ভালোবাসায় বন্দিনী পর্ব ৮

0
1865

#ভালোবাসায়_বন্দিনী
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৮
সাদমানের সাথে হৈমীর বেশ ভাব হয়ে গেলো।
কারন হৈমী রুদ্রর নামে এতো এতো নালিশ করছে আর সাদমান হু হা করছে। মানে হৈমীকে সাপোর্ট করছে সে। সেই খুশিতে হৈমী বেশ আয়েশ করে সিটে বসলো।দু পা উপরে তুলে ভাজ করে বসে মনের যতো রাগ, ক্ষোপ আছে ঢেলে দিচ্ছে একদম। কথা বলতে সে এতোই ভালোবাসে যে আর কোনদিকে হুশ নেই৷ রুদ্র চলে গেছে এ সুযোগে বের হওয়ার কথাও তাঁর মাথায় নেই৷ বরং মনের সমস্ত রাগ কথা বলে উপচে দিচ্ছে।

সাদমান শুধু কথাগুলো গিলছে আর জোর পূর্বক হাসছে। কারন এগুলো রুদ্র শুনলে হৈমীর দু চাপায় একটা দাঁত ও আর লেগে থাকবে না।সব খসে খসে পড়বে। নয়ন হৈমীকে এতো থামানোর চেষ্টা করছে পারছেই না। বরং হৈমী তাঁকে ধমক দিচ্ছে “চুপ থাক তুই তোর তো স্বাদের বেয়াই তাঁর খারাপ গুন গুলো টাশ টাশ করে বললে তো তোর গায়ে লাগবেই৷
আর সে যে আমাকে ঠাশ ঠাশ দেয় তাতে তোর কিচ্ছু জায় আসে না। ফ্রেন্ড নামের কলঙ্ক তুই দূর হো আমার চোখের সামনে থেকে” ব্যাস নয়ন আর টু শব্দ টিও করলো না। চুপচাপ হৈমীর কথাগুলো গিলতে লাগলো।
.
হৈমীর জন্য বেশ কিছু শপিং করলো রুদ্র। তাঁর মধ্যে ওড়না,ওড়না স্কার্ফ নিলো ১৬ টা ৮টা ওড়না আর ৮ টা ওড়না স্কার্ফ৷ শপিং মলের মেয়েটিকে বলে দিয়েছিলো সব রঙ মিক্সড করেই দিতে। মেয়েটি সেভাবেই সব দিয়েছে। নয়নের জন্যও কয়েকটি ড্রেস নিলো। শপিংমল থেকে বেরিয়েই সূচনা কে ফোন করে বললো “রেডি হয়ে বাড়ির সামনে দাঁড়াতে”।

সূচনা বিলিভই করতে পারছে না। রুদ্র তাঁকে রেডি হয়ে বাড়ির সামনে দাঁড়াতে বলেছে। কোথায় নিয়ে যাবে তা নিয়ে বিন্দু পরিমানও ভাবলো না। রুদ্র তাঁকে জাহান্নামে নিয়ে গেলে তাতেও সে রাজি। কালো, সাদা মিশ্রিত রঙের থ্রি পিচ পড়ে নিলো। ওড়নাটা গায়ে মেলে পিনআপ করে মাথায় ওড়না স্কার্ফ পড়ে নিলো৷ সুরভী বেগম তো বেশ খুশি এ প্রথম রুদ্র সূচনা কে নিয়ে বের হবে৷ সূচনার থুতনিতে চার আঙুল রেখে বললো,”মাশাআল্লাহ আমার ছেলের চোখ যেনো আজ জুরিয়ে যায়” কপালে চুমু খেয়ে কাধে ধরে গেট অবদি এগিয়ে দিয়ে আসলো সুরভী বেগম।
.
গাড়িতে ওঠতেই রুদ্র সাদমান কে বললো,
— তুই আসতে পারিস। আমি তোকে পরে ফোন করবো।
— কোথায় যাবি ভাবির জন্য কি পুরো শপিংমলের সব জামা কাপড় কিনে নিয়ে এসেছিস নাকি??
রুদ্র রাগি চোখে তাকাতেই সাদমান বোকা বোকা হাসি দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়লো।
তা দেখে হৈমী চিৎকার শুরু করলো। “ভালো ভাইয়া কোথায় যাচ্ছেন আপনি?? আপনি খুব ভালো।কোথায় যাচ্ছেন আমাকে নিয়ে যান।

