মায়া,পর্ব:১১+১২

0
1402

#মায়া
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-১১:

শুভ্রা ও সীমান্ত সেই রহস্যময় বাড়িটিতে ঢুকে পড়লো ছোটুকে সাথে নিয়ে। প্রথমে সেই সিন্দুকটি যে ঘরে ছিলো সেই ঘরটিতে গেলো তারা। সিন্দুকের ভেতরে থাকা সেই নকশাটি বের করলো শুভ্রা।

শুভ্রা: এটি হয়তো এই বাড়িটির নকশা৷ তাই এই নকশাতেও রহস্য আছে।

সীমান্ত: নকশাতেও রহস্য?

শুভ্রা: হ্যাঁ, এই নকশাটির ছবি উঠিয়েছিলাম আমি ফোনে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো, ছবিটি ফোনো কালো হয়ে গিয়েছিলো। যখন উঠিয়েছিলাম একেবারে পরিস্কার ছিলো। কিন্তু মায়ের বাসায় যখন দেখলাম ছবিটি কালচে হয়ে গেছে।

শুভ্রা ফোন বের করে সীমান্তকে ছবিটি দেখালো। ছবিটি দেখে মনে হচ্ছে কোনো কালো কাগজের ছবি উঠিয়েছে শুভ্রা।

সীমান্ত: খুব অদ্ভুত লাগছে শুভ্রা। আমরা বাড়ি ফিরে যায় চলো৷ মনে হচ্ছে খারাপ কিছু হবে।

শুভ্রা: সন্ধ্যার আগে ফিরে যাবো। এখন মাত্র দুপুর। সন্ধ্যা হতে অনেক সময় বাকী।

তারপর তারা দুজন মিলে কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়ার আশায় বাড়িটির প্রতিটি জায়গা খোঁজাখুঁজি করলো, আর শেষমেশ তাদের হাতে তথ্য চলেও এলো।

শুভ্রা আর সীমান্ত যেই ঘরটিতে ছিলো সেই ঘরের আলমারিতে কাপড়ের ভাঁজে একটি বিয়ের কার্ড পেয়েছে তারা।

কনের নাম- রীতিকা শাহরিয়ার রীত।
বাবার নাম- সৈয়দ শাহরিয়ার হোসেন।
মায়ের নাম- রাবেয়া নাহার।

বরের নাম- মাহবুব জিহান।
বাবার নাম- আলমগীর কবির।
মায়ের নাম- সুরাইয়া খাতুন।

কার্ডটি নিয়ে শুভ্রা বললো,
শুভ্রা: যেই রাতে খুন হয়েছিলো, সেই রাতে মেহেদী অনুষ্ঠান ছিলো এই বাড়ির মেয়ের। তবে কি রীতিকা নামের মেয়েটির বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো?

সীমান্ত: হয়তো।

শুভ্রা: আমরা তো সেই বরের খোঁজ নিতে পারি, তাই না? তখন সব কিছুই পরিস্কার হয়ে যাবে।

সীমান্ত: কিভাবে খুঁজে পাবো সেই বরকে? অনেক বছর আগের ঘটনা!

শুভ্রা: তো? নাম আর পরিচয় দিয়ে খুঁজবো। তারা বেঁচেও তো থাকতে পারে। আর দেখো, গ্রামের বাড়ির ঠিকানাও দেওয়া আছে সেই বরের। আমরা সেখানে গিয়ে খোঁজ নেবো।

সীমান্ত: এখন তবে বাসায় ফেরা যাক। সব জায়গায় তো খোঁজা হলো।

শুভ্রা: না, এই ঘরের পাশের ঘরটিতে এখনো যাওয়া হয় নি।

সীমান্ত: সন্ধ্যা হয়ে যাবে কিছুক্ষণ পর। আর ছোটুকে নিয়ে এইখানে থাকাটা কি ভালো হচ্ছে? যদি সত্যি খারাপ কিছু থাকে এই বাড়িতে৷ আর শিশির শেফাও তো আমাদের খুঁজবে।

