ভালোবাসার ফোড়ন ২ পর্ব ৮

0
994

#ভালোবাসার_ফোড়ন_২
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_৮

মাথা নিচু করে ‌পায়ের বুড়ো আঙুল’র দিকে তাকিয়ে আছি। মাথায় আসছে না ঠিক কি বলবো তাদের। আকাশ ভাইয়া অধীর আগ্রহে দাঁড়িয়ে আছে আমার কথা শোনার জন্য। সবাই চুপ, সবার নিঃশ্বাস’র শব্দ আসছে। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে সবাই, এর কারন হচ্ছে তারা সবাই উত্তেজিত। আমার বলতে যত দেরি করছি সবার আগ্রহ তত বাড়ছে।

আকাশ ভাইয়া এক পর্যায়ে আমাকে ডেকে বলেন..
“নিহা সব ঠিক আছে এতো!

আমি ছোট একটা শ্বাস নিয়ে ভাইয়ার দিকে তাকালাম। তার ঠিক পিছনে আহিয়ান দাঁড়ানো। সবার এতো আগ্রহ অথচ তার মুখে এসবের কোন প্রভাব নেই। বইয়ের মাঝে মুখ গুঁজে আছে। এতো মনোযোগ দিয়ে পড়ছে নাকি সে। আচ্ছা তার কি মনে আছে সেদিনের কথা, সে কি জানে এই সিগারেট’র কারণে হাত পুড়ে যাওয়ার ঘটনা টা! ‌

আমি কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই দেখলাম আহিয়ান তার বই টা বন্ধ করল।‌ বই টা পড়া হয়তো শেষ। সে একটু স্বাভাবিক ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকাল। অতঃপর হালকা গলা ঝেড়ে বলল..
“ওর হাত আমার সিগারেট’র আগুনে পুড়ে গেছে!

উনার কথায় আমি সহ সবাই অবাক। আনিকা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে দেখছে তাকে। সবার অবাক হবার কারন ছিল এটা কি হতে পারে, উনার জলন্ত সিগারেট’র আগুনে আমার হাত পুড়বে কিভাবে! আর আমার অবাক হবার কারন ছিল, উনি কি দেখেছিলেন তার সিগারেট’র আগুনে আমার হাত পুড়েছে। দেখেছে হয়তো নাহলে বললেন কিভাবে।

আনিকা অবাক হয়ে বলে উঠে..
“আহি তুই কি বললি?

আকাশ ভাইয়া বলে উঠে..
“তোর সিগারেট’র আগুন ওর হাতে লাগল কিভাবে?

আহিয়ান হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল..
“আমার হাতে জলন্ত সিগারেট ছিল, আর সেই হাত দিয়ে ওকে ধরেছিলাম তখন লেগেছে। তবে এটা কোন গুরুতর বিষয় না। ছ্যাকা খেয়েছে শুধু বেশি কিছু হয় নি। হলে আমিই দেখতাম! আমাদের সময় হয়ে গেছে, তুই আয় আমি গাড়িতে বসছি!

বলেই উনি চলে গেলেন। তার পিছু পিছু আনিকা চলে গেল, কিন্তু যাবার আগে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। মনে হচ্ছে আমার মুখ টা মনে রাখার চেষ্টা। আকাশ ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে..

“সরি নিহা, আসলে আমি!

“ভাইয়া আমি জানি, আপনি যা বলছেন আমার ভালোর জন্যই বলছেন। আমার জন্য চিন্তা করছেন আপনি এজন্য আপনার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তবে তেমন কেন ব্যাপার না।

“যদি কখনো তেমন সমস্যা হয় তাহলে অবশ্যই জানিও, সাহায্য করার চেষ্টা করবো তোমায়!

“জ্বি ভাইয়া অবশ্যই!

অতঃপর ভাইয়া চলে গেল। আমি ইতি’র দিকে তাকালাম। সে হা করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তার মুখটা বন্ধ করে দিয়ে বললাম..

“মুখ টা বন্ধ কর নাহলে মাছি ঢুকবে!

“আহি ভাইয়া সত্যি তোর হাত ধরেছিল!

“সেটা একটা এক্সিডেন্ট ছিল, আমি পড়ে নিলাম তখন ধরেছিল।

“কখন, কিভাবে, কোথায়?

“গতকাল বাগানে!

“তুই আমাকে বললি না কেন?

আমি উল্টো হয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলি…
“এটা তেমন কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না যে বলে বেড়াব!

ইতি আমার সাথে সাথে হাঁটতে হাঁটতে বলে..
“তুই বুঝতে পারছিস না এটা কতো বড় বিষয়, আহি ভাইয়া তোর হাত ধরেছে বুঝতে পারছিস। যদি নিতি জানে তো কি করবে তোর!

“আমি বলে দেবো এটা একটা এক্সিডেন্ট!

“তুই বললেই কি সে মেনে নেবে!

“তুই চুপ করবি, ভালো লাগছে না আর এইসব।

“নিহা, বলি কি দুদিন ভার্সিটিতে আসিস না।

“কেন?

