ভালোবাসায় বন্দিনী পর্ব ৫

0
1959

#ভালোবাসায়_বন্দিনী
#জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৫

খাঁচার ভেতর যেনো কোন পাখি কে বন্দি করে রেখেছে রুদ্র। আর সে পাখিটা বাইরে বের হাওয়ার জন্য ছটফট করছে। নিজের সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ধস্তাধস্তির করতে করতে পা দিয়ে শব্দ করতে শুরু করলো হৈমী। ড্রাইভার শরীফ পিছন ঘুরতেই রুদ্র ধমকে ওঠলো,

— যে কাজ করছো সেদিকে মনোযোগ দাও। এদিকে বার বার ঘুরছো কেনো?? ড.সুবর্ণার বাসার সামনে নিয়ে থামবে একদম।

শরীফ ভয়ে এক ঢোক গিলে আবারো গাড়ি চালাতে মনোযোগ দিলো। ভয়েস শুনে হৈমী চমকে ওঠলো। হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরেছে বিধায় শুধু উম উম শব্দ করতে থাকলো। রুদ্র হাতটা আরেকটু শক্ত করে চেপে নিজের সাথে আরো শক্ত করে জরিয়ে বসে রইলো। হৈমী ছাড়ানোর চেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছে।

হৈমীর এমন বাড়াবাড়ি তে রুদ্র প্রচন্ড বিরক্ত হলো। রাগ হলো ভীষণ দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

— আর একটু নড়া চড়া করলে তোমার অবস্থা খারাপ করে ছাড়বো আমি। তুমি কার কাছে আছো ভুলে যেওনা। রুদ্রর সামনে কোন পাগলামি চলবে না। সব পাগলামি ছুটিয়ে ফেলবো একদম।

এবার হৈমী সিওর হয়ে গেলো এটা সেই রোবট মার্কা ভূতটা। তাই আর দেরী নয় যে হাতে রুদ্র তাঁর মুখ চেপে ধরেছে সে হাতে সাজোড়ে এক কামড় বসিয়ে দিলো। সঙ্গে সঙ্গে রুদ্র হাত সরিয়ে হৈমীর গালে ঠাশিয়ে দিলো এক থাপ্পড়। থাপ্পড় খেয়ে হৈমী কিছুটা ছিটকে গেছে রুদ্রর থেকে। শব্দ করে কান্না শুরু করলো গাল ধরে আর বলতে লাগলো,

— অ্যাঁ আমার কোমড়, আমার গাল,আমাকে এই লোহার রোবট টা মেরে ফেললো গো ৷ আমাকে কিডন্যাপ করলো। কেউ কি নেই আমাকে বাঁচানোর। ও দাদুগো আমি আর রাতের বেলা লুকিয়ে বের হবো না। আর চিকু মামার চকলেট, আইসক্রিম খাওয়ার লোভ করবো না এবারের মতো বাঁচাও। কে বাঁচাবে এখন আমায় ও নয়না আপু তোমার কোন বাড়ি বিয়ে হলো গো। বিয়ে করলা তুমি আর কপাল পুড়লো আমার যেদিকেই যাই সেদিকেই বন মানুষ টা খাবলে ধরে আমায়।

এসব অহেতুক বেয়াদবীপনা কথা শুনে রুদ্র প্রচন্ড রেগে আরো একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিয়ে ধমকে বললো,

— চুপচাপ বসে না থাকলে থাপড়ায়ে বএিশটা দাঁত ফালাই দেবো। গাড়ি থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিবো। এখন তুমি ভাবো কি করবে চুপচাপ বসবে নাকি মুখ চালিয়ে নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনবে। স্টুপিড কোথাকার!

পরের থাপ্পড় টা এতোই জোরে ছিলো যে মাথা টা ভন ভন করছে হৈমীর৷ মাথায় হাত দিয়েই আহত গলায় বললো,

— প্লিজ আমাকে আর মারবেন না। আমি বোধহয় বাংলা সিনেমার মতো স্মৃতি হারাই ফেলবো৷তখন যদি নিজেকেই চিনতে না পারি??আমি বাড়ি যাবো আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন। বলেই নিচু আওয়াজে কাঁদতে লাগলো।

রুদ্র এবার চরম বিরক্ত হয়ে রাগি চোখে চেয়ে দাঁতে দাঁত চেপে ধমকে বললো,

— মুখ চালাতে নিষেধ করেছি।ছাগলের মতো গ্যান গ্যান করছো কেনো?? একদম সাইলেন্ট!