সাদমান কিছু বলার জন্য নিচু হতেই রুদ্র গাড়ি স্টার্ট দিলো। আর কিছু বলার সুযোগ পেলো না কেউই।
হৈমী এবার কান্নাকাটি শুরু করলো। নয়ন পড়েছে মহাবিপদে সে কি বলবে কি করবে কিচ্ছু বুঝতে পারছে না৷ কান দিয়ে গরম হাওয়া বের হচ্ছে এখন তাঁর। হৈমী এবার মিনমিন করে বকছে আর কাঁদছে।
নয়ন কিছু বলতে যেতেই এক ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিচ্ছে। গাড়ি এসে থামলো শেখ বাড়ির সামনে।

নয়ন তো মহাখুশি নয়নার সাথে দেখা করতে পারবে বলে রুদ্রর দিকে চেয়ে বললো,

— আমি আপুর কাছে যাবো।
রুদ্র নয়নের দিকে তিনটে শপিং ব্যাগ দিলো৷ নয়ন অবাক হতেই ইশারা করলো নিতে নয়ন হালকা হেসে নিলো। রুদ্র বললো,
— যাও ভিতরে।
হৈমী এতোক্ষণ চুপ থাকলেও এবার খুশি তে গদগদ হয়ে নয়ন কে বললো,
— তারাতারি নাম নামবো আমি।
রুদ্র সামনের ডোর খুলে সূচনাকে ওঠতে বললো।সূচনা দাঁড়িয়ে ছিলো নয়নকে দেখে একটু অবাক হলো সে।চুপচাপ সামনে বসলো বসার পর বুকটা ধক করে ওঠলো পিছনে হৈমীকে দেখে। এদিকে নয়ন নামার সাথে সাথে ডোর লাগাতে বললো। নয়ন প্রথমে লাগালো না সে ভেবেছিলো হৈমীকেও নামতে দিবে কিন্তু না। রুদ্র মৃদু ধমক দিতেই নয়ন অসহায় চোখ মুখে হৈমীর দিকে চেয়ে বাইরে থেকেই ডোর ধাক্কা দিলো রুদ্র সামনে থেকে হাত দিয়ে লাগিয়ে দিলো তারপর নিজের সিটে গিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো।

এসব কান্ড দেখে হৈমীর এতো অভিমান আর রাগ হলো যে টু শব্দটিও করলো না সে৷ নয়নের ওপর অভিমানটা বেশীই হলো। তার সামনে কেউ তাঁর বান্ধবী কে নিয়ে যাচ্ছে অথচ সে বিন্দু প্রতিবাদও করলো না।সিরিয়াস কান্না পেলো তাঁর।

সূচনা হৈমীকে দেখে খুশি না হলেও ভদ্রতার খাতিরে জিগ্যেস করলো,
— কেমন আছো হৈমী??
হৈমী মনটা ভাড় করে বললো,
— একদম ভালো নেই আপু। ওনি আমার সাথে কেনো এমন করে। আজো আমাকে মেরেছে এই দেখো গালটা লাল হয়ে গেছে। আর জোর করে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে দেখো।
সূচনা সন্দেহী চোখে রুদ্রর দিকে তাকালো।শান্ত গলায় বললো,
— কোথায় যাচ্ছো ওকে নিয়ে এসেছো কেনো?? আবার ওকে মেরেছো কিন্তু কেনো?? এমন করছো কেনো কি হয়েছে??
— তুই কি আমার কাছে কৈফিয়ত চাইছিস৷ গম্ভীর গলায় বললো রুদ্র।
সূচনা থতমত খেয়ে গেলো৷ হৈমী কথা শুনে বিরবির করে বকতে শুরু করলো।
— কৈফিয়ত না যা হচ্ছে ঠিক হচ্ছে না। তাই বলছি এইটুকুন মেয়েকে বার বার কেনো মারছো কি করেছে কি ও??মনে সাহস জুগিয়ে কথাটা বললো সূচনা।

