ভালোবাসি_প্রিয় পর্ব_৯

0
1244

ভালোবাসি_প্রিয়
পর্ব_৯
#সুলতানা_সিমা
[কপি করা নিষেধ। শেয়ার করা যাবে]

রাতে অষুধ খাওয়ায় সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজেকে অনেকটা হালকা অনুভব করলেন জহুরা বেগম। মনে মনে ভাবলেন আজ ডাক্তার বাড়ি যাবেন। অরিন এখনো ঘুমাচ্ছে। জহুরা বেগম রান্নাঘরে গিয়ে রান্নাবান্না শেষ করে নিলেন। ততক্ষণে অরিন ঘুম থেকে উঠে যায়। সারারাত দিহানের কথা মনে পড়েছে। দুচোখ এক করতে পারেনি। বার বার দিহানের মুখটা চোখে ভেসে উঠছিলো। জহুরা বেগম সব কাজকর্ম গুছিয়ে ডাক্তার বাড়ি চলে গেলেন। অরিনের কলেজ যাওয়ার ইচ্ছে ছিলো। কিন্তু গেলো না। ইচ্ছে থাকলেও যেতে ভালো লাগেনি তাঁর।

জহুরা বেগম ডাক্তার বাড়িতে এসে দেখলেন সবাই উঠুনে বসে আছে। শাওন নীল আর দিহান বাদে। শায়লা বেগম জহুরাকে দেখেই বললেন”আরে ভাবি এতো সকাল চলে আসলা? আমরা মাত্র তোমার কথা বলছিলাম। জহুরা শায়লার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন,” কী কী করতে অইবো ভাবি কন?” শায়লা বেগম বললেন”ভাবি কিছু করতে হবেনা। আপনি গিয়ে অরিনকে পাঠিয়ে দিন।
_আমি পারুম ভাবি কন কি করতে অইবো।
_আপনি পারবেন বুঝেছি, কিন্তু আমি অরিনকে চাইছি।” জহুরা বেগম মাথা নিচু করে বললেন,”
_ভাবি মাফ কইরেন। মাইয়ারে কামে দিতে পারুম না। বাড়িতেও তারে কিছু করতে দেইনা আমি।
_অরিনকে কিছু করতে হবেনা। শুধু রান্নাটা করবে। আসলে মা মুরুব্বি মানুষ বুঝই তো? উনার কাছে অরিনের রান্না নাকি অনেক ভালো লাগছে। মা আর তিনদিন থাকবে। তিনদিব পরে অরিনকে আর আসতে হবেনা। এই তিনদিনের ব্যাপার মাত্র।
_কিন্তু ভাবি। কাম কইরা শেষ করতে রাইত অইয়া যাইবো। আর রাইতের বেলা জোয়ান [যুবতি] মাইয়ার যাওয়া, এইটা কি ঠিক অইবো?
_এটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবেনা। তিনদিন অরিন আমাদের এখানে থাকবে।”
জহুরা বেগম কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন,”
_আইচ্ছা ভাবি। তয় ভাবি, অরিনরে দিয়া বেশি কাম করাইবেন না। কাম অইলে আমারে খবর পাঠাইলে আমি আইয়া কইরা যামুনে।
_ঠিক আছে ভাবি আপনি যান।” জহুরা বেগম চলে গেলেন। শান্তি চৌধুরী বললেন,”সৎ মা বলে মনে হচ্ছে না। মানুষ যতটা নিজের সন্তান নিয়ে ভাবে ততটাই দেখি ভাবছে।
_হুম শুনেছি সেও নাকি এতিম ছিলো। সৎ মা ছিলো দুটো। উনারা ভালো ছিলেন না। তাই হয়তো মেয়েকে আদর করে।
_হুম হতেই পারে।

