মায়া,পর্ব:৯+১০

0
1646

#মায়া
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-০৯:

আজ শুভ্রার জন্মদিন। অথচ কিছু দেওয়ার মতো সামর্থ্য নেই সীমান্তের। দোকানের বাইরে একটি চেয়ারে বসে অন্যমনস্ক হয়ে কিছু একটা ভাবছিলো সীমান্ত।

ছোটু এসে বলল,
ছোটু: ভাইজান কি ভাবতাছো?

সীমান্ত: কিছু না।

ছোটু: আমারে আফার কাছে কবে নি যাইবা?

সীমান্ত: আচ্ছা ছোটু, তুই শুভ্রাকে কেন খুঁজছিস বল তো?

ছোটু: আমার নাম ছোটু না ভাইজান, চিতুই। আর আমার আফারে লাগবোই। তোমারে কইয়া লাভ নাই।

সীমান্ত হেসে বলল,
সীমান্ত: আচ্ছা, বুঝলাম। আচ্ছা, আগে বল তো তোর নামটা কে রেখেছিলো?

ছোটু: আম্মা রাখতে কইছিলো।

সীমান্ত: ওহ, তোর চাচা ছাড়া আর কেউ নেই?

ছোটু: না গো ভাইজান। আব্বা আমার জন্মের আগেই শেষ। আম্মা তো জন্মের পর পর আমারে ফেলাইয়া আল্লাহর কাছে চইলা গেছে। চাচা আমারে বড়ো করছিলো। এহন চাচাও নাই।

সীমান্ত: তোর আব্বার কি হয়েছিলো?

ছোটু: আব্বারে খুন কইরা ফেলসে মেলা বছর আগে। যেই বাসায় আপনারা ছিলেন, সেই বাসার দারোয়ান ছিলো আমার আব্বা। আমার আব্বার কোনো দোষ ছিলো না। তবুও খালি খালি তারে মাইরা ফেলছে।

সীমান্ত: তোর চাচাকে কে মেরেছে? কারো উপর সন্দেহ হয় নি তোর?

ছোটু: কেইস তো বন্ধ কইরা দিসে। সন্দেহ হইয়াও লাভ নাই। ভূতের লগে পুলিশ পারবো না।

সীমান্ত: কি বলিস?

ছোটু: আমার সামনে চাচারে মারছে গো ভাইজান। আমি পালাইয়া আরেক গেরামে উঠছিলাম। নইলে আমারেও মাইরা ফেলতো। পরের দিন যহন গেরামে গেছিলাম তহন পুলিশ ভাইজান রে কইছি ভূতে মারছে, আমার কথা মানে নাই। আর তোমরাও চইলা গেলা, তাই এহানে আইলাম আফামণির লগে দেখা কইরবার জন্যি।

সীমান্ত: শুভ্রাকে কি বলবি? আমাকে বল।

ছোটু: তুমি বুঝবা না।

সীমান্ত: তোর চাচাকে যখন মেরেছিলো, তুই দেখেছিস ভূতটাকে?

ছোটু: না ভাইজান। আচমকা চাচাজান গলা ধইরা রাস্তায় শুইয়া পড়ছে। তারপর দেখলাম, মুখটা খারাপ হইয়া যাইতাছে। তারপর আর জানি না কিছু।

সীমান্ত ভাবছে হয়তো এটা প্রাকৃতিক মৃত্যু। মানুষ শুধু শুধু কথা বাড়াচ্ছে৷ চাচাটি হয়তো অসুস্থ ছিলো। তাই সেই বাড়ির সামনে থাকা অবস্থায় তার মৃত্যুটা হয়। আর মানুষ ভাবছে বাড়ির ভূতগুলো মেরে ফেলেছে তাকে।

ছোটু: ভাইজান, ভূতটা বহু খারাপ। চাচাজান কইছিলো, ওই বাড়ির ভেতরে একখান দরজা আছে, সেইখানে বন্ধ কইরা রাখছে ভূতটারে। ভূতটা ওই বাড়ির এক মাইয়ারে বিয়া করতে চাইছিলো। কিন্তু তারা মানে নাই৷ তাই ভূতটার বাবা সবাইরে মাইরা ফেলসে।