রুদ্র কোন উত্তর দিলো না সে নিজের মনে গাড়ি চালাচ্ছে। সূচনা পিছন ঘুরে হৈমীর মুখটা দেখে হাত তুলে ভরসা দিলো কিছু হবে না আমি আছি। হৈমীও কিছুটা ভরসা পেয়ে চুপচাপ রইলো।
.
গাড়ি এসে থামলো সুখনীড়ের সামনে। জায়গাটা সূচনার অচেনা। হৈমী গাড়ি থামতেই চিল্লিয়ে ওঠলো,

— আমার বাড়ি আমার বাড়ি নামবো আমি।
রুদ্রর দিকে তাকাতেই দেখলো সেও নামছে। হৈমী আর এক মূহুর্ত দেরী করলো না ডোর খোলার চেষ্টা করলো। ওপাশ থেকে রুদ্র খুলে দিতেই হৈমী নামলো।সূচনাও নেমেছে। রুদ্র বললো,
— শপিং ব্যাগ গুলো নিয়ে আয়।
সূচনা ভ্রু কুঁচকে গাড়ির ভেতর তাকাতেই দেখলো অনেক শপিং ব্যাগ এতোক্ষণ তো খেয়ালই করেনি।
কি হচ্ছে কিচ্ছু ঢুকছে না সূচনার মাথায়৷ তবুও রুদ্রর হুকুম মেনে সবগুলো নিলো। কয়েকটা বার্তি নিতে পারলো না বিধায় সেগুলো রুদ্রই নিলো।

এদিকে হৈমী এদের দুজনকে রেখে দৌড়ে বাড়ির ভিতরে চলে গেছে। একদম নিজের রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে চুপটি মেরে বসে রইলো সে।
.
সূচনার মাথা ঘুরছে। রুদ্র কেনো এসব করছে, এই মেয়ের বিষয়ে কেনো এতো মাথা ঘামাচ্ছে উত্তর মিলছে না সূচনার কাছে।এতোগুলো বছর ধরে যার চোখের ভাষা পড়ার জন্য তীব্র চেষ্টা করেও পড়তে পারেনি৷ আজ খুব সহজেই তাঁর চোখের ভাষা পড়ে ফেলতে পারছে৷ কিন্তু এই ভাষা যেনো সত্যি না হয় তাহলে যে সে বাঁচবে না৷ পাগলের মতো ভালোবাসে মানুষ টা কে সে৷ সহ্য করতে পারবেনা মানুষ টাকে হারানোর যন্ত্রণা।

রুদ্র সূচনাকে শপিং ব্যাগ গুলো দিয়ে হৈমীর রুমে পাঠিয়েছে। আর বলেছে,সব হৈমীকে দিতে তার চলাফেরার পরিবর্তন ঘটাতে বলেছে। একজন মা যেভাবে তাঁর মেয়ে কে বাস্তবতা শেখায়,মেয়েদের জীবনকে বোঝায়, মেয়েদের সভ্যতা,ভদ্রতা শেখায় ঠিক সেভাবেই যেনো সে হৈমীকে শেখায় বোঝায়।

বাচ্চা মেয়েটা কে ভালো-মন্দ বোঝাতে কোন আপত্তি নেই সূচনার। এসব যদি শুধু একটি মেয়ের হেফাজতের জন্য হয়ে থাকে তাহলে সূচনা হাসি মুখে মেনে নেবে। কিন্তু এর পিছনে যদি রুদ্রর কোন দূর্বলতা থাকে তাহলে কি করে মানবে সে। পরোক্ষনে ভাবলো ” না কি ভাবছি আমি রুদ্র তো এমনই। হৈমী ছোট একটা মেয়ে ওর প্রতি রুদ্র দূর্বল হবে তা অসম্ভব।