_______________________

_আমি পারবো না মা। ওদের মেহমান যতদিন থাকবে ততদিন আমি ওদের বাড়িতে যাবো না।
_অরিন এইডা কি কইতাছিস তুই। মেমানরাই [মেহমানরা] তো কতাইছে তোরে যাওয়নের লাগি।
_ওদের মেহমানকে গিয়ে বলো আমি যেতে পারবো না।” অরিনের ঝাঁঝালো গলার কথা শুনে চুপ হয়ে যান জহুরা। আর কিছু বললেন না। পিছনের আলগ ঘরে গিয়ে গাভীকে নিয়ে মাঠে বেঁধে আসলেন। এসে দেখলেন অরিন ঘুমিয়ে আছে। দুপুর গড়িয়ে যায়। আকাশের সূর্য লালচে রং ধারণ করে। তখন শায়লা বেগম আসেন অরিনদের বাড়ি। উনার শান্তি নামক মায়ের অশান্তির জন্যই আসতে হয়েছে। বার বার শুধু, ওই মেয়ে আসেনা কেন? তুই গিয়ে এই মেয়েকে নিয়ে আয়। এটা ওটা বলে শায়লা বেগমের কান ঝালাপালা করে দেয়। সেলিনা বেগম বাড়িতে নাই বলে আমিরুন নেছা আজ অরিনদের ঘরে আছেন। আমিরুন নেছা আর জহুরা গল্প করছেন। অরিন শুয়ে শুয়ে তা শুনছে।

শায়লা বেগম চারিদিকে তাকিয়ে জহুরাকে ডাক দিলেন৷ “জহুরা ভাবি।” ডাক শুনে জহুরা বাইরে আসলেন। শায়লা বেগমকে দেখে হন্তদন্ত হয়ে বললেন,”ভাবি আপনে আমাগো বাড়ি? কোনো সমস্যা অইছে?” শায়লা বেগম কিঞ্চিৎ হেসে বললেন,”
_না। আসলে মা পাঠিয়েছেন অরিনকে নেওয়ার জন্য।” অরিন বাইরে বের হচ্ছিলো এটা শুনে আবার ঘরে ঢুকে যায়। জহুরা শায়লাকে বলেন,”আহেন ভাবি ঘরে আহেন।” শায়লা ঘরে যান। অরিন মুখ কালো করে খাটে বসে আছে। শায়লা অরিনকে বললেন,” অরিন আমি তোমাকে নিতে আসছিলাম। দিহান বলল কাল নাকি তুমি গেছিলে। তুমি যা যা রান্না করেছিলে মায়ের খুব ভালো লাগছে। এখন মা চায় যতদিন মা থাকবে তুমি রাঁধবে। মা চলে গেলে চলে আসবে।” অরিন কিছু বলল না। শায়লা বললেন,”তুমি কি যেতে অনিচ্ছুক?
_আরে না চাচি কী বলেন এসব।
_তাহলে আসো।” অরিন একবার তাঁর মায়ের দিকে তাকালো। উনি ব্যথিত চোখে অরিনের দিকে তাকিয়ে আছেন। অরিন কিছু না বলে চলে গেলো উনার সাথে। সত্যি বলতে অরিন রাতের ব্যাপারটা নিয়ে এখনো লজ্জায় আছে। তাই দিহানের সামনে আর যেতে চায়না। দিহানের খাওয়া পানিটা না খেলে কী এমন হতো? না খেলে তো এই লজ্জাটা পেতে হতোনা। নিজেকে বকতে বকতে ডাক্তার বাড়ি চলে আসে।

