ভালোবাসি_প্রিয়_সিজন_টু পর্ব_১০

0
1222

ভালোবাসি_প্রিয়_সিজন_টু
পর্ব_১০
#সুলতানা_সিমা

দিহানের কথা শুনে অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে যায় অরিন। এসব কি বলছে দিহান? মাত্র কয়েকদিন হয়েছে তাদের দেখা হয়েছে,আর এরই মাঝে দিহান এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে? দিহান কী তাকে ভালোবেসে ফেলেছে? দুদিনের পরিচয়ে কী ভালোবাসা হয়? কই অরিন তো ভালোবাসলো না? হ্যাঁ এটা সত্যি যে অরিন দিহানের প্রতি দূর্বল। তাই বলে এই দূর্বলতার নাম তো ভালোবাসা দেওয়া যায়না। দিহান আবার বলল,”
_আমি সম্পর্কের একটা নাম দিতে চাই অরিন। যেটা হয়ে গেছে সেটা মেনে নিতে চাই।
_আপনার মাথা ঠিক আছে তো? আপনি বুঝতে পারছেন আপনি কি বলছেন?
_দেখো অরিন। এটা তো মিথ্যে নয় যে আমাদের বিয়ে হয়েছে। আমরা তো হাসবেন্ড ওয়াইফ। তাহলে কেন কথাটা বলবো না?
_দেখুন, আবেগকে প্রশ্রয় দিয়ে এমন কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নিবেন না, যেটা আপনার জন্য বিপদ ডেকে আনে। এক মাস আগে যা হয়েছে সেটা শুধুমাত্র একটা এক্সিডেন্ট ছিলো। এর থেকে বেশি কিছু নয়৷ তাই শুধু শুধু বার বার হাসবেন্ড ওয়াইফ বলবেন না।
_হাসবেন্ড ওয়াইফ না বললে কি সত্যিটা মিথ্যে হয়ে যাবে অরিন?” অরিন কিছু বলল না। এর প্রশ্নের উত্তর নেই তাঁর কাছে। দিহান আবার বলল,”তুমি যদি এ বিয়েটা না মানো তাহলে ঠিক আছে। আমি তোমাকে আবার বিয়ে করবো।” অরিন অবাক হয়ে তাকালো দিহানের দিকে। দিহান তাকে বিয়ে করবে বলছে? সে কী সত্যি শুনছে? অরিন কাটা গলায় বলল”
_মা মাত্র দু দুদিনের পরিচয়ে আপনি এসব কী বলছেন?
_সত্যিই কী আমাদের দুদিনের পরিচয় অরিন?” অরিন এবারও চুপ হয়ে গেলো। সত্যিই তো। তাঁদের পরিচয় তো দুদিনের নয়। হ্যাঁ দেখা হয়েছে মাত্র হাতে গুনা ছ-সাত দিন। কিন্তু একমাস আগে তো এই মানুষটা তাঁর মনের ঘর নাড়িয়ে দিয়ে গেছিলো। সেদিনের পর থেকে তো একদিনের জন্যেও দিহানকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারেনি। ঘৃণা করে হলেও বার বার দিহানের কথা মনে পড়তো। অরিনের জবাবের অপেক্ষা করে কোনো জবাব না পেয়ে। দিহান কাতর গলায় বলল,

“অরিন প্লিজ না বলোনা। আমার খুব খারাপ লাগে তোমার এতো কষ্ট দেখে। আমি তোমায় এই কষ্ট থেকে মুক্তি দিতে চাই অরিন।” অরিনের মনের ঘরে সাথে সাথে আঁধার নেমে আসলো। কত বোকা সে। সে তো ধরেই নিয়েছিলো দিহান তাকে ভালোবাসে। দিহান কিনা তাঁকে দয়া করছে? অরিনের খুব কষ্ট হলো। কেন জানি খুব কান্না পেলো তাঁর। শুকনো এক ঢোক গিলে বলল”
_অহ। তাহলে সিম্প্যাথি দেখাচ্ছেন?
_আমি মোটেও সিম্প্যাথি দেখাচ্ছিনা।
_তাহলে কী মিস্টার দিহান?
_অরিন রেগে যাচ্ছো কেন? বুঝার চেষ্টা করো৷ আজ কানাডা থেকে কল এসেছে। আমাকে শীঘ্রই কানাডা ব্যাক করতে হবে। আবার আসতেও লেট হবে৷ ততদিনে যদি তোমার বিয়ে হয়ে যায়?” অজানা কারণে অরিনের বুকটা ধুক করে উঠলো। দিহান বলল” এদিকে আব্বু বলছে আমার জন্য পাত্রী দেখবে। আর মাত্র দুটো দিন আমি একখানে আছি অরিন। আমি তোমাকে নিজের করে রেখে যাই। তখন তোমাকে কেউ বিয়ে দিতে পারবে না। কেউ তোমাকে ছোট করে দেখতে পারবে না। আমাদের দেখা না হলে এই বিয়েটা এক্সিডেন্ট বলে মেনে নিতাম। কিন্তু এখন পারবো না অরিন। তোমার মাঝে আমার আমার মনটা আটকে গেছে। এক্সিডেন্টলি হলেও এটা সত্যি আমাদের বিয়ে হয়েছে। তুমি কী চাও তোমার স্বামী থাকার পরেও তোমার অন্য কোথাও বিয়ে হোক? ”

