ভালোবাসায় বন্দিনী পর্ব ৬

0
1865

#ভালোবাসায়_বন্দিনী
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৬

এই পৃথিবীতে অনেক অসহায় মানুষ দেখতে পারি আমরা। রাস্তায় অসংখ্য ভিখারি দেখতে পাই। ষাটোর্ধ বয়সি বৃদ্ধ দের রাস্তায় হাত পাততে দেখলে, তাঁদের অসহায় মুখের দিকে তাকালে তাঁদের প্রতি মায়া হয় সহানুভূতি দেখাতে পারি। চার,পাঁচ বছরের বাচ্চাদের ফুল বিক্রি করতে দেখলেও আমাদের খারাপ লাগে একটার জায়গায় দুটো ফুল কিনে সহানুভূতি দেখাই।অথচ আরো অনেক অসহায় মানুষ থাকে,দুঃখী মানুষ থাকে যাদের অসহায়ত্বের কথা, দুঃখের কথা আমরা জানতেও পারি না।

শিশু এবং বৃদ্ধ এ দুই শ্রেণীর মানুষরা সব থেকে বেশী অসহায় হয়। কেনো জানো কারন এই দুইশ্রেনীর মানুষ যখন তাঁদের পরিবারে জায়গা পায় না তখন তাঁদের আশ্রমে রেখে আসা হয়। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়৷ শিশু বয়সটাই জীবনের শুরু আর এই শুরুটা যদি হয় বাবা,মা হীন পরিবার বিহীন তাহলে এর থেকে বড় দুঃখ জনক বিষয় আর কিছু হতে পারে না৷ তেমনি বৃদ্ধ বয়সটা একজন মানুষের জীবনের শেষ বয়স। শেষ বয়সে এসে সবাই চাইবে জীবনের শেষ সময়টা পরিবার, আত্মীয় স্বজন,ছেলে-মেয়েদের সান্নিধ্যে থাকার অথচ ভাগ্যের পরিহাসে শেষ বয়সে তাঁদের স্থান হয় বৃদ্ধাশ্রমে। এমন করুণ পরিণতি সত্যি কি কোন বাবা,মা কোন মানুষের হওয়া উচিত???কিন্তু হয়েছিলো আমার।

হৈমীর স্থান হয়েছিলো শিশু আশ্রমে আর আমার স্থান হয়েছিলো বৃদ্ধা আশ্রমে। সরকারি চাকুরিজীবি ছিলাম আমি।পেনশনে আসার পর ছেলেরা আমাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেয়। পাঁচ বছর আগের ঘটনা এটা। আমি বুঝতে পারি আমি আমার সন্তান দের মানুষ না অমানুষ করে গড়ে তুলেছি। তাই এই অমানুষ দের সাথে মানুষের আচরণ করার থেকে ওদের ভাষায় ওদের শিক্ষা দেওয়া উচিত। বৃদ্ধাশ্রমের মালিক ছিলেন একজন জজ। ওনার সাথে পরামর্শ করে সমস্ত কাগজপএ ঠিক করে বাড়িটা দখল করে নেই। বাড়ি থেকে বের করে দেই ছেলে, ছেলের বউদের।

নিজের পেনশনের টাকায় বেশ চলছিলো। কিন্তু নিসঃঙ্গ জীবন কাটাতে কারোরি ভালো লাগে না। এ বয়সটা তো নাতী,নাতনীর সাথে খেলাধূলা করার বয়স বলো। ছেলে আছে নাতী,নাতনী আছে তবুও আমি নিঃস্ব। সিদ্ধান্ত নেই এ বাড়িটা আমি এমন ভাবে গড়ে তুলে যাবো যে সারাজীবন সবাই আমাকে স্মরণ করবে। আমি একটা আলাদা পরিবার তৈরী করবো। যে পরিবারটায় কোন বিভেদ থাকবে না। দুঃখ থাকবে না থাকবে শুধু সুখ, হাসি,খুশি একটা পরিবার হবে আমার। যে পরিবারে থেকে আমি আমার সব দুঃখ কষ্ট কে ভুলতে পারবো৷
কথায় আছে বৃদ্ধ বয়সে প্রত্যেকটা মানুষের মাঝেই শিশুসুলভ আচরন এসে যায় আমারো এলো।
আমার এই সুখনীড় পরিবার কে সত্যিকারের সুখ নীড় করার জন্য মরিহা হয়ে ওঠলাম৷ আমি সফলও হলাম৷ আজ আমার এই নীড়ে শুধু পাখিদের কিচিরমিচির। আর এর সূচনা হয় হৈমীকে দিয়েই।