ডাক্তার বাড়িতে এসে পা রাখতেই অরিনের হার্টবিট বেড়ে গেলো। দিহান আছে এই বাড়িতে। দিহানের সামনে কেমনে বের হবে? কাল রাতে যা কান্ড করেছে তাঁর পর থেকে একা একাই লজ্জায় আধমরা হয়ে আছে। এরই মাঝে যদি দিহানের সম্মুখীন হয়, তাহলে তো লজ্জায় মরে যাবে সে। শায়লা বেগমের পিছু পিছু সদর দরজা দিয়ে ঢুকলো অরিন। ড্রয়িং রুমে এসে ঢুকতেই চোখ গেলো সোফার দিকে। দিহান শাওন নীল আর শান্তি চৌধুরী বসে আছেন। শায়লা বেগম উনার মায়ের উদ্দেশ্যে বললেন,”এই নাও এনেছি তোমার রাঁধুনি। এবার খুশি?” শায়লার কথায় দিহান নীল শাওন এক সাথে থাকায়৷ দিহান আর শাওনের মুখ সাথে সাথে বিষন্ন হয়ে যায়। দুজনেরই একই কষ্ট, অরিন কাজে এসেছে৷ নীল শাওন দিহানের প্রতিক্রিয়া দেখতে আড়চোখে তাদের দিকে তাকালো। দুজনের চেহারায় আঁধার নেমে এসেছে। নীল চোখ ফিরিয়ে নিয়ে তাচ্ছিল্য হাসলো।

শান্তি চৌধুরী অরিনকে বললেন,”তোমাকে দেখার খুব ইচ্ছে ছিলো। যাক আলহামদুলিল্লাহ দেখা হয়ে গেছে।”অরিন মাথা নিচু করে থাকলো। কেন জানি তাঁর খুব লজ্জা লাগছে। শান্তি চৌধুরী বললেন” ওই তোরা তিনটা উঠতো। তুমি এসে বসো অরিন।” শাওন দিহান নীল উঠে উপরে গেলো। তিনজন শাওনের রুমে গিয়ে বসলো। শাওন তাঁর মাকে ডেকে আনলো রুমে। শায়লা শাওনের রুমে ঢুকতেই শাওন বলল,”আম্মু এসব কি? তুমি অরিনকে এনেছো কেন?
_আমি কি করবো? তোর নানুমনি তো ওর জন্য পাগল হয়ে গেছেন।” শায়লার কথায় শাওন আর কিছু বলল না। দিহান ভিতরে ভিতরে হাসলো। শাওনেরও কেন জানি খুব ভালো লাগলো। দুজনেরই ভালো লাগার একটাই কারণ তাদের শান্তি জানুটা অরিনকে পছন্দ করেন। শায়লা চলে গেলেন নিচে।

শান্তি চৌধুরী অরিনের রান্নার অনেক প্রশংসা করছেন। আর বসে বসে তা শুনে যাচ্ছে অরিন। এতো মজার রান্না যে সে কোন জন্মে রেঁধে খাওয়ালো সেটা তাঁর মাথায় ঢুকছে না। শায়লা বেগম বললেন,”মা তোমার কথা বলা সারাদিনেও শেষ হবেনা। এবার অরিনকে ছাড়ো, ওকে রান্না করতে হবে।
_হ্যাঁ অরিন যাও গিয়ে রান্না করো। আর শুনো কালকের মতো রাঁধবে কিন্তু। তোমার হাতের রান্না আর দিহানের হাতের রান্নার অনেক মিল জানো। দিহান যখন রান্না করে তখন না,,,,,,”,শায়লা বেগম মায়ের কথার মাঝখানে বললেন,”উফফফ মা থামবে? তোমার এই কথা বলার সময় স্বভাবটা সবার উপরে প্রভাব ফেলছে জানো? এই অরিন যাওতো তুমি কিচেনে যাও। ” অরিন ঠোঁটের কোণে জোরপূর্বক হাসির রেখা টেনে কিচেনে চলে গেলো। শান্তি চৌধুরী মেয়ের দিকে রাগি লুকে তাকালেন।

