ভালোবাসার ফোড়ন ২ পর্ব ৪

0
1088

#ভালোবাসার_ফোড়ন_২
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_৪

“নিতি তোকে বলেছিলাম সাবধানে গাড়ি চালাতে, কি করলি তুই এটা!

“সরি আহি আমি বুঝতে পারি নি!

“আহি” নামটা শুনেই আমি তার দিকে ফিরে তাকালাম।
দেখলাম সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমাকে দেখে যেন থমকে গেলেন উনি। আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।‌ আচ্ছা তিনি কি আমায় চিনতে পেরেছেন নাকি চেনার চেষ্টা করছে। আজ প্রায় ২ মাস পর দেখছি তাকে। এই ২ মাসে আমাকে ভুলে যাওয়া টা অস্বাভাবিক কিছু না।

অনুভব করছি হাতে টনটন ব্যাথা করছে। মনে হচ্ছে হাত কিছুটা ছুলে গেছে। একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে একবার আমাকে আর একবার আহিয়ান কে দেখছে। এর মাঝেই দেখলাম পেছনে তার সেই বন্ধু গুলোও আছে। তারাও আমাকে দেখে বেশ অবাক। হঠাৎ আকাশ ভাইয়া আমার কাছে বলেন..

“তুমি নিহা নাহ!

“( আমি মাথা নাড়লাম )

আকাশ ভাইয়া হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন…
“ঠিক আছো তুমি! বেশি ব্যাথা পাও নি তো!

“জ্বি ভাইয়া ঠিক আছি আমি!

“কিন্তু তুমি এখানে..

“আমি এই ভার্সিটিতে বাংলা বিভাগের প্রথম বর্ষের স্টুডেন!

“এই ভার্সিটিতে! How coincidence, আমরাও এখানেই পড়ি তবে আমরা লাস্ট ইয়ারের স্টুডেন।
আমি হেসে তাদের দিকে তাকালাম। আহিয়ান কেমন ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। পেছনে তার দুই বন্ধু তার সাথে দুই মেয়েও আছে। আমাকে দেখে কানাকানি করছে। হয়তো আমার সম্পর্কে’ই বলছে। আমার সামনের মেয়েটা কেমন একটা চাহনির প্রতিফলন দিচ্ছে আমার দিকে। অতঃপর আমি আকাশ ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বলি..

“ভাইয়া ক্লাস শুরু হয়ে যাবে, আমাকে যেতে হবে।

“সরি নিহা! দোষ টা আমাদের ছিল, এতো জোরে গাড়ি চালানো ঠিক হয় নি। জানি তুমি ব্যাথা পেয়েছ কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে বলছো না।

“না ভাইয়া এমন কিছু না আমি একদম ঠিক আছি! আসছি আমি!

বলেই চলে এলাম, দ্রুত ভার্সিটির ওয়াশরুম এ এলাম। হাতের কনুই’র দিকে খুব জ্বলছে। হাত উঠিয়ে দেখলাম বেশ খানিকটা ছিলে গেছে। রক্তও পরছে! আমি পানি দিয়ে রক্ত টা ধুয়ে নিলাম। আমার গায়ে লাল রঙের একটা ওড়না ছিল। তা দিয়ে’ই সেটা ঢেকে নিলাম। কারন আমার কাছে কিছুই নেই!

চলে এলাম ক্লাসরুমে, দেখি ক্লাস অলরেডি শুরু হয়ে গেছে। আমি ম্যামের অনুমতি নিয়ে ক্লাসে ঢুকলাম। অতঃপর শেষ বেঞ্চের দিকে গেলাম। একজন খুব রেগে বসে আছে। রাগের কারনে আমার দিকেও তাকাচ্ছে না। আমি তার পাশে বসে একটা হাসি দিয়ে বললাম..

“কিরে জামাই মেরেছে বুঝি, মুখটা এতো গোমড়া করে রেখেছিস যে!

সে ফিসফিসিয়ে বলল..
“এই ক্লাসটা শেষ হতে দে, তোর ক্লাস নিচ্ছি!

