মায়া,পর্ব:১৩+১৪

0
1855

#মায়া
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-১৩: (রহস্যের উন্মোচন-০১)

এক মাস পর মাহবুব জিহানের সাথে দেখা করার সুযোগ হলো শুভ্রার। সীমান্ত ও শুভ্রা একটি অফিসের ওয়েটিং রুমে বসে আছে।

একজন পিয়ন এসে তাদের ঢেকে ভেতরে নিয়ে গেলো।

মাহবুব জিহান রকিং চেয়ারে বসে আছেন একটা বই হাতে। চশমার ফাঁকে শুভ্রা আর সীমান্তকে দেখে তিনি বিস্মিত হয়ে হাতে থাকা বইটি টেবিলের উপর রাখলেন।

অস্ফুটস্বরে বলে উঠলেন, নদী!

শুভ্রা নদী নামটি শুনে চমকে উঠলো। এই নামটি সে কোথায় শুনেছে? হ্যাঁ, ওই বাড়িটির এলবামে থাকা নামগুলোর মধ্যে একটি ছিলো এই নামটি।

মাহবুব জিহান চেয়ার ছেড়ে উঠে দ্রুত বেগে শুভ্রার কাছে চলে এলো। ভালোভাবে শুভ্রার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নিলো। আর ভাবলো, হ্যাঁ, এটাইতো আমাদের নদী।

মাহবুব জিহান ব্যস্ত স্বরে বললেন,
মাহবুব জিহান: নদী, তুই বেঁচে আছিস? আমার তো বিশ্বাস হচ্ছে না? কোথায় ছিলি তুই এতোদিন?

সীমান্ত: নদী কে? ও তো আমার ওয়াইফ, শুভ্রা। আপনার হয়তো ভুল হচ্ছে।

মাহবুব জিহান: ভুল? আমার? আমি আমাদের নদীকে চিনবো না। আমার বোনকে চিনবো না আমি? এই নদী, কি বলছে ও?

শুভ্রা: আমি বলছি, একটু আমাদের কথাটা শুনুন। আমার নাম শুভ্রা। আর ও সত্য বলছে। ও আমার হাসবেন্ড, সীমান্ত। আমরা আপনার কাছে এসেছি, সেই বাড়িটির রহস্য জানার জন্য। এই দেখুন।

শুভ্রা ব্যাগ থেকে বিয়ের কার্ড আর সেই বাড়িটির ছবি বের করে দেখালো।

শুভ্রা: আমরা এই বাড়িতে থাকতে গিয়েছিলাম৷ সেখানেই এসব পেলাম। আপনার কাছে কিছু জানার ছিলো।

মাহবুব জিহান শুভ্রার কথাগুলো শুনে অবাক হলো। সে ভাবছে নদী কেন এমন অপরিচিতদের মতো আচরণ করছে!

শুভ্রা: আপনি সেই বাড়ির লোকদের সম্পর্কে কিছু বলবেন আমাদের?

জিহান তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
জিহান: তুই আমাকে বলছিস, তোর পরিবারের লোকদের নিয়ে আমি তোকেই বলবো? আমার চেয়ে তোর বেশি জানার কথা। কি সব প্রশ্ন করছিস তুই? আর এতো বছর কোথায় ছিলি তুই?

শুভ্রা: আমি আমার অতীত নিয়ে জানতে এসেছি। আমার অতীতের পরিচয় নদী নামে ছিলো কিনা তা আমি বলতে পারবো না। তবে আমি এখন শুভ্রা। আমি শুধু আপনাকে এখন এতোটুকুই বলতে পারবো, যে আমার অতীতের কিছুই মনে নেই।

জিহান অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর বলতে শুরু করলো অতীতের ঘটনা।

বাড়িটির প্রথম মালিক মো. ইব্রাহীম খান। তিনিই এই বাড়িটি বানিয়েছেন তার একমাত্র ছেলের জন্য। ইব্রাহীম খানের একমাত্র বংশধর ছিলেন মো. সুফি খান শাহ। তিনি সেই সময়ের অনেক উচ্চ শিক্ষিত ছিলেন। তার গ্রামের কেউ নিজের নামটাও লিখতে পারতো না। গ্রামের মানুষজন কবিরাজ আর পীর-দরবেশদের অনেক বেশি সম্মান করতো, আর তাদের কথা মতো চলতো। অসুস্থ হলে ডাক্তার দেখাতে হয়, এসব তারা জানতো না। এসব অশিক্ষা আর কুসংস্কার তিনি দূর করতে চেয়েছিলেন। তাই গ্রামেই তার বাবার তৈরী বাড়িটিতেই স্থায়ীভাবে বসবাস করা শুরু করেন। সেই সূত্রে, গ্রামে স্কুল-কলেজ এবং হাসপাতাল নির্মাণ করেন। তার এই কাজের কারণে কিছু কবিরাজ আর পীর-দরবেশদের বড় ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয়। এরপর থেকেই তার শত্রু বেড়ে যায়।

