শুকতারা (দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ) পর্ব-৯

0
179

#শুকতারা ( দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
#পর্ব-৯
#হালিমা রহমান

অন্তুর নতুন কর্মজীবন শুরু হয়েছে তিনদিন আগে।বেশ ভালোই লাগছে তার।আরামের চাকরি। ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে মেয়েদের তিনটা সেকশন আর ছেলেদের দুটো।এখনো শিক্ষকের অভাব।তবে সারাদিনে ওকে ক্লাস নিতে হয় মাত্র তিনটে।ছেলেদের দুটো, মেয়েদের একটা।শান্তর বন্ধু হিসেবে প্রিন্সিপাল কবিরের সাথে বেশ ভালো সম্পর্ক ওর। প্রিন্সিপালের মুখেই শুনেছে মাঝেমধ্যে দু-একটা একাউন্টিং ক্লাস নিতে হবে।শিক্ষকের স্বল্পতা, সারা কলেজে হিসাববিজ্ঞানের শিক্ষক মাত্র একজন।অবশ্য অন্তুর সমস্যা নেই। ফিন্যান্সের সাথে সাথে এই বিষয়টাও ওর বেশ লাগে।পড়াতে বিরক্ত আসে না।
নতুন চাকরিতে প্রথম শুক্রবার। শান্তসহ সবাই বাসায়।দুপুরের জম্পেশ একটা খাওয়া-দাওয়ার পরে শিলা গেল ঘুমাতে।লাবনী গেল লাইভে,সূচি বরাবরের মতো ঘরে আর অন্তু-শান্ত-লাবিব বসলো টিভির সামনে।ইন্ডিয়ান একটা চ্যানেলে চলছে বেলাশেষে।শান্ত হা করে দেখছে।মুভিটা ওর ভালোই লাগে।পাশেই বসে লাবিব সাপের মতো মোচড়াচ্ছে বারবার।মিনিট দুয়েক পরপর শোনা যাচ্ছে তার অস্থির গলা, ” পাল্টাও না আব্বু।কী দেখো এগুলা? বুড়ো মানুষদের ছবি ভাল্লাগে না।আমি কিছুই বুঝি না।”

” সাপের মতো মোচড়াবি না লাবিব।যা ঘুমা,এটা টিভি দেখার সময় না।”

” রিমোটটা দাও না প্লিজ।রুদ্রার নতুন এপিসোড দিবে এখন।”

” লাবিব ভ্যাজর ভ্যাজর করবি না।”

” শিলা বললে ঠিকই দিতে তুমি।”

” শিলা আমার মেয়ে আর তুই তোর মায়ের ছেলে।যা তোর মায়ের কাছে যেয়ে চা।”

” দাও না প্লিজ।”

” তোকে ফড়িংয়ের মতো ছুঁড়ে ফেলে দিব এখন।”

বাপের ধমকের পরেও আরো কয়েকবার হাত-পা ছোড়াছুড়ি করে নাচল লাবিব।সাথে আছে ঘ্যানঘ্যানে সুরের নালিশ।শিলা চাইলে ঠিকই দিতো।শেষে চাচার ফোন হাতে পেয়েই শান্ত।নিজের ফোনটা ভাতিজার হাতে ধরিয়ে দিলো অন্তু।আদর করে বললো, ” ফ্যাচফ্যাচ করিস না।যা গেমস খেল।”

খানিক বাদে লাবনী এলো ব্যস্ত পায়ে।লাইভ শেষ।ঘষে ঘষে লিপস্টিক তুলছে।শান্ত টিভি থেকে নজর তুলে ভ্রু কুঁচকে তাকালো।
” টাকা দিয়ে কিনে এমন ঘষাঘষি করতে আত্মা কাঁপে না? ইশ! কত দাম দিয়ে কেনা। কিছুক্ষণের জন্য দিয়েই তুলে ফেলো! কি হয় এসব আটা-ময়দা না মাখলে?”

” আমার টাকায় আমার মেকাপ।আমি রাখব নাকি ঘষব তা আমার ব্যাপার।তুমি বলার কে?”

” তবু টাকার জ্বলনি বলতেও একটা কথা আছে। শুধু শুধু আটা-ময়দা..

