মোনালিসা পর্ব ৭

0
1264

মোনালিসা
মৌমিতা_দত্ত
পর্ব ৭

“তারপর তোর সাথে যোগাযোগ করেনি উর্বশী?”

হতাশা মাখা গলায় ধীরে ধীরে রাজীব বলে ওঠে, “জানিস তো যখন কেউ প্রথম নেশা করা শুরু করে তখন নিজের অজান্তেই মাথা ধরা স্তিমিত মুহূর্তটাই তার কাছে পরম উপভোগ‍্য লাগে আর ক্রমে সে নেশার দিকে ধাবিত হয়। কিন্তু, নেশার বস্তু যখন তার নাগালের বাইরে থাকে তখন যন্ত্রণায় ছটফটানিও একজন নেশারুকেই সহ‍্য করতে হয়।
ঠিক সেইরকম অবস্থাই হয়েছিল আমার। আত্মগ্লানি বোধে জর্জরিত হয়ে পড়ছিলাম প্রতিদিন। আমার কাঙ্খিত বাসনা একটাই ছিল একবার অন্তত উর্বশীর সাথে দেখা হওয়া।
দশদিন পেরিয়ে গেছে। আমিও আশা ছেড়ে দিয়েছি। এমন সময় একদিন দুপুরে আমি অফিসে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছি ,এমন সময় একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন আসে । ফোনটা রিসিভ করামাত্র ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে প্রাপ্ত পরিচয়ে আমি প্রায় লাফিয়ে উঠি। এতোদিনের চাপা কষ্টের অবসান হতে চলেছে।
সন্ধ‍্যেবেলায় শ‍্যামবাজারের কাছে একটা ক‍্যাফেতে আমাকে দেখা করতে বলে উর্বশী।
অনেক জমানো কথা তার সাথে দেখা হওয়া মাত্র বলবো মনে করে রওনা দিলাম শ‍্যামবাজার।
ক‍্যাফেতে পৌঁছনোমাত্র সামনের টেবিলে বসে থাকা উর্বশীকে দেখেই আমার সবকিছু কেমন যেন গুলিয়ে যেতে থাকে, কথাগুলো মুখের কাছে এসেও জিভ যেন অসাড় হয়ে গেল সেই মুহূর্তে। কোনোকিছুই তাকে বলে উঠতে পারলাম না।
একদিকে অপরাধবোধ আর অপরদিকে ভালোবাসাবোধ দুই মিলে যখন মনের দোলাচলে অস্থির হয়ে কোনরকমে তার সামনে গিয়ে বসলাম।
তখন আমি কিছু বলার আগেই আমাকে চমকে দিয়ে উর্বশী এমন কিছু কথা বললো যা আজও তীরের মতো আমার মনে বিঁধে আছে।”
এইবলে নিজের কোলে মাথা গুঁজে কিছুক্ষণ বসে থাকার পর রাজীব আবারও বলতে থাকে –
“সেদিন আমার সব ভাবনা চিন্তায় জল ঢেলে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উর্বশী বললো, সেদিন সে রাতের ঘটনা সব কিছু ভুলে যেতে। কারণ, অন‍্য কারোর সাথে তার রেজিস্ট্রি অনেক আগেই হয়ে গেছে। আর কিছু দিনের মধ‍্যেই তাদের সামাজিক বিয়ে। তাই সেদিনের অ্যাক্সিডেন্টকে আমি যেন মনে না রাখি।
তুই বললে বিশ্বাস করবি না, সেদিন ক‍্যাফে থেকে বেরিয়ে আমার পা জোড়া যেন আর এগোতেই চাইছিল না। ঘোরের মধ‍্যে হাঁটছিলাম আমি।
সেই রাতে বাড়ি ফিরে বারংবার নিজের মনকে একই প্রশ্ন করেছি – ‘কোনটা সত‍্যি, সেই রাতের ঘটনাটা নাকি ক‍্যাফেতে উর্বশীর বলা কথাগুলো!’
প্রশ্নজালে জর্জরিত হয়ে রাতের পর নিজের ডায়রিতে আঁকিবুকি কেটেছি শব্দের। ভুলতে চেয়েছি সমস্ত কিছু, কিন্তু পারিনি জানিস। আর আজও পারছি না, সবকিছু ভুলতে।”

সবটা শোনার পর রাজীবের কাঁধে হাত রেখে আবীর বলে ওঠে , “তুই ওকে বুঝিয়ে বলতে পারতিস তোর মনের কথা । হয়তো বুঝলে বুঝতেও পারতো। হয়তো বিয়ে না ভাঙতে পারলেও তোর ফিলিংসের জন‍্য অন‍্যকিছু করতে পারতো।”

