ভালোবাসার ফোড়ন ২ পর্ব ১৩

0
937

#ভালোবাসার_ফোড়ন_২
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_১৩

আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছি, সময় মনে হল থমকে গেছে।‌‌ আমি কি ঠিক দেখছি! এটা কি বাস্তব না কোন দুঃস্বপ্ন! স্বপ্ন হলেই বেশি খুশি হবো আমি। আমার চোখের সামনে রক্তাক্ত অবস্থায় আহিয়ান পড়ে আছে গাড়ির ভেতর। আশপাশ মানুষের ভীড়ে দাঁড়ানোর জায়গা নেই কিন্তু কেউই তার কাছে যেতে চাইছে না। পুলিশ কেস হলে ফেঁসে যাবে তাই বলে কি একটা মানুষ কে এভাবে রেখে দেবে তারা। যদি কিছু হয়ে যায় তখন!

আমি আর না দাঁড়িয়ে সবাইকে সরিয়ে তার কাছে গেলাম। মাথা দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। হুশ নেই কোন! সামনেই একটা গাছ, মনে হচ্ছে গাছের সাথে গাড়ি টা খুব জোরে ধাক্কা খেয়েছে। তার শরীরে কিছু কাঁচ ও ঢুকে গেছে। আমি তাকে কয়েকবার ডাকলাম। কিন্তু তিনি সাড়া দিলেন না।

ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে তার মুখে ছিটে দিলাম। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। উনার জ্ঞান ফিরছে না। আশপাশের মানুষজন তাকিয়ে আছে আমার দিকে। হয়তো সবাই অবাক আমাকে এমন ভাবে ডেকে। আমি আরো কয়েকবার তাকে ডাকলাম।

“আহিয়ান! আহিয়ান!

একজন লোক বলে উঠে,
“আপনি চিনেন একে।

“জ্বি আমি চিনি উনাকে। একটু সাহায্য করুন না আমায় উনাকে হসপিটালে নিয়ে যাবো।

“অ্যাম্বুলেন্স কে কল করা হয়েছে। ওরা আসছে! আমি উনার জ্ঞান ফিরানোর চেষ্টা করুন!

আমি মাথা নেড়ে উনার মুখে পানি ছিটাতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর’ই অ্যাম্বুলেন্স চলে এলো। তাকে অ্যাম্বুলেন্স এ ঢোকানো হলো। আমিও তার সাথে গেলাম। মনে হলো একবার উনার জ্ঞান ফিরেছে। উনি আমার দিকে তাকালেন। আমি উনার হাত শক্ত করে ধরে বলি,

“কিছু হবে না ঠিক হয়ে যাবেন আপনি। জ্ঞান হারাবেন না আহিয়ান। আহিয়ান!

অতঃপর উনি আবারো জ্ঞান হারালেন। উনার হাত পা সব ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। খুব ভয় লাগছে এখন আমার। উনি অনেকবার আমাকে সাহায্য করেছেন! আর যখন আমার সময় এলো তখন কি আমি পারবো না।

উনার মুখে অক্সিজেন মাস্ক! গাড়ি চলছে দ্রুত গতিতে,আমি উনার হাত শক্ত করে ধরে বসে আছি। অতঃপর খানিকক্ষণ পরেই চলে এলাম হসপিটালে!

উনাকে অপারেশন থিয়েটারে রাখা হয়েছে‌। আমি বাইরে দাঁড়ানো। ভয়ে হাত পা সব ঠান্ডা হয়ে গেছে আমার। একবার ভাবলাম আকাশ ভাইয়া কে জানানো দরকার কিন্তু জানাবো কিভাবে? আমার কাছে না আছে ফোন আর না আছে তার নাম্বার।

ডাক্তার বের হলেন। বললেন,
“এখন ঠিক আছে তবে এক্সিডেন্ট টা ভয়ানক ছিল। অনেক রক্ত বের হয়ে গেছে। কপাল কেটে গেছে আর শরীরে কাঁচ ও ঢুকে গেছে। আপাতত এখন ঠিক আছে। ঘুমের ঔষধ দেওয়া হয়েছে আজকের দিনটা পুরোপুরি বেড রেস্ট এ থাকবেন তিনি।

“আপনাকে অনেক ধন্যবাদ! একবার দেখা করতে পারি উনার সঙ্গে!