শুভ্রা: এসেছি যখন সেই ঘরটিতে অবশ্যই যাবো। আমি একটা অংশও বাদ রাখতে চাই না।

শুভ্রার কথায় সীমান্ত রাজি হলো। তারপর সেই ঘরটির সামনে এলো তারা।
শুভ্রা সেই ঘরটির দরজার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।

সীমান্ত বললো,
সীমান্ত: এই ঘরটিতে তালা দেওয়া। তুমি ঢুকেছো কিভাবে? আর এই ঘরটি আগে আমাদের চোখে পড়ে নি কেন? আমার স্পষ্ট মনে আছে এইখানে কোনো দরজা ছিলো না।

শুভ্রা এখনো দরজাটির দিকে তাকিয়ে আছে।

সীমান্ত: কি হলো, শুভ্রা?

শুভ্রা: দরজা না হয় বন্ধ হলো আপনা-আপনি, কিন্তু তালাও ঝুলবে, আমি তা ভাবতেও পারি নি।

সীমান্ত: তুমি ঢুকেছিলে?

শুভ্রা: ঢুকেছি। বের হওয়ার পর দরজাটা বন্ধও হয়ে গিয়েছিলো আমার চোখের সামনে, কিন্তু তালা ঝুলাবে কে? এতোটা সূক্ষ্ম ভাবে এসব কে করছে?

সীমান্ত তালা ভেঙে ভেতরে ঢুকলো। ভেতরের পোড়া গন্ধটা নাকে লাগছে। তারপর তারা ঘরের জিনিসপত্র সব নেড়ে ছেড়ে দেখলো। হঠাৎ শুভ্রার চোখ পড়লো সেই উপুড় হয়ে থাকা ফটো ফ্রেমটির দিকে।

শুভ্রা: সীমান্ত এই ফ্রেমটি কিসের তা একবার দেখা প্রয়োজন।

সীমান্ত শুভ্রার কথামতো ফ্রেমটির উপরে পড়ে থাকা আলমারিটি সরালো। তারপর ফ্রেমটি হাতে নিয়ে স্থির হয়ে গেলো।

শুভ্রা বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলো। আর উত্তরের আশায় সীমান্তের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। আর সীমান্ত একবার ফ্রেমটির দিকে তাকায় আরেকবার শুভ্রার দিকে।

শুভ্রা: কি হলো সীমান্ত? চুপ করে আছো কেন?

ধীর কন্ঠে সীমান্ত বললো,
সীমান্ত: এই মেয়েটি অনেকটা তোমার মতো শুভ্রা।

শুভ্রা ফ্রেমটি নিজের হাতে নিয়ে দেখলো, সীমান্তের কথা সত্য। ছবির মেয়েটি একদম তার মতো। যদিও ছবিটির একপাশ পুড়ে গেছে। কিন্তু যারা ভালোভাবে শুভ্রাকে দেখেছে বা শুভ্রার মুখ যাদের কাছে খুবই পরিচিত, তারা চোখ বন্ধ করে বলতে পারবে এই ছবির মেয়েটি শুভ্রা ছাড়া কেউ নয়। কিন্তু শুধুই একবার যদি কেউ শুভ্রাকে দেখে তাহলে এই ছবির মালিক শুভ্রা কিনা তা বুঝতে পারবে না।

সীমান্ত: এই মেয়েটা যদি তুমি হয়ে থাকো। তাহলে এই পরিবারটি তোমার পরিবার নয়তো শুভ্রা?

শুভ্রা ছলছল চোখে তাকালো সীমান্তের দিকে।

শুভ্রার বুকটা মোচড়ে উঠলো। এই পরিবারের মানুষগুলো যদি তার আপনজন হয়, তাহলে কতোটা যন্ত্রণাদায়ক হবে তার জন্য এই সত্যটা মেনে নিতে, কারণ মানুষগুলোর খুন হয়ে গেছে।
কেউ এই সত্যটা মেনে নিতে পারবে না যে তার পরিবারের সদস্যদের মেরে ফেলা হয়েছে।

এই বাড়ির ফ্যামিলি ফটোতে সবার ছবি আছে শুধু শুভ্রার মতো দেখতে এই মেয়েটির ছবি ছিলো না। এই ফটো ফ্রেম আর সেই নষ্ট করে ফেলা ছবির মধ্যে কি কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে?