“কেন আজ কি দুলাভাই’র ক্লাস নিতে পারিস নি!

“নিহা কি বাচ্চি তোকে তো আমি!

“কিন্তু প্রেগন্যান্ট তো তুই ছিলি তাই নাহ!

ইতি আর কিছু বললো না চুপ হয়ে গেল। আমার বেশ লাগে ইতি কে জ্বালাতে। ইতি হলো আমার ক্লাসমেট আর বেস্ট ফ্রেন্ড দুটোই। এই ভার্সিটিতে শুধু ওর সাথেই আমার বন্ধুত্ব হয়েছে। সুন্দর, কিউট, ইনোসেন্ট একটা মেয়ে বললে ভুল হবে। ও একদম’ই তেমন না হি হি হি! ওর নামে আবোল তাবোল বলতে আমার বেশ লাগে।

ইতি অনেকক্ষন চুপচাপ বসে বসে ক্লাস করল। ক্লাস শেষ হওয়া মাত্র ইতি হেসে আমার দিকে তাকাল। আমি উঠে দিলাম দৌড়! ইতিও আমার পিছনে দৌড়াচ্ছে। দুজন দৌড়াতে দৌড়াতে ক্যাম্পাসে দিকে চলে গেলাম। আমি একটা গাছের পিছনে একদিক থেকে ওদিকে যাচ্ছি আর ইতি আমাকে ধরার চেষ্টা করছে। একপর্যায়ে ইতি আমার হাত ধরে ফেলল। দুজনেই ধপাস করে বসে পড়লাম ঘাসের উপর। হাপাঁচ্ছিলাম দুজন!

আমি ইতি’র গাল টা টেনে বলি..
“এসময় এতো দৌড়াদৌড়ি করতে নেয় ইতি!

“ওহ্ আচ্ছা!
বলেই ইতি আমার চুল টানল। আমি ওর হাত ধরতে যাবো তখন সে হাসি থামিয়ে আমার হাতটা ধরল। অতঃপর সেই ছিলে যাওয়া অংশ টা দেখে চমকে উঠল। বলল..
“কিরে? এটা হলো কি করে?

“আরে তেমন কিছু না।

“তেমন কিছু না মানে অনেকখানি কেটে গেছে। তুই আমার সাথে চল আমি ঔষধ লাগিয়ে দিচ্ছি।

“কিন্তু!

কিছু বলার আগেই ইতি আমাকে টেনে নিয়ে গেল রেস্ট রুমে। অতঃপর হাতে ঔষধ লাগিয়ে দিল। হালকা কিছু বকাঝকা ও করল। অতঃপর আমাকে টেনে বাইরে নিয়ে এলো। হঠাৎ করেই মাথায় একটা বাড়ি মেরে বলল..

“বাঁদর মেয়ে একটা, যদি আমি না দেখতাম তাহলে কি
হতো জানিস!

“আরে জানি জানি..

“কি এতো জানো!

আমি আর ইতি দুজনেই ধমকে গেলাম। সামনে তাকিয়ে দেখলাম আকাশ ভাইয়া আর আহিয়ান। তিনি বরাবর হাতে একটা ফোন আর কানে হেডফোন দেওয়া। কি জানি দেখছে সে ফোনে। আকাশ ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। আমি হেসে বলে উঠি…
“কিছু না ভাইয়া!

“ওহ আচ্ছা!

ইতি বলে উঠে..
“তুই চিনিস আকাশ ভাইয়া কে!

আকাশ ভাইয়া বলে উঠে…
“হুম আমরা একে অপরকে চিনি অনেক, আমাদের পরিচয় টা একদম অন্যরকম ছিল। তা ইতি কোথা থেকে এলে তোমরা!

“আসলে নিহা’র হাতে একটু চোট পেয়েছিল সেই জন্য ঔষধ লাগিয়ে নিয়ে এলাম।

“চোট! নিহা তখন তুমি ব্যাথা পেয়েছিলে তাহলে বললে না কেন।

“ভাইয়া এটা তেমন কোন ব্যাথা ছিল না আমি ঠিক আছি।

“কোন ব্যাথা, আর কিসের কথা বলছো তোমরা দুজন!