” ঠিক আছে এখন থেকে আমি না মেখে তোমার জন্য রেখে দিব। কী করবে তুমি এগুলো? নিজে মাখবে নাকি রুটি বানিয়ে খাবে? এগুলো তো আটা-
ময়দাই।”

” খোঁচা মারার স্বভাবটা আর গেল না।”

” না, গেল না।মানে আমি বুঝি না আমার জন্যে সৃষ্টি মেকাপ, আমার টাকায় কিনে, আমি আমার মুখে মাখব। তোমাদের মতো ছেলেগুলোর সমস্যা কী? মেকাপ নাকি আটা-ময়দা! হাহ! না সোনা,এটা আটা-ময়দা না।এটা যে কি জিনিস তা তোমার মতো বেকুবেরা বুঝবে না।সবকিছুর মর্ম যদি সবাই বুঝতো তো পৃথিবীতে সব মানুসই থাকতো, হাত- পাওয়ালা ছাগল থাকতো না।যত্তসব।”

মুখখানা হাঁড়িপানা করে লাবনী চলে গেল বেসিনের কাছে মুখ ধুতে।শান্ত ভাইয়ের উরুতে চাপড়ে দিয়ে ফিচেল হাসলো।
” শোন কখনো বউদের মেকাপ নিয়ে কথা বলবি না।একদম ছিঁড়ে ফালা ফালা করে ফেলবে বললে।”

” তাহলে তুমি কেন বললে?”

” এমনিই।মাঝে মাঝে তোর ভাবিকে রাগাতে ভালো লাগে।”

কিছুক্ষণ পরে বসার ঘরে লাবনীকে আবার দেখা গেল।পরিপাটি ভাব,হাতে ব্যাগ,বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত।শান্ত আরেক দফা ভ্রু কুঁচকে তাকায়, ” কই যাও?”

” টেইলার্সে যাব একটু।আসতে দেরি হবে।শিলাকে একটু পর তুলে দিও।ঘুমের আগে হিসু করেনি।দেরি করে তুললে পরে বিছানা ভাসিয়ে ফেলবে।”

স্বামীকে নির্দেশ দিয়েই চলে গেল না লাবনী।সেখান থেকেই গলা উঁচিয়ে সূচিকে ডাকলো।
” সূচিইই, হলো তোমার? তাড়াতাড়ি আসো।”

” ও কোথায় যাবে ভাবি?”

” বাইরে যাচ্ছি, ভাবলাম একটু নিয়ে যাই।মেয়েটা এসে অবধি ঘরেই আছে।এভাবে ঘরবন্দী থাকলেও মানুষ অসুস্থ হয়ে যায়।”

” হুহ আদিখ্যেতা।ঢং দেখলে গা-পিত্তি জ্বলে যায়।”

স্বামীর খোঁচাটুকু গায়ে মাখার সময় হলো না।ততোক্ষণে গুটিগুটি পায়ে সূচি এসে দাঁড়িয়েছে বসার ঘরে।কপাল অবধি ঘোমটা টানা।দৃষ্টি নিচের দিকে,মুখে ভীষণ একটা অপ্রস্তুতের ভাব।না তাকিয়েও বুঝতে পারছে শান্তর তেরছা চাহনি ওর দিকেই।জ্বলন্ত চোখে মেপে যাচ্ছে ওকে।শান্তকে সূচি মাত্রাতিরিক্ত ভয় পায়।
___________________________
বিসমিল্লাহ টেইলার্সের সাইনবোর্ডটা বাড়ির সামনের রাস্তা থেকেই দেখা যায়। বড়জোর পনেরো-বিশ পা।তিনতলা একটা বাড়ির নিচতলায় ছোট্ট একটা টেইলার্স।মান ভালো কিন্তু কাস্টমার কম।এদিকের বেশিরভাগ মানুষ বাজারের কাছের বড় টেইলার্সে যায়।তবে লাবনী এখানকার নিয়মিত কাস্টমার।শিলার ফ্রক থেকে শুরু করে ওর দামী ড্রেস– সবই এদিকেই হয়।
টেইলার্সের সহকারী মেয়েটা হিন্দু।বিকেলের গরমে অতিষ্ঠ হয়ে ফ্লোরে বসে কাপড় কাটছিলো।লাবনীকে দেখে মিষ্টি হাসলো,
” দিদি, দিনকাল ভালো?”

