ভালোবাসার ফোড়ন ২ পর্ব ১১

0
988

#ভালোবাসার_ফোড়ন_২
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_১১

সকালে ফুটপাতের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি আর আশপাশের মানুষজন কে দেখছি। কেউ হয়তো অনেকটা অসহায় অন্যদিকে অনেকের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে বেশ বড়লোক! এটাই তাদের মাঝে ভিন্নতা। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি পাখি গুলো মুক্ত ডানা মেলে আকাশে ঘুরছে। ইশ যদি তাদের মতো মুক্ত আকাশে উড়ার স্বাধীনতা টা পেতাম। কিন্তু মূহুর্তে’ই হতাশ হয়ে গেলাম, কারন ছিল গতকালের ঘটনা। এখনো তা ভাবলে শরীর শিউরে উঠছে আমার। শুধু ভাবছি আহিয়ান না থাকলে কি হতো আমার!

এই যুগে মেয়েদের একা থাকার অনুমতি তো আছে তবে এই একা থেকে বেঁচে থাকাটাই যে কষ্টসাধ্য। একা একটা মেয়েকে পেলে কেউই এই সুযোগ হাত ছাড়া করতে চায় না, মনুষ্যত্ব বোধ কমে যাচ্ছে সবার মাঝে।
আচ্ছা আজ কি হবে, ছেলে গুলো তো আবার আসবে আজ। গতকাল আহিয়ান বাঁচিয়েছিল কিন্তু আজ কে বাঁচাবে আমায়। ভাবতে গিয়ে শরীর আবারো শিউরে উঠছে। ভয় করছে খুব। এখানে এই খোলামেলা আকাশের নিচে হাঁটতেও এখন ভয় করছে আমার।

ভার্সিটির ক্যাম্পাসে একটা গাছের তলায় বসে আছি আমি। গাছটির চারপাশে ইট আর সিমেন্ট দিয়ে ঘেরাও করা। অনেকটা উঁচু সেটা। আমি সেখানেই এক কোনে হাত পা গুটিয়ে বসে আছি আমি। ইতি এখনো আসি নি, আজ কি আসবে না সে। একা একা এখানে কি করবো আমি। ব্যাগ টা শক্ত করে ধরে মাথা নিচু করে বসে আছি। হঠাৎ মনে হলো কেউ এসে দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে। আমি মাথা উঁচু করে তাকিয়ে দেখি আকাশ ভাইয়া। একটা মৃদু হাসি দিয়ে আমাকে স্বাগত জানাল সে।

আমি তাকে দেখে হাসার চেষ্টা করলাম। তিনি হেসে বললেন,
“একা বসে আছো যে!

“এভাবেই!

“ইতি’র জন্য অপেক্ষা করছো নাকি।

“হুম। আমার বান্ধবী বলতে তো একমাত্র সেইই।

“বসবো এখানে।

“হ্যাঁ বসুন।

তিনি বসলেন আমার পাশে। অতঃপর দুজনেই মিলেই কিছুক্ষণ গল্প করলাম। গল্প গুলো আমাদের কারোর ব্যাপারে ছিল না। ছিল কিছুটা সামাজিক কথাবার্তা। বলতে হবে একজন চমৎকার মানুষ কিন্তু তিনি। খুব সহজেই মিশে যান সবার সাথে। আমার সাথেও ব্যতীক্রম হলো না। প্রায় অনেকক্ষণ কথা বললাম তখন ইতি চলে এলো। অতঃপর তিন মিলে খানিকক্ষণ আড্ডা দিলাম। এর মাঝেই ভার্সিটিতে একসাথে ৩ টা গাড়ি ঢুকল। একটা নিতি’র , আরেকটা আহিয়ান’র বন্ধু নাহানের আরেকটা আহিয়ানের! এই টা কালকের সেই গাড়ি। তাদের দেখে আকাশ ভাইয়া উঠে গেলেন তাদের কাছে। আমি হেসে তার থেকে মুখ সরিয়ে ইতি’র দিকে তাকিয়ে বলি,

“আকাশ ভাইয়া খুব ভালো একজন মানুষ নাহ বল।

“( নিশ্চুপ )