ধমক খেয়ে এবার হৈমী একদম চুপ হয়ে গেলো। গাল দুটো ব্যাথায় টনটন করছে, কোমড়ে অসহনীয় যন্ত্রণা হচ্ছে। হাত, পায়ে ছিলেও গেছে বোধ হয়। আধমরা হয়েই গেছে মুখ চালিয়ে পুরোপুরি মরার শখ নাই ভেবেই চুপ থাকলো সে। মনে মনে আল্লাহ কে বলতে লাগলো,

— আল্লাহ এবারের মতো বাঁচিয়ে দাও এই হৃদয়হীন রোবট টার থেকে। ধূর রোবট দের তো হৃদয় থাকেই না। আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে এই রোবট টা আমি বাড়ি যাবো।

রুদ্র আড় চোখে চেয়ে দেখলো হৈমী মিনমিনে স্বরে কাঁদছে। বিরক্ত হয়ে চোখ সরিয়ে নিলো সে।
.
ড.সুবর্ণা রাতের বেলা রুদ্র কে দেখে সাথে হৈমীকে দেখে বেশ অবাক হলো। প্রথমে রুদ্র কে চিনতে তাঁর একটু অসুবিধাও হলো বটে। কারণ তাদের বাবরি চুলওয়ালা কাবলী পড়া ফ্রেন্ডের নতুন লুক। যদিও এখনো পড়নে কালো রঙের কাবলী আছে তবে বাবরি চুল নেই দাঁড়িও আগের মতো বড়সড় নেই। বেশ লাগছে ভেবেই মুচকি হেসে বললো,

— কি খাবি চা না কফি আর ও কে??

হৈমী কিছু বলতে নিয়েও রুদ্রর রাগি গম্ভীর মুখটার দিকে চেয়ে থেমে গেলো। রুদ্র গম্ভীর স্বরে বললো,

— রিলেটিভ। ছোট্ট একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে ট্রিটমেন্ট কর। আমি আসছি বলেই রুদ্র ওঠে গেলো।

সুবর্ণা ভ্রু কুঁচকে হৈমীর দিকে তাকালো। হৈমী রুদ্রর যাওয়ার দিকে ওকি, ঝুঁকি দিয়ে যখন বুঝলো রুদ্র বেড়িয়ে গেছে তখন কান্না শুরু করলো।

সুবর্ণা চমকে গিয়ে দ্রুত হৈমীর পাশে বসলো। এক কাঁধে হাত রেখে বললো,

— এ মা কাঁদছো কেনো তুমি?? কোথায় ব্যাথা লেগেছে কি সমস্যা হয়েছে বলো আমায়। কিছু হবে না ভয় পেও না।

হৈমী কাঁদতে কাঁদতেই বললো,

— ঐ লোকটা আমাকে জোর করে তুলে এনেছে। প্রথমে নিজের ইয়া বড় গাড়ি দিয়ে আমার ছোট মাসুম গাড়িটাকে ধাক্কা দিলো৷ তারপর আমাকে তুলে নিয়ে এলো। দুই দুইটা থাপ্পড় ও দিয়েছে। দেখুন গালটা লাল হয়ে গেছে ব্যাথায় টনটন করছে বলেই ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো।

সুবর্ণা দেখলো সত্যি গাল দুটো একদম লালচে বর্ন ধারন করেছে। রুদ্রকে সে ভালো মতন চিনে। চিকিৎসার জন্যই নিয়ে এসেছে কিন্তু ভালোভাবে বুঝিয়ে নিয়ে আসেনি৷ আসতে চায়নি তাই হয়তো মেরে দিয়েছে। উফফ এই রুদ্র কে নিয়ে আর পারা যায় না ভেবেই হৈমীর পাশ থেকে ওঠে ফার্স্ট এইড বক্স আনতে চলে গেলো।
.
যেখানে যেখানে ছিলে গেছে স্যাভলন দিয়ে পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করে দিলো। আর হৈমী রুদ্রর নামে এক বস্তা নালিশ করলো সুবর্ণার কাছে৷ সুবর্ণা মুচকি হাসছে আর কাজ করছে। বেশ বুঝলো মেয়েটা অত্যাধিক বাচাল।