“হুম পারেন।‌ কিন্তু আপনি কে? আহিয়ানের সাথে আপনার কিসের সম্পর্ক!

“আপনি চিনেন তাকে।

“হ্যাঁ চিনি।

“আমি উনার পরিচিত একজন তবে এতোটা না। আপনি যদি উনাকে চিনে থাকেন তাহলে দয়া করে উনার বাবা কে একটু ফোন করে উনার অবস্থা টা জানান। আমার কাছে তার নাম্বার নেই।

“আচ্ছা জানাচ্ছি। আহিয়ান কে শিফট করা হবে তারপর আপনি দেখা করতে পারেন তবে বেশিক্ষণ না।

“জ্বি ধন্যবাদ!

অতঃপর আহিয়ান কে কেবিনে শিফট করা হলো। আমি উনার কেবিনে গেলাম। ঘুমিয়ে আছেন তিনি, শরীরে বিভিন্ন জায়গায় ব্যান্ডেজ করা। অক্সিজেন মাস্ক টা এখন আর নেই। যাই হোক আমি কিছুক্ষণ উনার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।‌ একটা নার্স এসে আমাকে উনার ফোন আর মানিব্যাগ টা দিয়ে গেলেন। ভাবলাম আকাশ ভাইয়া কে কল করবো।

কিন্তু উনার ফোন টা লক করা। এখন কি করবো? হুট করেই ফোনে রিং হলো। ফোনের স্ক্রিনে আকাশ নামটা ভেসে উঠলো। আমি চট করে রিসিভ করে নিলাম কলটা,

“হ্যালো আকাশ ভাইয়া!

“কে?

“ভাইয়া আমি নিহা!

“নিহা তুমি! তোমার কাছে আহিয়ান’র ফোন কিভাবে?

“ভাইয়া আপনি আমার কথা শুনুন!

অতঃপর ভাইয়া কে সব বললাম। এটাও বললাম এক্ষুনি হসপিটালে চলে আসার জন্য। ভাইয়া বলল সে আসছে। অতঃপর তার ফোন আমি রেখে দিলাম।

ফোনটা রাখার পর’ই আবারো রিং হলো। এবার দেখি স্ক্রিনে আপু নামটা ভেসে উঠলো। আমি প্রথম ভাবলাম ধরবো না কিন্তু পরে ভাবলাম হয়তো তারা আহিয়ানের এক্সিডেন্ট’র খবর পেয়ে ফোন করছে। তাই রিসিভ করে নিলাম কল টা,

“হ্যালো!

“হ্যালো! কে তুমি! আহি কোথায় ওকে দাও। আর তুমি কে?

“আপু আহিয়ান এখন ঠিক আছে। ডাক্তার তাকে ঘুমের ঔষধ দিয়ে দিয়েছেন তিনি ঘুমাচ্ছে। তোমরা চলে এসো হসপিটালে।

“আচ্ছা আসছি এক্ষুনি!

অতঃপর সেখান থেকে কল টা কেটে গেল। মনে হলো সে গাড়িতে, আশপাশ থেকে অনেক আওয়াজ আসছে। নাকি নিজেই গাড়ি চালাচ্ছে যার কারনে চট করেই কল টা কেটে দিল।

আমি উনার ফোনটা উনার পাশে টেবিলে রেখে দিলাম। অতঃপর বাইরে এসে দাঁড়ালাম। চলে যাবো কি না তাদের জন্য দাঁড়াব বুঝতে পারছি না। যদিও তার ফ্যামিলির কাউকে চিনবো না কিন্তু আকাশ ভাইয়া কে তো চিনবো। একা একটা রোগী কে এভাবে রেখে যাওয়া ঠিক হবে না। তাই বাইরে এসে বসে পড়লাম।
.
কিছুক্ষণ বসে থাকার পর সামনে তাকিয়ে দেখলাম নিতি দৌড়ে আসছে। তার পিছন পিছন নাহান,‌আনাফ, টিনা! আমি উঠে দাঁড়ালাম। নিতি এসে আমার সামনেই দাঁড়াল। খুব রেগে আছে মনে হচ্ছে। আমি বলে উঠি,

“আপু আহি…

বলার আগেই চুপ হয়ে গেলাম। গালে হাত দিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি আমি। আশপাশের লোকজন সবার নজর এখন আমার দিকে। আমি চোখ বন্ধ করে নিলাম। নিতি বলে উঠে,

“সাহস হলো কিভাবে তোমার,আহির কাছে কেন তুমি!
তোমাকে তো আমি আজ!