আমি ওর মুখের দিকে ভালো মতো তাকালাম। দেখি ওর চোখ আহিয়ান’র দের সব বন্ধুদের উপর। তারা সবাই গাড়ির উপর বসে আড্ডা দিচ্ছে। কিন্তু ইতি এক ধ্যানে কি দেখছে তাদের দিকে। আমি আরো ভালো মতো তাকালাম। দেখি ইতি’র চোখ সবার উপর না আকাশ ভাইয়া’র উপর। হঠাৎ চোখে চোখ পড়ল আমার আর আহিয়ানের। আহিয়ান চোখ সরিয়ে নিল। আমি চোখ সরিয়ে নিতে যাবো তখন’ই নিতির চোখে চোখ পড়ল। দেখেই মনে হচ্ছে বেশ রেগে আছে সে। আমি মূহুর্তে’ই সেখান থেকে মুখ ঘুরিয়ে ইতি’র কে খোঁচা দিলাম।

“আহ! কি হইছে?

“আমি তো এটাই জিজ্ঞেস করছি। কি হইছে!

“মানে

“কি ওখানে। এতো মনোযোগ দিয়ে কি দেখছিস ওখানে।

“কককই কিছু না।

“আচ্ছা

“হুম। চল ক্লাসে যাই!

বলেই আমাকে ধরে নিয়ে গেল। বেশ বুঝলাম সে কিছু লুকাচ্ছে আমার কাছ থেকে। বিষয়টা কি নিয়ে হতে পারে,আকাশ ভাইয়া! হ্যাঁ ইদানিং দেখছি আকাশ ভাইয়া’র সামনে ওর হাবভাব পরিবর্তন হচ্ছে। ব্যাপারটা কি জানতে হবে।
.
রিনু,‌ তোহা আর তুহিন কে পড়িয়ে রওনা হলাম অর্ণ কে পড়াতে। যত’ই আগাচ্ছি তত’ই গতকালের কালো অতীত আমাকে তাড়া করতে লাগলো। হাত পা রীতিমতো এখন’ই কাঁপছে আমার। বেশ ভুল করেছি আমি এখানে এসে কেবল এটাই মনে হচ্ছে। আসা টা একদম উচিত হয় নি। কিন্তু না এসে’ই বা উপায় কি? এটা নতুন টিউশনি, এখন ঠিকমতো না পড়ালে যে হাতছাড়া হয়ে যাবে। সহজে আর টিউশনি পাবো বলে মনে হচ্ছে না আমার।

অর্ণ বাসায় আসবার সময় সেই ছেলে গুলো কে দেখতে পেলাম না। মন টা শান্ত হলো কিন্তু ভয় কাটলো না। এমন’ও তো হতে পারে ওরা রাতে আসবে। হয়তো জানে না আমি কখন আসবো এখনে। গতকাল যেই সময়ে আমাকে দেখেছে আজও ঠিক সেই সময়ে আমাকে পাবে, এমনটাই হয়তো ভেবে রেখেছে তারা। কিন্তু সব কথার আগে হয়তো কথাটা জুড়ে দিয়ে নিজেকে বিপাকে ফেলে দিলাম। আমি যা ভাবছি তা যে হবে এমন না আবার এর চেয়ে ভয়ানক কিছুও হতে পারে। মানুষের ভাবনা বোঝা বড় মুশকিল।

অর্ণ কে পড়িয়ে বের হবার আগে তার মা কে বললাম আমাকে যেন একটু এগিয়ে দিয়ে যায়। এখানকার রাস্তা বেশ অন্ধকার। আমার খুব ভয় করে।

আমি ভেবেছিলাম হয়তো তিনি না করবেন। কিন্তু তা না! তিনি মুচকি হেসে বললেন,
“তুমি বসো আমি বোরকা টা পড়ে আসছি!

অতঃপর সেই আমাকে নিয়ে বের হলো। যাক হাফ ছেড়ে কিছুটা হলেও বাঁচলাম। গতকালের মতো আজও রাস্তা বেশ অন্ধকার। খুব ভয় করছে, যদিও অর্ণ’র মা আজ আমার সাথে তবুও ভয় করছে। কারনটা কি হতে পারে গতকালের ঘটনার জন্য। হ্যাঁ সেটাই, গতকালের ঘটনা খুব প্রভাব ফেলেছে আমার উপর।

“নিহা রাস্তাটা বেশ অন্ধকার নাহ ‌

“জ্বি!