কোমড়ে ব্যাথা পেয়েছে তাই প্রথমে ইনজেকশন দিতে চাইলো৷ কিন্তু ইনজেকশনের নাম শুনেই হৈমী এমন চিৎকার,চেচামেচি শুরু করে দিলো যে সুবর্ণা বাধ্য হয়ে রুদ্র কে ফোন করলো। রুদ্র নিচে ছিলো ফোন করার সাথে সাথেই উপরে চলে এলো। সুবর্ণা একটা মেসেজ করলো রুদ্র কে যাতে ইনজেকশনের জন্য হৈমীকে রাজি করায়।

রুদ্র বিরবির করে বললো,

— এই মেন্টাল পেশেন্ট কে সামলানো আর দশটা ছাগল সামলানো একি কথা৷ ডিজগাস্টিং সেদিন হাত ধরায় যার গালে থাপ্পড় লাগিয়ে দিলাম। আজ পরিস্থিতির চাপে বার বার তাকেই স্পর্শ করতে হচ্ছে??

এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রুদ্র হৈমীর পাশে গিয়ে বসলো।
রুদ্র কে দেখে হৈমী বির বির করে সমানে বকতে থাকলো। পাশে বসায় খানিকটা সরে বসলো। রুদ্রর সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই সে এক হাত বাড়িয়ে হৈমীকে হেচকা টান দিয়ে বাম হাতটা প্রচন্ড শক্ত করে চেপে ধরলো। সুবর্ণা চট করে আরেকপাশে এসে হৈমীর হাতে ইনজেকশন পুশ করে দিলো। এমন ছক কষা হবে হৈমী স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি। কয়েক সেকেন্ডের ভেতরে এত্তো জোরে চিৎকার দিলো যে সুবর্ণা, রুদ্রর কানের পর্দা বোধহয় ফেটে যাবে। চোখ মুখ খিচে রুদ্রর কাবলী এক হাতে খামচে ধরে আছে হৈমী৷ এত্তো ভয় ইনজেকশনে যে কাঁপতে শুরু করেছে মেয়েটা। ফুঁপাতে, ফুপাতে বললো,

— আপনি খুব খারাপ, খুব খারাপ আপনি। আমার জীবনের অনেক বড় শত্রু আপনি। কখনো ক্ষমা করবো না আপনাকে৷ রুদ্রকে শক্ত করে ধরেই কাঁপতে কাঁপতে কথা গুলো বললো হৈমী৷

সুবর্ণা কিছু ওষুধ লিখে দিলো৷ হৈমীর অবস্থা দেখে রুদ্র হৈমীর কাঁধে হাত রেখে জরিয়ে বসে রইলো। হৈমীও কেমন নেতিয়ে রইলো আর বির বির করে করে রুদ্রকে বকতে থাকলো,দোষারোপ করতে থাকলো।

সুবর্ণা বললো,

— চাইলে থেকে যেতে পারিস দশটা বেজে গেছে আমি রান্না বসাই।

রুদ্র বললো,

— নাহ ওর বাসা কাছেই দিয়ে আসবো।
— কেমন রিলেটিভ বললি না তো??
— রাদিফ ভাইয়ের শালিকা।
— ওহ আই সি তাই তো বলি এমন ফুসফুস করে কেনো মেয়েটা তোকে দেখলেই।
রুদ্র চোখ গরম করে তাকাতেই সুবর্ণা বললো,
— ওহ প্লিজ এমন সিচুয়েশনে এমন টা ঠিক মানাচ্ছে না। আমি কিন্তু সব রোগের আভাসই পাই৷ তোর রোগ ধরতেও বেশী টাইম কিন্তু লাগে নি।