হৈমীর চালচলন পছন্দ হয়নি। তাছাড়া হৈমীর বাবা,মা নেই প্রত্যেকটা ছেলে-মেয়েকে সঠিকভাবে গড়ে তুলে তাঁর মা,বাবা,পরিবার। কিন্তু নয়না ভাবির কাছে শুনেছি ওর বাবা,মা নেই এখানে যারা থাকে সব বাচ্চা, আর একজন বুড়ো লোক থাকে৷তাই সেভাবে শিক্ষা দেওয়ারও কেউ নেই৷ রুদ্র হয়তো এজন্যই চাইছে ওকে বোঝাতে,শিক্ষা দিতে।দেশের যা অবস্থা এভাবে চললে,যে কোন দূর্ঘটনার সম্মুখীন হতে পারে। রুদ্রর জন্য গর্ব করা উচিত আমার। সত্যি সে সবার থেকে আলাদা” মনকে শান্ত করে দরজায় ঠকঠক আওয়াজ করলো সূচনা। হৈমী বসা থেকে চমকে ওঠে দাঁড়ালো।

কাঁপা গলায় বললো,
— কে??
— আমি সূচনা হৈমী ভয় পেয়ো না দরজা খুলো।
— ঐ লোকটা নেই তো!
— উহম, নেই।
— সত্যি তো??
— পাক্কা সত্যি।
.
দাদুর সাথে কথা বলছে রুদ্র। দাদুর বেশ ভালো লাগছে। “ছেলেটা একটু রগচটা হলেও মনটা বেশ ভালো।এই ছেলের মতো এতো নিঁখুত চিন্তা আজকাল কজন করে?? সত্যি তো হৈমী কে আমি আমার শিক্ষায় মানুষ করছি ঠিকি কিন্তু অনেক খাদ থেকে গেছে। উপরওয়ালা হয়তো এজন্যেই এই ছেলেকে পাঠিয়েছে। হৈমীর সকল অপূর্ণতা পূরণ করতে, বাচ্চা সুলভ মেয়েটাকে আগলে রাখার জন্য এমন একজন শক্ত মানুষের খুব দরকার ছিলো। আমি আর কদিন আছি দুনিয়াতে। তাছাড়া হৈমীও তো বড় হচ্ছে যতোই বলুক সে একা থাকবে কারো সাথে জীবন জরাবে না কিন্তু কল্পনা আর বাস্তব তো এক হয় না। দুনিয়াতে একা টিকে থাকা যায় না।

” একপায়ে যেমন মানুষের চলাফেরা কষ্টকর তেমনি দুনিয়াতে একা একা মানুষের তাঁর জীবন চালিয়ে নেওয়াও কষ্টকর”

হৈমীর প্রতি রুদ্রর এতো কেয়ার দেখে এমন সুন্দর বিহেভিয়ার দেখে এসবই ভাবলো দাদু। ছেলেটা সত্যি অসাধারণ তা না হলে কি নিজের বাড়ির মেয়েকে নিয়ে এসে এভাবে হৈমীকে বোঝানোর উদ্যেগ নেয়??”শুধু টাকা পয়সা থাকলেই বড় মানুষ হওয়া যায় না বড় মন মানসিকতাই আসল” যা রুদ্রর মাঝে ফুটে ওঠেছে।
.
রুদ্র টুকটাক কথা বলছে সেই সাথে দাদুকে একটি অফার ও দিলো৷ সুখনীড় পরিবারে সেও যোগ দিতে চায়। বাড়ির সামনে বেশ জায়গা আছে দরকার পড়লে পাশের জায়গা গুলো কিনবে সে। আরো অসহায় বাচ্চা দের এখানে রাখতে চায়। তাঁর জন্য আরো জায়গা করতে চায় । দাদুর সাথে সেও এই মহান কাজে যোগ দিতে চায়।