তিনি বিয়ে করেছিলেন অত্যন্ত রূপবতী একজন নারীকে। এতো সুন্দর নারী, গ্রামের মানুষদের নজরে চলে আসে।
গ্রামের কিছু মানুষ কথা বলার বাহানায় তাদের ঘরে বার বার আসতে থাকে। তিনি চাইলেও বারণ করতে পারতেন না। আর গ্রামের পরিবেশ তো এমনই হয়। যাওয়া আসা সবারই থাকে। তাই তিনি বাড়িটি পুনঃনির্মাণ করেন, যাতে বাড়িতে কেউ আসলে বাড়ির মহিলারা কারো নজরে না পড়ে। কারণ আগের ঘরটি শুধু একতলা ছিলো। হাঁটাচলার সময় মহিলারা বাইরের মানুষের নজরে পড়ে যেতো।
আর এখন যেই বাড়িটি আছে সেটি পুনঃনির্মাণ করা। তিনি শিক্ষিত হলেও নারী বা মেয়েদের ব্যাপারে খুবই রক্ষণশীল ছিলেন।

এইটুকু বলে জিহান এক গ্লাস পানি জগ থেকে ঢেলে নিয়ে বললো,
জিহান: এতোক্ষণ যার কথা বলছিলাম তিনি হচ্ছেন, তোমার দাদাজান। আর তোমার তো কিছুই মনে নেই! তুমি জানো সেই বাড়ির সবচেয়ে আদরের মেয়ে তুমিই ছিলে। নদীর জন্য দাদাজান অনেক ত্যাগ করেছেন। তোমাকে বাঁচানোর জন্য আজ তাদের জীবন ত্যাগ করতে হলো। আর দেখো তুমি বেঁচে আছো। সত্যি তারা মরেও সার্থক।

শুভ্রার চোখ দুটি ছলছল করে উঠলো। কারণ তার কিছুই মনে নেই। কিন্তু তবুও মাহবুব জিহানের কথাগুলো শুনে খুব মায়া লাগছে দাদাজানের জন্য।

জিহান আবার বলতে শুরু করলো।

মো. সুফি খান শাহের দুই ছেলে এক মেয়ে। তার বড় ছেলে শাহরিয়ার খান, মেজো ছেলে সুফিয়ান খান আর মেয়েটির নাম অপ্সরা লিপি। তিনি ছেলেদের জন্য খুব সম্ভ্রান্ত ঘর থেকে মেয়ে এনেছিলেন। কিন্তু তার মেয়েটির কপাল ভালো ছিলো না। বিয়ের চারদিনের মাথায় তার স্বামী মারা যায়। তার স্বামী একজন সেনা অফিসার ছিলেন। একটা মিশনে গিয়েছিলেন, কিন্তু আর ফিরে আসেন নি। লিপি খুব রূপবতী ছিলেন একদম মায়ের মতো। শুরুটা তাকে নিয়েই হয়েছিলো। তিনিই মূল কারণ ছিলেন সবকিছুর। তবে তার কোনো দোষ ছিলো না, ভুল ছিলো। মারাত্মক ভুল।

জিহান চেয়ার ছেড়ে উঠে একটি ড্রয়ারের সামনে গেলো। ডায়েরীর ফাঁক থেকে একটা ছবি বের করে শুভ্রার হাতে দিলো।

শুভ্রা ছবিটি হাতে নিয়ে বললো,
শুভ্রা: উনি অপ্সরা লিপি?

জিহান হেসে বললো,
জিহান: হুম, চিনতে পারলে। তাহলে কেন বলেছিলে তুমি আমাদের নদী নও?

শুভ্রা: শুধুই ভেবে নিয়েছি। তাকে নিয়ে যেহেতু কথা বলছেন, তাই ভাবলাম তার ছবি।

জিহান: তোমার সত্যিই কিছুই মনে নেই? কিন্তু মনে না থাকার কারণটা কি?