হৈমীর বয়স তখন বারো বছর। ওর দাদা আমার চাচাতো ভাই ছিলো।আমি লোক মুখে শুনেছিলাম হৈমীকে আশ্রমে দিয়ে আসা হয়েছে। বড্ড আফসোস হলো। ছোট বেলায় বাবা কে হারালো শেষ ভরসা ছিলো মা। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে সেই মা কেও হারালো। মহান আল্লাহ তায়ালা যা করেন তাতেই নাকি মঙ্গল। কিন্তু মা, বাবা দুজনকে নিয়ে মেয়েটা কে এতিম করে দেওয়ায় কি মঙ্গল ছিলো তখনও আমি জানতাম না৷ যেহেতু আমারই চাচাতো ভাইয়ের বংশধর সেহেতু আলাদা এক টান ছিলোই।
একটু খুতিয়ে দেখতে গেলে সমাজে অবহেলিত ছিলাম বৃদ্ধ হিসেবে আমি আর এতিম হিসেবে হৈমী।
হৈমী ছিলো পিতা-মাতাহীন বলে এতিম আর আমি ছিলাম কুসন্তান দের বাবা হওয়ায় এতিম।

এসব বিবেচনা করে মায়ার টানেই আমি হৈমীকে আমার কাছে নিয়ে আসি। আমার সুখ নীড়ে প্রথম কোন পাখির আগমন ঘটে। তখনও হৈমী এতো চঞ্চল, প্রাণোচ্ছল ছিলো না৷ মেয়েটা ভীষণ চুপচাপ থাকতো৷ ওটুকু বয়সে এতো ধাক্কা গুলো ও নিতে পারেনি। ভালোবাসা, পরিবার বুঝে ওঠার আগেই সব কেড়ে নিয়েছে উপরওয়ালা ওর থেকে। মেয়েটা গুম মেরে থাকতো কেমন। ধীরে ধীরে আমার সাথে খানিকটা স্বাভাবিক হতে থাকে।

আমার বাড়িতে তখন রহিম নামের এক ছেলে কাজ করতো। হৈমী কে ক্লাস এইটে ভর্তি করিয়েছি তখন।
ভোর ছয়টায় ওকে পড়তে বসিয়েছি অংক করাচ্ছিলাম বীজগণিতের। তখনি রহিম চেঁচামেচি করতে থাকলো। রিয়াজ কাকা তারাতাড়ি বাহির আসুন। আমি আর হৈমী বিছানা ছেড়ে বেরিয়ে এলাম৷ আর দেখলাম রহিমের কোলে একদম কুচকুচে কালো এক শিশু চোখ দুটো ফুটেনি। রহিম বললো,

— কাকা রোয়া গারছি ক্ষেতে পল্টনে মেশিন জুরে দিয়ে ক্ষেত গুলা দেখতেছিলাম৷ ড্রেনের সাইটে এই বাচ্চা টা পড়ে ছিলো। প্রথমে ভাবছি কোন জন্তুর বাচ্চা হবে। কিন্তু পরে দেখি মানুষের বাচ্চা আধমরা হইয়ে গেছে কি করবো???

হৈমী ভয়ে আমার হাত চেপে ধরলো। আমার কপালে তখন চিন্তায় তিনটা ভাজ পড়লো৷ এগিয়ে গিয়ে পর্যবেক্ষণ করে দেখলাম বেঁচে আছে কিন্তু হয়তো বেশীক্ষণ বাঁচবে না৷ তবুও বাঁচানোর চেষ্টা করলাম।পরিচিত ডাক্তার কে ফোন করলাম। বড় কাঁথা চারভাজ করে বাচ্চা টা কে মুড়িয়ে নিলাম। ডাক্তার এর কথা মতো গরম পানি দিয়ে পরিষ্কার করে গোসল করালাম। হৈমী টুকটাক সাহায্য করলো।
গোসল করিয়ে কম্বল গায়ে দিয়ে শরীর গরম করতে চেষ্টা করলাম। ডাক্তারের লেখা দুধ কিনে নিয়ে এলো রহিম৷ খাওয়ানোর পর বাচ্চা টা দু’ঘন্টা ঘুমালো। আবার দু’ঘন্টা পর ফিটারে করে দুধ খাওয়ানো হলো।যা বুঝলাম বাচ্চা টা সবল হচ্ছে। শীতে কাঁদায় গায়ের রং কুচকুচ করলেও এখন উজ্জ্বলতা বেড়ে গেছে। জন্মানোর পর পরই ফেলে দিয়েছিলো কেউ হয়তো৷