অরিন কিচেনে এসে ভাবতে লাগলো। আসলে কাল রান্নাটা করেছে কে? দিহান নয়তো? দিহানকে পেলে কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইবে সে। মনে মনে অনেক গুলা প্রশ্ন জমা করে নিলো। দিহানকে এখন বেশ সুবিধের মনে হচ্ছে না অরিনের কাছে। শায়লা এসে যা যা রান্না করতে হবে বলে গেলেন। এতো গুলা রান্নার লিস্ট শুনেই অরিনের কলিজা শুকিয়ে কাঠ। এগুলা সে রাঁধবে কেমনে। শায়লা বেগম ড্রয়িংরুমে গিয়ে টিভি দেখতে লাগলেন। অরিন রান্না শুরু করলো। কিছুক্ষণ পরে কিচেনে লুপা আসলো। অরিন লুপার দিকে একবার তাকিয়ে রান্নায় মনোযোগ দিলো। সে লুপাকে চিনতে পারছে না। লুপা অরিনের পাশে দাঁড়িয়ে বলল,হাই।” অরিন লুপার দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ স্বরে হ্যালো বলল। তারপর তাঁর কাজে মন দিলো। লুপা বলল” আমি লুপা। শাওন ভাইয়ার মামাতো বোন।” অরিন শুধু ছোট করে অহ বলল। লুপা একহাতে নাইফ নিয়ে অন্যহাতে একটা টমেটো নিতে নিতে বলল,”আমি তোমাকে সবজি কাটতে হেল্প করি?

_আরে না না কী বলছেন এসব। আমি পারবো।
_আমি তোমাকে তুমি করে বলছি আর তুমি আমাকে আপনি করে বলছো? সো সেড।” লুপা মুখটা বাচ্চাদের মতো করে রাখলো। অরিনের খারাপ লাগলো। অরিন কিছু বলতে যাবে তখন লুপা উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল,হেই তুমি পায়েশ বানাতে পারো?” অরিন বোকার মতো হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো। এই ক্ষণিক সময়েই লুপাকে তাঁর কাছে অদ্ভুত মনে হচ্ছে। অরিন হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াতেই লুপা অরিনকে চট করে জড়িয়ে ধরলো। তারপর বলল,”রান্না শেষে আমাকে পায়েশ বানিয়ে দিবে? প্লিজ প্লিজ প্লিজ।
_হুম। আপনি পায়েশ খেয়ে পছন্দ করেন?
_আবার আপনি? ওকে। বাট আমি না পায়েশ খেতে একদম পছন্দ করিনা। ওটা আমার কাছে কেমন যেন লাগে।
_তাহলে কার জন্য বানাতে বলছেন?
_আছে একজন। ও না পায়েশ খুব পছন্দ করে, কিন্তু আমার ফুপিটা ওর মনের মতো করে পায়েশ বানাতে পারেনা।
_ও কে? শাওন ভাই?
_আরে না না ওটা তো আমার ভাইয়া হয়।
_তাহলে কে?
_বলব একদিন। আচ্ছা তুমি কাউকে ভালোবাসো?
_না না কাউকে ভালোবাসি না।” অরিনের অস্বস্তি লাগছে৷ অরিনের কাছে লুপাকে অদ্ভুতের থেকেও বেশি কিছু মনে হচ্ছে। মানুষ প্রথম দেখায় নাম,লেখাপড়া,থাকে কই এসব জানতে চায়। আর এই মেয়ে কিনা? অরিনের কিঞ্চিৎ বিরক্ত লাগছে কিন্তু প্রকাশ করলো না। লুপা হঠাৎ উঠে বলল,”আচ্ছা তোমার নাম অরিন তাইনা?
_জ্বি।” লুপা এবার আস্তে আস্তে অরিনকে সব জিজ্ঞেস করতে লাগলো। পরিচয় পর্ব শুরু হলো একদফা কথা বলার পর। লুপার এমন উল্টা কাজটা দেখে অরিনের হাসি পেলো।

