অনেকগুলি।ঐগুলি কাটুম।ডাবের পানি খামু।”

” তোরটা দিয়া হইব না?”

” না,আমারটায় ধার নাই।দে তো আইন্না ভাই। বাসায় যামু,শরীরটা খারাপ লাগতাছে। শুইয়া ঘুমামু কতক্ষণ।”

” বাড়িতে আইসা বয়।”

” না,একেবারে বাড়িতেই যাই।ভাল্লাগতাছে না।”

বাড়ি থেকে এক হাতের চেয়ে একটু ছোট ধারালো দা’টা এনে বন্ধুর হাতে তুলে দেওয়ার সময় আঁতকে উঠলেন রতন পাটোয়ারী। মমিন শেখের দু’পা ঠকঠক করে কাঁপছে।হেলেদুলে পড়ে যাওয়ার আগেই জড়িয়ে ধরলেন রতন পাটোয়ারী। ভীত গলায় বললেন, ” তোর কি লো পেশার মমিন?”

” জানি না।”

” এহন রায়হানের ফার্মেসীতে যায়া মাপাবি। চল, নিয়া যাই।”

বন্ধুর হাতের বাঁধন থেকে জোর করে মুক্ত হলেন মমিন শেখ।চকচকে দা’টা প্রায় ছিনিয়ে নিলেন রতন পাটোয়ারীর কাছ থেকে।

” তুই একা যাইতে পারবি?”

” পারুম।”

মাতালের মতো টলতে টলতে বাড়ির পথ ধরলেন মমিন শেখ।পিছন থেকে ঠায় চেয়ে রইলেন রতন পাটোয়ারী।চেনা চোখেই চেনা বাল্যবন্ধুকে আজ ভীষণ অচেনা ঠেকলো।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here