“তোমার বুঝি অনেক ভয় করে এভাবে রাতের বেলা একা একা আসতে।

“আপনার কি করছে

“হ্যাঁ তা তো করছে। আসলে কি বলোতো বাসা থেকে তেমন একটা বের হই না তো আর এই রাস্তাটাও তেমন একটা আসা হয় না তাই।

“ওহ আচ্ছা।

“তুমি বরং একটা কাজ করো, কাল থেকে দুপুরে এসে ওকে পড়িয়ে যেও। একা মেয়ে এতো রাতে করে আসাটা ঠিক না।

“আচ্ছা!

যাক একটা কাজ তো ভালো হলো। তাকে নিয়ে আসা টা বোধহয় আমার’ই লাভ হয়েছে। আমি তাকে আনবার সময় এতো কিছু ভাবে নি তবুও যা হয় ভালোর জন্যই হয়।
আজকে আর ওই ছেলে গুলো দেখতে পাচ্ছি না তবে দূরে কিছু লোক দেখতে পাচ্ছি। তারা ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ কেউ বলাবলি করছে, “একজন এসে নাকি কয়েকটা ছেলে কে উরাধুরা মেরেছে। ছেলে গুলোর অবস্থা বেহাল। রক্তারক্তি কান্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে পুরো। মেরে এখানেই ফেলে রেখে গেছে। একজন নাকি অ্যাম্বুলেন্স কে কল করেছে এসে পড়বে।”

বলতে বলতে অ্যাম্বুলেন্স এসেও পড়ল। বাকি জনগনের মতো আমি আর অর্ণ’র মাও আগ্রহ নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি তাদের অবস্থা দেখার জন্য। অনেক ভিড় তবুও আমি একটু উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করছি। আর যা দেখলাম তাতে আমার চক্ষু চড়কগাছ! এই তো গতকালের সেই ছেলেটার মাঝে একজন। যদি সে এখানে থাকে তার মানে তার সাথে থাকা ছেলে গুলোও এখানে আর তাদের অবস্থা এই ছেলেটার মতোই।

ছেলেটার অবস্থা আসলেই অনেক খারাপ। হাত পা বিভিন্ন অংশ থেকে রক্ত পড়ছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। লোকজন বলাবলি করছে, “ছেলে গুলো নাকি সবসময় এখানে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে বেড়ায়। হয়তো এদের মাঝেই কেউই এই অবস্থা করেছে। একটা লোকের কথা তখন আমার কানে এলো। কথাটা এমন ছিল,

“ব্যাটাদের সাথে যা হয়েছে একদম ঠিক হয়েছে। আল্লাহ উচিত বিচার করেছে। ওদের জন্য এখানে বউ বাচ্চা নিয়ে থাকাই মুশকিল। শালারা রাত বেরাতে মদ খেয়ে মাতলামি করতে থাকে। বেশ হয়েছে এখন বুঝুক। দুদিন হাসপাতালে পড়ে থাকলে সব তেজ বের হয়ে যাবে। অতঃপর একটা বিচ্ছিরি গালি দিল তাদের উদ্দেশ্যে। লোকটার কথা বার্তা দ্বারা মনে হচ্ছে ছেলেগুলোর এই অবস্থা হওয়ায় সেই ই বেশি খুশি। যে এই কাজটা করেছে তাকে পেলে হয়তো অনেক কিছু বলতেন।

আমরা আর দাঁড়ালাম না। দুজনেই হাঁটতে শুরু করলাম। অর্ণ’র মা এসব ঘটনা দেখার পর আমাকে মসজিদ অবদি এগিয়ে দিয়ে গেলেন আর আবারো বলে গেলেন কাল থেকে যেন দুপুরে পড়াতে যাই।
আমি মসজিদ থেকে একা একা আসছি আর হাসছি। যদিও ওদের এই অবস্থা দেখে বেশ মায়া লাগছিল কিন্তু সেই লোকটার কথা মনে পড়তেই হাসি চলে আসছে। কিন্তু ছেলে গুলোর এই হাল করলো কে?