“তোকে বলছি আয়, আচ্ছা ভাইয়া আমি এখন যাই হুম!

“আচ্ছা যাও। কিন্তু একটা কথা আমার মনে রয়ে গেল।

“কি কথা!

“তোমরা সেই প্রিয় মানুষ! যার জন্য তুমি ঢাকায় এসেছিল। সে..

“আমি তার সাথেই আছি ভাইয়া। আপনি চিন্তা করবেন না।

“তাহলে কি তোমায় পড়াশোনা সে করাচ্ছে!

“জ্বি ভাইয়া!

“যাক তাহলে তো ভালো!

ভাইয়া কার কথা বলছে আমি বেশ বুঝতে পারছি কিন্তু ইতি হয়তো কিছুই বুঝতে পারছে না। সব ওর মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। সে হা করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি হেসে ইতি কে টেনে নিয়ে এলাম। সে তার প্রশ্নের ঝুড়ি নিয়ে বসল।‌ কোথায় দেখা হলো, কিভাবে দেখা হলো, কে সে প্রিয় মানুষ, কার কথা বলছে সব জানার আগ্রহে সে প্রায় অস্থির। অতঃপর আমি আমি ওকে শুধু আধটুকু বলে বললাম..

“বাকি টা কাল শুনাবো। আমার লেট হচ্ছে যেতে হবে!

“কিন্তু..
অতঃপর তার বাকি কথা শোনার প্রয়াস করলাম না। চলে এলাম কারন আমাকে এক্ষুনি পড়াতে যেতে হবে। আর যাদের পড়াবো তাদের বাসা আমার বাসা ক্রস করে যেতে হবে। তাই‌ এখন না গেলে দেরি হয়ে যাবে!
.
বাসায় আসতে আসতে দুপুর গড়িয়ে গেছে। অতঃপর দ্রুত বাসায় গিয়ে একটু রেস্ট নিয়ে খেয়ে নিলাম। তারপর আবার বের হলাম। ৩ টা টিউশনি করি আমি। আরেকটা খোঁজ করছি। পেলে ভালো হবে। তিনজনকে পড়িয়ে বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা নেমে যায়। আমার দিনগুলো এখন প্রতিনিয়ত এভাবেই কাটছে।‌

রিণু, তোহা আর তুহিন এই তিন জনকে পড়াই আমি। তিন জনেই ২০০০ টাকা করে দেয়। মাস শেষে পাই ৬ হাজার টাকা। দাদা আর দাদি আমার থেকে একটু কম ভাড়া রাখেন, তারা খুব ভালো মানুষ। আমার অসুবিধার কথা তারা জানেন। তারা আমার থেকে ৩০০০ টাকার বেশি নেন না। যেখানে মিতু আর মুন্নি আপু ৪ হাজার করে দেয়। এতে মুন্নি আপু বেশ রাগ। কারন আমি তাঁদের থেকে কম টাকা দেই। এটা তিনি মেনে নিতে রাজি নন।

বাড়ি ভাড়া দেবার পর বাকি টাকা ভার্সিটির বেতন আর নিজের খাওয়া দাওয়ার জন্য রাখতে হয়। দেখতে দেখতে চলে এলাম রিনু’র বাসায়। সে ক্লাস ফোরের ছাত্রী। তার মা বেশ রাগী টাইপের একজন মানুষ। আমি যখন আসি তখন’ই তিনি ঘড়ি দেখেন। মানে সময় হিসেব করেন যে আমি এক ঘন্টা পড়াই কি না। আবার ১০ মিনিট পর পর এসে একবার রুমের বাইরে এসে ঘুরে যান। ব্যাপার টা কেমন অদ্ভুত তাই না। হ্যাঁ আমার কাছে অদ্ভুত কিন্তু তার কাছে না। তার ধারনা তিনি আমাকে যথেষ্ট বেতন দেন। এরপরও কি আমি তার বাচ্চা কে পড়ানোর ক্ষেত্রে চোরামি করি কি না তিনি সেটা খেয়াল করেন।