হয়তো কারো পাপের ফল বা কোন অভিশপ্ত পরিবারের সন্তান। কন্যাসন্তান হওয়াতে হয়তো পরিবার গ্রহণ করেনি বা কোন কলঙ্কিত বাবা,মায়ের সন্তান। যাই হোক না কেনো এই বাচ্চা কে যখন বাঁচিয়েছি তখন মানুষের মতো মানুষও করে তুলবো।
হয়তো সমাজ আমাকে নানারকম কথা বলবে তবুও আমি একে মানুষ করবো৷ সত্যি তাই দুদিনের মাথায় আশে পাশের মানুষ আমাকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো পরিচয়হীন মেয়েকে কেনো আমি তুলে আনলাম৷ কারো পাপের ফলও তো হতে পারে। আমি তাঁদের একটাই জবাব দিলাম শিশুটির কোন দোষ নেই। এই শিশুটি পাপি নয়।
যখন কোন সন্তান তাঁর বাবা,মায়ের দায়িত্ব অস্বীকার করে বাবা,মাকে বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে আসে। তখন তো তোমরা প্রতিবাদ করতে আসো না। পিতা-মাতা হীন এতিম এক সন্তান কে যখন তাঁর পরিবার, বংশের লোক তাঁর সকল অধিকার থেকে বঞ্চিত করে শিশু আশ্রমে দিয়ে আসে তখন তো তোমরা প্রতিবাদ করতে আসো না। ন্যায়, অন্যায় শেখাতে আসো না চুপচাপ ঘরে বসে থাকো। দূর থেকে শুনে আহারে, ওহারে করো। তাহলে এখন কেনো তোমাদের এতো মাথা ব্যাথা এই বাচ্চা শিশুটিকে নিয়ে। তোমাদের তো খুশি হওয়া উচিত ছিলো যে বাচ্চা টার দায়িত্ব কেউ একজন নিয়েছে। কেউ ওকে অস্বীকার করে প্রত্যাখ্যান করেছে। কিন্তু আমি ওকে স্বীকার করে নিয়েছি। ওর মাথার ওপর ছাদ হয়ে দাঁড়িয়েছি। তোমরা নিজেরা তো ওর দায়িত্ব নিবে না তাহলে আমি নিলে তোমাদের সমস্যা কোথায়। যখন অন্যায় ঘটবে তখন যেমন ঘাবটি মেরে ঘরে বসে থাকো যখন ন্যায় ঘটবে তখন কেনো চুপচাপ বসে থাকতে পারো না???
তাহলে কি আমি বুঝে নিবো এই সমাজ উচিত,ন্যায় কে গ্রহণ করতে পারে না৷ অন্যায়,অবিচারকে সহজে গ্রহণ করে নেয়।

