বেলা_শেষে_শুধু_তুমি পর্ব ২৬

0
1231

বেলা_শেষে_শুধু_তুমি পর্ব ২৬
#আনিশা_সাবিহা

শুনশান রাত। পিনপিনে নিরবতা। শাপলা ফুলের বিলের মাঝে দুটো নৌকা বহমান। বিলের ওপর জ্বলছে জোনাকিপোকা। রাত হলেই তাদের মেলা বসে। প্রথম নৌকাতে অনিন্দিতা সহ সকলে রয়েছে। আর দ্বিতীয় নৌকাতে শুধু ঐশানী ও অভয় রয়েছে। গ্রামের পরিবেশে সন্ধ্যার পরেই সবটা নিরব হয়ে যায়। এখানেও তার ব্যতিক্রম না। কালকেই আবার সবাই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেবে। বাসের টিকেট কাটা হয়েছে। ঐশানীর তো মোটেও যাওয়ার ইচ্ছে নেই। গ্রামটা এখনো ভালো করে ঘুরেই দেখা হয়নি। তাই গাল ফুলিয়ে বিলের পানিতে পা ডুবিয়ে বসে আছে সে। অন্য নৌকাটি বেশ এগিয়ে। সেই নৌকার একেবারে কিনারায় পানিতে পা ডুবিয়ে বসেছে অনিন্দিতা। পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দটা বেশ মুগ্ধ করছে অনিন্দিতাকে তবে তার মুখটা বেশ শুকনো। সবাই যে কতশত গল্প জুড়েছে সেসবে তার খেয়ালও নেই।

পেছন থেকে কেউ অনিন্দিতার কাঁধে হঠাৎ করেই হাত রেখে জোরে চিৎকার দিয়ে, ‘ভাউউউউ’ বলে ওঠে। আচমকা এই ঘটনায় ভয়ের সঙ্গে পানির নিচে পড়ে যেতে নেয় অনিন্দিতা। পেছনে থাকা ব্যক্তিটি কাঁধ ধরে বাঁচিয়ে নেয়।
–“ছাগল ছানার মতো মুখ করে বসে আছিস কেন? আর একটু হলেই তো পরে যেতিস।”
ইশানের কন্ঠেই অনিন্দিতা তাকে চিনে ফেলে। ইশানের দিকে না তাকিয়েই অনিন্দিতা বেশ গাম্ভীর্যের সঙ্গে উত্তর দেয়…..
–“পড়লে তো তোমার জন্যই পড়তাম।”
–“পা ডুবিয়ে বসে আছিস কেন পানিতে? এখানে কতরকম সাপ থাকে জানিস?”
–“তো? কামড়ালে কামড়ে দেবে। তাতে কার কি যায় আসে ইশান ভাইয়া?”

–“বলিস কি? তুই তো একমাত্র ছাগল ছানা। তোকে হারালে কষ্ট হবে না?”
অনিন্দিতার পাশে বসতে বসতে বলে ইশান। অনিন্দিতার বিশেষ কোনো হেলদোল হয় না। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বসে থাকে সে। ইশান তা দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। হঠাৎ মেয়েটার এমন পরিবর্তন হলো কেন? ও তো কোনোদিন হাসি ছাড়া থাকে না। সবাইকে যে মেয়ে হাসিতে মাতিয়ে রাখে তার মনই আজ খারাপ? কৌতুহল বশত ইশান অনিন্দিতাকে একটু ধাক্কা দিয়ে বলে…..
–“কি হয়েছে তোর? এমন রামগরুড়ের ছানার মতো মুখ করে আছিস কেন?”
–“কিছু না। কি হবে আমার?”
ইশান জোড়াজুড়ি করে বলে……
–“আরে বল না!”
–“জোর করবে না। আমি বলতে চাই না। আমার কথা বলতে ভালো লাগছে না। তুমি চুপ থাকতে পারলে এখানে থাকো নয়ত যাও।”
ইশান চুপ হয়ে বসে থাকে আকাশ পানে তাকিয়ে।