দাদু প্রথমে ইতস্তত বোধ করছিলো তাই রুদ্র সোজাসাপ্টা বললো,
— আপনার বয়স হয়েছে মহান আল্লাহ তায়ালা কখন কার প্রাণ নিবে আমরা কেউ জানিনা। আজ যদি আপনার কিছু হয়ে যায় এই বাচ্চা গুলোর ভবিষ্যৎ কি বলতে পারেন?? আমি আপনার জন্য প্রস্তাব টা দেইনি এই বাচ্চা গুলোর ভবিষ্যৎ ভেবে দিয়েছি। হৈমীর ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনার ভাবতে হবে না। আপনি বাকিগুলোর কথা ভেবে আমার প্রস্তাবে রাজি হন নয়তো আমি জোর খাটিয়েই আমার কাজ সফল করবো।

ছেলেটা কথায় কথায় হুমকি দেয় ভেবেই দাদু হু হা করে হেসে ওঠলো। বৃদ্ধ বয়সেও তাঁর হাসির আওয়াজ পুরো রুম কাঁপিয়ে তুলে। তাঁর হাসিই বলে দিলো সে রাজি। রুদ্রও বাঁকা হাসলো দাদুর সম্মতি পেয়ে।
.
হৈমী কল্পনাও করতে পারছেনা একটা ছেলে এমনও হতে পারে। পুরো শপিংমলই যেনো তুলে নিয়ে এসেছে। পুরো বিছানা ভর্তি জামাকাপড়। সূচনা তাকে খুব সুন্দর করে বুঝিয়েছে। “নিজের ভুলগুলো নিজের চোখে কখনোই ধরা পড়ে না। তাই নিজের ভুলগুলো ধরিয়ে দেওয়ার মানুষ খুব প্রয়োজন আমাদের জীবনে”

জীবনকে হৈমী যেভাবে ভাবে,যেভাবে ভেবেছে আসলে জীবনটা তা নয়। মা নেই তো কে বোঝাবে তাঁকে এসব। নয়নের মা তাঁকে খুব ভালোবাসে তবুও এসব বিষয় তেমন কিছু বলেনি কখনো তাঁরা শুধু তাঁকে ভালোবেসেই গেছে। আর রুদ্র তাঁকে ভালোবাসে না অথচ তাঁর কতোটা ভালো চায়।

রুদ্রর ওপর যতো রাগ ছিলো সব নিমিষেই উধাও হয়ে গেছে। একরাশ লজ্জা ভর করেছে তাঁর চোখেমুখে। নিজের ওপর নিজেরই রাগ হচ্ছে এখন৷ লজ্জায় বিছানার নিচে ঢুকে বসে থাকতে মন চাচ্ছে। সেদিন চিঠিতেও বলেছিলো রুদ্র কিন্তু সেটা সে মালুম করেনি। আজ যখন সূচনা তাঁকে বোঝালো। আর রুদ্রর রাগের কথা জানালো, থাপ্পড়ের কারন জানালো তখন তাঁর সব রাগ চলে গেছে বরং রুদ্রর প্রতি কিছুটা শ্রদ্ধা বোধ তৈরী হয়েছে। আজকাল এসবের জন্য কোন ছেলে রাগ দেখায়। কিছু কিছু ছেলে আছে রাস্তা ঘাটে মেয়েদের এমনভাবে চলা ফেরা দেখলে চোখের চাহিদা মেটায়। তাঁদের ভিতর লোভ,লালসা জাগ্রত হয়ে ওঠে। কেউ কেউ সেই লোভ থেকেই সুযোগ খুঁজে। আর রুদ্র তাঁকে মেরেছে শাসনের অধিকার নেই তবুও শাসন করেছে। লোকটা আসলেই অন্যরকম। ভাবলো হৈমী।
.
রিকশা থেকে নামল হৈমী আজ প্রাইভেট ছিলো না। তাই সরাসরি কলেজে এসেছে গেটের সাইটে দাঁড়ালো নয়নের জন্য। খানিকবাদেই সাদমান হাসি হাসি মুখ নিয়ে সামনে এলো হৈমীর। হৈমী অবাক হয়ে চোখ বড় বড় করে বললো,