রুদ্র চোখ কটমট করে বললো,
— মুখ টা বন্ধ রাখ। জাষ্ট নিজের দায়িত্ব টা পালন করলাম। বিপদগ্রস্ত এজনকে বিপদ মুক্ত করলাম।
সুবর্ণা চোখ টিপ মেরে বললো,
— এভাবে জরিয়ে ধরে??
রুদ্র থতমত খেয়ে গেলো রাগটা কমিয়ে শান্ত গলায় বললো,
— এ বিষয়ে পরে কথা বলবো। রুদ্র তাঁর ধর্মের বাইরে যায় নি। আর পরিস্থিতির জন্য যদি গিয়েও থাকে তাহলে তা হালাল করার মানসিকতা নিয়েই করেছে।হালাল করার ক্ষমতাও মহান আল্লাহ তায়ালা অবশ্যই দিয়েছেন।

সুবর্ণার যা বোঝার তা বোঝা হয়ে গেলো। কিন্তু তাই বলে নিজের স্বভাবের একদম বিপরীত কাউকে ভাবতেই গা শিউরে ওঠছে তাঁর।
.
গাড়িতেই ঘুমিয়ে গেছে হৈমী ইনজেকশন এর কড়া ডোজেই ঘুম এসে গেছে তাঁর। নয়নার কাছে হৈমী যেখানে থাকে তাঁর ঠিকানা নিয়েছিলো রুদ্র। আজ সেখানেই যাচ্ছিলো উদ্দেশ্য ছিলো নেকলেসটা ফেরত দিবে। তাঁর আগেই কতোসব কান্ড ঘটে গেলো।আজ আর নেকলেসটা ফেরত দেবে না৷ জাষ্ট ওকে পৌঁছে দেবে। ভাবলো রুদ্র।

শরীফ কে দিয়ে ফার্মেসি থেকে ওষুধ আর চিকু মামার দোকান খুঁজে বের করে আইসক্রিমে বক্স তিনটা নিলো। বেশ কিছু চকোলেট নিয়ে গাড়িতে বসলো শরীফ৷ রুদ্র কে সব দিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো আবারো।
.
শরীফ লাইট ধরলো রুদ্র হৈমীকে পাঁজাকোল করে নিয়েই বাড়ির মেইন দরজার সামনে দাঁড়ালো। শরীফ কলিং বেল বাজাচ্ছে রাত তখন এগারোটা। বাচ্চা রা সবাই ঘুমাচ্ছিলো কলিং বেলের আওয়াজে কয়েকজনের ঘুম ছেড়ে গেলো। দাদুও চশমা চোখে দিয়ে রুম ছেড়ে বের হয়ে এলো। ধীর পায়ে নামারকম ভাবনা ভেবেই দরজা খুললো। দুজন অপরিচিত মুখ একজনের কোলে হৈমী। বিস্মিত হলো দাদু৷ আহত গলায় বললো,

— তোমরা কারা?? আর হৈমী কিভাবে এখানে??

রুদ্র তাঁর নিজের পরিচয় দিলো এক্সিডেন্ট থেকে শুরু করে সবটা দাদুকে জানালো। হৈমী রাত করে বের হয়েছে আইসক্রিম, চকোলেটের জন্য সাইকেল নিয়ে বেরিয়েছে সবটাই জানানো হলো দাদু কে। সব শুনে দাদু প্রচন্ড রেগে গেলেন। কিন্তু প্রকাশ করলেন না। রুদ্র কে ভিতরে ঢুকতে দিলো হৈমীর রুমেও নিয়ে গেলো। রুদ্র হৈমীকে বিছানায় শুইয়িয়ে দিলো। মেয়েটার পোশাক,আশাক দেখলে মেজাজ বিগরে যায় তাঁর কারন হৈমী লেডি জিন্স,লেডি শার্ট আর পাতলা একটা ওড়না পড়া আছে। শরীফ আইসক্রিম, চকোলেট, আর ওষুধ গুলো দাদুর কাছে দিলো। ওষুধ বুঝিয়েও দিলে। রুদ্র বেশ রাগ নিয়েই হৈমীর রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো। দাদু রুদ্র কে কৃতজ্ঞতা জানালো। এক কাপ চা অফার করলো কিন্তু রুদ্র বেশীক্ষণ দেরী করলো না৷ যাওয়ার আগে বলে গেলো,