” এই তো চলছে।মিতু আপু নাই?”

” দিদির শরীর খারাপ।দুপুরের পরে আর এলো না।”

লাল রঙা আরএফএলের টুলে বসলো লাবনী।আরেকটা এগিয়ে দিলো সূচির দিকে।হাত দিয়ে ওকে বসার ইশারা করে ব্যাগের কাপড়গুলো এগিয়ে দিল সহকারী চন্দ্রার দিকে।

” দুটো জামা আছে।একটা আমার,একটা সূচির।কবে হবে?”

” ঝামেলার কাজ?”

” না, সুতির জামা।ওতো ডিজাইন-ফিজাইন নেই।”

” আমি তো বলতে পারছি না।মিতু দিদি বলতে পারবে।”

” তাহলে আপু আসলে আমাকে একটা ফোন দিতে বলো।ওরটা আর্জেন্ট লাগবে।”

” আচ্ছা।দিদি একটু দাঁড়ান।আপনার মাপগুলো নিয়ে নেই”– সবাইকে দিদি ডাকার স্বভাব চন্দ্রার।লাবনীর ছোট ও,একুশ বছরের হাসি-খুশি প্রাণোচ্ছল মেয়ে।
কাজের ফাঁকে টুকটাক কথা-বার্তার শেষে বেরিয়ে এলো লাবনী।ওরা যখন বাইরে পা রেখেছে তখন চলছে ঝিমানো অবসন্ন বিকাল।সূর্যের তাপের ঝাঁঝ কিছুটা কমলেও গরম কমেনি।বাইরের দূষিত বাতাস ভিতরে টেনে নিতেই বেশ খানিকটা ধুলো চলে গেল নাকের ভিতরে।ধুলোমাখা রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে দু-একটা রিকশার টুংটাং শব্দ কানে টেনে নিতে নিতে একটা সিদ্ধান্ত নিলো লাবনী।ও এখন বাড়ি ফিরবে না।চোখের উপর হাত রেখে রোদ আড়াল করে সূচির দিকে চেয়ে মিষ্টি হাসলো,
” চলো আজ আমরা গল্প করি।”

মিনমিন করে প্রশ্ন করে সূচি, ” এখন বাড়ি যাবেন না আপু?”

” উঁহু। উত্তরে দুটো গলি পেরিয়ে লাবিবদের স্কুল।স্কুলের সাথেই একটা মাঠ আছে।বিকালে সবাই হাঁটতে যায় ওখানে।চলো আজ আমরাও যাব।”

” অনেক রোদ তো,এখন বাড়িতেই যাই?”

” একদমই না।রোদের সাথে তোমার শত্রুতা আছে নাকি? এতোদিন ঘরে থাকতে থাকতে পচে গেছো।আজ গায়ে রোদ লাগাও।আমার মাঝে মাঝে ভয় হয়।মনে হয় তুমি আসলে মানুষ না,মানুষের মতো দেখতে একটা বিশাল মাছ।তাই আলো-বাতাস সহ্য হয় না।কী করে থাকো সারাদিন অন্ধকারে? বিরক্ত লাগে না?”

লাবিবদের ব্রাইট স্কুলের গা ঘেঁষে শুয়ে থাকা মাঠটা খুব একটা বড় নয়।মাঠের পাশেই একটা নতুন বাড়ি হচ্ছে।ইট,বালু,সিমেন্ট,রড রেখে মাঝারি আকারের মাঠের একাংশ গিলে ফেলেছে বাড়ির মালিক।স্কুলের ভিতরের বিশাল জারুল গাছের মাথাটা বেরিয়ে এসেছে দেওয়াল পেরিয়ে বাইরে।মাঠ থেকেই দেখা যায় এর বিশাল ডাল-পালা।গাছের ছায়া পড়েছে মাঠের ওদিকটায়।সৌভাগ্যবশত সেদিকেই একটা ছোট্ট বেঞ্চ পাতা।স্কুলের বাচ্চাদের জন্যই পেতে দিয়েছিল স্কুল কতৃপক্ষ। সূচির আগে আগে সেখানে যেয়ে বসলো লাবনী।পিছনে পিছনে সূচিও গেল।ছোট বেঞ্চ,কিছুটা গা ঘেঁষেই বসতে হয়।লাবনীর পাশে যেয়ে একরাশ শঙ্কা নিয়ে বসেই রইলো সূচি।আগ বাড়িয়ে বললো না কিছু।অজানা এক উৎকন্ঠায় অকারনের বাঁশ পাতার মতো দুলছে মন।