— ভালো ভাইয়া আপনি এখানে??
— এই তো পিচ্চি বোনটাকে দেখতে আসলাম।
— কেনো, আমিতো অসুস্থ নই তাহলে কেনো দেখতে এলেন?? কি করে জানলেন আমি এই কলেজে পড়ি??
— এ কেমন অবিচার বোন শুধু অসুস্থ হলেই দেখতে আসতে হবে বুঝি?? কাল দেখা হয়েছিলো তখনি বুঝেছি কোন কলেজ। বলেই দাঁত কেলিয়ে হাসলো সাদমান।
— তা না তবে আপনি এসেছেন আমি খুব খুশি হয়েছি। আচ্ছা আপনার বাসা কোথায় তাই তো জানলাম না। ভয় নেই আমি কিন্তু মোটেও যেতে চাইবো না। অনেক ছদ্মবেশীও তো থাকে তাই যাচাই করতে চাচ্ছি আর কি।
সাদমান হকচকিয়ে গেলো কি সাংঘাতিক মেয়ে রে বাবা রুদ্র কে প্রথম দেখায় বন মানুষ আর আমাকে দ্বিতীয় দেখায় ছদ্মবেশী??

.
গাড়িতে বসে সিগারেটে সমান তালে টান দিয়ে যাচ্ছে রুদ্র। আবির দৌড়ে এসে বললো,

— রুদ্র হৈমী মমানে ভাবি এসেছে।
সিগারেটে আরো কয়েক টান দিয়ে ফেলে দিলো৷ ফু দিয়ে ধোঁয়া উড়াতে উড়াতে গাড়ি থেকে নামলো।

সাদমান তো হৈমীর সাথে বেশ আলাপ জুরে দিয়েছে৷ হৈমীও বেশ গল্প করছে তাঁর সাথে। রুদ্র তাঁর চুলগুলো আঙুলের ফাঁকে নিয়ে পিছন দিক নিতে নিতে এগুচ্ছে। আজকে হৈমী সুন্দর করে স্কার্ফ বেঁধেছে কাল সূচনাই শিখিয়ে দিয়েছে তাকে।এভাবে বেশ লাগছে সাদা রঙ টা হৈমীর ফর্সা গোলাপি রঙটাতে বেশ মানিয়েছে। বাঁকা হাসলো রুদ্র।

কথা বলতে বলতেই রুদ্রর দিকে চোখ পড়লো হৈমীর৷ রুদ্র তাঁর দিকেই এগিয়ে আসছে। তাঁকে আসতে দেখেই চুপসে গেলো হৈমী৷ লজ্জা পেলো, ভয়ও পেলো ভীষণ আবার যদি মারে না জানি আবার কি ভুল হয়ে গেছে তাঁর । এক ঢোক গিলে আমতা আমতা করে সাদমানকে বললো,
— ভালো ভাইয়া আপনি থাকুন আমি ক্লাসে যাই আমার না দেরী হয়ে যাচ্ছে। টাটা আপানার সাথে পরে কথা বলবো। বলেই এক দৌড়ে ভিতরে চলে গেলো।
সাদমান পিছন ঘুরতেই রুদ্র দেখলো। হৈমীর এভাবে চলে যাওয়ার কারনটাও বেশ বুঝলো।