অরিন কিছু বলল না। চাঁদের আলো এসে পড়ছে অরিনের উপর। সেই আলোতে চিকচিক করছে অরিনের গাল। নিশ্চয়ই অরিনের চোখ থেকে বর্ষন হচ্ছে। দিহান চোখের পানিটা মুছে দিতে হাত বাড়িয়ে ও বাড়ালো না। হয়তো চোখের পানি মুছে দেওয়ার অধিকার এখনো তাঁর হয়নি। অরিন দিহানের দিকে তাকিয়ে ভেজা গলায় বলল, “আমি কারো করুণা নিয়ে বাঁচতে চাইনা দিহান। ভালো লাগলো এটা শুনে যে আমার কষ্ট দেখে আপনার খারাপ লাগছে। ধন্যবাদ আপনাকে। ভালো থাকবেন। বায়।” কথাটা বলেই অরিন চলে যেতে লাগে। দিহান হাত ধরে ফেলে। অরিন হাত ছাড়াতে চাইলে দিহান অরিনের সামনে দাঁড়ায়। তারপর বলে,”সবার কষ্ট দেখে খারাপ লাগেনা অরিন। কিছু কিছু মানুষ আছে যাদের কষ্ট সহ্য হয়না।” অরিন গম্ভীর গলায় বলল”
_পথ ছাড়ুন।
_অরিন প্লিজ বুঝার চেষ্টা করো। আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি।” দিহানের মুখে ভালোবাসার কথা শুনে তাচ্ছিল্য অরিন। তারপর বলল”
_একটা সত্যি জানেন? দুদিনের পরিচয়ে কাউকে ভালোবাসা সম্ভব নয়। শুধু ভালো লাগাই সম্ভব। এই ভালো লাগাকে ভালোবাসা ভেবে সম্পর্ক জোড়লে, পরে সেটা জীবনের কাল হয়ে দাঁড়ায়। আবেগ নিয়ে পা এগুবেন না। নয়তো একসময় দেখবেন আপনার পা আপনা আপনি ভেঙে গেড়ে যাবে মাটির উপর। থেমে যাবেন আপনি। শুধু চলতে থাকবে আপনার সাথে চলা মানুষটা।”
_এটা আবেগ নয় অরিন। আমরা স্বামী স্ত্রী। আমাদের মাঝে ভালোবাসা জন্ম নিতে বছরের প্রয়োজন হবে কেন? প্রবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ আমরা। আর ভালোবাসতে যুগ যুগের প্রয়োজন হয়না। ক্ষনিকের দেখায়ও ভালোবাসা হয়।
_ওটাকে ভালোবাসা বলেনা আবেগ বলে। আর হ্যাঁ আপনি যে দু’দিন আছেন। সেই দুদিন আমার থেকে দূরে থাকবেন প্লিজ।
_আমি পারবো না অরিন। আমার দম বন্ধ হয়ে আসবে।
_আপনাকে পারতেই হবে দিহান। আমি নিজেকে দূর্বল করতে চাইনা। প্লিজ আমার থেকে দূরে থাকবেন।” অরিনের কণ্ঠে স্পষ্ট কান্না বুঝা যাচ্ছে। দিহান বলল” ঠিক আছে অরিন, আমরা বন্ধু হয়ে থাকি। প্লিজ।
_আপনি কথা বাড়াচ্ছেন কেন? বলছিনা আমার থেকে দূরে থাকবেন।”
কথাগুলা বলে অরিন চলে আসলো। দিহান আর কিছু বলেনি। শুধু অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকে অরিনের দিকে। অরিনের খুব কষ্ট হচ্ছে। সে তো ভেবেছিলো দিহান হয়তো তাকে ভালোবাসে, তাই তাকে বিয়ে করতে চায়। কিন্তু দিহান তো দয়া করছে। কেন কেউ তাকে দয়া করবে? আর সে কেন কারো দয়া নিয়ে বেঁচে থাকবে? রুমে এসে লুপার পাশে শুয়ে পরল অরিন। বুকটা খুব ভারি লাগছে তাঁর। এই মানুষটার প্রতি অনেক দূর্বলহয়ে গেছিলো সে। আজ তাঁর চোখ খুলেছে। বড়লোকেরা কাউকে ভালোবাসেনা। দয়া করে দয়া।