শাওন নীল দিহান মিলে গল্প করছিলো। তখন শাওনের ফোনে একটা কল এলো। একজন রোগি দেখতে শাওনকে যেতে হলো। শাওন যাওয়ার পরেই দিহান বলল,”নীল তুই বস আমি আসছি।
_কই যাবি?
_এইতো আছি। আসছি আমি বস তুই।” দিহান বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। নীল ঠিকই আন্দাজ করতে পারছে শাওন কই যাবে। তাঁর বুক ছিঁড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো। কোনো একটা সময় হয়তো এই অরিনকে নিয়ে ঝগড়া করে তাদের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাবে। এমনও হতে শাওন আর দিহানের পরিবারেও এ নিয়ে মনমালিন্য চলে আসে। নীলের খারাপ লাগছে এসব ভেবে। মনে মনে দোয়া করছে এমন কিছু যেন না হয়।

দিহান ড্রয়িংরুমে এসে আটকে গেলো। এতোগুলা মানুষের চোখ ফাঁকি দিয়ে কেমনে কিচেনে যাবে সে। দিহান ভাবলো উপরে চলে যাবে। তারপর নিজেকে দমিয়ে রাখতে না পেরে সাহস করে পা বাড়ালো কিচেনের দিকে। সবার মনোযোগ টিভিতে হওয়ায় কেউ ততটা খেয়াল করেনি। কিন্তু এক জোড়া চোখ ঠিকই দিহানের এইভাবে কিচেনে যাওয়াটা দেখেছে।

দিহান কিচেনে ঢুকে দেখলো। অরিন আর লুপা কথা বলছে। কথা লুপাই বেশি বলছে অরিন শুধু হুম হা করছে। দিহান গলা খাঁকারি দিতেই লুপা অরিন পিছনে তাকালো। দিহান লুপাকে বলল,”তোকে নাকি ছোট আম্মু ফোন দিচ্ছে,তুই ফোন তুলছিস না কেন?
_আমি তো ফোন রুমে রেখে এসেছি। আমি তাহলে এখন যাচ্ছি অরিন আম্মুর সাথে কথা বলে আসবো।” বলেই লুপা কিচেন থেকে চলে গেলো। দিহান এসে অরিনের পিছনে দাঁড়ালো। অরিন এতোক্ষণ যতগুলা প্রশ্ন জমিয়েছিলো মনে, দিহানকে দেখেই সব উঁড়ে গেছে। কাল রাতের কথাটা চট করে মনে পড়ে গেলো। অরিনের লজ্জা লাগছে খুব। লজ্জার আভা তাঁর চোখে মুখে ফুটে উঠলো।