শুভ্রা এসব ভাবতে লাগলো হঠাৎ ছোটুর চিৎকার শুনে সীমান্ত আর শুভ্রা দৌঁড়ে ঘরটির থেকে বের হলো।

সন্ধ্যা হয়ে গেছে সাথে একটি নিষ্পাপ প্রাণ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে।

শুভ্রা ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে ছাদের এক কোণে। আকস্মিকভাবে ঘটা ঘটনায় সে পাথর হয়ে গেছে।
সীমান্ত শুভ্রার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে, যেন ছেড়ে দিলেই শুভ্রা হারিয়ে যাবে।

কিছুক্ষণ আগে ছোটুর চিৎকার শুনে শুভ্রা আর সীমান্ত ঘরটি থেকে বের হয়ে দেখলো ছোটু সেই বন্ধ সিঁড়ির গ্রিল ধরে ছটফট করছে। শুভ্রা অবাক হয়ে গেলো কারণ শিশিরের সাথেও দুইবার এমন হয়েছিলো। কিন্তু শুভ্রা স্বপ্ন ভেবে উড়িয়ে দিয়েছিলো প্রতিবারই। কিন্তু আজকেরটা স্বপ্ন নয়। শুভ্রা আর সীমান্ত ছোটুকে ধরতে যাবে তার আগেই সে এক দৌঁড়ে ছাদে উঠে যায়। এরপর চোখের পলকে ছাদ থেকে ঝাপিয়ে পড়ে।

সীমান্ত আর এক মুহূর্ত দেরী না করে শুভ্রাকে নিয়ে সেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসলো৷ তারপর বাসায় ফিরে এলো তারা।

শুভ্রা ফ্রেশ হয়ে বিয়ের কার্ডটির দিকে তাকিয়ে আছে। আর বিড়বিড় করে বললো,
শুভ্রা: অভিশাপটি অনেক প্রাণ কেঁড়ে নিয়েছে। এখন এই অভিশাপ দূর করা খুব দরকার।

তারপর ফোন হাতে নিয়ে একজনকে ফোন করলো শুভ্রা।

চলবে–

#মায়া
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-১২:

শুভ্রা তার ভার্সিটির এক ফ্রেন্ডকে কল করলো। তার বান্ধবীটি সেই গ্রামে থাকে যেই গ্রামের ঠিকানা বিয়ের কার্ডটিতে দেওয়া আছে।

শুভ্রা তার বান্ধবীর সাথে অনেক গল্প করার পর বললো,
শুভ্রা: রিসা, আমার একটা সাহায্য করবি?

রিসা: হ্যাঁ, বল।

শুভ্রা: আচ্ছা, তোর গ্রামের বাড়ি চন্দনাইশ, তাই না?

রিসা: হ্যাঁ। কেন?

শুভ্রা: তুই আলমগীর কবিরের খোঁজ দিতে পারবি আমাকে?

রিসা: কে উনি?

শুভ্রা: আমি তোকে ডিটেইলস এড্রেস পাঠাচ্ছি৷ প্লিজ একটু খোঁজ নিয়ে বল। একটু তাড়াতাড়ি জানাবি কিন্তু। খুব দরকার। তার খবর না পেলে, মাহবুব জিহান নামের কাউকে চিনলেও হবে।