নৌকা বেশ ধীর বেগে দুলছে। আগের নৌকা কত এগিয়ে! তা দেখে ঐশানী আদেশের সুরে বলল…..
–“আপনার গায়ে জোর নেই? খুব তো অন্য সময় গায়ের জোর দেখান। এখন কি হলো? দ্রুত নৌকার বৈঠা বাইতে পারেন না?”
অভয় আগের মতোই ধীরে ধীরে বৈঠা বাইতে বাইতে বলল…..
–“আমরা এখানে কম্পিটিশন করতে আসিনি। যদি দ্রুত যাওয়ার থাকে তাহলে এই নাও ধরো। তুমি নৌকার বৈঠা নাও।”
ঐশানী ভেংচি কেটে পানি থেকে একবার পা তোলে আর নামায়। তার হাতে কয়েকটা শাপলা ফুল। অভয় তাকে তুলে দিয়েছে। তার বেশ ভালো লেগেছে।

অভয় মাঝে মাঝে বৈঠা বাইছে আর নিজের দৃষ্টি স্থির করে রাখছে ঐশানীর দিকে। আজ পূর্ণিমা। আকাশে গোল থালার মতো চাঁদ। চারিদিকে চাঁদ ও জোনাকি পোকার আলোয় আলোকিত। সেই আলোতে এক অন্য রকম ঐশানীকে আবিষ্কার করেছে অভয়। চোখ যেন মেয়েটার থেকে সরানো দায়।
ঐশানী তার পাশে থাকা গিটারে হঠাৎই হাত বোলালো। আনমনে প্রশ্ন করে উঠল…..
–“নৌকার মাঝে গিটার দিয়ে কি হবে?”
–“গিটার দিয়ে নিশ্চয় নৌকা চলবে না! গিটার দিয়ে যা হয় তাই হবে। ইশান আমাকে গিটার ধরিয়ে দিয়েছে। এর চেয়ে বেশি কিছু জানি না।”
–“আপনি গিটার বাজাতে পারেন?”
অভয় বৈঠা রেখে এসে ঐশানীর সোজাসুজি বসে পড়ে। গিটারে হাত দিয়ে উত্তর দেয়…..
–“একটুআধটু পারি। ইশান পারে তো তাই তার থেকেই শেখা।”

–“ওহ।”
ছোট্ট করে কথাটি বলেই গালে হাত দিয়ে বসে থাকা ঐশানী। তা দেখে অভয় গিটার হাতে তুলে বলে….
–“চারিদিকে পূর্ণিমার আলো। তবে বউটার মনে যেন অমাবস্যার অন্ধকার।”
ঐশানী চমকে উঠে তাকায়। পলকহীন চোখে তাকিয়েই থাকে অভয়ের দিকে। তা লক্ষ্য করে অভয় টুংটাং গিটারে সুর তুলতে ব্যস্ত হয়ে বলে….
–“উমম….মনে হচ্ছে আমি এমন কিছু বলে ফেলেছি যেটাতে ম্যাজিকের মতো আমার সৌন্দর্য একেবারে সোনার মতো চকচক করছে। নয়ত এভাবে তাকিয়ে থাকার মতো মেয়ে তো তুমি নও!”
ঐশানী অভয়ের দিকে গভীর মনোযোগ দিয়ে অস্ফুটস্বরে বলে…..
–“বউ….!”

অভয় সরু চোখে তাকায়। তারপর এগিয়ে বসে চুপিচুপি প্রশ্ন করে……
–“বউ ম্যাজিক্যাল ওয়ার্ড?”
ঘোর থেকে বেরিয়ে আসে ঐশানী। অপ্রস্তুত হয়ে বলে….
–“জানি না।”
ঐশানীর কাছে ‘বউ’ শব্দটি ম্যাজিকাল। তবুও সে স্বীকার করল না। সে যে বড়ই অবাধ্য। সে নিজের মনের অবাধ্য। মন যা চাইছে সেটা তার মস্তিষ্ক চাইছে না। এর আগেরবার যখন সে বিয়ের পরের দিন রিসেপশনে বউ শব্দটি শুনেছিল সে একই ভাবে সম্মোহিত হয়েছিল। সে বুঝতে পারে না আসলে ‘বউ’ শব্দটা তাকে সম্মোহিত করে? নাকি বউ শব্দটি বলা মানুষটার কন্ঠ তাকে সম্মোহিত করে? না বুঝতে পেরে হাল ছেড়ে দেয় ঐশানী। কিছু কিছু জিনিস বোঝার ক্ষমতার বাইরেও থাকা উচিত।