” আজ আমাদের শুক্রবার।বাচ্চা-কাচ্চা, সংসার,ব্যবসা সামলে তোমার সাথে গল্প করার এক দন্ড সময় পাই না।তোমার পুরো নামটা যেন কী?”

” সূচনা আক্তার সূচি।”

” সুন্দর নাম।কে রাখলো?”

” আমার বড় আপা।”

” তোমার বড় আপার নাম কী?”

” ভূমি আক্তার।”

” সে কি আমার বয়সী?”

” আপনার চেয়ে বড় বোধহয়।বড় আপার চেয়ে আপনাকে ছোট দেখায়।”

গা দুলিয়ে হাসে লাবনী।হাসলে ওর বাম ভ্রুটা একটু উপরে উঠে যায়।মুখের অভিব্যক্তির সাথে পাল্টায় চোখের নাচন।

” আমার বয়স জানো?”

দু’দিকে মাথা দোলায় সূচি।লাবনীর সহজ কথাবার্তা, সরল হাসিতে ভয় কাটছে কিছুটা।

” চব্বিশে আমার বিয়ে হলো,ছাব্বিশে লাবিব।লাবিবের এখন চলছে নয়।তাহলে কত হলো?”

” পঁয়ত্রিশ!! কিন্তু বড় আপার মাত্র পঁচিশের শুরু।”

” আমি তাহলে তার থেকে প্রায় দশ বছরের বড়।”

সূচির মুখটা অজান্তেই হা হয়ে গেল।ছোট-খাটো একটা টুনটুনি পাখি অনায়াসে ঢুকতে পারবে সেই গর্তে।বিস্ময়ের সুরে বললো, ” একদম বোঝা যায় না আপু।বড়জোর তেইশ-চব্বিশ মনে হয়।”

” অনেকেই এই ভুলটা করে।আচ্ছা, তোমার কথায় আঞ্চলিকতা নেই কেন? গ্রামের মানুষদের কথায় কিছুটা আঞ্চলিকতা থাকে কিন্তু তোমার নেই।আমি খুব অবাক হই তোমার কথাগুলো শুনলে।”

” বড় আপা খুব একটা আঞ্চলিকতা পছন্দ করে না।আমার একটা দুঃসম্পর্কের ভাই আছে,রায়হান নাম ওনার।আমরা একই বাড়িতে থাকি।রায়হান ভাই এভাবে কথা বলে।তার থেকে আপা শিখলো, তারপর আমাকে শিখিয়েছে।ছোট থেকেই আমার কথা এমন।কোনো আঞ্চলিকতা নেই।বড় আপা যেখানেই হাত দেয় সেখানেই পরিপাটি থাকে সবকিছু।আমার দেখা সবচেয়ে পার্ফেক্ট মানুষ আমার আপা।”

” তোমার বড় আপাকে খুব ভালোবাসো?”

” খুব।”

” যাবে ওর কাছে? তুমি তো চাইলেই তোমার বড় আপার কাছে যেতে পারো।”

ছলছলিয়ে আসে সূচির বড় বড় চোখ দুটো। ওড়নার খুঁট আঙুলে জড়ায়।ধরা গলায় বলে, ” যেতে পারলে আগেই যেতাম,রাতের আঁধারে মরতে যেতাম না।”

” আমিও না তোমার এই কাজের কোনো মাথা-মুন্ডু খুঁজে পেলাম না।এই কয়েকদিনে তোমার কথা থেকে এটুকু বুঝেছি ভূমির মতো প্রিয় তোমার আর কেউ নেই।তাহলে ওর কাছেই যেতে পারতে।অযথা মরতে গেলে কেন?”