___________________

সকালে ঘুম থেকে উঠে লুপা অরিনকে বলো পায়েশ বানানোর জন্য। অরিন বলল,”আপনি বললেন না যে কার জন্য বানাবেন?
_বলবো একদিন।
_কবে?
_আছে একদিন। তবে তুমি একটু আন্দাজ করতে পারবে। আজ যে সব থেকে বেশি পায়েশ খাবে সে। ” অরিন আর কথা বাড়ালো না। কেন জানি তাঁর খুব ইচ্ছে করছে দিহানের বিষয়ে জানতে কিন্তু কিভাবে জিজ্ঞেস করবে ভেবেই পাচ্ছেনা। লুপা পকপক করেই যাচ্ছে। অরিনের কানে এসব ঢুকছে না। তাঁর মাথায় দিহানের কথা ঘুরছে। বার বার মনে পড়ছে দিহানের বলা ভালোবাসি কথাটা। লুপা অরিনের গায়ে হালকা ঝাকি দিয়ে বলল,”হেই তুমি শুনতে পাচ্ছো?” অরিন চমকে উঠে বলল”
_জ্জ জ্জ জ্বি বলুন।”
_জানো আজ আমার এক ফ্রেন্ডের বার্থডে ও না খুব ভালো। ও কয়টা প্রেম করেছে জা,,,,,। অরিন লুপার কথার মাঝখানে কথা জোড়লো হতে,,”
_আচ্ছা আপনি মিহান ভাইয়ার বোন?
_তুমি আমার ভাইয়াকে চিনো?
_হুম। উনি তো এখানে প্রায়ই আসতেন। জিহান ভাইয়াকেও চিনি। মিহান ভাইয়া সারাদিন বই নিয়ে থাকতে পছন্দ করেন তাইনা।
_হুম। ভাইয়ার কাছে দুটো জিনিস খুব মূল্যবান। আমার দাদুমনি আর তাঁর স্ট্যাডি। সবকিছু ছেড়ে ছুঁড়ে এই দুটো জিনিস নিয়ে পড়ে থাকতে সে খুব পছন্দ করে।
_অহ আচ্ছা। ওই যে দি দি দিহান৷,,,, আব,, উনি,, মানে,, উনি কী করেন?
_ভাইয়া না খুব ভালো সবাইকে খুব ভালোবাসে। জানো ভাইয়া একটা মেয়েকে ভালোবাসতো। ওই মেয়েটা না ভাইয়াকে ছেড়ে অন্যকোথাও বিয়ে করে ফেলছে।
_অহ।
_আচ্ছা তুমি এক কাজ করো। তুমি আমাকে বলে বলে দাও আমি পায়েশটা রান্না করছি।
_আরে না না। এসব কি বলছেন আমি করতে পারবো।
_তুমি তো করতে পারো তাই করতে পারবে৷ কিন্তু আমি যে করতে পারি না। প্লিজ দেখিয়ে দাও। তুমি শুধু বলে বলে দিলে হবে, আমি পারবো। প্লিজ প্লিজ প্লিজ।”

অরিন লুপাকে দেখিয়ে দিতে লাগলো। লুপা মনে মনে অনেক খুশি তাঁর খুব ইচ্ছে ছিলো নীলকে নিজ হাতে পায়েশ বানিয়ে খাওয়ানোর। হয়তো এটাই একমাত্র সুযোগ। পায়েশ হয়ে গেলে অরিন টেবিলে নিয়ে সবাইকে ডাক দিলো। সবাই আসলো শুধু দিহান ছাড়া। অরিনের খুব খারাপ লাগলো। বার বার আড়চোখে সিঁড়ির দিকে তাকালো দিহান নিচে নামে কিনা দেখতে। লুপা নীলের দিকে তাকিয়ে আছে। এই পায়েশ বানাতে গিয়ে তাঁর হাত পুড়িয়ে ফেলছে। তবুও তাঁর কষ্ট নেই। নীলের জন্য তো করেছে।