“তোর ভালোর জন্য,‌নিতি মেয়েটা বেশ সুবিধার না।

“তুই এভাবে এভাবে ভয় পাচ্ছিস দেখিস কিছু হবে না।

ইতি কিছু বলার চেষ্টা করল আমি তাকে আটকে দিলাম। ভালো লাগছে না আর এসব শুনতে!
.
মিতু আপু আজ একটু বেশি বেশি খুশি লাগছে, মাঝে মাঝে দেখছি একা একা হাসছে। মুন্নি আপু খাটের এক কোণে বসে কার সাথে যেন কথা বলছে। ভিডিও কল মনে হচ্ছে, কারন সে ফোনটা তার সামনে ধরে বকবক করছে।

মিতু আপু সবে সব কিছু জোগাড় করে রান্না ঘরে গেছে রাঁধতে, তার পিছু পিছু আমিও গেলাম। গিয়ে দেখি সে দাঁড়িয়ে কিসব ভাবছে আর হাসছে। এদিকে কড়াই গরম হয়ে পুড়ে ধোয়া উড়ছে। আমি দ্রুত গিয়ে আপু কে ডাকলাম, অতঃপর চুলা কমিয়ে দিয়ে তাতে পেঁয়াজ ছেড়ে দিলাম। আপু খুন্তি দিয়ে পেঁয়াজ নাড়তে লাগল। আমি বলে উঠি..

“কার ভাবনায় এতো বিভোর তুমি!

“কি বলছিস এসব!

“মনে হচ্ছে পাগল হয়ে গেছো।

“কি?

“হ্যাঁ তাই তো, তা না হলে কি আর একা একা হাসো। এই আপু তোমাকে ভূত ধরে নি আবার।

“নিহা..

আমি ফিক করে হেসে বলি..
“ভূত’ই ধরেছে। প্রেমের ভূত! আমি জানি।

“পাজি মেয়ে দেবো তোকে একটা।

“ইশ! তা ভাব হলো নাকি তোমার।

“তুই চুপ করবি।

“এই বিয়ে কবে হবে বলো না।

আপু আমার দিকে খুন্তি নিয়ে বলল..
“দেবো!

অসহায় মুখ করে বলি,
“বলবে না আমাকে..

আপু হেসে বলে,
“তোকে বলবো না তো কাকে বলবো।

“তাহলে বলো না কি হলো!

“তেমন কিছু না। এভাবেই দিন কাটছে।

“কি করলে আজ!

“আজ! কিছুই না শুধু দুজন মিলে গল্প করছিলাম আর তখন..

“তখন!

“কিছু না যা এখান থেকে।

“এই বলো না কি হলো? নাহলে আমার যে আর ঘুম আসবে না বলো না গো আপু। মিষ্টি আপু, বলো!

“তেমন কিছু না আমাকে জরিয়ে ধরল।

আমি চোখ বড় বড় করে বলি,
“তুমি একটা থাপ্পর দিলে না তাকে।

আপু আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে,
“কি, থাপ্পড় কেন মারব।

“একটা ছেলে তোমাকে জরিয়ে ধরল আর তুমি তাকে মারলে না এটা কোন কথা!

আপু অবাক চোখে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল। অতঃপর নিজের কাজে আবার মনোযোগ দিল।‌ব্যাপারটা কি হলো।‌ আপু কি আমার কথাটা ঠিক বুঝতে পারল না। ভালোবাসলেই বুঝি জড়িয়ে ধরতে হবে, বিয়ে টিয়ে কিছু হলো না আর জরিয়ে ধরল। বাহ!

আপু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। অতঃপর বলল..
“শোন পাকা মেয়ে, যাকে তুই ভালোবাসিস সে তোকে জরিয়ে ধরলে তুই কি তাকে থাপ্পড় মারতে পারবি।

“কেন পারবো না। একশবার পারবো।

“উহু পারবি না।

“কেন?

“সেটা তখন তুই নিজেই বুঝবি যা এখন পড়তে বস। যা!

আপু তাড়িয়ে দিল আমাকে রান্না ঘর থেকে। আমি আনমনে এসে বসে পড়লাম বিছানায়। সত্যি কি এমন হয়। আর হলেও আমার কি এসব ভেবে আমার লাভ কোথায়। এর চেয়ে বরং পড়লে লাভ হবে। পড়তে বসি!
.
ভার্সিটিতে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম আমি আর ইতি। হুট করেই টিনা এসে দাঁড়াল। বলল নিতি আমাকে ডাকছে। তিন তলায় সিঁড়ির কাছে আছে সে। আমাকে যেতে হবে।
আমি আর ইতি টিনা’র সাথে গেলাম নিতি’র কাছে। সে সেখানে আনিকা’র সাথে দাঁড়িয়ে ছিল। আমাকে দেখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল আমার দিকে। আমি স্বাভাবিক ভাবেই তার সামনে দাঁড়িয়ে বলি..

“আপু ডেকেছিলে আমায়!

নিতি কিছু না বলে চট করে আমার হাত টা ধরে বলে,
“আহি নাকি তোমার হাত ধরেছিল।

“আপু!