অভয় আস্তে আস্তে গিটারে একটা গানের সুর তুলে চলেছে। সে গান গায় না। বলা বাহুল্য সেভাবে কখনো কারোর জন্য গান গায়নি বললেই চলে। তবে আজ বড্ড ইচ্ছে জেগেছে তার প্রেয়সীর উদ্দেশ্যে গান গাইতে। হালকা কেশে গিটারে সুর তুলে অভয় গাইতে লাগল…..
–“হয়ত তোমারি জন্য
হয়েছি প্রেমে যে বন্য,
জানি তুমি অনন্য
আসার হাত বাড়াই।
যদি কখনো একান্তে
চেয়েছি তোমায় জানতে,
শুরু থেকে শেষ প্রান্তে
ছুটে ছুটে গেছি তাই!!”

ঐশানী আকাশ ছোঁয়া বিস্ময় নিয়ে তাকায়। মনে জাগছে অজস্র অনুভূতির জোয়ার। কি মারাত্মক সেই অনুভূতি। ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে সামনের মানুষটার কাঁধে মাথা রেখে গানটা শুনতে। কারণ সে জানে গানটা অভয় তার জন্যই গাইছে। গানের মাঝে ঐশানী খুঁজে পেয়েছে শুধু এবং শুধুই নিজেকে। ইচ্ছেগুলো জাগলেও নিজেকে সংযত করে বিলের পানির দিকে তাকালো ঐশানী। চাঁদের প্রাকৃতিক আলোয় যেন পানি চিকচিক করছে। সেই সঙ্গে ঐশানীর চোখের কোণেও যে পানি চিকচিক করছে। সেই গিটার! সেই সুর! আর তাকে উদ্দেশ্য করে গাওয়া গান!!

চোখ বন্ধ করে অতিতের সমস্ত কথা মনে করতে থাকে অভয়। তার সঙ্গে অদ্ভুত ভাবে ঐশানীর দেখা হওয়া। সেই লাল রঙের টপস আর কালো ওড়না পড়ে থাকা মেয়েটি। পিটপিট করে তাকিয়ে বোকা বোকা হাসি দিয়ে কথা বলা মেয়েটি। সেদিন তার বিব্রতবোধ করে সরি বলার কথা মনে পড়তেই হাসি পায় অভয়ের। সেদিন অভয় তার সরি এক্সেপ্ট করেনি। চোখ খুলে আরেকটু এগিয়ে বসে অভয়। মিটিয়ে ফেলে তার আর ঐশানীর মাঝখানে যতটুকু দূরত্ব ছিল। মনের দূরত্বটা কবে মিটবে? ঐশানীর কাঁধের কাছে মাথা নিয়ে এসে আবারও গাইতে লাগে অভয়।
–“আমি যে নিজেই মত্ত
জানিনা তোমার শর্ত!
আমি যে নিজেই মত্ত
জানিনা তোমার শর্ত!
যদি বা ঘটে অনর্থ
তবুও তোমায় চাই।”

গাইতে গাইতে থামে অভয়। ঐশানীর কাঁধে নিজের থুঁতনি রেখে সাইড থেকে পর্যবেক্ষণ করে ঐশানীকে। সে আবিষ্কার করে ঐশানীর ঠোঁট কাঁপছে। আজ যদি সত্যিই কোনো অনর্থ ঘটে তবে সত্যিই কি হবে কোনো ক্ষতি? নাহ, হবে না। সবাইকে সাক্ষী রেখে ধর্ম, আইন অনুসারে বিয়ের করেছে অভয় ঐশানী। নিজের ইচ্ছেকে অপূর্ণ না রেখে ঐশানীর বাম গালে নিজের ঠোঁটজোড়ার স্পর্শ করায় অভয়। ঐশানী কোনো হেলদোল হয় না। ও যেন রোবটের মতো বসে আছে। চুমু খেয়ে একটু দূরে সরে আসে অভয়। দেখে ঐশানীকে। তার চোখজোড়া পানির দিকে স্থির। চোখে ছলছল করছে পানি। এমনটা কেন? সে কি কষ্ট পাচ্ছে? কি হয়েছে তার?