বলেই আমার দিকে আগাতে যাবে, তখন পিছন থেকে নাহান এসে তার ধরে বলে,

“নিতি শান্ত হ,‌এটা হসপিটাল!

“নাহান!

“নিতি চুপ!

“ওকে ডান ছাড় আমায়।

অতঃপর নাহান নিতি কে ছেড়ে দেয়। নিতি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমার দিকে তাকিয়ে বলে,
“তোমাকে পরে দেখে নিচ্ছি আমি!

বলেই আমাকে একটা ধাক্কা দিয়ে কেবিনে চলে গেল। আমি গালে হাত দিয়ে আশপাশ তাকিয়ে দেখি সবাই এখনো আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আর দাঁড়ালাম না সেখানে। দৌড়ে বেরিয়ে এলাম। বেরিয়ে আশার সময় আকাশ ভাইয়া’র সাথে ধাক্কা খেলাম। তিনি আমায় ডাকলেন তবুও আমি পিছনে ফিরে তাকালাম না। আকাশ ভাইয়ারা সাথে আরো কেউ ছিল বলে মনে হলো। যাই হোক তাতে আমার কি! আমার কাজ ছিল উনাকে সাহায্য করা করে দিয়েছি। আর কি?

তবু মন মানছে না। চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পরল। আমি উড়না দিয়ে সেটা মুছে সামনে হাঁটা ধরলাম। মন কে বোঝালাম,

“তার প্রিয় মানুষটি অসুস্থ, আর সেই রাগ’টা সে আমার উপর ঝাড়লো। সে তো আর জানে না কি হয়েছে!

এসব ভেবে বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে সামনে হাঁটা ধরলাম। কিন্তু গাল টা খুব জ্বলছে এখনো। ইশ খুব জোরে মেরেছে আমাকে। সবাই অবাক ছিল কেউই বুঝতে পারি নি আপু এমন কিছু একটা করবে। বুঝতে পারলে হয়তো আটকাতো। হুম নাহান ভাইয়া তো আটকালো। সেও বেশ অবাক ছিল কিন্তু এরপর.. এরপর কি হবে।
.
বাসায় এসে গোসল করে বিছানায় বসে রইলাম। আজ আমার দুবার গোসল করতে হলো। যাই হোক চুল গুলো খুব ভিজে। পানি পড়ছে টপটপ করে। আমি বিছানা থেকে উঠে ভিজে কাপড় নিয়ে রওনা হলাম ছাদে। শুকাতে দিবো এগুলো!

সন্ধ্যায় বাসায় আসার পর চিরচেনা মুখটা দেখে বেশ অবাক হলাম। তাকে অবশ্য আমি আশা করি নি এখানে। আমাকে দেখে একটা মুচকি হেসে বলল,

“অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম!

“কখন আসলি ইতি!

“বেশ অনেকক্ষণ! এতো রাত করে বাসায় আসিস তুই জানতাম না তো!

“এতো রাত কোথায়! আয় ভেতরে আয়।

অতঃপর দরজা খুলে ইতি কে ভেতরে বসতে বললাম। ইতি ভেতরে বসে বলল,

“এখানে থাকিস তুই!

“হুম এখানেই। তা তুই আজ এখানে হঠাৎ!

“ভার্সিটিতে আজ আসলি না তাই এলাম।

“তাই বলে এখন!

“আরে শোন তো, ভেবেছিলাম খেয়ে দেয়ে আসবো। তো কি হলো আমি খেয়ে টেয়ে দিলাম এক ঘুম। এরপর চোখ খুলে দেখি বিকেল হয়ে গেছে। হায়রে কি যে একটা অবস্থা কি বলবো।

“ভালো! তা চা খাবি!

“না তুই বস গল্প করবো।

“আচ্ছা তুই দুটো মিনিট বস আমি একটা চা পাতি কিনে আনি।

“আরে নিহা শোন তো!

“তুই বস!