শুভ্রা: আমার একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিলো। সেখানেই আমার মেমরি লস হয়। আমার বাঁচার কোনো সম্ভাবনা ছিলো না। বেঁচে গিয়েছি এটাই অনেক।

জিহান: ওহ, তা-ই তুমি বেঁচে আছো! তাহলে তুমি সেদিন বাড়িতে পৌঁছাতে পারো নি? বাড়িতে পৌঁছে গেলে তুমি আজ আমার সামনে থাকতে না হয়তো। তোমার তো সেদিন কলেজ হোস্টেল থেকে বাড়ি ফেরার কথা ছিলো।

সীমান্ত কথার প্রসঙ্গে ঘুরিয়ে বললো,
সীমান্ত: নদী সম্পর্কে আপনি অনেক কিছুই জানেন দেখছি। আর তার পরিবার সম্পর্কেও? আর বললেন অপ্সরা লিপির জন্যই এতো ঘটনা ঘটেছে। উনিই কি খুন করিয়েছিলেন?

জিহান ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
জিহান: লিপি ফুপুজান, এমনটা জীবনেও করবেন না। তিনি তো খুব শান্ত, সরল মনের ছিলেন। কিন্তু তিনি ভুল করেছেন, ভুল মানুষকে ভালোবেসে।

জিহান এসে চেয়ারে বসলো। তারপর আবার বলতে শুরু করলো।

ফুপুজান অতি সুন্দরী হওয়ায় তাকে বাসায় রাখাটা একপ্রকার ঝামেলার মতো ছিলো। বাড়ির বর্তমান মেইন গেইটে আগে দারোয়ান ছিলো একজন। পরে লিপি ফুপুর নিরাপত্তার জন্য আরো পাঁচজন নতুন রাখা হয়েছিলো। কারণ একটাই পাড়ার বখাটে ছেলেরা বাড়ির দেয়াল টপকে ফুপুর বারান্দায় ঢিল ছুঁড়তো, চিঠি দিতো, আরো অনেক কিছুই। দাদাজান মেয়েদের ব্যাপারে অনেক দায়িত্বশীল ছিলেন। আর সেই সময় মানে…… এক যুগ আগেরও আগে। তখন মেয়েদের বর্তমানের মতো এতো স্বাধীনতা ছিলো না। তাই কম বয়সে তার বিয়ে হয়, আর কম বয়সেই সে বিধবাও হয়ে যায়। গ্রামের মানুষরা এরপর থেকে তাকে অপয়া বলতো। কিন্তু এইটা শুধুমাত্রই নিয়তির ব্যাপার ছিলো। এখানে কারো হাত নেই।
দাদাজান সমাজ বা নিকটাত্মীয়ের সামনে কিছু না বললেও গোপনে ফুপুর জন্য ভালো ছেলে দেখছিলেন। ফুপুর মন-মেজাজ তখন ভালো ছিলো না। স্বামী মারা গেছে, কারো কি মন ভালো থাকতে পারে? তিনি নিজেকে খুব একা একা ভাবতেন, আর মানুষের কথাগুলোও তার কানে এসেছিলো। বিধবা শব্দটি তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না। তার সঙ্গীর খুব দরকার ছিল। আর তার বয়সও তো কম ছিলো!
দাদাজান এমন ভাব করতেন যেন লিপিকে তারা নিজের কাছেই রেখে দেবেন। কারণ তিনি চান নি মেয়ে নিজেকে বোঝা মনে করুক বাবা-মার কাছে। কিন্তু ফুপু বিধবা নামটি মুছে দিতে চাইছিলেন। তাই অনেকটা জোর করেই একটা সম্পর্কে জড়িয়ে যান। কারণ তিনি ভেবেছেন সম্পর্ক মানেই ভালোবাসা, আর ভালোবাসা মানেই বিয়ে। আর বিয়ে মানে তিনি আর বিধবা নন।
কিন্তু ভুলটা ছিলো ভুল মানুষকে বেছে নেওয়া। তিনি যেই লোকটার সাথে সম্পর্কে জড়ান সে ছিলো একজন শয়তানের উপাসক। কালো জাদু করতেন মানুষের উপর। এটা নেশা ছিলো তার কাছে। আর তার বাবার সাথেও পূর্ব শত্রুতা ছিলো দাদাজানের। সেই সূত্রে সেই লোকটা মায়ায় ফাঁসিয়ে ফেলে ফুপুকে। তারপর পালিয়ে বিয়ে করে তারা। তাদের একটা সন্তানও হয়, আর লোকটা নিজের সন্তানকে বলিও দেয় শয়তানকে খুশি করার জন্য।

শুভ্রা কথার মাঝে বলে উঠলো,
শুভ্রা: কেউ নিজের সন্তানকে বলি দেবে এটা বিশ্বাসযোগ্য?

