বেলা_অবেলা-৪র্থ পর্ব ©শাহরিয়ার

0
1374

#বেলা_অবেলা-৪র্থ পর্ব
©শাহরিয়ার

জব্বার মিয়া বলতে শুরু করলো আরে ফুপু এসব মেয়েদের ঔষধ কি তা আমার জানা আছে। এথন তুমি ঘরে চলো প্রচণ্ড খুদা লাগছে খাবার দিবা।

– দু’জন কথা বলতে বলতে সেখান থেকে চলে গেলো। আমি জানি জব্বার মিয়া খুব একটা সুবিদার লোক না। যতটুকু সম্ভব তাকে এড়িয়ে চলতে হবে। না হলে কখন কোন অঘটন ঘটিয়ে ফেলে বলা যায় না। দুপুরে মামা বাড়িতে আসতেই জব্বার মিয়া বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলো। আমি রাইসাকে সঙ্গে নিয়ে খেতে বের হলাম। খাবার টেবিলে মামী কিছু বললো না। বরং না চাইতেও দ্বিতীয় বার প্লেটে ভাত তুলে দিলো। আমার কাছে মনে হলো আজ অনেক দিন পর পেট ভরে ভাত খেলাম। রাইসাও আজ মনে হয় তৃপ্তি নিয়ে খেলো।
মামী কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারছে না কেমন জানি আমতা আমতা করছে, আমি আর সেদিকে খেয়াল করলাম না। খেয়ে রাইসাকে সঙ্গে নিয়ে উঠে নিজের রুমে চলে আসলাম। দু’চোখে ঘুম লেগে আসছে এমন সময় টিনের চালে বৃষ্টির টপটপ শব্দ কানে ভেসে আসতেই দু’চোখ খুলে গেলো। বিয়ের বছর দুি পরের ঘটনা, তখনো আমাদের মাঝে কত ভালোবাসা। একদিন রাতে খাওয়া শেষ করে বিছানায় এসে শুয়ে পরেছি। এমন সময় প্রচণ্ড জুড়ে বৃষ্টি শুরু হলো।
আমি জানালা খুলে দু’হাত বাড়িয়ে দিয়ে বৃষ্টি ছুঁয়ে দিচ্ছি হঠাৎ করেই আবির ঘরে ঢুকে পেছন থেকে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমি বলে উঠলাম কি করছেন?

– আবির তেমন কিছু না বউকে একটু আদর করছি।

– আমি লজ্জা পেয়ে ইস কি সব বলেন আপনি?

– আবির আচ্ছা তোমার কি বৃষ্টি খুব পছন্দ?

– হুম আমার ভীষণ পছন্দ, কলেজে পড়ার সময় যখন বৃষ্টি হতো, তখন আমি বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বাড়িতে ফিরতাম। আমার ভীষণ ভালো লাগতো কিন্তু কেন বলেনতো?

– আবির না এমনি, এ বাড়িতে আসার পর তো তোমাকে কখনো বৃষ্টিতে ভিজতে দেখিনি।

– আমি হাসতে হাসতে বললাম, কি করে দেখবেন? এখনতো আর বৃষ্টিতে ভিজি না। বিয়ের পর মেয়েদের অনেক সুখ আহ্লাদ ত্যাগ করতে হয়। নয়তো নাকি সংসার সুখের হয়না।

– আবির আচ্ছা তোমাকে এসব আজগুবি কথা কে বলেছে? মানুষের মনে সুখ আহ্লাদ না থাকলে সে সংসার কি করে সুখের হয়?

– আমি আবিরের প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে পারিনি। এক দৃষ্টিতে বাহিরে তাকিয়ে ছিলাম। হঠাৎ করেই আবির আমাকে কোলে তুলে নেয়। আমি তাকে বলি কি করছেন? সে কোন উত্তর না দিয়ে হাসে আমি মুগ্ধ হই তার হাসিতে, সে আমাকে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসে। ঝুম বৃষ্টিতে সে আমাকে কোলে নিয়ে বাড়ির উঠানের মাঝে এসে দাঁড়ায়। তার কপাল বেয়ে টপটপ করে বৃষ্টির পানি আমার গালে মুখে পরতে থাকে। লজ্জায় আমি চোখ মেলে তাকাতে পারছিলাম না। বৃষ্টির সাথে শোঁ শোঁ করে বাতাস হচ্ছিলো। চারিপাশে গাছের পাতারা যেন সে বাতাসে নিজেদের মত শব্দ করে নৃত্য করে যাচ্ছিলো। মাঝে মাঝে আকাশে বর্জ্যপাতের শব্দে আমার চোখের পাপড়ি কেঁপে কেঁপে উঠছিলো। আমি সে শব্দে শক্ত করে আবিরের পিঠ খামছে ধরছিলাম। আমার কাছে তখন মনে হচ্ছিলো আমি পৃথিবীর সব চেয়ে সুখি নারী। কে বলে বিয়ের পর নিজের সব সুখ বিসর্জন দিতে হয়? আবিরের মত বর যার ভাগ্যে আছে সে ভাগ্যবতী। একটা সময় মেঘের গর্জন বাড়তে থাকে। আমি কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে আবিরকে বলি চলো আর ভিজবো না। আমার ভীষণ ভয় করছে। আবির শব্দ করে হেসে উঠে। আমি চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি সে হাসি, এতো সজীব আর প্রাণবন্ত হাসি আমি যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলি সে হাসিতে। একটা মানুষের হাসিও এতো সুন্দর হতে পারে? আমি আবিরের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করি।