দিহান অরিনকে বলল,”কেমন আছো?” অরিন কিছু বলল না। দিহান বলল,”মেডাম কি রেগে আছেন নাকি কথা বলার রুচি নাই?
_কাল আমাকে মিথ্যে বললেন কেন?” অরিনের গলায় ঝাঁঝ। দিহান স্বাভাবিক ভাবেই বলল”
_কোনটা?
_ আপনি বললেন রান্না করা আছে রাঁধতে হবেনা। সবাই বলছে আমি রেঁধেছি। এসবের মানে কি? সবাই এসব বলছে কেন?
_সবাই যেটা জানে সেটা বলেছে।
_আপনি বলেছেন সবাইকে আমি রান্না করেছি?
_কি মনে হয়? তবে আফসোস কি জানো? এত কষ্ট করে রান্না করার পরেও নামটা শুধু তোমার হচ্ছে।” দিহানের কথায় অরিনের চোখ কপালে উঠে যায়। অবাক হয়ে বলে,”আপনি রেঁধেছিলেন? কিন্তু কেন? আমিও তো রাঁধতে পারতাম।
_হুম পারতে। বাট বন্ধুকে হেল্প করাই তো যায়। তাইনা?
_আপনাকে কখন বললাম আমি আপনার বন্ধু?
_যখন তুমি গ্লাসের পানি খেয়েছিলে তখন তো বুঝিয়ে দিলে আমায় বন্ধু ভাবো। বন্ধু না ভাবলে কী পানি খেতে?” বলেই দিহান ঠোঁট কামড়ে হেসে উঠলো। লজ্জায় অরিনের মরে যাই যাই অবস্থা। দিহান তাকে লজ্জা দিতে এটা বলছে এতে কোনো সন্দেহ নেই৷ অরিনের ইচ্ছে হলো বলবে,”পানিটা আমি রাতে খেয়েছি রান্নাটা আপনি দিনে করেছেন। তখন কি দেখে ভাবছিলেন আমি বন্ধু ভাবি?” বলতে ইচ্ছে হলেও বলতে পারলো না অরিন। লজ্জায় গলায় সব আটকে আছে। ড্র‍য়িংরুম থেকে শাওনের গলার স্বর এলো। অরিন দিহানকে বলল ”
_যান এখান থেকে প্লিজ।
_হুম চলে যাবো। একটা কথা বলতে এসেছি।
_প্লিজ চলে যান। কেউ চলে আসলে আমাকে কথা শুনাবে।
_হুম যাবো কথাটা বলে যাই।
_অন্যসময় বলবেন প্লিজ যান।
_তাহলে বলো রাতে ছাদে দেখা করবে?
_ক্ক ক্ক কি বলছেন এসব?
_যা বলছি তাই৷ করবে দেখা?
_প্লিজ চলে যান কেউ আসবে।
_দ্যাত,,আসুক তাতে কি? আমরা তো হাসবেন্ড ওয়াইফ তাইনা?” অরিন রাগি লুকে তাকালো। দিহান বলল, না মানে এমনি বললাম। বন্ধু তো আমরা তাইনা?
_আপনি যাবেন?
_তার আগে বলো ছাদে যাবে রাতে?
_ওকে যাবো। যান এবার প্লিজ।
_ যে কোনো সময় গেলে চলবে। বাই।” দিহান চলে আসে কিচেন থেকে। এসে দেখে শাওন সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠছে। দিহান খুব সাবধানে শাওনের পিছু পিছু চলে গেলো।

অরিনের মনে হঠাৎ করে যেনো সুখের মেলা বসলো। চারদিকে শুধু সুখের ছড়াছড়ি মনে হচ্ছে। দিহান তাঁর জন্য রান্না করেছে? ভাবতেই কী ভালো লাগছে। অরিন কানে বাজলো দিহানের বলা কথাটা “আসুক তাতে কি? আমরা তো হাসবেন্ড ওয়াইফ তাইনা?”কথাটা মনে হতেই অজানা অনুভূতি অজানা সুখ তার মনের ছোট ঘরে ঝড় তুলে দিলো। এই ঝড়টাও অরিনের অজানা। আচমকা একটা মানুষের সাথে দেখা হওয়া। আচমকা বিয়ে হওয়া। কাকতালীয় ভাবে আবার তার সাথে দেখা হওয়া। তার জন্য মনের মধ্যে অজানা অনুভূতির জন্ম হওয়া। এই সবকিছুর পেছনে কি একটাই কারণ, যে সে দিহানের পাজরের অংশ থেকে সৃষ্টি? প্রশ্নগুলা মনে মনে আওড়াতে আওড়াতে একা একা হেসে উঠল অরিন।

