বেলা_অবেলা- ৭ম ও শেষ পর্ব ©শাহরিয়ার হোসেন

0
5420

#বেলা_অবেলা- ৭ম ও শেষ পর্ব
©শাহরিয়ার হোসেন

আমি খুব অবাক হই, সে সাথে একদম নির্বাক হয়ে যাই যে বাড়িতে আমি কাজ করতাম, সেই ভদ্র লোকের ব্যবহারে। গত কাল রাতেই তার ছেলে মেয়ে দু’জন বিদেশে চলে গেছে আর আজ দুপুরেই কিনা সে আমার শরীর স্পর্শ করতে আসে? ছিঃ ভাবতেই অবাক লাগে মানুষ এতোটা নিচ আর জগন্যও হতে পারে। বাবার বয়সী একজন মানুষের চোখেও এ দেহটা নিরাপদ নয়। সকালের নাস্তা বানানোর সময় লোকটা হুট করে এসে পেছন থেকে ঝাপটে ধরে আমাকে।

– বলতে শুরু করে রুকাইয়া তোমাকে রাজরানী করে রাখবো আমার সংসারে, তুমি খুব সুন্দরি।

– আমি তাকে বলি এসব কি করছেন ছাড়ুণ আমাকে নয়তো আমি চিৎকার করবো।

– সে হেসে হেসে বলে তোমার চিৎকারে কেউ আসবে না। বলেই আরও শক্ত করে আমাকে দু’হাত দিয়ে চেপে ধরে।

– আমি প্রচণ্ড রকমের ভয় পেয়ে যাই শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে তার হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করি। সেই সাথে চিৎকার চেঁচামেচি করতে থাকি। তার পরেও উনি আমাকে ছাড়তে চাচ্ছেন না। তখন বাধ্য হয়ে একটা সময় হাতে থাকা রুটি বেলার বেলুন দিয়ে উনার মাথায় আঘাত করি।

– লোকটা আমাকে ছেড়ে দেন, সেই সাথে আমার চিৎকারে আসে পাশের মানুষজন জড়ো হয়ে যান। অনেকে বলতে থাকেন উনার এই খারাপ ব্যবহারের জন্যই কেউ এ বাড়িতে কাজ করতে চান না।

– সেখান থেকে কেউ একজন হয়তো পুলিশে খবর দেন। অল্প সময়ের ভিতর পুলিশ চলে আসে। এবং সব ঘটনা শুনে তাকে ধরে নিয়ে যান।

– মুহুর্তের ভিতর আমার সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো। আমি আস্তে আস্তে হেঁটে বাড়ি ফিরে আসি। ঘরে এসে চুপচাপ শুয়ে থাকি।

– আমাকে চুপচাপ শুয়ে থাকতে দেখে দুপুরে মা এসে প্রশ্ন করে শরীর খারাপ কিনা?

– আমি মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না করে দেই। তাকে সব খুলে বলি।

– মা শুনে খুব কষ্ট পায়, বলে মানুষটারে বাহির থেকেতো ভালোই দেখায় কিন্তু মনটা এতো খারাপ তাতো জানতাম না।

– আমি মাকে বললাম সবই আমার ভাগ্য।

– মা বললেন তুই চিন্তা করিস না তোর জন্য আমি অন্য কোথাও কাজ দেখবো।

– আমি মাকে বললাম, না আমি আর মানুষের বাড়িতে কাজ করবো না। অন্য ভাবে প্রতিষ্ঠিত হবো।

– মা আর কিছু বললেন না, মাথায় হাত রেখে বললেন দোয়া করি যেন তুই সফল হতে পারিস।

– আমি চিন্তা করতে শুরু করলাম কি ভাবে সফল হওয়া যায়। রাতে পারুল আপাও মন খারাপ করে বাসায় ফিরলেন।

– জিজ্ঞাসা করলাম কি হয়েছে?