জিহান: তারা যদি এতোটা মানবিক হতো, এতো বড়ো অমানবিক কাজ করতে তাদের কি হাত কাঁপতো না? খুন শুধু সেই বাড়ির লোকেদের হয় নি, খুন আরো অনেকের হয়েছে।

শুভ্রা: কি বলতে চাইছেন? আরো খুন হয়েছে?

জিহান: খুনের শুরু তো সেই বলি দিয়ে হয়েছিলো। খুন তো এরপর আরো অনেক হয়েছে। সেই গ্রামের মাটিতে লাশের গন্ধ পাওয়া যেতো। রাস্তায় রাস্তায় রক্তের দাগ লেগে ছিলো। লিপি ফুপু যদি লোকটাকে বিয়ে না করতেন তবে এইটা সম্ভব ছিলো না। তার বিয়ের পর ফুপুর নামে যেসব জায়গা ছিলো তা ওই লোকটার নামে চলে যায়। এরপর সে ওই গ্রামেই স্থায়ীভাবে উঠে। আর তান্ডব চালানো শুরু করে।

সীমান্ত: তান্ডব চালিয়েছে তাকে তো পুলিশে দেওয়া দরকার ছিলো।

জিহান: প্রমাণ কি ছিলো? গ্রামের অশিক্ষিত লোকেরা ভাবতো এটা খুন নয়, এইটা অভিশাপ। হঠাৎ বাতাসেই একটা লোক হাওয়া হয়ে গেলো। চোখের পলকেই একটা মানুষের গলা ফাঁক হয়ে গেলো। হঠাৎ পুকুরে বাচ্চাদের অহরহ লাশ ভেসে উঠলো। অশিক্ষিত লোকেরা কি এইটা খারাপ শক্তি ভাববে না? আর এর মুক্তির উপায়টা যদি সেই শয়তানের উপাসকটাই বের করে দেয়, তখন কি ওই লোকটার শাস্তি গ্রামের অশিক্ষিত মানুষরা হতে দেবে? তারা তো তাকে অনেক ভক্তি করতো। বরং দাদাজান লোকটার বিরুদ্ধে বললে গ্রামের মানুষরাই তার উপর ক্ষেপে যেতো। সেই কুসংস্কারগুলো আবার ফিরে এসেছিলো সেই গ্রামে, যা দাদাজান দূর করে দিয়েছিলেন। আর এতে কোনো সন্দেহ নেই যে এই খুনগুলো কোনো খারাপ শক্তির মাধ্যমে হয়েছিলো। কারণ মানুষ খুন করলে প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু কোনো অদৃশ্য শক্তির অপরাধের চিহ্ন কোথায় পাওয়া যাবে?

শুভ্রা: লিপি ফুপু জানতো না এসব?

জিহান: ধাক্কা খেলে বুদ্ধি ফেরে, কিন্তু বুদ্ধি যতোই দেরীতে আসে ততোই ক্ষতিটা নিজের। তিনি নিজের আর তার পরিবারের যেই ক্ষতিটা করে ফেলেছেন, তার মুক্তি এতো সহজ ছিলো না।

শুভ্রা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।

কুসংস্কার মানুষের বিবেক কমিয়ে দেয়। গ্রামের মানুষদের কুসংস্কারের প্রতি অন্ধবিশ্বাস তাদের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। চাইলেও কি এতোগুলো জীবন আর ফিরে আসবে? সেই লোকটা কোনো খারাপ শক্তির দ্বারা গ্রামে তান্ডব চালায়, তারপর আবার সেই শক্তি দিয়ে এর প্রতিরোধ করে, যার ফলে তিনি হয়ে যান গ্রামের প্রধান।

পৃথিবীতে ভন্ড মানুষের অভাব যেমন নেই, তাদের সমর্থকেরও কিন্তু কমতি নেই। তারা মানুষের অনুভূতি নিয়ে খেলে। আর তাদের খেলনাগুলোও কিন্তু তাদের ইশারায় চলতে থাকে। বিবেক দিয়ে ভেবে দেখে না।