তখন ওরা আর কিছু বলতে পারেনি। আমিও সমাজ কে তোয়াক্কা করিনি। এই সমাজ পরিবার, আত্মীয় স্বজন তো সেদিনই ত্যাগ করেছি যেদিন আমার ছেলেরা আমাকে বৃদ্ধাশ্রমে জায়গা দিলো। আর সমাজের মানুষ রা প্রতিবাদ না করে সঠিক না বুঝিয়ে বেঠিক নিয়েই তাঁকে উৎসাহ দিলো। সেদিন থেকে হৈমীর মাঝেও পরিবর্তন এলো। বাচ্চা টা কে কোলে তুলে নিয়ে বিশ্বজয়ী এক হাসি দিলো সে। চিৎকার করে বললো- মিষ্টি পরী তুই আমার মিষ্টি পরী৷ নাম দিলো ওর পরী৷ সব দুঃখ, কষ্ট যন্ত্রনা কে দূরে ঠেলে পৃথিবীর সমস্ত সুখ,সমস্ত খুশিকে বরণ করে নিলো সে। বাড়িটা আমার আনন্দে ভরে ওঠলো। হৈ চৈ রমরমা পরিবেশে বেড়ে ওঠতে থাকলো হৈমী, পরী আরো অনেকেই।
পরী আসার পরের মাস থেকেই আমি আরো ছোট অসহায় বাচ্চা দের খোঁজ করতে থাকি। রাস্তা থেকে অনেক ছেলে,মেয়েকে নিয়ে আসি। ছেলেদের পাঠাই আশ্রমে আর মেয়েদের রাখি এখানে। শতশত রাখা সম্ভব না আমার সাধ্য নেই। কিন্তু যেটুুকু সামর্থ্য আছে সেটুকুর মধ্যে এই বিশ,পঁচিশ জন বেশ চলে যায়। তখন আমি অনুভব করি আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যই করে। হয়তো এই মাসুম বাচ্চা গুলোর জন্যই আমাকে আর হৈমীকে এতিম করে দিয়েছে। আর এতোগুলো এতিমের জায়গা করার জন্যই কোন না কোন উসুলায় হৈমীকে আমার কাছে পাঠিয়েছে। এই বিশ্বে ভালো,মন্দ যা কিছুই ঘটুক না কেনো সবই তো উপরওয়ালার ইচ্ছা। যা কিছু খারাপ ঘটে তাঁর পরিবর্তে ভালো কিছুই বেশী ঘটে।
.
রুদ্র গম্ভীর মুখে বসে আছে একদম চুপ সে। তাঁর ভিতর ঝড় বয়ে যাচ্ছে। এতো কষ্ট চাপিয়ে এমন মর্মান্তিক অতীত বুকে চেপে একটা মেয়ে এতোটা প্রাণোচ্ছল কি করে থাকতে পারে??তাহলে সেদিন কি এই জন্যেই ওর চোখে অশ্রু ঝরেছিলো?? মা, বাবা,পরিবার নিয়ে প্রশ্ন তুলে ওকে আমি আঘাত করেছিলাম?? ওর এই কষ্ট,যন্ত্রণা কেনো বুঝতে পারিনি?? সত্যি কি হাসির আড়ালে কষ্ট লুকিয়ে থাকতে পারে??

দাদু রুদ্রর মুখোভঙ্গি দেখে বললো,

— কি ভাবছো যার অতীত এতো যন্ত্রণাময়, কষ্টকর তাঁর বর্তমান এতো সুখকর কেনো??এতো সব চেপে হৈমী এতো প্রাণোচ্ছল কেনো??

রুদ্র দাদুর দিকে তাকালো। দাদু মৃদু হেসে বললো,

— “আমাদরে আশেপাশে এমন বহু পরিচিত মুখ রয়েছে। যাদের দেখে, যাদের সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা সময় কাটিয়ে মনে হবে এর থেকে সুখী মানুষ দুনিয়ায় আর দুটি নেই। অথচ প্রকৃতপক্ষে সেই মানুষ টার জীবন গোড়া থেকে জানতে গেলে বুঝতে পারবে এর থেকে দুঃখী মানুষ দুনিয়ায় আর দুটো হয় না। অথচ সে ভাব টা এমন করে যেনো সেই পৃথিবীর সব চেয়ে সুখী মানুষ”।
“যখন দেখবে কোন মানুষ কারণ ছাড়াই খুব খুশি থাকে।অকারনেই বেশী কথা বলছে তখন বুঝবে সে কিছু একটা লুকাচ্ছে। আর তাঁর এই লুকোচুরি তে রয়েছে এক আকাশ সমান দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা” নিজের দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা কে নিজের ভিতর চেপে সর্বক্ষণ কিছু মানুষ অন্যদের হাসিয়ে রাখে অন্যদের সেই হাসি,খুশি জীবনটা দেখে নিজেও হাসে,নিজেও সুখ পায়, নিজেরও হাসি,খুশি জীবন বজায় রাখার চেষ্টা করে।