রিসা: আচ্ছা আমি তোকে জানাবো।

এদিকে শুভ্রা আর সীমান্ত গতকাল রাতের ঘটনা নিয়ে ভাবছে। এখনো তাদের মাথায় কিছুই আসছে না। তাদের চোখের সামনে ছোটু ছাদ থেকে ঝাপিয়ে পড়েছিলো। কিন্তু নিচে গিয়ে তারা ছোটুকে কোথাও খুঁজে পায় নি। ছোটুর রক্তাক্ত দেহটি নিচে নিথর পড়েছিলো তা তারা নিজ চোখে ছাদ থেকেই দেখেছিলো। কিন্তু হঠাৎ নিচে নামার আগেই কিভাবে গায়েব হয়ে গেলো ছোটুর দেহটি? আশেপাশে বহু খুঁজেও পেলো না ছোটুকে।

সীমান্ত আজ রাতেও দোকানে থাকবে। আগামীকাল একটা বাসায় উঠবে তারা। দোকানের মালিক সীমান্তকে বাড়িটির সন্ধান দিয়েছে। ছাদের উপর ঘর৷ আশেপাশে মানুষজন আছে যথেষ্ট। খারাপ কিছু হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

রাত দুইটা। শুভ্রার শরীর কাঁপছে অকারণে। শীতল কিছু তার আশেপাশে অনুভব করছে সে। ঘুমে তার শরীর অবশ হয়ে আসছে কিন্তু চোখ না খুললেও তার অস্বস্তিটা থেকেই যেতো। তাই জোরপূর্বক চোখ খুলে সামনে থাকা মানুষটিকে দেখে পুরো শরীর শিরশিরিয়ে উঠলো তার।

অস্ফুটস্বরে শুভ্রা বলে উঠলো, ছোটু!

ছোটু: আফামণি, তুমি আমারে ফেলাইয়া চলে আইলা কেন? আমারে আইসা নি যাইবা না? চলো আমার লগে। চলো।

ছোটু ধীর পায়ে শুভ্রার দিকে এগিয়ে আসছে। ভয়ে শুভ্রার গলা শুকিয়ে কাঠ৷ চোখের ঘুম উড়ে গেছে বহু আগেই।

শুভ্রা খেয়াল করলো ছোটু তার অনেক কাছেই ছিলো। কিন্তু তবুও শুভ্রাকে ধরতে পারছে না। অনেকক্ষণ ধরেই ছোটু কাছে আসার চেষ্টা করছে কিন্তু অদৃশ্য এক শক্তি শুভ্রাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে।
হঠাৎ তার ঘরটি খানিকটা আলোকিত হয়ে গেলো। শুভ্রা খেয়াল করলো বারান্দায় কেউ দাঁড়িয়ে আছে। সেখান থেকেই আলোটা আসছে। ছোটুর চোখ দুটি ভয়ংকর হয়ে উঠলো। তার মুখ থেকে গল গল করে রক্ত বের হতে লাগলো। হিংস্র দানবের মতো বারান্দায় ছুটে গেলো সে। তারপর কোথায় হারিয়ে গেলো ছোটু। আর সাথে সেই আলোটাও বিলীন হয়ে গেলো। শুভ্রা সাথে সাথে লাইট অন করলো। মেঝেতে কোথাও রক্তের দাগ নেই। কিন্তু ছোটুর শরীর বেয়ে অজস্র রক্ত ঝরছিলো।

এদিকে সীমান্তের সাথেও প্রায় একই ঘটনা ঘটেছে। রাত দুইটার সময় তাদের দোকানের বাইরে থেকে বাচ্চার কান্নার শব্দ আসছিলো। সীমান্ত চোখ খুলে খেয়াল করলো ছোটু তার মুখোমুখি। হাওয়ায় ভাসছে তার শরীর। একেবারে সীমান্তের শরীরের উপর। ছোটুর শরীর বেয়ে রক্ত ঝরছে, আর সেই রক্তে সীমান্তের পুরো শার্ট ভিজে গেছে। দম আটকে গেছে তার।
সীমান্তের পাশেই তার সহকর্মী ঘুমিয়েছিলো। তিনি চোখ খুলে সীমান্তের মুখের দিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে যান। কারণ সীমান্তের পুরো মুখে রক্ত। আর সে ভয়ে কাতড়াচ্ছে।