অতঃপর বেরিয়ে গেলাম, একটা চা পাতি আর বিস্কিট নিয়ে এলাম। চুলোয় গরম পানি বসিয়ে ইতি সাথে দাঁড়িয়ে গল্প করতে লাগলাম। অতঃপর চা বানিয়ে ইতি কে দিলাম,

“নে রং চা খা!

“এটা বেস্ট নাহলে আমি কালো হয়ে যাবো।

“ওরে সুন্দরী!

“বিস্কিট আনার কোন দরকার ছিল না।

“ছিল তুই বুঝবি না। এখন বল কি বলবি।

“শোন!
বলেই সে তার ব্যাগ থেকে দুটো বই বের করে আমায় দিল।

“এগুলো কি?

“বই! সামনে পরিক্ষা আমি জানি তোর বই লাগবে তাই নিয়ে এলাম।

“কোন দরকার ছিল না ইতি।

“ছিল। বাপি কে বলে দু সেট আনিয়েছি। একটা তোর জন্য আরেকটা আমার।

“ইতি আমি..

“এটা দয়া না নিহা, বন্ধুত্ব! বুঝলি।

“ঋণী করে দিলি তো।

“সুদে আসলে নিবো, আচ্ছা টাকার ব্যাপারে চিন্তা করিস না। আমি..

“না ইতি। আমি জোগাড় করেই রেখেছি আর না।

“আচ্ছা সেটা রেখে দে না। আংকেল’র চিকিৎসা’র জন্য কিছুটা হলেও তো হবে।

“না।‌ সেটার ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

“কিভাবে হবে, সারাদিন ধরে কি তুই কাজ করবি শুধু।

“করলে করলাম কি হবে বল।

“তুই কেন কথা শুনতে চাস না বলতো।

“ভালো লাগে না তাই।

“ভার্সিটিতে এলি না কেন?

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলি,
“ভাবছি কয়েকদিন যাবো না।

“কি কেনো?

“বাসায় বসে পড়বো, তাই!

“তুই না গেলে আমিও যাবো না। একটা কাজ করবো আমিও তোর বাসায় এসে পড়বো। দুজনে একসাথে পড়বো।

“আচ্ছা আসিস!

“আচ্ছা তাহলে এখন চলি রে, নাহলে খুব দেরি হয়ে যাবে।

“সাবধানে যাস কেমন!

“হুম!

অতঃপর ইতি চলে গেল। আমি খানিকক্ষণ ঠাই বসে রইলাম।কিছুই ভালো লাগছে না করতে। ইতি কে বললাম না আসল ব্যাপারটা! এড়িয়ে গেলাম, আচ্ছা কি বলতাম আমি। বলার মতো কি কিছু ছিল!

৩ দিন কেটে গেলো, ভার্সিটিতে যাই না। সকালে ইতি এলে ছাদে বসে দুজনে পড়ি। কিছুক্ষণ দাদু ভাই আর দাদি’র সাথে গল্প করি অতঃপর দুপুর হলে পড়াতে যাই। এভাবেই কেঁটে যাচ্ছে। আচ্ছা ভার্সিটিতে না যাবার কারন কি হতে পারে, নিতির মুখোমুখি! হ্যাঁ ঠিক তাই। আমি চাই না ওর মুখোমুখি হতে, অপমানিত হতে।

আচ্ছা আহিয়ান কি সব জানে, জানলেই বা কি? ও কি করবে! একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তাকিয়ে রইলাম আকাশের দিকে। চাঁদ টা কে আজ বেশ উজ্জ্বল দেখাচ্ছে, বেশ মিষ্টি লাগছে তাকে দেখতে। আকাশের বুকে যেন মা আর বাবা’র প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠলো। আমার মন টা কেঁদে উঠলো। খুব ইচ্ছে করছে তাদের সাথে কথা বলতে,‌খুব ইচ্ছে করছে তাদের দেখতে। কিন্তু আমি যে অসহায়!

বাসায় এসে সিঁড়ি তে উঠতে না উঠতেই দাদি দৌড়ে এলো আমার কাছে। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। কিছু হলো নাকি! দাদি’র মুখে চোখে কেমন একটা অস্থিরতা। অতঃপর দাদি আমাকে বললেন,

“একজন এসেছে তোর জন্য, অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে!

ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম,
“কে সে ?

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here