সীমান্ত গম্ভীরমুখে ভাবলো কিছুক্ষণ। হয়তো ছোটু বানিয়ে বানিয়ে বলছে। এসব বাচ্চারা খুব সুন্দর করে রসিয়ে রসিয়ে মিথ্যে কথা বলতে পারে। তারা ভাবে, এসব শুনালে শ্রোতা ভয় পাবে। কিন্তু সীমান্তের বরং ভালোই মজা লেগেছে।

ছোটুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
সীমান্ত: ভালো সৃজনশীলতা আছে তোর। পড়াশুনা করলে একদিন বড় কিছু হবি।

শুভ্রা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বসেছিলো জানালার পাশে। আজ তার মন মেজাজ ভালো।
এদিকে শিশির আর শেফা খালাম্মার নাতি-নাতনীদের সাথে খেলছে। শুভ্রার খালাম্মা রোকসানা হোসেনের একটি মাত্র ছেলে। স্বামী মারা গেছে অনেকবছর হয়েছে। তারপর থেকেই রোকেয়া হোসেন বোনের বাসায় থাকে। ছেলে দেশের বাইরে চাকরী করে। কিন্তু তার স্ত্রী তিনবাচ্চা নিয়ে শাশুড়ীর সাথেই থাকে।

রোকেয়া হোসেন একটি বক্স হাতে শুভ্রার পাশে এসে বসলেন।

শুভ্রা: এইটা কি মা?

রোকেয়া হোসেন: এইগুলো তোর জন্য রেখেছিলাম। কখনো দেওয়া হয় নি৷

রোকেয়া হোসেন বক্স খুলে শুভ্রার হাতে দিলেন। শুভ্রা দেখলো সব ভারী গহনা।

শুভ্রা: মা এসব আমার লাগবে না।

রোকেয়া হোসেন: শুভ্রা, না করিস না মা৷ তুই ছাড়া আমার কেউ নেই। তাই এগুলো তোর জন্য। এসবে শুধু তোর অধিকার। আমি তো তোর মা, তাই না? আমার কি মেয়েকে কিছু দিতে মন চাইবে না?

শুভ্রা: তোমার ভালোবাসা আর দো’আর চেয়ে বেশি কিছু চাই না আমি। তুমি সীমান্তের মতো একটি ছেলেকে আমার জন্য খুঁজে দিয়েছো, এতেই আমি অনেক খুশি।

রোকেয়া হোসেন: সীমান্ত ছেলেটা আসলেই অনেক ভালো। আচ্ছা, দেখ তো গহনাগুলো তোর ভালো লেগেছে কিনা। শেফার জন্য একটি বানিয়েছিলাম।

শুভ্রা মায়ের মন রাখার জন্য গহনাগুলো নিলো। তারপর একটা একটা দেখতে লাগলো।
হঠাৎ একটি লকেটে শুভ্রার চোখ আটকে গেলো।

লকেটটি হাতে নিয়ে শুভ্রা ভালোভাবে লক্ষ্য করলো। এই লকেটটা আগে কোথায় দেখেছে? অনেক পরিচিত মনে হচ্ছে!
শুভ্রা অনেকক্ষণ চিন্তা করার পর তার মনে পড়লো, অবিকল এই লকেটটি সেই রহস্যময় বাড়ির সিন্দুকটিতে থাকা লকেট তিনটির মতো।

শুভ্রা কোনো কিছুই মেলাতে পারছে না। সবকিছুই রহস্যময় লাগছে তার কাছে।

শুভ্রা দেরী না করে রোকেয়া হোসেনের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
শুভ্রা: মা, দেখো তো, এই লকেটটা? এইটা তুমি কোথায় পেয়েছো?

রোকেয়া হোসেন লকেটটি হাতে নিয়ে বললেন,
রোকেয়া হোসেন: এইটা তো তোর৷ দশ বছর আগে তোকে যখন পেয়েছিলাম, এই লকেটটা তোর গলায় ছিলো।

শুভ্রা লকেটটা হাতে নিয়ে বলল,
শুভ্রা: আমার লকেট?

রোকেয়া হোসেন: হ্যাঁ, তোর।

শুভ্রা কি ভেবে বলল,
শুভ্রা: মা, আমি একটু বাইরে যাবো। তুমি শিশির আর শেফাকে দেখে রাখবে।

রোকেয়া হোসেন: কোথায় যাবি?