নীল পায়েশ দেখে তাঁর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। নীলের হাসি দেখে লুপার সব কষ্ট সার্থক হয়ে গেলো। নীল চামচ হাতে নিলো। শান্তি চৌধুরী খেয়ে বললেন,”খুব ভালো হয়েছে অরিন। তবে মিষ্টিটা আরেকটু কম হলে ভালো হতো। তবে শাওন আর নীলের জন্য ভালো হয়েছে। এই বেড়াল দুইটা খুব মিষ্টি খায়।” অরিন বলতে যাবে আমি রান্না করিনি, তখন শাওন আর নীল নানুমনি বলে ধমক দিয়ে উঠল। তাঁদের বিড়াল ডাকছেন সবার সামনে ধমক না দিয়ে কি থাকা যায়? শান্তি চৌধুরী হাসতে হাসতে বললেন,”আরে খা খেয়ে দেখ অনেক ভালো হয়েছে।” শাওন অরিনের দিকে তাকিয়ে বলল,”জানি নানুমনি। অরিনের হাতে রান্না সব খাবারই অনেক মজার হয়।” নীল খেতে যাচ্ছিলো। অরিন বলল”আরে না ভাইয়া আমি রান্না করিনি। ওটা লুপা আপু রান্না করছে।” পায়েশটা মাত্র মুখে ঢুকাচ্ছিলো নীল। লুপার নাম শুনে সাথে সাথে নীলের হাত থেমে যায়। চামচটা বাটিতে টাস করে রাখে কিছু পায়েশ ছিঁটকে পড়ে টেবিলে। সবাই নীলের দিকে তাকিয়ে আছে। শায়লা বললেন,”কিরে কি হইছে।” নীল গম্ভীর গলায় বললো ”
_আমি মিষ্টি এখন আর খাইনা খালামনি। অরিন আমাকে এক কাপ চা দাও বোন।” নীল উপরে চলে গেলো। সবার চোখে বিষয়টা স্বাভাবিক হলেও দিশা আর অরিনের চোখে অন্যরকম লাগলো। লুপার চোখের কোণে জমে যাওয়া জলটা খুব সাবধানে মুছে দিলো। তারপর তাঁর দাদীর পাশে বসে খেতে লাগলো। নিজেকে স্বাভাবিক করতে খেতে বসেছে। তাই ভুলেই গেছে সে অরিনের সাথে খাবে বলেছিলো।

অরিনের খুব খারাপ লাগছে। সবাই খেতে আসলো। দিহান কেন এলোনা? ও কী রাগ করেছে? অরিন কি এমন বলল যে দিহান রাগ করবে? অরিনের মনে শান্তি কাজ করছে না,কিন্তু বলতেও পারছে না কিছু। হঠাৎ দিশা প্রশ্ন করলো”ভাইয়া কই শাওন ভাই?
_ও ঘুমাচ্ছো। জাগাতে নিষেধ করলো।” দিশা কিছু বলল না। শাওন পায়েশ খাওয়া শেষ করে চলে গেলো উপরে। অরিনকে সবাই পায়েশ খেতে জোর করলো। অরিন কিছুই মুখে নিলোনা। দিহানের জন্য খুব খারাপ লাগছে তাঁর।

লুপা নাস্তা সেড়ে উপরে গিয়ে কাঁদতে লাগলো। নীলের এতো অবহেলার কি নাম দেবে সে বুঝে উঠতে পারেনা। আদৌ কী কেউ কাউকে এতো অবহেলা করে? চোখ মুছে শুয়ে পরল লুপা। অরিনের বালিশের উপর একটা চাদর রাখা। লুপা উঠে বসে চাদরটা হাতে নিলো। এই চাদরটা কোথায় যেন দেখেছে সে। লুপা মনে করার চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না। চাদরটা হাত থেকে রেখে দিলো লুপা। চট করে তাঁর মনে পড়ে গেলো, চাদর পরা রক্তিম দুটো চোখেই সেই মানুষটার কথা। এই চাদরটাইতো ছিলো। লুপা চাদর হাতে নিলো। আবার মনে হলো চাদরের মতো কী চাদর হতে পারেনা। কথাটা ভাবতেই রেখে দিলো আবার। কিন্তু তাঁর চোখ আটকে থাকলো চাদরের মাঝেই।