“জানিস তো, একই কথা আমিও ভেবেছিলাম। আর ঠিক সেইজন‍্যই কয়েকদিন পর ফোনও করি । কিন্তু, নম্বরটা ইনভ‍্যালিড ছিল।”
কিছুক্ষণের বিরতির পর রাজীব আবারও বলতে থাকে, “আসলে উর্বশীরা যুগে যুগে আবির্ভূত হয় তার মায়াজালে বিদ্ধ করে পুরুষদের বিবশ করার জন‍্য, সংসার করার জন‍্য নয়।”

“আচ্ছা, সবটা তো শুনলাম। কিন্তু, একটা কথা বুঝতে পারছিনা । তুই যখন মানসিক ভাবে এতোটাই বিপর্যস্ত ছিলিস তাহলে বিয়েটা করলি কেন?”

“এই ঘটনার পর থেকে আমি তোর ,দিদির সবার সাথে যোগাযোগ প্রায় না রাখার মতই চলছিলাম। প্রতিদিন অফিস ফেরত বারে গিয়ে ড্রিংকস করা শুরু করি। মদ‍্যপ অবস্থায় মাঝরাতে বাড়ি ফেরা সবই চলছিল। ঘোরের মধ‍্যে জীবন কাটছিল।
জ্ঞানত সেই রাতের ঘটনা তাড়া করে বেড়াতো আমাকে সারাক্ষণ। আর ড্রিংক করে শুধু ঘুমাতে চাইতাম। তাতেও যখন কাজ হচ্ছিল না তখন স্লিপিং পিল নিতে শুরু করি। এইভাবে টানা তিনদিন আমার কোনো হুঁশ ছিলনা।অফিস যেতে পারিনি। অফিস থেকে আমাকে ফোনে না পেয়ে দিদির কাছে ফোন যায়।
দিদি ফোন পাওয়ার তিনদিনের মধ্যে বাড়ি চলে আসে । সমস্ত ছড়ানো, ছেটানো ঘরদোর দেখে দিদির বুঝতে অসুবিধা হয়না আমার জীবনে চরম কোন বিপর্যয় ঘটে গেছে।
তাই আমি স্বাভাবিক হলে, দিদি আমার সাথে আলোচনায় বসলে সেদিন প্রথম দিদিকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদেছিলাম। তারপর একে একে সব কথা দিদিকে বলি। সব শুনে দিদি আমাকে বলে, কোনোকিছু ভুলতে চাইলে সেটা মানসিক ঘাত প্রতিঘাতের সাথে প্রতিনিয়ত লড়াই করে ভুলতে হয়। নেশা করে বা ঘুমের ওষুধ খেয়ে কখনোই নয়।
যা ছেড়ে গেছে তা ছিলনা কখনোই আমার। তাই এ নিয়ে অযথা বেশি মাথা ঘামালে আমার কষ্ট বাড়বে বই কমবে না।
সেদিন দিদির কথাগুলো ভীষণভাবে বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছিল। অন‍্যভাবে ভাবার চেষ্টা করছিলাম। তাই দিদি যখন সেদিন বললো তার উপর ভরসা রাখতে ভরসা করেছিলাম। কথা দিয়েছিলাম দিদি যা বলবে আমি তাই করবো।
আর তাই এই ঘটনার পাঁচ মাসের মাথায় দিদি আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলে। প্রথমে আমি রাজি হইনি বিশ্বাস কর। আমি চাইনি আমার জন‍্য অন‍্য কারোর জীবন নষ্ট হোক। কিন্তু, দিদির ইমোশনাল ব্ল‍্যাকমেলিং – এ এক রকম বাধ‍্য হয়েই বিয়েটা করেছি।
কিন্তু, বিশ্বাস আমার থেকে দশ বছরের ছোট একটা মেয়েকে বিয়ে করে তার জীবনটাও আমি নষ্ট করলাম। কারণ, আমি বেশ বুঝতে এই মেয়ের দিকে কোনোদিন আমি ভালোভাবে তাকাতেও পারবো না।
গোটা জীবনটা কিভাবে কাটাবো ! কিছুই বুঝে উঠতে পারছিনা। আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। নিজেকে নিজেই সামলাতে পারছিনা। আর একজনকে সাথে নিয়ে এগোবো কিভাবে! এবার তুই বল, আমার কী করণীয়!”