শুভ্রা: কিছু সমস্যার সমাধান খুঁজতে যাচ্ছি৷

শুভ্রা সীমান্তের নম্বরে একটি মেসেজ দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। উদ্দেশ্য সেই বাড়ি।

শুভ্রা বাড়িটির সামনে নামলো ভাড়া মিটিয়ে৷ বাড়িটির সামনে দাঁড়ানোর পর ভয় ভীড় করছে মনে৷ কিন্তু অনেক সাহস দেখিয়ে এতোটুকু পথ চলে এসেছে। আর পিছনে ফিরে যাওয়ার সুযোগ নেই।

বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়াতেই প্রথম দিনের মতোই দরজটা আপনা-আপনি খুলে গেলো। ঘরে ঢুকেই দাঁড়িয়ে গেলো সে। মনে হলো বাড়ি ভর্তি মানুষ। আর তারা শুভ্রার দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু শুভ্রা কাউকে দেখছে না, তবুও আশেপাশে অনেকগুলো অস্তিত্বের আভাস পাচ্ছে।

কি মনে করে শুভ্রা একটু জোরে শব্দ করে বলল,
শুভ্রা: আমি প্যারানরমাল ব্যাপারে বিশ্বাস করি না। তবুও আজ বিশ্বাস করতে মন চাইছে। যদি সত্যি এই বাড়িতে এই মুহূর্তে আমি ছাড়া অন্য কিছু থেকে থাকে, তবে আমাকে এর কোনো ইঙ্গিত দিতে হবে।

কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে ঘরটির সবগুলো ফ্যান চলতে শুরু করলো। শুভ্রা এই ঘটনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না।

যদিও সে খুব সাহস নিয়ে বলেছিলো, কিন্তু সত্যি সত্যি এর সাড়া পাবে তা সে কল্পনা করে নি। ভয়ে তার মাথা ঘুরছে এখন।

কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে শুভ্রা বলল,
শুভ্রা: এই বাড়ির সাথে কি আমার কোনো সম্পর্ক আছে? আমার এই লকেট আর সেই সিন্দুকের লকেটগুলোর মিল থাকার কি কোনো কারণ আছে? আর সেই সিন্দুকটির মতো ডিজাইন করা দরজা স্বপ্ন দেখা, যখন আমি এই বাড়িতেই আসি নি। এসব কেন আমার সাথেই হচ্ছে? আমার কি অপরাধ ছিলো?

শুভ্রা ভেবেছে এবার কোনো সাড়া আসবে, কিন্তু না। বরং কিছু শীতল হাওয়া বয়ে গেছে তার পাশ দিয়ে। এরপর আর কিছুই মনে নেই তার।

চোখ খুলে নিজেকে একটি ঘরে আবিষ্কার করলো শুভ্রা। সে বিছানায় শুয়ে আছে। পাশের বারান্দাটি খোলা। বাতাস আসছে পুরো ঘরে৷ শরীরটা ভারী ভারী লাগছে খুব। মনে হচ্ছে খুব জ্বর এসেছে তার। মাথাটা হালকা তুলে ধপ করে বালিশে ফেলে দিলো শুভ্রা। চোখ বন্ধ করতেই মনে হলো একটি শীতল হাত তার কপালে ঠেকেছে। কিন্তু চোখ খুলে কিছুই দেখলো না। হঠাৎ কানে আসলো একটি গানের সুর৷ কেউ একজন সুরেলা কন্ঠে গান গাইছে। কন্ঠটি খুব পরিচিত মনে হচ্ছে তার কাছে। আবার মাথা তুলে বোঝার চেষ্টা করছে কে গানটি গাইছে। কিন্তু পারছে না বিছানা ছেড়ে উঠতে।

সে আবার চোখ বন্ধ করলো, কারণ চোখটি খোলা রাখতেই পারছে না। খুব জ্বলছে তার চোখ দুটি।
শুভ্রা বুঝতে পারলো কেউ তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
এদিকে সেই কন্ঠটিও এবার খুব কাছে মনে হচ্ছে। একেবারে কানের কাছে।

শুভ্রার শরীর থরথর করে কাঁপছে। কেউ একজন শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরেছে।