অরিনের মন ছটফট করছে দিহানের জন্য। নীল তো চা চেয়েছিলো। অরিন চা নিতে গিয়েও নিলোনা। দিহান তো কিছুই খায়নি। অরিন নুডলস বানালো। বানানো হলে তিন বাটি নিয়ে উপরে গেলো। শাওনের দরজার সামনে দাঁড়ালো অরিন। দিহান খাটে হেলান দিয়ে পা লম্বা করে বসে আছে। নীল সোফাতে বসা, শাওন টেবিলে বসে ল্যাপটপে কাজ করছে। দিহানের মলিন মুখটা দেখে অরিনের বুকটা ধুক করে উঠলো। অরিন শাওনকে ডাক দিলো। “শাওন ভাই।” শাওন ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকিয়ে অরিনকে দেখে তড়িঘড়ি করে উঠে দরজার দিকে গেলো। দিহান দরজার দিকে একবার তাকিয়ে আর তাকায়নি। শাওন অরিনের হাত থেকে ট্রে নিতে নিতে বলল,” তুমি কেন কষ্ট করে আসতে গেলে উপরে? ডাক দিলে তো আমরা নিচে যেতাম। আর এসব আবার কষ্ট করে বানাতে গেলে কেন?” অরিন বলল,”উনারা খাননি তাই চাচি বললেন।” [মিথ্যে বলল]
_আচ্ছা তুমি যাও। আর শুনো চা দিতে হবেনা। আমরা বাইরে গিয়ে খেয়ে আসবো।
_বাইরে গিয়ে খাবেন কেন আমি দিচ্ছি।
_না না দিবানা তুমি। আমরা বাইরে একটা দরকারেই যাবো। যাও তুমি।” অরিন আড়চোখে একবার দিহানের দিকে তাকিয়ে চলে আসলো। দিহান একটা বইয়ের পৃষ্টা উলট পালট করছে। হয়তো অরিনের থেকে মনোযোগ সরাতে এটা করছে।

কিছুক্ষণ পরে উপর থেকে ট্রে এলে অরিন দেখে একটা বাটি সম্পূর্ণ রয়ে গেছে। তারমানে কেউ খায়নি, হয়তো দিহান খায়নি। অরিনও আর কিছু খেলো না৷ আসলে খেতে তাঁর ইচ্ছেই করেনি। দিহান শাওন নীল সত্যি সত্যি বাইরে চলে যায়। অরিন ভেবেছিলো চা নিয়ে আবার উপরে যাবে। কিন্তু তাঁর আগেই তাঁরা চলে গেলো। দুপুরের জন্য রান্না বসালো অরিন। আজ শুক্রুবার। অরিন প্রতিদিন কোরআন নিয়ে না বসলেও প্রতি শুক্রুবারে বসে। রান্না শেষে একটু কোরআন পড়তে বসবে। রান্না করতে তাঁর দু’ঘন্টা সময় লেগেছে। এই দু’ঘন্টার মধ্যে লুপা একবারও আসেনি কিচেনে। লুপার এতো এতো দুষ্টুমি কথা বলার পিছনে অনেক বড় কোনো কষ্ট লুকিয়ে আছে বলে মনে হয় অরিনের। রান্না শেষে কোরআন পড়তে বসে অরিন। দিহানকে আর একবারও দেখেনি সে। শাওনরা জুম্মা থেকে আসার অনেক্ষণ পরে শায়লা বেগম এসে খাবার নিতে লাগলেন। অরিন উনাকে হেল্প করে। একে একে সবাই এসে টেবিলে বসে। সবার পরে দিহান আসলো।