তাকে পড়িয়ে পড়াতে যাই তোহা কে। তার মা আবার আরেক বিচিত্র মানুষ। তার মেয়েকে পড়ানোর বিষয়ে সে এতো মনোযোগ দেয় না অন্য সবার মতো। কিন্তু তোহা কে পড়ানোর পর টানা ১০ মিনিট তার সাথে বসে গল্প করতে হয়। যদিও আমি মানা করি তবুও সে মানতে চায় না। হাত ধরে তার পাশে বসিয়ে গল্প করতে শুরু করে। এর কারন ও আছে বটে, সেটা হলো তিনি প্রেগন্যান্ট! আর বাসায় মানুষ বলতে তিনি আর তার মেয়ে। বলতে গেলে নিজের একাকিত্ব টা কাটানোর জন্য’ই আমাকে নিয়ে গল্প করতে বসে পড়ে। তার সাথে চানাচুর, বিস্কুট আর এক কাপ চা। ব্যস আমাকে বসিয়ে বসিয়ে গল্প করা শুরু করে দেন।

অতঃপর বিকালের শেষ ভাগে পড়াতে যাই তুহিন কে। তুহিন সবচেয়ে দুষ্টু আর বেশ ছোট। ছোট বলেই দুষ্টুমি বেশি তার। তার মা আমার আরেক দুই স্টুডেনের মা থেকে আলাদা। আমি এলেই তিনি তুহিনের নামে একগাদা বিচার নিয়ে বসবে। বলবে..

“সারাদিন শুধু খেলাধুলা আর টিভি দেখা। একটু বই টা ছুঁয়েও দেখা না ম্যাম। আপনি আজ একটু বেশি করে বকে দেবেন ওকে।

তার কথায় আমি মাথা নাড়াই। অতঃপর সে চলে যাবার পর আমার স্টুডেন বলতে শুরু করে…

“ম্যাম আম্মু শুধু শুধু সব কিছু বানিয়ে বলছে। আমি আপনার সব পড়া পড়েছি।

“তাই নাকি। তাহলে তোমার আম্মু বিচার দিলো কেন?

“কি জানি। মনে হচ্ছে আম্মু কে চকলেট দিতে হবে। তাহলে আর বলবে না।

“ঘুস দেবে তুমি!

“এটাকে বুঝি ঘুস বলে।

“তোমাকে কেউ এমন ভাবে চকলেট দেয় বুঝি।

“হ্যাঁ আব্বু দেয়।

“কিহহ?

“হ্যাঁ তো সেদিন খাবার টেবিলে আব্বু তরকারি ফেলে দেয়। আমি সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখতে থাকি। আব্বু আমাকে দেখতে পেয়ে আদর করে বলে “তোমাকে কাল দুটো চকলেটের প্যাকেট দেবো। তুমি আম্মু কে কিছু বলো না ঠিক আছে!

“তা তুমি কি করলে!

“আমি খুব ভালো ছেলে, সবার কথা শুনি। তাই আম্মু কে কিছু বলেনি। এখন মনে হচ্ছে আব্বু কে বলতে হবে আরো ২ টো চকলেটের প্যাকেট বেশি আনতে যাতে আম্মু কে দিতে পারি। তাহলে আম্মু আর তোমাকে কিচ্ছু বলবে না। ভালো বুদ্ধি না বলো।

“হুম খুব ভালো বুদ্ধি এখন নাও পড়তে বসো!

বলেই আমি ফিক করে হেসে দিলাম। সে খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল। অতঃপর পড়তে লাগল। হয়ত ভাবছে আমি কেন হাসলাম। কিন্তু ও”তো আর জানে না প্রতিদিন এমন বিচিত্র মানুষের কান্ড দেখে আমি অবাক। কতোটা বিচিত্র এই মানুষ প্রকৃতি!

আগাম একটা করে বেশি পর্ব পড়তে চাইলে আমাকে ফ্লো করুন ✊?️

,

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here