হঠাৎ ঐশানী রোবটরে মতো বলে ওঠে…..
–“গিটার আর বাজাবেন না। গানও গাইবেন না।”
অভয় গিটারের সুর তোলা থামিয়ে দেয়। আর গান তো কিছুক্ষণ আগেই থামিয়েছে। ভ্রু উঁচিয়ে বলে….
–“আমার গিটার বাজানো আর গানের গলা এতোই খারাপ নাকি? এমনভাবে বলছো যেন আমার গান শুনে তোমার কান খারাপ হয়ে গেছে।”
–“গিটারের সুর আর গান আমার একদম পছন্দ না। এসব শুনলে আমার মাথা ব্যাথা করে। আর বাজাবেন না গিটার। শুনেছেন?”
প্রচন্ড রকমের উত্তেজিত হয়ে কথাগুলো বলে ঐশানী। তার কথায় যথেষ্ট ঘৃণা। বিশেষ করে গিটারের প্রতি! অভয় পরিস্থিতি সামাল দিতে গিটার রেখে দিয়ে ঐশানী বাহু আলতো স্পর্শ করে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করে বলে…..
–“এইতো রেখে দিয়েছি। আর বাজাবো না। হয়েছে?”
ঐশানী হ্যাঁ বা না কোনোটাই না বলে নিরব হয়ে বসে থাকে।

অনেকক্ষণ কেটে গেছে। ঐশানীর হাবভাব কিছুই বোধগম্য হয় না অভয়ের। মেয়েটা মূহুর্তেই কেমন যেন চুপ হয়ে গেল। অভয় কথা বলার চেষ্টা করছে তার সাথে। কিন্তু পারছে না। সে পানির দিকে তাকিয়ে একটু হাসার ভঙ্গিতে বলল….
–“পানিতে পা দিয়ে আছো? পানিতে বড় বড় রাক্ষস মাছের বসবাস। একবার কামড়ে দিলে কিন্তু আর বাঁচার উপায় নেই।”
ঐশানী বাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিজের পা জোড়া আরো ডুবিয়ে দিয়ে বলে….
–“আজগুবি কথাবার্তা।”
–“আরে না সত্যি বলছি।”
ঐশানী আবারও থম মেরে যায়। অভয়ও কথা বলার কোনো উপায় খুঁজে পায় না। তবে সে ভালোভাবে বুঝেছে এমন কোনো খারাপ স্মৃতি রয়েছে যেটা গিটার সম্পর্কিত! ইশশ….কবে যে ঐশানীকে গভীরভাবে জানবে সে!

মিনিট পাঁচেক পড়েই কাঁপুনি দিয়ে উঠে নিজের পায়ের দিকে তাকায় ঐশানী। পানির নিচে তার পায়ে কোনোকিছু একটা মনে হচ্ছে কামড়ে ধরেছে। সুড়সুড়ি লাগলে লাফিয়ে পা তুলে চিল্লিয়ে অভয়ের গলা জড়িয়ে ধরে সে। ভয়ের সাথে চিৎকার করতে করতে বলে…..
–“আমার পা খেয়ে ফেলল! আমার পা নেই। রাক্ষস মাছ আমার পায়ে কামড় দিয়েছে। আমার পা শেষ। আমার কি হবে?”
অনেকক্ষণ পর যেন আগের ঐশানীকে দেখতে পাচ্ছে অভয়। তাকে স্বাভাবিক দেখে মুচকি হাসি ফুটে ওঠে অভয়েরও। সুযোগের সৎ ব্যবহার করলে মন্দ হয় না। ঐশানী ভীতিকর তার একদম কাছে বিদ্যমান। ঠোঁটজোড়া এগিয়ে নিয়ে গিয়ে অন্য গালেও চুমু বসিয়ে দেয় অভয়।

অভয়ের কাজে এক ঝটকায় দূরে সরে গিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে তাকায় ঐশানী। তাকে কটাক্ষ করে ঝাঁঝালো গলায় বলে…..
–“এদিকে আমার পা রাক্ষস মাছ কামড় দিয়েছে বলে লাফাচ্ছি আর আপনি ইয়ে দিচ্ছেন?”
–“ইয়ে আবার কি?”
–“ওইতো কিস। যেটাই হোক। আপনি তো অসভ্যের গোডাউন! কোথায় ভেবেছিলাম আমার পায়ে কি হলো তা নিয়ে চিন্তায় পড়বেন কিন্তু আপনি কিনা সুযোগের সৎ ব্যবহার করছেন?”
–“কি হয়েছে তোমার পায়ে?”
পায়ের দিকে তাকিয়ে বলে অভয়। পায়ে কোনো ক্ষতও তো নেই।