অরিন শান্তি চৌধুরীকে ভাত বেড়ে দিতে লাগলো। দিহান নিজেরটা নিজে বেড়ে নেয়। অরিন দিহানকে তরকারি দেওয়ার জন্য তরকারির বাটি হাতে নেয়। দিহান অন্য বাটি থেকে নিয়ে নিলো। অরিন শান্তি চৌধুরীকে তরকারি দিয়ে বাটি রেখে দিলো। আর কাউকে দিলো না৷ শায়লা খেতে খেতে বললেন,”দিহান তুই আর কতদিন আছিস দেশে?
_সিয়র না।” প্লেটের দিকেই তাকিয়ে বলল দিহান। শায়লা বললেন,”
_ভাবি ফোন দিছিলেন আমায়। ভাইয়া নাকি জিহানের সাথে তোর বিয়েটাও সেরে ফেলতে চায়। তুই না বলছিস কেন?
_আমি এখন এসব নিয়ে ভাবছি না।”দিহানের গলা গম্ভীর। ইশি দুষ্টুমি করে বলল”
_এসব নিয়ে ভাবছি না ভাবছি না বলে তলে তলে বিয়েটা সেরে ফেলিস না আবার।” দিহান বিষম খেলো। নীল দিহান পিঠে একটা কিল দিয়ে বলল”মরে যাসনা ভাই। নয়তো তোর তলে তলে বিয়ে করা বউটা দেখার সৌভাগ্য হবেনা আমাদের।” দিহান এক গ্লাস পানি ঢকঢক করে খেয়ে বলল ” এ এ এটা কো কো কোন ধরনের মজা? সি সি সিরিয়াস বিষয় নিয়ে ম মজা করতে আসবি না।” শাওন বলল” কী ব্যাপার দিহান? সিরিয়াস বিষয় মানে? তুই বিয়ে করে ফেলিস নি তো?” দিশা বলল,”ও হ্যালো আমার ভাইয়া এটা? এরকম ফালতু কাজ আমার ভাইয়া করবে না। সবাইকে নিজের মতো ভাবিস নাকি?
_তুই অলওয়েজ আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে কথা বলিস কেন? আমার সাথে ঝগড়া না করলে তোর পেটের ভাত হজম হয়না, তাইনা?” শায়লা বেগম ধমক দিয়ে বললেন”
_চুপ একদম চুপ। কাল থেকে তোরা দুজন এক সাথে খেতে বসবিনা।” শাওন কিছু বলল না চুপ হয়ে গেলো। দিশা বলল” আমার বয়েই যাচ্ছে ওর মতো একটা ষ্টুপিডের সাথে খেতে।
_দেখেছো আম্মু তোমার ভাইঝি আমায় কী বলল?
_বেশ বলেছি।” শায়লা বেগম আবার ধমক দিয়ে বললেন”
_চুপ যাবি নাকি থাপ্পড় লাগাবো দুটোকে?” দিশা শাওনকে ভেংচি কেটে খেতে লাগলো। দিহান অরিনের দিকে আড়চোখে একবার তাকালো। অরিনের চেহারায় স্পষ্ট ভয় ফুটে আছে। খাওয়ার মধ্যে আর কোনো কথা হয়নি। দিহান খেয়ে উঠে চলে গেলো। আস্তে আস্তে সবাই চলে যায়। শুধু টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে অরিন। দিহান তো ঠিকই দূরে থাকছে। তাহলে সে কেনো পারছে না? দূরে থাকার কথাটা তো সে নিজেই বলেছিলো? তাহলে এই দূরে থাকছে বলে এতো কষ্ট কেন হচ্ছে?

_____________________________________

জহুরা বেগমের ইচ্ছে করছে একবার ডাক্তার বাড়ি গিয়ে অরিনকে দেখে আসতে। কিন্তু উনারা যদি কিছু মনে করেন? আর তো মাত্র একটি দিনের ব্যাপার। তারপর তো অরিন চলে আসবে। নিজেকে দমিয়ে নিলেন জহুরা। কিন্তু মনটা ছটফট করছে উনার। অরিন ওখানে কেমন আছে? তাকে দিয়ে উনারা রান্না ছাড়া অন্য কোনো কাজ করাচ্ছেন কিনা? বার বার এগুলা মনে আওড়াচ্ছে। অরিনকে কখনোই সৎ সন্তান ভাবেন নি তিনি। সব সময় ভেবেছেন অরিন উনার নিজের সন্তান। সৎ মা কতোটা বিষাক্ত শব্দ সেটা উনি জানেন। তাই তিনি অরিনের সৎমা হয়ে থাকতে চাননি। আর তাছাড়া উনাকে অরিনের বাবা বিয়ে করার পর বাসর ঘরে মাথায় হাত রেখে কসম খাইয়েছিলেন। অরিনকে যেন কখনো মায়ের অবাব বুঝতে না দেন।স্বামীর কথা তিনি রেখেছেন। বুক ছিঁড়ে আসা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন জহুরা।