– হুট করেই আবির প্রশ্ন করে এমন করে তাকিয়ে কি দেখছো?

– আমি লজ্জায় অন্য দিকে মুখ লুকিয়ে বলি কিছুনা। এতো সময় ধরে আমাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন আপনার কষ্ট হচ্ছে না? আমাকে নামিয়ে দিন।

– আবির আবারো সেই মুগ্ধ করা হাসিয়ে দিয়ে আমাকে আরেকটু উপরের দিকে তুলে নিয়ে বলে। হ্যাঁ একটু যে কষ্ট হচ্ছে না, তা ঠিক নয়, তবে সে কষ্ট এখুনি পুষিয়ে নিচ্ছি বলে তার ঠোঁট জোড়া নামিয়ে নিয়ে আসে আমার ঠোঁটে।

– হঠাৎ বজ্রপাতে বাস্তবতায় ফিরে আসি। রাইসাকে বুকে টেনে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখি যেন এ শব্দে ওর ঘুম ভেঙে না যায়। মানুষের জীবনে হয়তো সুখের সময় খুব কম। তবে সে সুখের স্মৃতি মানুষ সারা জীবন ভয়ে বেড়ায়। প্রতিদিন প্রতিক্ষণে মানুষ কষ্টের সাথে মোকাবেলা করে, তাইতো সুখের স্মৃতি গুলো মানুষ খুব সহজে ভুলতে পারে না। আমার জীবনের হয়তো সুখের মুহুর্ত গুলো চলে গিয়েছে, তবে সময় সে মুহুর্ত গুলো রঙ্গীন হয়ে আছে আমার সমস্ত হৃদয় জুড়ে। তাইতো চাইলেও খুব সহজে তা আমি ভুলে যেতে পারবো না। পারবো না আমি ভুলে যেতে আবিরকে। জীবনের সাতটি বছর যে মানুষটাকে ভালোবেসে কাটিয়েছি, যে মানুষটার ভালোবাসায় কাটিয়েছি, যে মানুষটার সাথেই আমার সব সুখের স্মৃতি সেই মানুষটাকে কি করে ভুলে যাবো? তাকে ভুলতে না পারলেও তার থেকে বহুদূরেই আমাকে থাকতে হবে। আমার মেয়েটার জন্য খুব কষ্ট লাগে, ছোট বেলায় বাবা মা হারিয়ে আমি এতিম হয়েছিলাম আর আমার মেয়েটা বাবা থাকতেও তার আদর থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। মেয়েটার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে চোখের পানি মুছে বুকের সাথে শক্ত করে চেঁপে ধরে এক সময় ঘুমিয়ে পরলাম।

– এক সময় বৃষ্টি থেমে গেছে টিনের চালের টপটপ শব্দ কিংবা গাছের ডালপালা রাও তাদের শব্দ থামিয়ে দিয়েছে। হঠাৎ বাহির থেকে মামার ডাকে ঘুম থেকে জেগে উঠি, রুম থেকে বের হয়ে দেখি মামা বিশাল বড় সাইজের একটা রুই মাছ নিয়ে এসেছে। আমি অবাক হয়ে গেলাম, মামা এতো টাকা কোথায় পেলো। এতো বড় মাছতো মামার কেনার কথা না, জীবনে কোন দিন মামাকে আমি এতো দামী মাছ কিনতে দেখিনি। আমার হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে মামা বলে উঠলো কিরে এভাবে তাকিয়ে থাকবি নাকি মাছটা নিয়ে রান্না করবি। মামার হাত থেকে মাছটা নিতে নিতে মামাকে বললাম এতো বড় মাছ কেন কিনছো মামা? এটারতো অনেক দাম।