চলবে—

#মায়া
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
পর্ব-১৪: (রহস্যের উন্মোচন ০২)

মাহবুব জিহান একটা ডায়েরী এগিয়ে দিলো শুভ্রার দিকে। শুভ্রা ডায়েরীর পাতা উলটে দেখলো একটি মেয়ের ছবি লাগানো আছে ডায়েরির প্রতিটি পাতায়।

মাহবুব জিহান বললো,
জিহান: রীত। তোমার বড় আপা। তোমায় অনেক ভালোবাসতো। আর তোমার কারণেই আমাদের সম্পর্কটাতে তোমার দাদা সম্মতি দিয়েছিলেন।
শাহরিয়ার খান ছিলেন তোমার বাবা। তোমরা এক ভাই, তিন বোন ছিলে। তোমার বড়ো ভাইয়া রুদি আর বড় আপা রীত৷ আর তোমাদের ছোট বোন গীত। গীত খুবই লক্ষী একটা মেয়ে ছিলো। সারাদিন তোমার পেছন পেছন পড়ে থাকতো আর নদীপ্পি নদীপ্পি করতো। তুমি গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়াতে তাকে। বয়স ছিলো মাত্র চারবছর।

জিহানের কথাগুলো শুনে শুভ্রার চোখ বেয়ে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।

জিহান: তোমার ছোট চাচারও এক ছেলে, এক মেয়ে। উজি আর তিথী। তিথী তোমার চেয়ে কয়েক বছরের বড়। রুদি ও উজির বিয়ে হয়েছিলো। রুদির একটা তিনমাসের বাচ্চাও ছিলো। খুনীরা সেই বাচ্চাটিকেও ছাড়ে নি।

সীমান্ত খুবই আগ্রহ নিয়ে জিহানের কথাগুলো শুনছে। শুভ্রার অতীত জীবন নিয়ে পুরোপুরি কিছুই জানে না সে। কারণ শুভ্রার কিছুই মনে ছিলো না, আর সীমান্ত মনে করতেও দেয় নি তাকে। শুভ্রাকে খুব ভালোবাসা দিয়ে তার অতীত ভুলিয়ে রেখেছিলো।

সে শুভ্রাকে প্রথম দেখেছিলো রোকেয়া হোসেনের সাথে। রোকেয়া হোসেন যেহেতু তার পূর্ব পরিচিত ছিলো, তাই মাঝে মাঝেই দেখা হতো তার সাথে। সীমান্ত জানতো তিনি বিয়ে করেন নি। আর তাই তার কোনো সন্তানও নেই।
রোকেয়া হোসেন শুভ্রাকে পাওয়ার পর, নিজের মেয়ের মতো তাকে ভালোবাসা দেন। শুভ্রা এক্সিডেন্টের পর অনেকটা অচল ছিলো। ঠিকমতো হাঁটতে পারতো না, হাতেও তার জোর কম ছিলো। অপরিচিত পরিবেশে সে অনেকটা ইতস্ততবোধ করতো। আর সেই মুহূর্তেই শুভ্রার পাশে সীমান্ত এসে দাঁড়ায়। প্রথম দেখায় শুভ্রাকে ভালো লেগে যায় তার, আর তখনই সে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়। রোকেয়া হোসেনও না বলেন নি, কারণ শুভ্রার দরকার কাছের মানুষ। আর নামহীন সম্পর্কগুলো শুভ্রার কাছে খুব এলোমেলোও লাগছিলো।
যেই মানুষ নিজেকেই চিনতে পারছে না, তার অন্য সম্পর্ক ভালো লাগার কথাও ছিলো না, তাও আবার নামহীন সম্পর্ক। শুভ্রা শুধু জানতো রোকেয়া হোসেন তাকে এক্সিডেন্ট স্পট থেকে উদ্ধার করে হাস্পাতালে ভর্তি করিয়েছে। তিনি না থাকলে শুভ্রা হয়তো বেঁচে থাকতো না।
শুভ্রার সেই মুহূর্তে একটা নামের প্রয়োজন ছিলো। আর একমাত্র স্বামীকেই সে আপন মানুষ দাবী করতে পারতো। তাই তাদের বিয়েটাও কোনো বাঁধা ছাড়া হয়ে যায়। আর সীমান্ত অল্প সময়ে শুভ্রার মনে জায়গাও পেয়ে যায়।
বিয়ের পর সীমান্ত শুভ্রাকে ভালো ডাক্তার দেখায়। এরপর ধীরে ধীরে শুভ্রা সুস্থ হয়। তারপর শুভ্রাকে সে পড়াশুনা শেষ করতেও সাহায্য করে। এর মধ্যেই শিশিরের জন্ম হয়। আর শুভ্রাও রোকেয়া হোসেনকে মা হিসেবে মেনে নেয়।
রোকেয়া হোসেন শুভ্রা সম্পর্কে বেশি কিছু জানতো না। এক্সিডেন্ট স্পটে শুভ্রার পরিচয় পত্র পাওয়া যায়, যেখানে শুধুই তার জন্ম তারিখটি অক্ষত অবস্থায় ছিলো, বাকী অংশটা পুড়ে যাওয়ায়, তার সম্পূর্ণ পরিচয় জানা যায় নি।