রান্না শেষ হলে অরিন কিচেনেই দাঁড়িয়ে থাকে। ড্রয়িংরুমে যেতে তাঁর দ্বিধা হচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে লুপা এসে বলল,”আরে রান্না শেষ?
_হুম।
_তাহলে দাঁড়িয়ে আছো কেন ড্রয়িং রুমে চলো।
_আরে না না আমি এখানেই ঠিক আছি।
_আচ্ছা। জানো ভাইয়া না আমাকে মিথ্যে বলেছে। গিয়ে দেখি আম্মু ফোনই দেয়নি।
অরিন ছোট করে অহ বলে বসে থাকে। লুপা বকবক করতে লাগে। অরিন শুধু কান দিয়ে সবকিছু শুনছে। লুপা যে এতো বক বক করতে পারে তাঁর জানা ছিলোনা৷ শায়লা এসে খাবার রেডি করতে বলেন। অরিন খাবার টেবিলে নিতে লাগে। সবকিছু নিতে অরিনকে লুপা সাহায্য করলো। শায়লা অরিন বাদে সবাই টেবিলে খেতে বসলো। অরিনকে সবাই খেতে বসতে বললো অরিন বসলো না। লুপাও উঠে গেলো। সে বলল অরিনের সাথে খাবে। জোর করে শায়লাকে বসিয়ে দিলো লুপা। উনি খেতে বসলেন। দিহান অরিনকে ইশারায় বুঝালো তাঁর প্লেটে তরকারি তুলে দিতে। অরিন প্রথমে নড়লো না। দিহান কাতর চোখে তাকালো। অরিন বাটি হাতে নিয়ে আগে শান্তি চৌধুরীকে দিলো তারপর শায়লাকে তারপর শাওনকে। শাওন অরিনের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। নীল অলরেডি খাওয়া শুরু করে দিছে। অরিন বাটি নিয়ে দিহানের পাশে আসলো। দিহানের প্লেটে তরকারি তুলে দেওয়ার সময় তাঁর অন্যরকম ফিল হলো। যা অন্যদের দেওয়ার সময় হয়নি। দিহানের ঠোঁটের কোণেও হাসি। হয়তো তারও অরিনের মতো ফিল হচ্ছে৷ হবেনা কেন? নিয়তির জোরে বাঁধলেও একই সুতোয় তো বাঁধা দুজন।

শান্তি চৌধুরীর কাছে রান্নাটা কালকের মতো লাগেনি কিন্তু ততটাও খারাপ লাগেনি উনার কাছে। ভালোই লাগছে। সবার খাওয়া শেষ হলে সবাই উঠে যায়। শুধু দিহান রয়ে যায়। তার প্লেটে ভাত অর্ধেক খেয়েছে অর্ধেক রয়েছে। একটা চিকেন লেগ পিচের একবাইট খেয়েছে আর পুরোটাই রয়ে গেছে। অরিন দিহানের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে প্লেট গুলা কিচেনে নিতে লাগলো। লুপাও সাহায্য করছে। অরিন প্লেট রেখে আবার টেবিলে আসলে দিহান পানি খেয়ে উঠে। যেতে যেতে অরিনের কানের সামনে ঝুঁকে বলে ,”বাকিটা তোমার জন্য।” বলেই দিহান চলে যায়। অরিনের হৃদপিণ্ডটা লাফাতে লাগে। দিহানের বলা ছোট বাক্য গুলা তার মনের খুব গভীরে গিয়ে স্পর্শ করে। বাকিটা তোমার জন্য কথাটা যেন তাঁর কলিজায় গেঁথেছে। অরিন তো ভেবেছিলো দিহান খেতে পারছে না। আসলে সে অরিনের জন্য রেখেছিলো?

লুপা আর অরিন খাওয়া শুরু করল। অরিন দিহানের প্লেটেই খেতে বসে। লুপার বকবকানির জন্য এসব খেয়ালই করেনি। যদি করতো তাহলে হয়তো বলতো তুমি ঝুটা প্লেটে খাচ্ছো কেন? অরিন দিহানের প্লেটে খাচ্ছে প্রতিটি লোকমায় যেন সে জান্নাতের কোনো খাবার খাচ্ছে এমন মনে হচ্ছে। এমন অনুভূতি হচ্ছে যে অনুভূতির নাম তাঁর জানা নাই৷ কারো প্রতি মন বসে গেলে মনে হয়ে এমন নতুন নতুন অনুভূতি গুলা মনে জন্ম নেয়। খাওয়া শেষে লুপা অরিনকে টেনে তাঁর সাথে নিয়ে যায়। এখানে এসে তাঁরা দিশা ইশি এক রুমে থাকছে। লুপা আর তাঁর দাদুমনি এক রুমে, দিয়া শাঞ্জুর রুমে ঘুমাতো। আজ সে শাঞ্জু আর দিয়াকে শান্তি চৌধুরীর কাছে পাঠিয়ে দিলো। সে অরিনের সাথে থাকবে সারারাত গল্প করবে। লুপার এই এক অভ্যাস, তাঁর কাউকে ভালো লাগলে তাঁর সাথে গল্প করতে করতে কানের ঝালাপালা করে ফেলে।