–“পানির নিচে মনে হলো হঠাৎ আমার পায়ে কোনো বস্তুর স্পর্শ পেলাম। সুড়সুড়ি লাগল। আবার মনে হলো কিছু কামড় দিচ্ছে।” (গোমড়া মুখে)
অভয় উচ্চস্বরে হেসে দেয়। হাসতে হাসতে উচ্চস্বরেই বলে….
–“আমি বললাম রাক্ষস মাছ আছে আর বিশ্বাস করে নিলে? এমন কিছু নেই পানিতে। হয়ত কোনো ছোট মাছ বা কাঁকড়া পায়ের সাথে লেগেছিল।”
বলে হাসার শব্দ আরো বাড়িয়ে দেয় অভয়। ঐশানী রেগেমেগে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বসে থেকে অভয়ের হাসি দেখতে থাকে একনাগাড়ে।

রাত অনেকটা গভীর হয়েছে। যে যার ঘরে শুয়ে পড়েছে। শুধু ঘুমায়নি অনিন্দিতা। রুমে দম বন্ধ লাগতে শুরু করায় বাইরে চলে আসে সে। বাইরের পরিবেশ টা প্রকৃতির নিজ বাতাসে ঠান্ডা ও শীতল করে রেখেছে। আজ ঘুমাতে যাবার আগে অনিন্দিতা আবারও ইশানের ঘর থেকে হাসাহাসির শব্দ শুনতে পেয়েছে। নিশ্চয় সায়রার সাথে কথা বলছিল! সব মিলিয়ে সে বিষন্ন। দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে উঠানের সিঁড়ি দিয়ে একপা একপা করে ছাঁদে উঠে আসে সে। ছাঁদে এসে ধারের কাছে নিচের পা দুলিয়ে বসে পড়ে নিজে। খোলা আকাশের নিচেও যেন অস্থিরতা কমে না তার। কিন্তু যার জন্য এই অস্থিরতা সেই তো বুঝতে পারল না!

এতো ভাবনার মাঝে অনিন্দিতার পাশে ঐশানীও এসে বসেছে সেটা খেয়ালই করেনি সে। সে যেন ভাবনার সাগরে ডুবে গেছে। তার ধ্যান ভাঙাতে ঐশানী নিজ থেকে বলে…..
–“এতো রাতে না ঘুমিয়ে ছাঁদে কি করছো?”
অনিন্দিতা একপ্রকার হকচকিয়ে উঠে তাকায়। ঐশানীকে দেখে অবিশ্বাস্য হয়ে বলে…..
–“তুমি কখন এলে ভাবি?”
–“তুমি যখন ইশান ভাইয়া কে নিয়ে ভাবনার সাগরে মত্ত ছিলে তখন।”
অনিন্দিতা আরেক দফা চমকায়। ঐশানী কি করে জানলো তার মনের খবর? বিষয়টাকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য সে তড়িঘড়ি করে বলল….
–“ইশান ভাইয়াকে নিয়ে আ…আমি কেন ভাবতে যাব ভাবি?”

–“কন্ঠ কাঁপতে থাকা মিথ্যে বলার লক্ষণ।”
অনিন্দিতা ঢক গিলে বোকা বনে যায়। মুখটাতে বিষন্নতায় ছেয়ে যায়। তা দেখে ঐশানী প্রশ্ন করে…..
–“কি হয়েছে তোমার? অনেকক্ষণ ধরে তোমায় লক্ষ্য করছিলাম। ইশানের সাথে কিছু হয়েছে?”
অনিন্দিতা ঠিক করে ঐশানীকে আর কিছু লুকাবে না। দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলে…..
–“আমি অনেক বোকা জানো তো ভাবি! ইশান ভাইয়াকে কখন যে মনের গহীনে নিজের ভেবে নিয়েছি তার ঠিক নেই। তাকে আমি সবসময় একতরফা ভালোবেসেছি। এটাই আমার কষ্টের কারণ।”
–“কি করে বুঝলে তুমি তাকে একতরফা ভালোবেসেছো?”
–“কারণ….. কারণ ও সায়রাকে পছন্দ করে। ওকে হয়ত ভালোবাসতেও শুরু করেছে।”