মাহবুব জিহান অনেকক্ষণ চুপ ছিলেন। রীতের কথা মনে পড়তেই মনটা খারাপ হয়ে যায় তার। চোখের জল আড়াল করে বললেন,
জিহান: রীতকে হারিয়ে আমি অনেক বছর মানসিক হাস্পাতালে ছিলাম। হঠাৎ নিতে পারে নি এই চরম সত্যটা, যে আমার রীত আর নেই! আমি শেষ দেখাটাও দিলাম না তাকে। বাবা-মা আমাকে যেতে দেন নি আর ওই বাড়িতে। খুন করার কারণটা সবাই জানতো তাই। তারা ভেবেছিলো আমাকেও মেরে ফেলবে। সুস্থ হওয়ার পর আমার এক কাজিনের সাথেই আমার বিয়ে দেয় তারা। বউ-বাচ্চা নিয়ে এখন ভালো আছি। কিন্তু রীতকে এখনো ভুলতে পারি নি। রীত যদি জানতে পারে আমি এখন অন্য কারো, অনেক কষ্ট পাবে হয়তো। কিন্তু আমি পারি নি। বাবা-মার কথা ফেলতে পারি নি। কারণ আমি যখন অসুস্থ অবস্থায় ছিলাম, তারা অনেক সহ্য করেছিলো আমার জন্য। নিজের অজান্তেই অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছিলাম তাদের।

শুভ্রা: জীবন তো কারো জন্য থেমে যায় না। অতীত ভুলে সামনে এগিয়ে যাওয়াটাই উত্তম সিদ্ধান্ত।

জিহান মিনিট খানেক চুপ থেকে, আবার বলতে শুরু করলো অতীতের সেই কালো অধ্যায়টি।

ফুপুর বাচ্চাটির বলি হওয়ার পর দাদাজান তাকে আর থাকতে দেন নি সেই লোকটার সাথে। ফুপুও আর চান নি থাকতে। ফুপুকে নিয়ে আসার পর লোকটা দ্বিতীয় বিয়ে করেন৷ সেই ঘরে তার একটি ছেলে সন্তান হয়। তারপর থেকেই ঘটতে থাকে অনেক অস্বাভাবিক ঘটনা।

বর্তমানে বাড়িটির বাম পাশে একটা খোলা মাঠ আছে। কিন্তু সেই সময় মাঠটিতে কিছু মাটির ঘর আর টিনের ঘর ছিলো সারি সারি। তার পাশে যতোগুলো বিল্ডিং দেখা যায় প্রায় সবগুলোই এখন পরিত্যক্ত।

সীমান্ত জিহানকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
সীমান্ত: পরিত্যক্ত? কিন্তু সেখানে তো মানুষ থাকে আমি যতোটুকু জানি।

জিহান: আর ইউ সিউর? তুমি নিজের চোখে দেখেছো?