প্রশ্নটার উত্তর দেওয়া হয় না আর।”অযথা” শব্দটা ঝুমঝুমিয়ে বাজে কানের কাছে।মন-প্রাণ অবশ হয়ে আসে সূচির।সত্যিই কি অযথা? সেদিন এছাড়া আর কী করতে পারতো সে? বাবার ঘরে আশ্রয় নেওয়ার কথা ভাবতেও পারে না, আর না ভাবতে পারে স্বামীর ঘরে মাটি কামড়ে পড়ে থাকার কথা।সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে বাকি থাকে ভূমি।কিন্তু সবার আগে কি ওর কাছেই যায়নি সূচি? গিয়েছিল তো।চব্বিশে এপ্রিল দিনের বেলার কথা ভুলে গেলে চলবে কেন? বড় আপার বাড়িতেই তো আগে আশ্রয় নিয়েছিল।কিন্তু লাভ হলো কি? বিকালে একদল মানুষের সামনে বাবার হাতে মার খাওয়া,শাশুড়ির অভিযোগ,ওকে জড়িয়ে ইশতিয়াকের চরিত্রে ফয়সালের কালি ঢালা আর সবশেষে ভূমির অসুস্থতা ছাড়া আর কিছুই এলো না হাতে।এরপরেও আশা থাকে? চূড়ান্ত অত্যাচারিত হওয়ার পরে আবার যেতে পারতো সূচি।কিন্তু এরপরেই বা কী হতো? নিজের মনে কল্পনা করে সূচি।ভূমি ওকে নিয়ে ছুটতো থানায়,আবার বিচার-সালিশ,আবার সেই অপছন্দনীয় তিনজন মানুষের মুখোমুখি দাঁড়ানো,আবার আবার ঝামেলা।এতোকিছুর ভর সহ্য করার ক্ষমতা সূচির আছে কি না তা কেউ জানতে চায় না। সবাই বলে “অযথা”।কিন্তু সত্যি কি অযথা? ভেবে ভেবে আর পারে না সূচি।উদয়পুর ওকে ঝামেলা ছাড়া আর কী দিয়েছে?

” উত্তর দিয়ে চাও না?”

উত্তর? লাবনীর করা প্রশ্নটাই ভুলে গেছে সূচি।তাই বোকার মতো চেয়ে থাকে একদিকে।

” আচ্ছা না দিতে চাইলে দিও না।কিন্তু একটা কথা বলো,তুমি এখন কী ভাবছো? মানে বলছি যে একটা সমস্যার মাঝে তুমি আছো।এখন এটা কাটিয়ে উঠতে হলে খুব চিন্তা-ভাবনা দরকার।তুমি কি কিছু ভাবছো?”

উপর-নিচে মাথা নাড়ে সূচি।মুহূর্তেই চকচক করে উঠে লাবনীর চোখ দুটো।
” কী ভাবছো? উদয়পুরে ফিরে যাওয়ার কথা নিশ্চয়ই?”

” আমার গায়ের এই দাগগুলো কবে যাবে? এখনো যায় না কেন? এগুলো আমাকে উদয়পুরের কথা মনে করিয়ে দেয়।পৃথিবীর ঐ একটা জায়গাকে আমি ভুলে যেতে চাই।”

বিনিময়ে কথা জোগায় না লাবনীর মুখে।সূচির ছলছলে উদাস চোখ দুটো তখন একটু দূরের একটা নোংরা, শুকনো, হাড় বেরোনো বিড়ালের উপরে নিবদ্ধ।বেচারার স্থায়ী আবাস নেই বলেই হয়তো চামড়া ঝলসানো রোদের মাঝে উত্তপ্ত মাটিতে শুয়ে আছে।সূচি দেখে আর দেখে।লাবনী আড়চোখে সূচির দৃষ্টি পড়ে।মেয়েটা কি ঐ গৃহহীন দুর্দশাগ্রস্ত বিড়ালের মাঝে নিজের ছায়া দেখে?