— তোকে দেখেই ভয়ে পালিয়েছে বাচ্চা মেয়েটার সাথে এতো রুড বিহেইভ না করে ওর মতো করে ওকে মানিয়ে নে। মেয়েটা বেশ প্রানখোলা এমন টাইপ মেয়েরা যদি কাউকে একবার ভালোবেসে ফেলে তাহলে নিজের সবটা উজার করে দিয়ে দেবে।
আমি সিওর তুই যতোটা ওর জন্য অস্থির হয়ে পড়েছিস ততোটা যদি ওকে বোঝাতে পারিস ও তোকে ভালো না বেসে থাকতে পারবে না। বয়স কম একবার যদি মনে ভালোবাসা তৈরী করাতে পারিস দেখবি তোর থেকে ওই তোকে দ্বিগুণ ভালোবাসছে। এমন মেয়েরা কিন্তু পাগলের মতো ভালোবাসতে জানে। সিরিয়াস হয়েই কথাগুলো বললো সাদমান। কারন রুদ্র হৈমীর প্রতি সিরিয়াস হয়ে গেছে। রুদ্রর অস্থিরতা আর কেউ না বুঝলেও সে বেশ বুঝতে পারছে।

সাদমানের দিকে চেয়ে রুদ্র বললো,

— মনে হয় ভালোবাসা নিয়ে তুই পি এইচ ডি করে আসছিস!
আবির হোহো করে হেসে ওঠলো। সাদমান আবিরের দিকে দাঁত কটমট করে চেয়ে আবার রুদ্রর দিকে তাকালো। সিরিয়াস ভাবেই বললো,

— দেখ কাল থেকে আজ অবদি যা বুঝলাম মেয়েটা বেশ সহজসরল। ওকে মানাতে খুব একটা অসুবিধা হবে না। তোকে দেখে ভয় পায় এমন আচরন না করে যাতে ভয় না পায় তেমন আচরন কর। অল্প বয়স মনের কথা বলে দে না হলে আবার কার ওপর মন পড়ে যাবে। তখন তোর থাপ্পড় থেরাপি চলবে আবার, ভালোবাসা থেরাপি দিয়ে বশ কর ভাই এতেই কাজে দেবে।

ভ্রু কুঁচকে তাকালো রুদ্র। সাদমান মাথা নাড়ালো। খানিকবাদেই নয়ন নামলো রিকশা থেকে। আবির আর সাদমান মুখে দুষ্টু হাসি টেনে জোর গলায় বললো,

— আসসালামু আলাইকুম পিচ্চি বেয়ান।
নয়ন ভাড়া মিটিয়ে ঘুরতেই রুদ্র সহ ওদের দেখে ভয়ে বেশ ঘাবড়ে গেলো। সাদমান বললো,
— একি বেয়ানসাব ভয় পাবেন না আমরা তো ভাবি আর বেয়ানকে দেখতে আসছিলাম।
নয়ন ভ্রু কুঁচকে জিগ্যেস করলো,
— মানে!
আবির বললো,
— সে কি তুমি জানো না ভাই আমাদের তোমার বান্ধবীর প্রেমে দিওয়ানা।
নয়ন চমকে গেলো যা সন্দেহ করেছিলো তাই ঠিক তাঁর মানে “ওহ মাই আল্লাহ হৈমী বইন তুই কই”
রুদ্র গেটের পাশে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নজর তাঁর ফোনের দিকে। নয়ন এগিয়ে গিয়ে সালাম দিলো। রুদ্র সালাম ফিরালো কেমন আছে, টুকটাক কথা বলে নয়ন ভিতরে চলে গেলো।
.
কলেজ ছুটির পর নয়ন আর হৈমী বেরিয়ে এলো।
হৈমী বেশ চিন্তায় আছে নয়ন যা বললো তাতে তাঁর লাইফ ডেঞ্জারাস পজিশনে আছে। যতোই ফান করুক প্রেম, ভালোবাসা নিয়ে কিন্তু সিরিয়াস ভাবে এসব নিয়ে ভাবতেও পারেনা সে। আর বিয়ে সাদি তো অসম্ভব। তাঁর থেকেও বেশী অসম্ভব রুদ্র কে লাইফ পার্টনার বানানো।

— গাড়িতে ওঠে বসো।

গম্ভীর গলার আওয়াজে চমকে গেলো হৈমী চোখ তুলে তাকাতেই রুদ্র কে দেখে তাঁর আত্মা টা কেমন কেঁপে ওঠলো। পাশে চেয়ে দেখে নয়ন নেই৷ সে কি নয়ন কোথায় গেলো??