সীমান্ত: হ্যাঁ। আমি রাতে অফিস থেকে ফিরছিলাম তখন……

জিহান: ওকে বুঝতে পেরেছি। আমি বলছি সবকিছু।

বাড়িগুলো পরিত্যক্ত কারণ সেই সারিতে থাকা প্রতিটি বাড়িতে ভয়াবহ আগুন লেগেছিলো। শুধুমাত্র দাদাজানের সেই বাড়িটিতে ছাড়া। এরপর থেকেই বাড়িটি অভিশপ্ত নামে পরিচিতি পায়। কারণ গ্রামের লোকেরা ভাবতো দাদাজানের বাড়িটির অভিশাপে পাশের গ্রাম আর বাড়িগুলো ছাই হয়ে গেছে। আসলে তারা কখনো ভাবতো না এমনটা, তাদেরকে ভাবতে বাধ্য করেছিলো সেই ভন্ড লোকটা।
তাদের ভাষ্যে, বাড়িটির মুখোমুখি বাড়িগুলোতে আগুন ধরে নি, তাই সেই বাড়িগুলো অভিশাপ মুক্ত ছিলো। আর তাই তারা ভেবে নেয় সেখানে মানুষের থাকতে অসুবিধে হবে না। যার ফলে বাড়িগুলো স্বাভাবিক এখনো। আর অভিশপ্ত বাড়িগুলো পরিত্যক্ত হয়ে যায়। আর পরিত্যক্ত কোনো জিনিসই ভালো না। আর লোকটা সেই বাড়িগুলোতে রাতে তন্ত্রমন্ত্রের সাধনা করতো। তাই জায়গাটা অনেকটা ভয়ংকর হয়ে পড়ে মানুষের কাছে। রাতে সেই বাড়ির আশেপাশে কেউ যেতে পারতো না। ভুলক্রমে হেঁটে গেলেও তাকে আর বেশিদিন বাঁচতে দিতো না। আর লোকটা কিছু খারাপ জ্বিনদের দিয়েই এসব কাজ করাতো।

শুভ্রা: এখনো কি সেই খারাপ জ্বিনগুলো সেই বাড়িগুলোতে আছে?

জিহান: জানা নেই।

শুভ্রা: সীমান্ত তো অনেকবারই রাতে সেই বাড়িগুলো অতিক্রম করেই এসেছিলো, ওর কিছু হয় নি কেন?

জিহান: শুধু সীমান্ত না, এখন কারো সাথেই এমন হয় না। হবেও না।

সীমান্ত: এর কারণ?

জিহান: শুনেছি সেই গ্রামে একজন নতুন মসজিদ তৈরি করেছেন, যা আগে ছিলো না। গ্রামের অনেকেই বলে সেখানে কিছু ভালো জ্বিন থাকে৷ আর তারা খুবই শক্তিশালী। তারাই গ্রামের মানুষদের খারাপ জ্বিন থেকে বাঁচায়।

সীমান্ত: আমি যাদের দেখেছি তারা ভালো জ্বিন?

জিহান: তুমি যদি বাড়িটির ভেতরে দেখে থাকো তবে খারাপ জ্বিন। কিন্তু গেইটের বাইরে দেখলে তারা ভালো। কারণ তারা খারাপ জ্বিনদের বাড়ি থেকে বের হতে দেয় না। আর যদি কোনো ভাবেই তারা বের হতে পারে, তবে কারো না কারো মৃত্যু ঘটে।

সীমান্ত: এতোকিছুর পরও যারা আছে তারা কেন থাকে সেখানে?

জিহান: যারা সেখানে থাকে তাদের আর্থিক অবস্থা ভালো না। আর তাই তাদের বাধ্য হয়ে এমন জায়গায় আসতে হয়। শুনেছি এসবের মাঝেও বিশাল বড়ো একটা কিন্তু আছে। যারা আর্থিক সংকটে পড়ে তারা বেশিরভাগই মিথ্যে মামলার আসামী হয়, আর তাদের অনেকেই দাবী করেছে অফিসের মোস্ট পাওয়ারফুল পজিশনে যাওয়ার আগ মুহূর্তেই সবার সাথেই ঠিক একই ধরণের ঘটনা ঘটে।

সীমান্ত শুভ্রার মুখের দিকে বিষ্ময়কর দৃষ্টিতে তাকালো। কারণ সীমান্তের সাথেও ঠিক এমনটি হয়েছিলো।

সীমান্ত: কেন এমনটি হয়?

জিহান: তাদের সাথেই কেন হয় বিষয়টা আমার জানা নেই।

শুভ্রা: আপনি তো সেই বাড়িতে আর যান নি। তাহলে বর্তমানে কি হচ্ছে সেই জায়গায়, তা আপনি কি করে জানলেন?

জিহান: সেই গ্রামের একটি বাড়িতে একজন দারোয়ান চাচা ছিলেন, তিনিই আমাকে সব খবর দিয়েছিলেন। শুনেছি, তারও অপ্রত্যাশিত মৃত্যু হয়েছে।

শুভ্রা: তিনি আপনার পরিচিত? তিনি আপনাকে কেন এসব বলতে যাবেন?