“হ্যাঁ বা না বলো, বেশি কথা আমার পছন্দ না।

পেছন থেকে ইতি বলল,
“আপু সেটা একটা এক্সিডেন্ট ছিল!

নিতি ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কেমন এক্সিডেন্ট শুনি, যার কারনে আহি তোমার হাত ধরতে বাধ্য হলো।

ইতি বলতে যাবে তখন নিতি বলে উঠে,
“তোমাকে জিজ্ঞেস করে নি আমি!

টিনা এসে ইতি’র থিতুনি চেপে ধরে বলে,
“বন্ধুর জন্য বেশ দরদ দেখছি!

ইতি কিছু বলতে পারছে না শুধু উমম উমম করছে। আমি বলে উঠি,
“আপু বিশ্বাস করো, এক্সিডেন্টলি সব হয়েছে।

নিতি আমার দিকে আগাতে আগাতে বলে,
“কেমন এক্সিডেন্ট শুনি!

তার পাশে আনিকা দুই হাত বাহু তে গুঁজে আমার দিকে আগাতে থাকে। সে হেসে বলে,
“আহি আজ পর্যন্ত কারো দিকে তাকাল না, আর তোমার হাত ধরে ফেলল।

“আপু বলছি তোমরা শোন!

“শোনার জন্য’ই দাঁড়িয়ে আছি, বল!

“আসলে হয়েছিল কি আমি পড়ে যেতে নিচ্ছিলাম আর উনি শুধু আমাকে বাঁচানোর জন্য আমার হাত ধরেছে!

নিতি আর আনিকা দুজনেই আমার দিকে আগাচ্ছে। আর আমি পিছিয়ে যাচ্ছি, এক কোনে টিনা ইতি কে ঘিরে আছে। এদিকে নিতি বলে উঠে,

“কিভাবে পড়ে গেলে তুমি, কি হয়েছিল? নাকি আহি কে দেখে ইচ্ছে করেই পড়ে গেলে!

“আপু বিশ্বাস কর এটা সত্যি এক্সিডেন্ট ছিল, আমি ইচ্ছে করে কিছুই করে নি।

নিতি আর আনিকা থেমে গেল, আমিও থেমে গেলাম। নিতি আমার দিকে তাকিয়ে ব্যঙ্গ করে বলল,

“ওহ আচ্ছা! তাহলে তোমার কথা হলো তুমি পড়ে যেতে নিলে আর তখন আহি তোমাকে ধরেছে। আচ্ছা একটা কথা বলো তো, এটা কি বার বার’ই হবে

“মানে!

“এটাই!
বলেই দুই হাত দিয়ে আমাকে ধাক্কা দিল। পিছনে সিড়ি’র কাছে যে চলে এসেছিলাম আমি এটা আমার খেয়াল’ই ছিল না। ইতি সেখান থেকে নিহা বলে চেচাল। আমি পড়ে যেতে নিলাম তখন মনে হলো কেউ এসে আমার হাত ধরল। সে আমার হাত ধরে তার দিকে টানল। আমি তাকিয়ে দেখি আহিয়ান! হ্যাঁ সেই আমার হাত ধরে আছে।

আমি একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছি। সে আমার হাত এখনো ধরে আছে খুব শক্ত করে। হুট করেই কেউ হাত টা ছাড়িয়ে ফেলল, তাকিয়ে দেখি নিতি। রাগে ফুঁসফুস করছে সে। পেছনে আকাশ ভাইয়া, আনাফ, নাহান সবাই ছিল।

আহিয়ান আমার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিতি’র দিকে তাকাল। অতঃপর তার হাত ধরে টেনে নিচে নেমে গেল। তার পিছন পিছন সবাই গেল। আকাশ ভাইয়া যাবার আগে আমাকে বলল “ঠিক আছো”! আমি শুধু মাথা নাড়লাম। ইতি এসে আমার পাশে দাঁড়াল।

দুজনেই হাঁটতে হাঁটতে উপরে উঠলাম। বারান্দার তাকিয়ে দেখলাম দূরে আহিয়ান আর নিতি কথা বলছে। আহিয়ান’র কথা বলার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে সে বেশ রেগে আছে নিতি’র উপর। ইতি আমার ঘাড়ে হাত রেখে বলল,

“আহিয়ান ভাইয়া আজ না থাকলে কি হতো, মারাত্মক অবস্থা ঘটে যেত।

“সে কি ছিল সেখানে!

“প্রথমে আমিও খেয়াল করি নি। উপরেই ছিল। তোকে পড়ে যেতে দেখে দৌড়ে এলো সে।

“( জবাবে আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম)

“তোকে বলেছিলাম না নিতি এটা এতো সহজে মেনে নিবে না।

এবারো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জবাব দিলাম। কি আছে আমার কপালে জানি না। আজ বেশ ভয় পেয়েছি। যদি উনি না থাকতেন তাহলে বেশ খারাপ অবস্থা হতো। তিন তলার সিঁড়ি গুলো বেশ খাড়া খাড়া। তাই বেছে বেছে এখানেই ডেকে এনেছে আমায়!

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here