আবার “আমাদের আশেপাশে এমন বহু পরিচিত মুখ রয়েছে। যাদের দেখে, যাদের সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা অনেকটা সময় কাটালে বোঝা যায় মানুষ টা অনেক বিষন্ন। সেই বিষন্নতা দেখে আমরা ভাবি ইশ না জানি কতো দুঃখ রয়েছে, ইশ না জানি কতো কষ্ট রয়েছে।
তাঁর জীবন পর্যালোচনা করে দেখতে গেলে ফলাফল মিলবে তাঁর জীবনে আসলে তেমন আহামরি কোন দুঃখই নেই। সে জীবনে অনেক পেয়েছে তাঁর জীবনে সব রয়েছে অথচ তাঁর আরো চাই এই চাই চাই এর থেকে যদি স্বল্প পরিমাণও কম পায় তাহলেই তাঁকে বিষন্নতরা চেপে ধরে। সবদিক দিয়ে নিজে সুখী তবুও অল্পপরিমাণ কিছু চাহিদার কমতি ঘটলেই নিজের জীবন সহ আশেপাশের অনেক মানুষ এর জীবনও বিষন্ন করে তোলে।মুখে ছেঁয়ে থাকে বিষাদের ছাঁয়া”।
.
প্রথম উদাহরণ টা হৈমীর হলেও দ্বিতীয় টায় নিজের সাথে বেশ মিল পেলো রুদ্র। সত্যি তো তাঁর সব আছে বাবা আছে মা আছে ভাই আছে একটা গোটা পরিবার আছে তাঁর। অথচ সে আরো চাই আরো চাই করে৷ অল্প কিছু শূন্যতা, অল্প কিছু অভিমান নিজের মধ্যে চেপে রেখে পরিবারের ওপর অভিমান থেকে সকলের ওপর বিরক্ত, রাগ প্রকাশ করে অথচ প্রকৃতপক্ষে সে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। আর হৈমী এতো দুঃখ, কষ্ট বেদনা চেপেই সব সময় হাসি খুশি থাকে। কেউ বুঝবেই না মেয়েটার এমন একটা অতীত আছে। ভাবলো রুদ্র।

দাদুর কথায় রুদ্রর ভাবনায় ছেদ পড়লো।দাদু বললেন,

— হৈমী সব সময় হাসিখুশি থাকতে পছন্দ করে সবাইকে হাসাতে ভালোবাসে। হৈমীকে দেখে আমার বহুবার একটা কথাই মনে হয় তা হলো “একটি মেয়ে সীমাহীন দুঃখ, কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা রাখে” “সীমাহীন কষ্ট বুকে চেপে প্রানখুলে হাসতে পারে শুধু মাএ একটি মেয়ে একজন নারী” হৈমীর মাঝে যেমন আমি চার,পাঁচ বছরের বাচ্চা কে দেখতে পাই। তেমন ওর মাঝে আমি আমার মা কে দেখতে পাই ওর মাঝে আমি আমার মেয়েকে দেখতে পাই ওর মাঝে আমি আমার নাতনীকে দেখতে পাই।

নয়নের পরিবারের সাথে ও যখন অল্প সময় কাটায় তখন সেই অল্প সময়ই এমন ভাবে কাটায় যেনো অল্প সুখটাই ওর সারাজীবন মনে থাকুক। সবার সাথে খুব প্রানখুলে মিশে মেয়েটা৷ পরিবার নিয়ে ওর যেমন নেগেটিভ ধারনা রয়েছে, তেমন পজেটিভ ধারণাও রয়েছে। যেমন নেগেটিভ অনুভূতি রয়েছে তেমন পজেটিভ অনুভূতি, আবেগ রয়েছে।

রুদ্র চা টা শেষ করলো। গম্ভীর স্বরেই বললো,

— থ্যাংকস! আমার যতোটুক জানার জেনেছি। এবার ওঠি।
— আরো তো কথা থেকেই গেছে দাদুভাই।
— বলুন।
— হৈমীর মনে পরিবার নিয়ে এতোটাই নেগেটিভ ভাবনা এসে গেছে যে ও চায় না কখনো পার্মানেন্টলি কারো পরিবারের সাথে নিজেকে জরাতে। ওর ধারনা পরিবার মানেই দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা। পরিবার মানেই অল্প সুখের বিনিময়ে অনেকটা সুখ কেড়ে নেওয়া৷ পরিবার মানেই একটু আলোর কিনারা দেখিয়ে সারাজীবন অন্ধকারে ডুবিয়ে দেওয়া৷ মেয়েটা সব সময় বলে সে কখনো বিয়ে করবে না সে এভাবেই হেসে,খেলে বাচ্চা দের নিয়ে জীবন পার করে দেবে৷