জিহান: হ্যাঁ, পরিচিত। তার ভাই তো সেই বাড়িটির দারোয়ান ছিলো। সেও খুন হয়েছিলো সেই রাতে। চাচাটা আমায় চিনতো। আমার খোঁজখবর তিনি নিজ থেকেই রাখতেন। তিনি আমায় বলতেন তিনি নাকি স্বপ্ন দেখতেন দাদাজানকে। উনার সাথে শেষ যখন দেখা হয়েছিলো, তিনি আমার বাসায় এসে বলেছিলেন গ্রামটি অভিশাপ মুক্ত হবে শীঘ্রই। দাদাজান নাকি তার স্বপ্নে এসে বলেছেন একজন নতুন অতিথি আসবে, তাকে যেন সেই বাড়িতে আশ্রয় দেয়।

শুভ্রা: আমি যে ওই মাঠে অনেক মানুষকে চাষাবাদ করতে দেখেছিলাম তারা কি মানুষ ছিলো না?

জিহান হেসে বললো,
জিহান: সেই জায়গার জমি খুবই উর্বর। তাই তারা চাষ করে। সন্ধ্যার আগেই ঘরে ফিরে যায়।

শুভ্রা: আমরা যখন বাড়িটিতে ছিলাম, তখন রাতে ছাদে হাঁটার শব্দ শুনেছি, ঘরেও কালো ছায়া দেখেছি অনেকবার।

জিহান আশ্বস্ত করে বললো,
জিহান: ভয় পেয়ো না। সেই বাড়িটিতে থাকলে তোমার কিছুই হবে না৷ তবে রাতে সেই বাড়ির ছাদে যাওয়াটা একদমই উচিত না। কারণ ছাদটি উন্মুক্ত। তাই খারাপ জ্বিন যদি কোনো ভাবে বের হওয়ার সুযোগ পায় তারা সহজেই আক্রমণ করতে পারবে।

সীমান্ত: বাড়ির ভেতরে খারাপ কিছু হবে না আপনি কিভাবে জানলেন? ছোটু আমাদের চোখের সামনেই ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়েছিলো। তাকে আর খুঁজেও পাওয়া যায় নি।

জিহান: ছাদে গিয়েছিলো তাই। বাড়ির ভেতরে সম্ভব না। কারণ বাড়িটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তাদের মৃত্যুর পরপরই একজন হুজুর এনে বাড়ি বন্ধ করে দিয়েছিলেন দারোয়ান চাচাটা। এইটাও দাদাজানই নাকি করতে বলেছিলো। তাই সেই বাড়িতে এখনো কেউ যেতে পারে নি। দারোয়ান চাচা বলেছিলো সেই বাড়িটি একজন ভালো জ্বিন পাহারা দেয়। এমনকি তিনি সেই জ্বিনটির সাথে দেখা করতে যান কিছুক্ষণ পর পর। বাড়ির ভেতরে কি হয় না হয়, সব জানান। কিন্তু তুমি পেরেছো সেই বাড়িতে প্রবেশ করতে। কারণ তুমি সেই বাড়ির মেয়ে। নদী, তোমার হয়তো কিছুই মনে নেই। কিন্তু এটাই সত্য।

শুভ্রা: বাড়ির ভেতরেও কেউ আছে। আমি অনুভব করেছি কারো স্পর্শ। কেউ কথা বলেছিলো আমার সাথে।

জিহান: তোমার পরিবারের লোকজন এখনো সেই ঘরে বন্দি। তাদের মুক্তি কিন্তু এখনো হয় নি।

শুভ্রা: কেন মুক্তি হয় নি?

জিহান: কারণ তুমি এখনো পুরোপুরি সেই মিথ্যে মায়া থেকে মুক্ত হও নি। আগে বুঝতে পারি নি কেন তার মরেও মুক্তি পায় নি। কিন্তু তোমায় দেখে বুঝে ফেলেছি। তারা এখনো নদীর মায়া ছাড়তে পারে নি। তোমাকে পুরোপুরি সেই ভন্ড লোকটার তন্ত্রমন্ত্র থেকে, বাঁচাতে না পারলে তারা যেতে পারবে না।

সীমান্ত: সেই তান্ত্রিক কি এখনো বেঁচে আছে?

জিহান: হুম, বেঁচে আছে তাই এখনো অভিশাপটাও আছে। তাকে আটকাতে পারলে সব সমস্যার সমাধান হবে।

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here