শুভ্রা ভাবছে সে হয়তো আজ মৃত্যুর দেখা পাবে৷ মনের অজান্তেই ভাবছে, কেন এসেছে আবার এই ঘরে? কিন্তু, না এসেও উপায় ছিলো না। এই বাড়ি যে তাকে মায়ায় বেঁধে ফেলেছে। তাই তো এক অদৃশ্য আকর্ষণে সে ছুটে এসেছে আবার।

হঠাৎ গলা ফাটিয়ে শুভ্রা চিৎকার দিয়ে উঠলো আর অবশেষে চোখদুটোও সব শক্তি দিয়ে খুলতে পারলো।

গানটি এখনো কানে বাজছে। এখন অনেকটা দূর থেকেই আসছে। শুভ্রা বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো। এইটা সেই রুম যেখানে শুভ্রা সীমান্ত আর বাচ্চাদের নিয়ে ছিলো।

শুভ্রার চলতে খুব কষ্ট হচ্ছিলো, তবুও নিজেকে টেনে টেনে ঘর থেকে বের করলো। শব্দটি ঠিক পাশের ঘরটি থেকে আসছে৷ শুভ্রা পা বাড়াচ্ছে কিন্তু কেউ তার পা দুটি আটকে ফেলছে। সে সামনে যেতেই পারছে না৷

শুভ্রা দেয়াল ধরে পা দুটি টেনে টেনে পাশের ঘরটির সামনে নিয়ে এলো নিজেকে। দরজাটির সামনে আসতেই দরজাটি আপনা-আপনি খুলে গেলো। সাথে সাথে তার পা দুটিও বাঁধন মুক্ত হলো। পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখলো, পায়ে কারো হাতের ছাপ পড়ে আছে৷

নিজেকে সামলে নিয়ে দরজার দিকে পা বাড়ালো। ঘরটির ভেতরের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে ঘরটিতে আগুন লেগেছিলো অনেক বছর আগে। পুড়ে একেবারে দগ্ধ হয়ে গেছে সবকিছু। দেয়ালেও পোড়া দাগ লেগে আছে। কালো হয়ে গেছে সাদা দেয়ালটি। শুভ্রা অবাক হলো খুব।

শুভ্রা ভাবছে,
এই পুরো বাড়িটি অক্ষত, শুধু এই ঘরটির এমন অবস্থা কেন? আর আগুন লাগলে পুরো বাড়িতে লাগার কথা ছিলো, শুধু এই ঘরটিতে লেগেছে! তার মানে কেউ ইচ্ছে করেই লাগিয়েছে।

হঠাৎ শুভ্রা দেয়ালে ভারী কিছু আঘাত করার শব্দ শুনলো। মনে হচ্ছে এই ঘরের পাশের ঘরে কেউ দেয়ালে আঘাত করছে। শুভ্রা ভয়ে পেছাতে শুরু করলো।

মনে মনে ভাবলো,
শুভ্রা: না এই ঘরে আর এক মুহূর্তও থাকা যাবে না।

কিন্তু যেই সে ঘরটি থেকে বের হতে যাবে তখনই পায়ে ভারী কিছুর সাথে আঘাত পেয়ে মেঝেতে পড়ে গেলো সে।

পায়ে হাত দিয়ে ভারী জিনিসটির দিকে তাকিয়ে শুভ্রা অবাক হয়ে গেলো।

চলবে–

#মায়া
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-১০:

খুব বড়ো একটি কাঠের ফ্রেম মেঝেতে পড়ে আছে। সেই ফ্রেমটির সাথে পা লেগে ব্যথা পেয়েছিলো শুভ্রা। উল্টো দিকে থাকায় ফ্রেমটিতে কি বাঁধানো আছে তা দেখতে পাচ্ছে না সে।
ফ্রেমটি আলমারির নিচে চাপা পড়ে আছে। এখন ফ্রেমটি কিসের তা দেখতে হলে আগে এই আলমারিটি সরাতে হবে। কিন্তু এই ঘরটিতে বেশিক্ষণ থাকাটা তার কাছে সুবিধার মনে হচ্ছে না। তাই ঘরটি থেকে সে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লো।

ঘরটি থেকে বের হয়ে জোরে জোরে শ্বাস নেওয়া শুরু করলো শুভ্রা। অদ্ভুত কিছু অনুভব করেছিলো সেখানে। যা মোটেও ভালো লাগছিলো না তার।