হৈমীর মনের কথা বুঝতে পেরে রুদ্র বললো,

— কোন রাজ্যের চিন্তায় মগ্ন ছিলে নয়ন কে কিছুক্ষন আগেই সাদমান রিকশায় ওঠিয়ে দিয়েছে।

হৈমী কাঁদো কাঁদো হয়ে রুদ্রর ডানপাশে তাকালো। হাসি হাসি মুখে হাত নাড়ছে সাদমান “হাই”।
হৈমী চিন্তায় এতোই মগ্ন ছিলো যে পাশ থেকে নয়ন উধাও হলো টের ও পেলো না। বজ্জাত মেয়েটা কিছু বললোও না৷ একবার সামনে পাই তোর একদিন কি আমার একদিন ভেবেই হৈমী গলার স্বর উঁচিয়ে বললো,

— দেখুন আমি কোন দোষ করিনি এখন। আমি একটু চিন্তায় ছিলাম তাও আপনাকে নিয়েই। তাই বলে আবার আমাকে শাস্তি দেবেন আপনি!

রুদ্র ভ্রু কুঁচকালো। হৈমী জিহ্বে কামড় দিলো। মুখ ফসকে সত্যি বলে দেওয়ায় ছিঃ কি লজ্জা! সাদমান দুষ্টু হেসে বললো,

— এতো বড় ধামড়া ছেলের চিন্তা তোমার করতে হবে না গো পিচ্চি। তোমার চিন্তায় তাঁরই প্রান যায় আর আসে হায়!
বলতে বলতেই সাদমান পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। বির বির করে বলে গেলো এনজয়,,,
.
রুদ্র আবারো বললো,
— গাড়িতে বসো।
— না বসবো না। আপনার সাথে যাবো না৷ আপনার মতলব ভালো ঠেকছে না আমার৷ নিশ্চয়ই পেটে পেটে বেশ শয়তানি আছে। একটু ভালো ভেবেছিলাম ঘাট হয়েছে আমার অন্যায় হয়ে গেছে। আমারই ভুল বলতে বলতেই রুদ্রকে পাশ কাটিয়ে যেতে নিলো।
রুদ্র দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
— সোজা কথার মানুষ তুমি না। বলেই হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেলো গাড়ির দিকে। হৈমী চেঁচিয়ে ওঠলো,” ছাড়ুন আমায় আমি কিন্তু চিল্লাবো”

— চিল্লাও নিষেধ কোথায়। বললো রুদ্র।
.
গাড়ি চলে যেতেই কয়েকটা মেয়ে গেটের বাইরে এলো। এতোক্ষন ভয়ে বের হতে পারেনি৷ রুদ্র কে হাড়ে হাড়ে চেনে মেয়েগুলো৷ ওদের একজনের বড় বোন রুদ্রকে প্রপোজ করেছিলো। রুদ্র মেয়েটাকে হিরহির করে টানতে টানতে সোজা বাড়িতে নিয়ে মেয়ের বাবার সামনে দাঁড় করিয়ে কি লজ্জাটাই না দিয়েছিলো। আর সেই ছেলেই আমাদের কলেজের মেয়ে কে এভাবে নিয়ে গেলো। নিশ্চিত মেয়েটাও কোন দোষ করেছে তাই পানিশমেন্ট দেবে। মেয়েগুলো একে অপরের সাথে বলাবলি করতে করতে বেরিয়ে গেলো।
.
গাড়ি নিয়ে চলে এলো উত্তরা ১৫ নম্বর সেক্টরে দিয়াবাড়ির রাস্তায়। কাশফুল বাগানের ভিতরের রাস্তায় গাড়ি থামালো ডোর খুলে এক ধমক দিয়ে বললো,
— নামো!

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here