রাত দুটো বেজে যায় লুপার বকবকানি শেষ হয়না। একটাও কাজের কথা বলছে না। সব আজাইরা কথা। তাঁর কলেজের কোন মেয়ে কার সাথে প্রেম করলো, কোন ছেলে কোন মেয়েকে কিভাবে পটিয়েছে। কোন টিচার লুচ্চা। কোন দোকানদার বেশি কিপ্টামি করে। অরিনের একবার মনে হলো লুপাকে বলতে “বইন চুপ যা এবার। এগুলা শুনে আমি কি করবো? কিন্তু বল না। হাই তুলে আবার শুনতে থাকলো। অরিনের দুচোখে ঘুম এসে বার বার উঁকি দিচ্ছে। কবে জানি চোখে ঢুকে তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় বিছানায়। রাত তিনটায় লুপা শুয়ে পড়ে। অরিন শুয় না। শুলেই সে ঘুমিয়ে যাবে এটা জানে। দিহান অপেক্ষা করছে হয়তো। লুপা ঘুমানোর পরে অরিন পা টিপে টিপে বেরিয়ে গেলো রুমে থেকে। নিজেকে অনেকবার বুঝিয়েছে যাবেনা কিন্তু পারেনি। চারদিকে তাকিয়ে চুপিচুপি ছাদে উঠল সে। যা ভেবেছিলো তাই। দিহান সত্যিই ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। অরিন এসে দিহানের পিছনে দাঁড়ায়। দিহান পিছন ঘুরে তাকাল। অরিন দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় ওড়না টানা,চাঁদের আলোয় তাকে আরেকটা চাঁদ লাগছে। অরিন বলল “কী বলবেন বলুন?” অরিনের গলা কাঁপা কাঁপা। শীতে সে কাঁপছে। দিহান নিজের গায়ের শাল খুলে অরিনকে পড়িয়ে দিলো। অরিন দিহানের দিকে তাকায়। দিহানের মুখটা চাঁদের আলোয় চিকচিক করছে। সুন্দর মানুষদের হয়তো চাঁদের আলোতে এতো সুন্দর লাগে তাই উনাকেও সুন্দর লাগছেন। দিহান মৃদুস্বরে বলল,”এতোক্ষণে এলে?” অরিন চোখ নামিয়ে নিলো কিছুই বলল না। দিহান অরিনকে বলল “চলো দোলনায় বসি?
_কী বলবেন বলেন তারাতাড়ি।
_এতো তাড়া কিসের?
_কেউ চলে আসবে।
_কেউ আসবে না।
_শাওন ভাই যদি আপনাকে খুঁজে ছাদে চলে আসে?” দিহান ভ্রুযুগল কুঁচকে বলল”
_ আচ্ছা তুমি কী শাওনকে ভয় পাও?
_কী বলবেন বলুন। নয়তো আমি চলে যাচ্ছি।
_ওকে বলছি। বাট Don’t worry শাওন নীল ঘুমানোর পরে আমি এসেছি।
_বলুন কি বলবেন।” দিহান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল”
_অরিন আমি আমাদের বিয়ের কথাটা সবাইকে জানিয়ে দিতে চাই।

চলবে,,,,,।

আজ গায়ে খুব জ্বর তবুও লেখার চেষ্টা করলাম। কি লেখেছি জানিনা। ভুলক্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।❤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here