হঠাৎ উনার মনে পড়লো অরিন সেদিন আলমারিতে কি যেন রাখছিলো। বিছানা থেকে উঠে বালিশের নিচ থেকে চাবি বের করে আলমারি খুললেন জহুরা। আলমারির প্রথম তাকে শুধু জহুরার কয়েকটা সুতির শাড়ি। এর পরের তাকে অরিনের কয়েকটা ড্রেস। তবে এগুলা রঙিন বলে অরিন এগুলা পড়েনা। পরের তাকে কয়েকটা সাদা ও কালো রংয়ের ড্রেস ও দুটো সাদা রংয়ের শাড়ি। জহুরা সবকিছু খুঁজলেন কিছুই পেলেন না। আলমারির নিচের তাকে একটা শাড়ি এলোমেলো ভাবে রাখা। জহুরা শাড়িটা টান দিয়ে সরাতেই বেরিয়ে এলো মাঝারি আকারের দুটো বক্স। জহুরা হাতে নিয়ে উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখলেন। উপরে চকলেটের ছবি দেখে বুঝে গেলেন এগুলা চকলেট। কিন্তু অরিন চকলেট বক্স পেলো কই? কেউ কী তাঁকে দিয়েছে? দিলে এভাবে লুকিয়ে রাখলো কেন? জহুরা বেগম আলমারিতে রেখে দিলেন। অরিন আসলে জিজ্ঞেস করে জেনে নিবেন কই পেলো এটা। দুজন মহিলা এসে জহুরা বেগমকে ডাক দিলেন। জহুরা আলমারি বন্ধ করে বাইরে বের হলেন। মহিলাটি জহুরাকে বললেন,”কী করতাছ ভাবি?
_না ভাবি ভালা আছি।
_তোমার মাইয়া কই? আমার জামা কি সেলাই শেষ অইছে।
_হ ভাবি শেষ অইছে। আপনে খাঁড়ান আমি নিয়া আইতাছি।” জহুরা ঘরে গিয়ে জামাগুলা নিয়ে আসলেন। একজন মহিলা বললেন,”অরিনরে দেখতাছি না যে?
_ডাক্তার বাড়িতে গেছে। উনাগো মেমান আইছেন তো, রান্নাবান্না করনের লাগি নিছে৷ উনাগো নাকি অরিনের রান্না ভালা লাগছে।” জহুরার কথা শুনে এক মহিলা আরেক মহিলাকে কনুই দিয়ে গুতা দিলেন। তারপর হেসে বললেন,”
_আইচ্ছা তাইলে জাইতাছি।”মহিলা গুলা চলে গেলো। গেটের সামনে গিয়ে একজন আরেকজনকে বলল,”দেখছো বইন? নিজেই মাইয়া হইলে কি পরের বাড়ি কামে দিতো? সৎ মা তো সৎ মা-ই হয়।
_যতই বলেন আপা। মায়েরটা কখনো সৎমা করতে পারব না। চেয়ারম্যান সাহেবের বউয়ের মুখে জহুরার এতো তারিফ। চেয়ারম্যান বাড়ির সামনে দিয়াই তো জাইমু। আইজকা উনারে বলইলা জাইমু উনার জহুরার কথা। মাগো মাগো জুয়ান পোলা এক বাড়িতে আছে ওই বাড়িতে মাইয়ারে কামে দিয়া দিলো?
_দিবোনা? এটা কি তাঁর পেটের মাইয়া। নিজের মা অইলে এভাবে বইয়া বইয়া খাইতো?” কথা বলতে বলতে দুজন চেয়ারম্যান বাড়িতে গিয়ে উঠল।

_______________________________

একদিন চলে গেলো। দিহান অরিনের দিকে একবারও তাকায়নি। অরিন কেন জানি এই ব্যাপারটা মেনে নিতে পারছেনা। তাঁর দম বন্ধ হয়ে আসছে দিহানের এমন আচরণে। ড্র‍য়িং রুমে সোফায় বসে সবাই গল্প করছে। গল্পের টপিক হলো। জিহানের হবু বউ। জিহানের হবু বউয়ের সৌন্দর্যের প্রশংসা সবার মুখে মুখে। শুধু দিহানের মুখে কোনো রা নেই। সে চুপ করে বসে আছে।অরিন সোফা থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে। তার কাতর দৃষ্টি দিহানের দিকে। কিন্তু দিহান একবারও অরিনের দিকে তাকাচ্ছে না। কষ্টে অরিনের চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এলো। মাথা নিচু করে খুব সাবধানে জল মুছে নিলো। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল সে। হঠাৎ অরিনের কেন জানি মনে হলো দিহান তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। তাকিয়ে দেখলো দিহান ফোন টিপছে। অরিন চলে আসলো কিচেনে। দিহানের তাকানোটা সে খুব মিস করছে। দুষ্টুমি চাহনির মিটিমিটি হাসি মুখটা বার বার চোখে ভাসছে। দিহানের ইশারায় কথা বলা গুলা মিস করছে। খুব তো দিহানকে বলে দিলো দুদিনে কাউকে ভালোবাসা যায়না এটা আবেগ। খুব তো বলল আমার সামনে আসবেন না। তাহলে তাঁর কেন এতো কষ্ট হচ্ছে? দিহান তো তাঁর কথাতেই এমন করছে।