” সূচি, তোমাকে আমি এখানে নিয়ে এসেছি এমনিই।বাড়ির বাইরে পা রাখার পরেও ভাবিনি তোমাকে নিয়ে হাঁটতে আসব।টেইলার্স থেকে বেরিয়েই ইচ্ছেটা জাগলো।এখন আরেকটা ইচ্ছা জাগছে।জানো কী?”

” জানি না কিন্তু আন্দাজ করতে পারছি।আপনি এখন আমাকে ভারী ভারী কথা শোনাবেন।খুব জ্ঞানের কথা বলবেন।আমি শুরুতেই এই আশঙ্কা করেছিলাম।”

” না, ভারী কথা বলব না।আমি ভারী ভারী কথা বলতে জানি না।আমার বিরক্ত লাগে।আমি সহজ মানুষ।তাই সহজেই তোমার মাঝে এখন টেনশন ঢুকিয়ে দেব।সবকিছুর মাঝেই একটা প্রশ্ন থাকে সূচি।তুমি কোন পরিস্থিতিতে ঘর ছেড়েছো তা আমি জানি না। তাই জ্ঞান দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।কারণ জ্ঞান দিতে চাইলেই তুমি এখন চট করে আমাকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেবে।বলবে,আমার জায়গায় থাকলে আপনি কী করতেন আপু? যেহেতু তোমার জায়গায় আমি নেই তাই উত্তরটাও আমার জানা নেই।অতএব ভারী ভারী উপদেশ তোমায় দেব না।তবে একটা প্রশ্ন করব।এরপরে কী হবে সূচি? এরপরে কী করতে চাইছো? তোমার সমস্যা স্থায়ী কিন্তু আশ্রয়টা অস্থায়ী।তুমি আমাকে চেনো না, আমি তোমাকে চিনি না।এই অবস্থায় ঢাকায় থাকার কথা কল্পনাতেও আনা যায় না।তাহলে কী করবে এবার? উদয়পুরই কি স্থায়ী আশ্রয় নয়? সেখানেই ফিরে যাওয়া স্বাভাবিক, তাই না?”

উত্তর দেয় না সূচি।প্রশ্নগুলো আদোও ওর কানে ঢুকছে কি না তাই বোঝা যায় না।স্থির দৃষ্টি পেতে রেখেছে নোংরা বিড়ালটার উপরে।ওখানে অবশ্য দৃশ্যপটে পরিবর্তন এসেছে।মঞ্চে আরেকটা নতুন চরিত্র।কোথা থেকে যেন একটা কুটকুটে কালো বিড়াল এসেছে ছুটে।অস্থিরভাবে নোংরা বিড়ালটার পেটে মাথা ঘসছে।হাবে-ভাবে বোঝা যায় ওটাকে তাপ থেকে বাঁচানোর জন্য ঘুম ভাঙাতে চাইছে।আবার অন্যকিছুও হতে পারে।পরের দৃশ্য মনোযোগ দিয়ে দেখছিলো সূচি।আচমকা হাতে চাপ পড়ায় ঘোর ভাঙলো।জিজ্ঞাসু চোখে চেয়ে আছে লাবনী।সূচির দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো, ” কী করবে এরপরে? উদয়পুরে ফিরে যাওয়া ছাড়া তো আর উপায় নেই।”

” আমি জানি না আপু।”

” জানতে হবে এবার। ভাবো সূচি,ভাবতে হবে।বাড়ির সবার সাথে যোগাযোগ করতে হবে, এরপরে উদয়পুরে ফিরে যেতে হবে।”

” কিন্তু ওখানে তো কেউ নেই আমার।কেউ মেনে নেবে না।এতোদিন বাইরে কাটানোর পরেও কি কেউ আমাকে আর ঘরে তুলবে?”

” মানে?”