হঠাৎ ধড়াম করে শব্দ হলে শুভ্রা কেঁপে উঠলো। পেছনে ফিরে দেখলো রুমের দরজাটি আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে গেছে।
শুভ্রা এক মুহুর্তও দেরী না করে দ্রুত পায়ে নিচে নেমে গেলো।

শুভ্রা মনে মনে বিড়বিড় করে বলছে,
শুভ্রা: এই বাড়িতে নিশ্চিত কিছু একটা আছে। আমার এক্ষুনি বেরিয়ে যাওয়া উচিত এই বাড়ি থেকে।

শুভ্রা বের হতে যাবে তখনই উপর থেকে কারো চিৎকারের শব্দ কানে এলো। কোনো পুরুষের কন্ঠ মনে হচ্ছে। পাশাপাশি আবার সেই সুরেলা মেয়েলি কন্ঠের গান ভেসে এলো কানে।

শুভ্রা সিঁড়ি বেয়ে অদৃশ্য এক টানে উঠতে যাবে, ঠিক সেই মুহূর্তেই বাড়ির বাইরে থেকে সীমান্তের কন্ঠ শুনতে পেলো সে। মুহুর্তেই তার শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো।

শুভ্রা এক দৌঁড়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। দেখলো সীমান্তের সাথে ছোটুও এসেছে।

সীমান্ত: তুমি কেন এই বাড়িতে এসেছো? আমায় বলেছো না আসতে কিন্তু নিজেই চলে এলে আবার!

শুভ্রা: সীমান্ত, এই বাড়িটিতে এক অদ্ভুত মায়া আছে। এই বাড়িটি অভিশপ্ত। এই বাড়িতে হয়তো অনেক রহস্য আছে।

সীমান্ত: কি বলছো?

শুভ্রা: এই দেখো লকেটটা। এইটা আমার লকেট। ঠিক এই রকম লকেট এই বাড়িতেও দেখেছি।

সীমান্ত: এইটা কাকতালীয় হতে পারে।

শুভ্রা: না কাকতালীয় নয়। এই জায়গাটা আমার পরিচিত। আমি আগেও এসেছি এখানে। কিন্তু আমার কিছুই মনে পড়ছে না।

সীমান্ত: কাম ডাউন শুভ্রা। তুমি এমন অস্থির হচ্ছো কেন?

শুভ্রা: আমি অস্থির হচ্ছি না। কিন্তু এই বাড়িতে কিছু একটা আছে। সীমান্ত তোমাকে আরো একটা কথা বলার আছে৷ এই বাড়িতে আরো একটা ঘর আছে। আমরা আগে দেখি নি সেই ঘরটি। তুমি আসো আমার সাথে একবার।

ছোটু দৌঁড়ে শুভ্রা আর সীমান্তের পাশে এসে বললো,
ছোটু: আমি তোমারে কইছি না, এই বাড়িতে ভূত আছে? তুমি তো মানো নাই ভাইজান। আফামণি, তুমি এই বাড়িতে যাইয়ো না আর। এহানে একটা খারাপ ভূত আছে। তোমারে আমি কইবো সব কথা। তোমারে তাই তো খুঁজতাছি আমি।

ছোটুর কথায় অবিশ্বাস করলেও শুভ্রা যখন বলছে এই বাড়িতে খারাপ কিছু আছে, তাহলে সীমান্তের তা অবশ্যই মানতে হবে। কারণ শুভ্রা কখনো বানোয়াট কথা বলবে না।