রাতের খাবার টেবিলেও দিহান একই কান্ড করলো। একবারও অরিনের দিকে তাকালো না। অরিন বাটি হাতে নিয়ে শান্তি, রুহান,দিশা,ইশিকে তরকারি তুলে দিয়ে শাওনকে দিলো। তারপর নীলকে দিয়ে দিহানের পাশে আসলো। অরিন দিহানকে তরকারি তুলে দিতে গেলে দিহান হাত বাড়িয়ে দিয়ে চামচ আটকিয়ে বাধা দেয়। তারপর স্বাভাবিক ভাবে আবার খেতে লাগে। অরিনের চোখ থেকে টুপ করে একফোঁটা জল গড়িয়ে পরলো। টেবিলের উপর দিহানের হাত ছিলো জলটা গিয়ে তাঁর হাতে পড়লো। হাতে তরল কিছু পড়ায় দিহান হাতের দিকে তাকিয়ে দেখে জল। দিহান আড়চোখে অরিনের দিকে তাকালো। অরিন বাটি হাতে নিয়ে কিচেনে চলে গেলো।

খাওয়া শেষ হলে কেউ ঘুমাতে যায়না সবাই ছাদে যায়। কাল সকালে সবাই চলে যাবে। তাই আজ সারারাত জমিয়ে আড্ডা হবে। লুপা অরিনকেও নিয়ে গেলো। ছাদে অনেক ঠান্ডা লাগছে তবুও কেউ নিচে যাচ্ছেনা। দিহান মাথা ব্যথা করছে বলে চলে গেলো নিচে। তার অনেক্ষণ পরে শান্তি চৌধুরী অরিনকে বললেন”অরিন যাও তো আমাকে তোমার মিষ্টি হাতে মিষ্টি চা বানিয়ে খাওয়াও।” শাওন কিছু বলতো। কিন্তু এতো মিষ্টি করে বলায় আর কিছুই বলল না। অরিন নিচে এসে দেখলো দিহান ড্রয়িংরুমে বসে আছে। খুব চিন্তিত লাগছে তাঁকে। অরিন দাঁড়িয়ে দিহানের দিকে তাকালো। দিহান একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলো। অরিন আর দাঁড়িয়ে থাকল না। কিচেনে ঢুকে চায়ের পানি বসাতেই দিহান কিচেনে গেলো। অরিনের পাশে দাঁড়িয়ে বলল,”কাল সকালে চলে যাবো অরিন।” অরিনের খুব খারাপ লাগছে। কিছু বলতে চায় সে কিন্তু বলতে পারছে না। কি বলবে? এতো বড় বড় কথা বলে সে নিজেই তো ঠিক থাকতে পারেনি। দুদিনে ভালোবাসা যায়না বলে তো সে নিজেই ভালোবেসে ফেলেছে। দূরে থাকার কথা বলে তো সে নিজেই কাছে ঘেঁষতে চেয়েছে। দিহান বলল,”কেঁদেছিলে কেন তখন?” অরিন কিছু বলল না। দিহান বলল”আমি শীঘ্রই চলে যাবো। দেশে ফিরতে দেরি হতে পারে। তখন হয়তো এসে শুনবো তোমার বিয়ে হয়ে গেছে। যেখানে থাকো যেভাবে থাকো ভালো থেকো অরিন।” দিহানের কথাগুলা শুনে ডুকরে কেঁদে উঠল অরিন। চট করে এসে দিহানকে জড়িয়ে ধরলো। দিহান আহাম্মকের মতো হা হয়ে যায়। অরিন কাঁদতে কাঁদতে বলল “আপনি চলে যাবেন শুনে আমার কেন খুব কষ্ট হচ্ছে বলবেন? আমি কেন এটা ভাবতে পারছিনা আপনি চলে গেলে আর দেখা হবেনা। এটা ভাবলে এতো কষ্ট হচ্ছে কেন বলুন?” দিহানের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। অরিনকে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে বলল” কারণ একটাই অরিন আমরা হাসবেন্ড ওয়াইফ।” অরিন কেঁদে গেলো। দিহান বলল” কিন্তু আমাদের বিয়ের কথা কাউকে বলে লাভ হবেনা অরিন। আমাদের কাছে কাবিননামা নেই।” অরিন কিছু বলতে যাবে তখন কানে শব্দ এলো সিঁড়ি দিয়ে কেউ দৌড়ে নামছে। অরিন আর দিহান চট করে দুজন দুজনকে ছেড়ে ভয়ার্ত চোখে একজন আরেকজনের দিকে তাকালো।

চলবে,,,,,,।
কপি করা নিষেধ
এত্ত বড় হওয়ার জন্য সরি?
গঠন মূলক মন্তব্য আশা করছি❤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here