দাদুর কথা শুনে রুদ্র স্ট্রেইট দাঁড়ালো। কাঠ কাঠ গলায় উত্তর দিলো,
— বয়স কতো ওর৷ কি করবে না করবে জীবন কোনদিক যাবে না যাবে তা ভাবার বা সিদ্ধান্ত নেওয়ার বয়স এখনো ওর হয়নি। মাথার স্ক্রু ঢিলা থাকলে এসব অহেতুক কথাবার্তা সবাই বলে।আমার সিদ্ধান্ত আমি আপনাকে জানিয়ে দিয়েছি।আমি ওর মতো ননসেন্সের সিদ্ধান্ত জানার প্রয়োজন মনে করছিনা।আশা করি আমার কাজে কোন বাঁধা আসবে না। উদ্দেশ্য আমার হালাল তাই আমার কাজে বাঁধা আসলে ভুল আমিও করবো কিন্তু উদ্দেশ্য সঠিক রেখে।
.
রুদ্র বেরিয়ে গেলো। দাদু চিন্তিত মুখেই বসে রইলো সোফায়। হৈমী এলো তিনটার দিকে কলেজ থেকে বেরিয়ে বন্ধু দের সাথে ঝালমুড়ি,ফুসকা খেয়ে বাচ্চা দের জন্য চকোলেট নিয়ে বাড়ি ফিরলো সে। তিনদিন হয়ে গেছে আজ সাহস করে দাদুকে সে বলবেই তাঁর সাইকেল ফেরত আনার কথা। সাইকেলটা রুদ্রর কাছেই আছে৷ “কেমন বাটপার সাইকেল নিয়ে ফেরত দেওয়ার নাম নেই” ভাবলো হৈমী।
.
কলিং বেলের আওয়াজ কানে বাজতেই দৌড়ে গিয়ে দরজা খুললো হৈমী৷ মাহেরের আসার কথা এসময়ই কারণ আজ পরীর জন্মদিন৷এই দিনেই পরীকে পেয়েছিলো হৈমী আর রিয়াজ উদ্দিন। মাহের বলেছে অফিস শেষ করেই কেক নিয়ে আসবে। কিন্তু দরজা খোলার পর দেখলো মাহের আসেনি। হ্যাংলা,পাতলা একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে মাস্ক পড়া। হৈমী ভ্রু কুঁচকে বললো,

— আপনি কে?? কি চাই এখানে?? আমি কিন্তু পরীর জন্মদিনে এক্সট্রা কাউকে দাওয়াত করিনি। আর আমি আপনাকেও চিনি না৷ ওর জন্মদিনে নয়ন আর মাহের ভাইয়া ছাড়া কাউকে ইনভাইট করিনি। অতো পয়সা আমার নেই আপনি এখন আসতে পারেন।

হৈমীর কথা শুনে ছেলেটা হকচকিয়ে গেলো। বাপরে বাপ কিছু বলার সুযোগই দিচ্ছে না৷ কিসের জন্মদিন কিসের মাহের নয়ন ধূর। ভেবেই ছেলেটি গলা খাকারি দিয়ে বললো,

— এক্সকিউজ মি ম্যাম আমি একটা পার্সেল নিয়ে এসেছি। পার্সেল টা হৈমন্তীর নামে এসেছে।

— পার্সেল কিসের পার্সেল ওহ মাই গড! আমাকে আবার কে পার্সেল পাঠালো হায় হায় বলে কি। আপনার ভুল হচ্ছে না তো???

— আপনি হৈমন্তী তো??

— হ্যা হ্যা আমিই হৈমন্তী হৈমী।

ছেলেটা আর কথা না বাড়িয়ে পার্সেল টা এগিয়ে দিলো।
হৈমী অবাক চোখেই পার্সেলটা হাতে নিয়ে চোখ বড় বড় করে কিছু বলতে নিতেই ছেলেটা দ্রুত পা চালিয়ে চলে গেলো। হৈমী কয়েকবার ডাকলেও সে এক মিনিট দাঁড়ালো না। যেনো এখান থেকে কেটে পড়লেই সে বাঁচে। মেয়ে মানুষ যে এমন নাগিনীর মতো ফুসফুস করে তা আগে শুনেছিলো। আজ নিজের চোখে দেখতেও পেলো।
.
“আমার ভালোবাসায় আমি করবো তোমায় ওগো বন্দিনী। আমার ভালোবাসার উষ্ণ ছোঁয়ায় ছুঁয়ে দিব তোমার ঐ হৃদয়খানি”

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here