সহকর্মীটি একজন হুজুর ছিলেন। তিনি ঘরে খারাপ কিছুর আভাস পেয়েছেন৷ তখনই আল্লাহর নাম নিয়ে আয়াতুল কুরসিসহ বিভিন্ন সূরা পড়তে লাগলেন। সূরা পাঠ করা শেষে সীমান্তের বুকে মুখে ফুঁ দেওয়ার সাথে সাথে সীমান্তের শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়লো৷ আর সীমান্তের শরীর থেকে রক্তের দাগগুলোও বিলীন হয়ে গেলো।

রাত তিনটাই সীমান্তের জ্ঞান ফিরলে সে সহকর্মী হুজুরটিকে সব জানায়।

লোকটি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
এইটা খুবই খারাপ জ্বীন। তুমি যার বেশে তাকে আসতে দেখেছো সে আর বেঁচে নেই। তার মৃত্যুর পর এই জ্বীনের শক্তি অনেক বেড়ে গেছে। আর এমন জ্বীন তোমার পেছনে কেন পড়বে? তোমার সাথে কি কারো শত্রুতা আছে?

সীমান্ত: শত্রুতার সাথে জ্বীন পেছনে পড়ার কোনো সম্পর্ক আছে?

– হ্যাঁ, আছে। কারণ এই জ্বীনটি কোনো মানুষের গোলাম। কোনো মানুষ এই জ্বীনটিকে পাঠিয়েছে তোমার ক্ষতি করার জন্য।

সীমান্ত: মানুষ কিভাবে জ্বীনকে গোলাম বানাবে?

-এই মানুষগুলো আমাদের মতো সাধারণ মানুষ নয়। এরা শয়তানের উপাসক৷ এরা কালো জাদু জানে।

সীমান্ত: এর থেকে বাঁচার উপায় নেই?

-অবশ্যই আছে। সেই মানুষটিকে খুঁজে বের করতে হবে। আর তার এই খারাপ কাজটি থামাতে হবে। যতোদিন খুঁজে পাবে না, ততোদিন নিজেকে পবিত্র রাখবে। আর মুখে মুখে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করবে। কারণ তিনি ছাড়া আর কেউ পারবে না তোমাকে বাঁচাতে।

সীমান্ত সকালে শুভ্রা ও বাচ্চাদের সাথে দেখা করতে গেলো শুভ্রার মায়ের বাসায়। সীমান্ত শুভ্রাকে রাতের ঘটনাটি না জানালেও শুভ্রা সব জানিয়ে দেয়।
সব শুনে সীমান্ত চুপ করে রইলো। সে চায় না শুভ্রাকে মানসিক চাপে রাখতে তাই এই ব্যাপারে আর কিছুই বলে নি। কিন্তু সেদিনের পর সীমান্ত সেই নতুন বাসায়ও উঠে নি, আর দোকানেও থাকে নি। রাতে শুভ্রার মায়ের বাসায় থাকতো। তারাও আর আপত্তি জানায় নি। কারণ শুভ্রা আর সীমান্তের মুখের হাবভাব দেখে তারা বুঝতে পেরেছে কোনো গুরুতর কিছু ঘটেছে তাদের সাথে। তারপর সিদ্ধান্ত হয় সীমান্ত যতোদিন থাকবে ততোদিন শুভ্রার খালাতো ভাইয়ের স্ত্রী তার সন্তানদের নিয়ে তার বাবার বাড়ি থাকবে। কারণ সেই বাসায় এতো মানুষ থাকার জায়গা নেই।