– মামা আরে আমি কিনি নাই, দুপুরে জব্বার মিয়া আসছিলো না সে কিনা দিছে। তুই বাড়িতে আসছিস তাই কিনা দিছে। ও তো এখন অনেক বড় ব্যবসায়ী বাজারের। মেলা টাকা পয়সার মালিক। তয় অহনো আমারে অনেক সম্মান করে।

– আমার ইচ্ছে না থাকলেও মাছটাকে নিয়ে রান্না ঘরের দিকে ঢুকতে শুরু করলাম। আমি ভালো মতই বুঝতে পারছি জব্বার মিয়ার নিশ্চই কোন কুমতলব আছে। তা না হলে সে এতো টাকা দিয়ে মাছ কিনে দেবার লোক না। মাছ কাটতে কাটতে হারিয়ে গেলাম আবিরদের বাড়িতে প্রথম যেদিন মাছ কিনে আনা হয় সেদিনে। কি পরিমাণ লজ্জায় পরেছিলাম তা মনে হলে এখনো একা একা হাসি। বিয়ের তিন কি চার দিন পরের কথা। আবির সকালের নাস্তা শেষ করে বাড়ি থেকে বের হবে এমন সময় মা ডেকে বললো বাজান হাট থেকে আসার সময় মাছ মাংস কিনা নিয়া আইছো। আবির মাথা নাড়িয়ে চলে গেলো। আমি আর আম্মা নাস্তা করে উঠানের মাঝে বসে আছি, আম্মা আমার মাথার চুল বেনী করে দিচ্ছে আর তার গল্প বলছে। এমন সময় আবির বাড়ির বাহিরে থেকে আম্মাকে আর আমাকে ডাকতে ডাকতে বাড়ির ভিতর ঢুকলো। তার মুখে রাজ্য বিজয়ের হাসি। আর হাতে ইয়া বড় একটা বোয়াল মাছ।

– মুখে হাসি নিয়ে আবির বলতে শুরু করলো আজ এই বোয়াল মাছ রুকাইয়া কেটে রান্না করবে। আর আমরা খাবো।

– আমি একবার আবিরের মুখের দিকে তাকাই আর একবার মাছের দিকে। মাছটা যদি নদীতে থাকতো আর আমাকে একা পেতো তাহলে মনে হয়না এক মিনিটও সময় লাগতো আমাকে হজম করে ফেলতে। আমি আম্মার হাত শক্ত করে ধরে বললাম ও আম্মা আমি পারমু না আমার ভীষণ ভয় লাগে। আমার কথা শুনে তারা মা ছেলে কি হাসা। আর আমি যতবারই মাছটার দিকে তাকাই ততবারই মনে হয় মাছটা বড় বড় চোখ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি আম্মার পেছনে যেয়ে দাঁড়ালাম। আম্মা বললো আচ্ছা হয়েছে আমার সাথে আয়। আম্মা আগে আগে আর আমি তার পিছু পিছু আম্মা মাছটা নিয়ে রান্না ঘরে ঢুকলেন এর পর কাটতে শুরু করলেন মাছটা। মাছ কাটা শেষ হওয়া পর্যন্ত যেন আমার ভয়ের কমতি ছিলো না। শীতের ভিতরেও আমি ঘেমে একাকার হয়ে গিয়েছিলাম। এরপর জীবনে কত মাছ কেটেছি আম্মাকে সাথে নিয়ে তখন আর ভয় লাগেনি, তবে জীবনে প্রথম সেই বোয়াল মাছ দেখে সে ভয়টাই না পেয়েছিলাম। এখনো মাঝে মাঝে একা একা হাসি সে কথা মনে পরলে। মাছ কাটা শেষ হতেই রান্না ঘর থেকে মাছ নিয়ে ধুয়ে নিয়ে আসতে কলপাড়ে চলে আসলাম। মাছ ধুয়ে নিয়ে রান্না ঘরের দিকে যেতেই।

-মামা বলতে শুরু করলো মাছ গুলো ভালো করে ভাজার জন্য, রাতে জব্বার মিয়া এ বাড়িতে খেতে আসবো।

– আমার প্রচণ্ড রাগ উঠছিলো ইচ্ছে করছিলো সব ছুড়ে ফেলে দেই, কিন্তু তা পারলাম না। নিজের মনকে শান্ত রেখে চুপচাপ রান্না ঘরের ভিতর ঢুকে পরলাম।

#চলবে…

আগের পর্বের লিংক
https://www.facebook.com/groups/2401232686772136/permalink/3139803172915080/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here