— আশা করি এর পর রাত করে বের হবে না৷

দাদু যথেষ্ট জোর দিয়ে বললেন,

— অবশ্যই। আমি যদি একবারো টের পেতাম এমনটি হতে দিতাম না। এবার জেনেছি এবার অবশ্যই নিষেধ করবো। কড়া শাসন করবো।
.
দিনের বেলা রুদ্র আজ হৈমীর বাড়িতে এলো। তিনদিন আগে রাতের বেলা আসায় খেয়াল করা হয়নি। বাড়ির সামনে ছোট্ট গেটে লেখা ছিলো ★সুখ নীড়★সুখ নীড়ে থাকে বলেই এতো সুখ মনে স্টুপিডটার?? ভাবলো রুদ্র।

কলিং বেলের আওয়াজে দরজা খুললো দাদু। রুদ্র কে দেখে চিনতে পারলো সে৷ বেশ সৌজন্যতা দেখিয়ে ভিতরে বসতে বললো।রুদ্রও চুপচাপ ভিতরে গিয়ে সোফায় বসলো। দাদু জমিলা নামে কাউকে ডেকে চা দিতে বললেন জমিলাও বললো,

— জ্বি আব্বা দিতাছি। (কাজের মেয়ে)

দাদুও গিয়ে সামনাসামনি সোফায় বসলো। রুদ্র শুনেছিলো এখানে আরো বাচ্চা রা থাকে। তাই জিগ্যেস করলো,

— শুনেছিলাম এখানে আরো বাচ্চা রা থাকে??

দাদু বললেন,

— ঠিকি শুনেছিলে সবাই স্কুলে গেছে।
— ওও আচ্ছা! আপনি কি আশ্রম চালান কিন্তু নাম শুনিনিতো??
দাদু মিটিমিটি হাসতে হাসতে বললো,
— রুদ্র শেখ এসেছে বাচ্চা দের খোঁজ নেওয়ার জন্য। কি সৌভাগ্য আমার কিন্তু এটা আশ্রম নয় এটা আমার একটা সুখী পরিবার। যে পরিবারের কর্তা আমি কর্তী হৈমী দিদিভাই।
কথাটা রুদ্রর পছন্দ হলো না হৈমী কর্তী হবে কেনো??তাঁর কর্তাই বা এই লোকটা হবে কেনো??
কাঠ কাঠ গলায় রুদ্র বললো,
— আমি ভণিতা করা লাইক করি না। আমি স্ট্রেইট কথাবার্তা পছন্দ করি এবং অভ্যস্ত।

জমিলা চা বিসকেট সামনে দিলো। দাদু রুদ্রর ভাবমূর্তি কিছুটা আঁচ করতে পারলো। তবুও বাকিটা শোনার অপেক্ষা করতে থাকলো। রুদ্রকে চা এগিয়ে দিয়ে নিজেরটা নিয়ে চায়ের কাপে এক চুমক দিলো।
রুদ্র চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বললো,

— হৈমীর বিষয়ে ডিটেইলে জানতে চাই আমি। ওর অতীত কি ছিলো?? কিভাবে আপনার কাছে এলো??

দাদু চিন্তিত মুখেই বললো,
— বলবো কিন্তু সবটা শুনতে চাওয়ার কারন টা জানলে ভালো হতো। কারন হৈমীর প্রেজেন্ট গার্ডিয়ান আমি।

রুদ্র গম্ভীর চোখ,মুখেই বললো,
–আর ভবিষ্যৎ গার্ডিয়ান আমি! আশা করি এবার বলতে অসুবিধা হবে না??
— বিয়ের প্রস্তাব বুঝি কেউ এভাবে দেয়??বললেন দাদু৷
— অন্য কারো সাথে আমাকে গুলিয়ে ফেলবেন না৷ আপনি বলুন আমি যা শুনতে চাই। প্রস্তাবটা ঘটা করেই পাঠানো হবে। আপাতত সীমিত ভাবেই নিন৷

ছেলে টা রগচটা, বেশ ত্যাড়া আর সে যদি কিছু না বলে হয়তো সিনক্রিয়েট করবে। বড় লোকদের মতিগতির ঠিক নাই। তাই গভীর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দাদু বলতে শুরু করলেন,