ঐশানী ভ্রু কুঁচকায়। খানিকটা হতভম্ব হয় সে। থেমে থেমে বলে…..
–“সায়রাকে পছন্দ করে?”
–“হ্যাঁ। ওদের মাঝে অনেক ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। আজ আমাকে প্রশ্ন করেছিল তাকে আমার ভাবি হিসেবে কেমন লাগবে? আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেছি। আমার বুকে কষ্টগুলো জমাট বাঁধছে। আমার কি করা উচিত ভাবি? আমাকে বলে দাও।”
–“ভালোবাসাকে হাওয়ার সাথে তুলনা করা যায়। এটা একটা দমকা হাওয়ার মতো! যাকে তুমি ধরে রাখতে পারবে না। আবার স্পর্শও করতে পারবে না। শুধু অনুভব করতে পারবে। আর ভালোবাসার মানুষটি যদি তোমার সাথে সুখি না থাকে, তাহলে তাকে মুক্তি দাও। কারণ তার ভালো থাকায় তোমাকে স্বস্তি দেবে। হাওয়া বা বাতাসকে যেমন বন্দি করা যায় না। তেমনই ভালোবাসাকেও বন্দি করা যায় না।”

অনিন্দিতার কথাগুলো বেশ লাগে। হুট করে বলে….
–“ভালোবাসা কী সেটা কত সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলে তুমি! আমার ভাইয়াকেও কি এভাবেই ভালোবাসো?”
–“এ…এখানে আমাদের নয় তোমার কথা চলছে।”
অনিন্দিতা চুপ থেকে হঠাৎ করেই হাসে। ঐশানীর হাত ধরে বলে…..
–“ধন্যবাদ তোমায়। আমি বুঝেছি। অনেক রাত হয়েছে। এখন ঘুমানো উচিত।”
ঐশানী সম্মতি জানিয়ে দুজনই নিচে নেমে যে যার ঘরে চলে যায়।

সকালে…..
–“উফফ….কি গরম! মনে হচ্ছে আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।”
গরমের প্রতি বিরক্ত হয়ে বলল ঐশানী। হাতে এক গাদা কাপড় লাগেজে ভরতে ব্যস্ত সে। কারেন্ট টাও নেই। সব মিলিয়ে সে ঘেমে একাকার। আজই তো এখান থেকে যাবে। তাই সবকিছু গোছগাছ করছে সে। কপালের ঘাম হাতের পিঠ দিয়ে মুছতে মুছতে বলে….
–“নোরা ফাতেহির ‘হায় গারমি’ গানটার জন্য গরম নিজে হানা দিয়েছে।”

একসময় ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ে সে। রুমের দুটো জানালা। একদিকের জানালা খোলা। অন্যদিকেরটা সবসময় কেন জানি বন্ধ থাকে। আচ্ছা জানালা খুললে হয়ত বাতাস পাওয়া যেতে পারে। সেই ভেবেই জানালা খুলতে গেল সে। জানালা খুলতেই তার চোখের সামনে পড়ল মৌমাছির ইয়া বড় মৌচাক। জানালা না খোলার কারণ তার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল। ঢক গিলে দ্রুত জানালা লাগাতে যাবে ওমনি দুটো মৌমাছি ঘরে ঢুকে পড়ে। ভয়ের চোটে তিড়িংবিড়িং করে লাফাতে শুরু করে ঐশানী। হাত এদিক ওদিক ছুঁড়ে নিচে নেমে যায় খাট থেকে। আশেপাশে পর্যবেক্ষণ করে কোনো মৌমাছি দেখতে না পেয়ে স্বস্তির শ্বাস ছাড়ে। তখনই তার নজরে আসে তার নাকের ডগায় হলুদ রঙের মৌমাছিকে। কিছু করবার আগেই মৌমাছি হুঁল ফুটিয়ে দেয় ঐশানীর নাকে। সঙ্গে সঙ্গে ‘আআআআআ’ শব্দ করে চিৎকার দিয়ে ওঠে সে।

চলবে……

[বি.দ্র. অনেকে ঐশানীর অতিত জানতে চাইছেন। তাও জানিয়ে দেওয়া হবে ধীরে ধীরে। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here