“দেখ, তুই যদি তোর ওয়াইফের সাথে থাকতে না চাস তাহলে থাকিস না। কিন্তু, একবছরের আগে তুই ডিভোর্স পাবিনা।
আর ভালো করে ভেবে দেখ, তোর অতীতের সব ঘটনার জন‍্য কোনো না কোনোভাবে তুই দায়ী।
তাই আমার মতে যে জিনিস অনেক আগেই কর্পুরের মতো তোর জীবন থেকে উবে গেছে তার জন‍্য সারাজীবন যদি আফশোস করিস তাহলে সেটা হবে তোর বোকামি।
আর বিয়ে করার পর তোর ওয়াইফের সাথে যে ব‍্যবহার তুই করছিস, সেটাও অনুচিত।
কারণ, বিয়ের পরে কারোর দায় তুই অস্বীকার করতে পারিস না। আর যদি করিস তাহলে সেই রাতে উর্বশী আর আজকের তোর মধ‍্যে কোনো তফাত থাকবে না।”

“মানে! কী বলতে চাইছিস তুই? সব শোনার পর তোর তাই মনে হচ্ছে।” বেশ জোর গলায় বলে ওঠে রাজীব।

“আমার কী মনে হচ্ছে ,সেটা বড় কথা নয়। তুই কী করছিস ,সেটাই আসল কথা। তাই অযথা গলা না চড়িয়ে একটু ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখ, সেদিন রাতের ঘটনা যখন এক নিমেষে অস্বীকার করে তোকে সবটা ভুলতে বলেছিল উর্বশী ,তখন তোর কেমন লেগেছিল!
আর আজ বিয়ে করার পর তোর বউয়ের সামনে গিয়ে তুই যদি তাকে বলিস বিয়েটা ভুলে যেতে, তার কেমন লাগবে! ভেবেছিস একবারও!”

“দেখ আমার পক্ষে কাউকে কোনোদিন অ্যাকসেপ্ট করা পসিবলই নয়।”

“অ্যাকসেপ্ট করতে বলছি না। কিন্তু, অস্বীকার করিস না। হাজব্যান্ড ওয়াইফের সম্পর্ক মানেই যে জোর করে একসাথে থাকতে হবে এমন তো নয়। তুই চাইলে তাকে ইগনোর না করে নরম‍্যাল কথা বলেই থাক। তাতে তোদের দুজনেরই গিল্ট ফিল কম হবে।
আরেবাবা, একজন মানুষের সাথে আর একজন মানুষের সৌজন‍্যমূলক সম্পর্কও তো থাকে।
একবার ভেবে তুই নিজের কথা অতিরিক্ত ভাবতে গিয়ে হয়তো তার সাথে অন‍্যায় করে ফেলছিস।
সমস্যা যাইহোক তাকে সামনে থেকে ফেস করতে হয় বন্ধু। তুই কথা বল তোর ওয়াইফের সাথে। ”

আবীরের বলা কথাগুলো শুনে কিছুক্ষণ পর রাজীব বলে ওঠে, “হয়তো তুই ঠিকই বলছিস। আমি এভাবে ভাবিনি কখনো। ”

এবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আবীর বলে ওঠে, “চল অলরেডি দশটা বাজে এবার ওঠা যাক।”

“হ‍্যাঁ, চল ।” এইবলে তারা দুজনেই উঠে পড়ে সেখান থেকে বাড়ির উদ্দেশ্যে।

রাজীব যখন বাড়ি পৌঁছালো তখন ঘড়ির কাঁটায় রাত এগারোটা বাজে।
ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে মেইন গেট খোলার পর সন্তর্পণে যখন নিজের ঘরে এসে সে পৌঁছালো তখন দেখলো চারিদিক সুন্দর করে গুছিয়ে খাটের একপাশে শুয়ে ঘুমিয়ে আছে একটি মেয়ে। যার মাথার উপর উজ্জ্বল লাল রঙ জ্বল জ্বল করছে। যে রঙ মনে করিয়ে দিচ্ছে তার অস্তিত্বের কথা গোটা মাথা জুড়ে।
কিছুক্ষণ চুপ করে সেদিকে তাকিয়ে থাকার পর ডাইনিং – এ এসে বসে সে। এতক্ষণে খেয়াল হয় তার যে মেয়েটি সারাদিন কী খেলো! একথা মনে হতেই রান্নাঘরে ঢুকে সবকিছু ফাঁকা দেখে আর ফ্রিজে গতকাল রাতের খাবার একইরকম রাখা দেখে নিজের উপরই রাগ হয় তার।
এক মুহূর্তের জন‍্য মনে হয় ঘুমন্ত মেয়েটাকে জাগিয়ে কিছু খেতে বলবে পরক্ষণে মনে হয় তার ব‍্যবহারের জন‍্য মেয়েটাও হয়তো মনে মনে তাকে ঘৃণাই করে।
তবে যাইহোক কাল সকালে একবার আবীরের কথামত কথা বলতে হবে তাকে মেয়েটির সাথে।
এইসব ভেবে আর একবার নিজের ঘরে গিয়ে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে, নিজে পাশের ঘরে শোওয়ার জন্য পা বাড়ায় সে।

(চলবে……..)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here