ছোটু শুভ্রার হাত ধরে বলা শুরু করলো, যা যা সে জানতো সব।

চিতুইয়ের চাচা অর্থাৎ যিনি মারা গিয়েছিলেন সেদিন রাতে, তার কাছে এই বাড়ির সব রহস্য জানা ছিলো। চিতুইয়ের বাবা যুবক বয়স থেকেই এই বাড়ির দারোয়ান ছিলো। প্রায় বারো বছর আগে এই বাড়ির সব সদস্যদের খুন করা হয়েছিলো। চিতুইয়ের চাচা এই খুনের সাক্ষী ছিলেন। কারণ তিনি নিজ চোখে দেখেছেন খুন হতে।
সেদিন এই বাড়ির মালিকের বড়ো নাতনির মেহেদী রাত ছিলো। বাসায় সেদিন বাড়ির সদস্য ছাড়াও নিকট আত্মীয়রাও এসেছিলো। আর যারা এসেছিলো সবাই সেই রাতেই খুন হয়ে যায়। তাদের কেন খুন করা হয়েছে তা চিতুই জানে না। কিন্তু এইটুকু জানে, এই বাড়ির মেজো নাতনিকে একটা ছেলে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলো। কিন্তু ছেলেটি ভালো ছিলো না। ছেলেটির বাবা শয়তানের উপাসনা করতো। তারা সেই মেয়েকে বশে আনার চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু পারে নি। বরং মেয়েটির দাদা যখন জানতে পারে তখন সেই ছেলেটিকে ধরে এনে এই বাড়িতে একটি ঘরে বন্দি করে রেখেছিলো।

খুন হওয়ার পরদিন সকালে পুলিশ এসে সবার লাশ পায় শুধু একজনের লাশ ছাড়া। কারণ এই পরিবারের মোট যতজন সদস্য ছিলো, আত্মীয়রা সহ তাদের মধ্যে শুধু একজনকে খুঁজে পাওয়া যায় নি। এখন কেউ জানে না সে কি আদৌ বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে।

চিতুইয়ের চাচা স্বপ্নে এই বাড়ির মালিককে দেখতো সবসময়। তিনি যা বলতেন চাচা তাই করতো। সীমান্ত আসবে সেটি চাচা আগে থেকেই জানতো। তাই এই বাড়িটি দেখিয়ে দেয় থাকার জন্য। কারণটি চিতুই জানে না। তবে এইটুকু জানে শুভ্রা এই বাড়িটি অভিশাপ মুক্ত করতে পারবে।

শুভ্রা আর সীমান্ত ছোটুর কথা শুনে অবাক হয়ে গেলো।

শুভ্রা: আমি কিভাবে অভিশাপ মুক্ত করতে পারবো?

ছোটু: তুমি ছাড়া আর কেউ পারবো না তা চাচা কইছিলো। বহু পুলিশ ভাইজান ওই কেইসটা ধরছিলো। কিন্তু কাউরে খুঁজে পাওয়া যায় নাই আর। তাই পুলিশ এই কেইস বন্ধ কইরা দিসিলো। বহু মানুষ ছিলো আগে এহানে। সবাই পালাইছে। যারা আছে তাদের জায়গা নাই তাই এহানে থাকে।

শুভ্রা মনে মনে স্থির করলো, সে এই বাড়িটি অভিশাপ মুক্ত করবে।

শুভ্রা সীমান্তের হাত ধরে বললো,
শুভ্রা: আমার সাথে এই বাড়ির নিশ্চিত কোনো সংযোগ আছে। সীমান্ত, আমি এই বাড়ি অভিশাপ মুক্ত করবো। তুমি আমার সাথে থেকো প্লিজ।

সীমান্ত শুভ্রাকে আশ্বস্ত করলো।
বারো বছর আগের তথ্য সংগ্রহ করা এতোটা সহজ হবে না৷ কিন্তু এই বাড়িতেই তথ্য পাওয়া যাবে।

শুভ্রা: চলো। হয়তো এই বাড়িতেই কিছু পাওয়া যাবে।

ছোটু: আফামনি, যাইয়ো না আর সেইখানে।

শুভ্রা: কিছু হবে না ছোটু। আমরা তো ছিলাম এই ঘরে। আমাদের কিছু হয় নি।

ছোটু: ভয় করে।

শুভ্রা: বাড়িতেই যদি না যায়, তাহলে অভিশাপ মুক্ত কি করে হবে?

ছোটু: আমি যামু না।

সীমান্ত: তুই তোর ঘরে চলে যা।

ছোটু: আমারে একা ছাইরো না। আমারে শেষ কইরা ফেলবো।

শুভ্রা: তাহলে আমাদের সাথেই চল। আমার সাথে সাথে থাকবি।

শুভ্রা আর সীমান্ত ছোটুকে নিয়ে আবার ঢুকলো সেই বাড়িতে।

শুভ্রা মনঃস্থির করে ফেললো, এই বাড়ির একটা কোণাও সে আজ বাদ রাখবে না৷ খুনিদের শাস্তি দেবে। আর এই অভিশাপকেও দূর করবে।

চলবে—

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here