আমি কিছুদূর এগুতেই দেখি আহিয়ান’র গাড়ি। উনার গাড়ি থেকে খানিকটা চমকে উঠি। এখানে উনার গাড়ি কি করছে। আমি গাড়িটার কাছে আসতেই গাড়ি টা চলতে শুরু করল। হঠাৎ এমনটা হওয়ায় বেশ ভয় পেয়ে গেলাম। দ্রুত দূরে সরে গেলাম। দেখছি গাড়ি টা নিজ গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। তার মানে গাড়িতে কেউ আছে,‌নিশ্চয়ই আহিয়ান। কিন্তু উনি এখানে কি করছে। গাড়িটা ওই রাস্তা দিয়ে এই এলাকায় এসেছে। কারন আমি সেখান থেকে এসেছি সেখান দিয়ে গাড়ি আসা সম্ভব না তাহলে ওই রাস্তা দিয়েই এসেছে। কিন্তু এসেছিল কেন? আমার জন্য! কিন্তু তা কি করে হয়। আমার জন্য এতোটা কেন করবেন উনি। আর যদি আসেও তাহলে বলতে হবে উনার স্মৃতি শক্তি বেশ ভালো নাহলে এক দেখাতেই এখানে আসতে পারতেন না তাও গাড়ি নিয়ে।

সিঁড়ি দিয়ে চড়ছি আর ভাবছি উনার এখানে আসবার কারন কি? আচ্ছা আমার ভাবনা টা ঠিক, আমার জন্য এসেছে এখানে। এটা তো নাও হতে পারে হয়তো অন্য কারনে এসেছেন। কিন্তু ছেলে গুলোকে মারল কে। দুইয়ে দুইয়ে চার করছি তবে পুরোটাই আন্দাজে। আমার জন্য তাদের মোটেও মারতে যাবেন না উনি। এতোটা ভালো সম্পর্ক নেই তার সাথে আমার। তাহলে… নাহ কাল’ই ভার্সিটিতে গিয়ে উনাকে জিজ্ঞেস করতে হবে।

ভাবতে ভাবতে সিঁড়ি বেয়ে উঠছি তখন হঠাৎ বাইকের আওয়াজ পেলাম। বাড়ির সামনেই থামল বলে মনে হলো। আমি সিঁড়ি ওখান থেকে উঁকি মেরে দেখলাম। দেখি মুন্নি আপু আর একটা ছেলে। সে ছেলের বাইক থেকে নামছে। সে আসতে নিলেই হুট করে ছেলেটা তার হাত ধরে টেনে তার কাছে টানল। এতো টুকু দেখার পর’ই আমি চোখ বন্ধ করে ঘুরে গেলাম। ব্যাপারটা বেশ লজ্জা জনক! খোলা রাস্তায় এসব একদম ঠিক না। মানুষ জন দেখলে কি বলবে। যদিও এই রাস্তাটা খুব নিরব তবুও কথাটা এতো জোর দিয়ে বলা চলে না। এই এলাকা টা বেশ ভদ্র এলাকা।
.
ভার্সিটিতে আসার পর পর’ই অপেক্ষা করছি আহিয়ানের। গতকাল সারা রাত আমার ঘুম হয় নি। সারারাত শুধু তার কথাই ভেবে গেলাম। ওখানে যা কিছু হলো এখানে হাত টা কি তার কি না জানার জন্য আমি বেশ অস্থির হয়ে গেছি।
খানিকক্ষণ পরেই আহিয়ান আসলো। আমি আর ইতি দূরে গাছের আড়াল থেকে তাকে দেখছি। ইতি বেশ কিছুক্ষণ পর পর”ই আমাকে খোঁচা দিচ্ছে, কি করছি এখানে আমরা,এভাবে কেন দাঁড়িয়ে আছি ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক প্রশ্ন। আমি ওকে একটা ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিলাম। অতঃপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আহিয়ান’র দিকে তাকালাম। পর্যবেক্ষন করতে লাগলাম তাকে। অতঃপর…

#চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here