তিন বছর বয়সে বাবা কে হারায় হৈমী৷ হৈমীর মা নির্জনা তখন বাচ্চা মেয়েটিকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে আসে। হৈমীর বাবা সরকারি চাকরুজীবি ছিলেন৷ পেনশনের টাকায়ই মা মেয়ের বেশ ভালোই চলতো। বাপের বাড়ি মেয়েকে নিয়ে থাকায় কোন অসুবিধা হতো না৷ খাবাড়,পোশাক সহ নিজের প্যারালাইজড মায়ের দায়িত্বও হৈমীর মা নিয়ে নিয়েছিলো৷ যার কারনে তাঁর ভাইরা বেশ সন্তুষ্টিই ছিলো তাঁর ওপর৷ ধীরে ধীরে হৈমী বড় হতে থাকে। স্কুল ভর্তি করানো হয় তাঁকে। প্যারালাইজড মায়ের মৃত্যুর পরও কোন সমস্যায় ভুগতে হয়নি ওদের৷ কিন্তু নিয়তির করুন খেলায় হেরে গেলো নির্জনা।
একা বাঁচার লড়াইয়ে হেরে গেলো সে। একা এক নারী হয়ে নিজের সন্তান কে নিয়ে দুনিয়াতে টিকে থাকার লড়াই টা খুব বেশী দিন করতে পারলে না।
ক্যান্সার নামক অভিশপ্ত রোগে আক্রান্ত হলো তাঁর দেহ। দীর্ঘ সাত বছর ক্যান্সারে ভুগে মারা যায় তিনি। চিকিৎসা করানোর জন্য পেনশনের শেষ টাকা খরচ করতে চায়নি৷ ত মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু বরণ করেছেন। হৈমীও তখন ছোট ছিলো এসব বুঝেনি। বাবা, মায়ের ভালোবাসা, বাবা মায়ের মর্ম বুঝে ওঠার আগেই মেয়েটা বাবা,মা হারা হয়ে গেলো এতিম হয়ে দুনিয়ায় টিকে রইলো। তখনও মেয়েটা জানতো না এতিম হয়ে দুনিয়াতে টিকে থাকা একটা অভিশাপ। এতিম শব্দটার সাথে আমরা সবাই পরিচিত। আমরা সবাই জানি পিতা-মাতাহীন বালক বালিকাকেই এতিম বলে গন্য করা হয়। কিন্তু এতিম সংজ্ঞা টা যতোটা সহজে আমরা ব্যাখ্যা দিতে পারি। দুনিয়াতে বসবাস কৃত প্রত্যকটা পিতামাতা হীন সন্তান রা এতো সহজে তাঁদের জীবনকে অতিবাহিত করতে পারে না৷

হৈমীও পারেনি৷ বারো বছর বয়সী একটা মেয়ের দায়িত্ব নেয় নি কেউ৷ মামারা দিয়ে আসে চাচার বাড়ি। দিনের পর দিন চাচির দুছছাই সহ্য করে থাকতো সেখানে। বাচ্চা মেয়েটাকে দিয়ে কাজ করাতো খাটিয়ে মারতো। তবুও মেয়েটা হাসি,খুশি থাকতো। চাচির মাঝে মা কে খুঁজে বেড়াতো, চাচার মাঝে বাবাকে৷ কিন্তু চাচি কোন দিন মা, চাচা কোন দিন বাবা হয় না৷ এটা তখনি বোঝা যায় যখন একটা বাচ্চার সম্পূর্ণ দায়িত্ব তাঁর চাচা,চাচির ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। হৈমীর দায়িত্বও কেউ নিতে চায় নি। আবর্জনা ভেবে দূরে দূরে ঠেলে দিয়েছে। হৈমীর বড় ফুপু এসব দেখে সহ্য করতে পারেনি৷ আবার নিজের কাছেও রাখতে পারেনি৷ ঐ যে নিয়তি নিয়তির কাছে প্রত্যকটা মানুষই বড় অসহায়। আর এই অসহায়ত্বকে নির্মমভাবে গ্রাস করেছিলো হৈমীকে।
হৈমীর ফুপু তাঁকে আশ্রমে রেখে যায়৷ আমি ছিলাম হৈমীর চাচাতো দাদা।

চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here