” আমি ঝামেলার দিন সকালে বড় আপার বাড়িতে গিয়েছিলাম।ইচ্ছা ছিল এখন থেকে সংসারের কপালে লাথি মেরে সেখানেই থাকব।আমার একটু শান্তির চাহিদা ছিল খুব।কিন্তু ওটা তো আমার কপালে নেই।ওখানেও ঝামেলা।লোক জমলো আপার বাড়িতে,খুব ঝামেলা হলো,আব্বার হাতে মার খেলাম।এতোকিছুর পরেও আপা আর ভাইয়া সাপোর্ট দিচ্ছিলো।এরপরেও ভেবেছিলাম আমি সেখানেই থাকব।কিন্তু এরপরে কী হলো জানেন? আপনার দেবর ঠুস করে একটা বাজে কথা বলে ফেললো।সাধু পুরুষ কি না,ন্যায় অন্যায়ের চিন্তাটাই আগে মাথায় আসে।আমি তার আদরের বউ,আমাকে নিয়েই তার সব চিন্তা।দুম করে বলে ফেললো,ইশতি ভাইয়ার কামনা-বাসনা আছে।তাই তার ঘরে রাখতে জানোয়ারটার ভরসা হবে না।বুঝতে পারছেন আপু? আদর-সোহাগ কিছু না।স্রেফ ইশতি ভাইয়ের মুখ বন্ধ করার ধান্ধা।সেই জানোয়ারটা কিন্তু এখনো আছে সেখানে।আমি উদয়পুর থেকে এসেছি অন্তু ভাইয়ের হাত ধরে।তার সাথে এতোদিন অচেনা শহরে থাকার পরে যদি আমি আবার সেই গ্রামে ফিরে যাই,তাহলে ও আবার আমার উপরে আঙুল তুলবে না? ও তো মানুষ নয়,অমানুষ একটা।”

” ও আঙুল তুললেই কী? মিথ্যা দুর্নামের ভয় পাচ্ছো?”

” আমি এখন আর ভয় পাই না আপু।কিন্তু দুর্নাম জিনিসটাই কেমন যেন।শুনতেই আমার গা ঘিনঘিন করে।আপনি কখনো গ্রামে থেকেছেন?”

” না।”

” তাহলে বলব আপনি অনেক কিছুই জানেন না।আমাদের গ্রামবাসীরা উদার মানুষ।একজনের খবর এরা ভাগাভাগি করতে ছাড়ে না।আমি ফিরে গেলে কী হবে জানেন?সবাই ভীড় করে আমাকে দেখতে আসবে,কানাকানি করবে,সবশেষে চরিত্রের উপরে আঙুল তুলবে।এরপরেও বেঁচে থাকতে বলেন আপু? দুর্নাম সত্যি হলেও বরং গায়ে সইতো।কিন্তু মিথ্যা দুর্নাম সইব কেন?”

হার মানে না লাবনী।সূচির কাঁধে হাত বুলিয়ে সাহস দেয়।
” বি পজিটিভ।খারাপ ভাবলেই খারাপ।সবাই আছে তোমার পাশে।একমাত্র কাজী বাড়ি ছাড়া গোটা উদয়পুরটাই তোমার।ভয় পাওয়ার কিছু নেই সূচি।সেই উদয়পুরেই ফিরে যেতে হবে।বুঝতে পারছো?”

” চলে যাব।কিন্তু তার আগে আমার কিছুদিন সময় লাগবে আপু।”

” আচ্ছা।”– লাবনীর গলায় সন্তুষ্টি।
সূচির স্থির দৃষ্টি বিড়াল দুটোর উপরে।দৃশ্যপটে পরিবর্তন এসেছে।কালো বিড়ালের খোঁচাখুঁচিতে নোংরা বিড়ালটা উঠে দাঁড়িয়েছে।দুটোতে মিলে হেলেদুলে হেঁটে চললো সিমেন্টের বস্তার কাছে।কিছুটা ছায়া আছে সেখানে।একটু জায়গা করে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়লো আরামের জায়গায়।শেষমেশ দেখে সূচির মাথায় এলো একটি কথা, ” হ্যাপি কাপল।”

” পৃথিবীতে মরার আগ পর্যন্ত কেউ আটকে থাকে না সূচি।হাঁটু ভেঙে যখন পড়েছো তখন উঠতেই হবে।অন্তত জীবনকে উপভোগ করতে হলেও উঠে দাঁড়াতে হবে।জীবন সুন্দর,আমরা যতটা ভাবি তার চেয়ে হাজার হাজার গুণ বেশি সুন্দর।”

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here