সেই ঘটনার পর এক সপ্তাহ কেটে যায়। তবে মাঝে মাঝেই ছোটুকে রাত বারোটার পর বারান্দার বাইরে দেখা যায়। ঘরের ভেতর খারাপ জ্বীন ঢুকতে না পারার ব্যবস্থা করে ফেলেছে তারা। সীমান্ত নাইট ডিউটি ছেড়ে দিয়েছে। মাগরিবের আগেই সে বাসায় ফিরে, সূর্য উঠার পর বাসা থেকে বের হয়। মালিক খুব সহজেই রাজি হয়ে যায় সীমান্তকে এই সুবিধা দেওয়ার কথায়। কারণ সহকর্মীটি মালিককে বুঝিয়েছিলো সীমান্তের রাতে ঘরের বাইরে থাকাটা ভালো হবে না।

এদিকে বিকেলের দিকে রিসার ফোন আসলো শুভ্রার নম্বরে৷ কল দেখেই শুভ্রা তড়িঘড়ি করে রিসিভ করলো।

রিসা: এই শুভ্রা৷ তুই কেন জানতে চাইছিস ওদের সম্পর্কে আগে বল?

শুভ্রা: আমার খুব দরকার তাদের সাথে দেখা করা। প্লিজ, আমি তোকে সমস্যা সমাধান হলে সব বলবো। কিন্তু এখন কিছুই জিজ্ঞেস করিস না।

রিসা: আচ্ছা, বলছি। আলমগীর কবির এখানকার পরিচিত একজন মানুষ। নাম বলতেই সবাই চিনে গেছে। তার দুই ছেলে। তার বড় ছেলের নাম মাহবুব জিহান। বর্তমানে সে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে শহরেই থাকে। কিন্তু আরেকটা কথা কানে এসেছে তার সম্পর্কে।

শুভ্রা: কি কথা?

রিসা: পাঁচবছর মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলো সে।

শুভ্রা: কেন?

রিসা: একটা মেয়েকে খুব ভালোবাসতো। বিয়ের কথাবার্তাও হয়ে যায়। কিন্তু বিয়ের আগের দিন রাতে সেই মেয়েটির খুন হয়ে যায় তার পুরো পরিবার সহ।

শুভ্রা: আমাকে তার ঠিকানা দিবি?

রিসা: শহরে থাকে সেইটা জানতে পেরেছি। শহরে কোথায় থাকে সেটি কেউ জানে না।

শুভ্রা: ফোন নম্বর?

রিসা: হ্যাঁ। পেয়েছি একটা। ছেলেটির বাবার নম্বর। কিন্তু উনি আর বেঁচে নেই।

শুভ্রা: কবে মারা গেছে?

রিসা: দুই তিন বছর হবে।

শুভ্রা: দাফন কোথায় হয়েছে?

রিসা: গ্রামের বাড়িতেই।

শুভ্রা: তাহলে ওরা নিশ্চয় গ্রামের বাড়ি যায়।

রিসা: হয়তো।

শুভ্রা: পরের বার গেলে আমাকে জানাবি? প্লিজ। তার সাথে যোগাযোগ করতে পারবো এমন নম্বরও খুঁজে রাখিস।

রিসার সাথে কথা বলার পর শুভ্রা আলমগীর সাহেবের নম্বরটিতে ফোন দেয়। শুভ্রা যা ভেবেছে তাই হয়েছে। নম্বরটি বন্ধ। তবুও সে সারাদিন ফোন দিতে লাগলো। শুভ্রা আশা ছাড়ে নি৷ কারণ এইটা এখন তার জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়েছে। তার অতীতের মুছে যাওয়া অংশের সাথে এর যোগসূত্র থাকতেই পারে। শুভ্রা টেবিলে রাখা লকেটটির দিকে তাকিয়ে আছে। তার অতীতের মায়া লেগে আছে এখনো। এতো সহজে সে অতীতকে হারিয়ে যেতে দেবে না।

মানুষ ভবিষ্যতের সন্ধান করে৷ বর্তমান নিয়ে ব্যস্ত থাকে। কিন্তু শুভ্রার জন্য কিছুটা ব্যতিক্রম হবে। অতীতকে নিয়েই সে ব্যস্ত থাকবে এখন। আর অতীতের সন্ধান করতে থাকবে, যতোদিন এর উত্তর না পায়।

চলবে–

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here