– পারুল আপুদা বললেন গার্মেন্টসে আর যাবেন না। নানান রকম সমস্যার কথা বলতে শুরু করলেন।

– আমি উনাকে শান্তনা দিয়ে বললাম বেশতো আর যেতে হবে না। আমরা এখন নিজেরাই কিছু করবো কিন্তু কি করবো তাই ভেবে পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ করেই মাথায় বুদ্ধি আসলো পারুল আপাতো গার্মেন্টসে চাকরি করছে সে সেলাই করতে পারবে। আর আমিও নকশিকাঁথা সেলাই করতে জানি।

– পরদিন সকালে আমার জমানো টাকা আর পারুল আপাকে সাথে নিয়ে যেয়ে একটা সেলাই মেশিন আর গজ কাপড় কিনে নিয়ে আসি। আপা অনেক খুশি হলেন নিজের মেশিন পেয়ে। শুরু করলাম দু’জন নতুন করে লড়াই। প্রথমে আমরা দু’জন নিজেদের খরচ দিয়েই কাঁথা আর কিছু ড্রেস বানালাম।

– তা নিয়ে বিভিন্ন মার্কেটে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করতে থাকলাম। আস্তে আস্তে আমাদের অর্ডার বাড়তে থাকলো।

– আমরা প্রথমে ছোট একটি দোকান ভাড়া নিলাম, সেই সাথে খুঁজে বের করলাম আমাদের মত যারা কষ্ট করে সমাজে বেঁচে আছে তাদেরকে। পারুল আপা আর আমি মিলে তাদেরকে নকশিকাঁথা আর সেলাইয়ের কাজ শিখাতে থাকি।

– আস্তে আস্তে মার্কেটে আমাদের পণ্যের বেশ চাহিদা বাড়তে থাকে, সেই সাথে আমাদের খারাপ সময় গুলোও কেটে যেতে থাকে।

– পারুল আপাকে এখন আর গার্মেন্টসে যেতে হয়না। মাকে মানুষের বাড়িতে কাজ করতে হয় না, রাতে ফুটপাতে চা বিক্রি করতে হয়না। সেই সাথে আমাদের দোকানটাও অনেক বড় হয়, বিশজন অসহায় মহিলা আমাদের দোকানে কাজের সুযোগ পায়। এভাবেই কেটে যায় তিনটে বছর।

– আমি আস্তে আস্তে দুঃখের সময় গুলো ভুলে যাবার সর্বোচ্চ চেষ্টা করি। সেই সাথে স্বপ্ন দেখি আরও বড় হবার। যখন দোকানে অসহায় মানুষ গুলোর মুখের হাসি দেখি, তখন সত্যি সত্যি আমি সব দুঃখ কষ্ট ভুলে যাই। মনে হয় এরাইতো আমার সব। আমি চিন্তা করি আরও মানুষের কর্ম সংস্থান কিভাবে করা যায়।

– একদিন চিন্তা করি গ্রামে যেতে হবে, মায়ের হাতের সেই বালা দু’টো নিয়ে আসতে হবে। সেই সাথে মামাকে সব সম্পত্তি গুলো লেখে দিয়ে আসবো।

– যেই ভাবা সেই কাজ একদিন পারুল আপাকে সব বুঝিয়ে দিয়ে ছুটে আসি গ্রামে। সোজা সেই দোকানটায় চলে যাই। আমাকে দেখে চিনতে চাচার একটুও ভুল হয়নি।

– চাচাকে সব বলার পর সে আরও খুশি হয়। আমি যখন চাচার হাতে টাকা গুলো তুলে দিয়ে মায়ের হাতের সে বালা গুলো নিয়ে, হাতে পরে নেই। তখন চাচা বলেন মারে পাপ বাপকেও ছাড়ে না।

– আমি চাচার কথা শুনে প্রচণ্ড চমকে যাই এবং প্রশ্ন করি চাচা আপনি এমন করে কেন কথা বলছেন?

– চাচা হাসতে হাসতে বললেন তোমার স্বামী আবির এখন অর্ধ পাগল হয়ে এ রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। তার নতুন স্ত্রী সকল সম্পত্তি নিজের নামে লেখে নিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিছে।

– কথাটা শোনার সাথে সাথেই বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। সে আমার সাথে যতই অন্যায় করুক তবুও সে আমার স্বামী। আমি চাচাকে প্রশ্ন করলাম আবিরকে কোথায় পাবো?

– চাচা বললেন বেশীর ভাগ সময়ই বাহিরে থাকে তবে সন্ধ্যার পর পর আম্মার কবরের পাশে যেয়ে বসে থাকে।

– আমি চাচার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সেখান থেকে চলে আসলাম। মামার বাড়ির পথে রওনা হলাম। হাতে যথেষ্ট্য সময় আছে সন্ধ্যা হতে। তাই চিন্তা করলাম, মামার নামে সব সম্পত্তির দলিল গুলো লেখে দিয়ে যাবো যাতে এখানে আসার জন্য আর কোন রকম পিছু টান না থাকে।

– কিন্তু মামার বাড়িতে যে আরও বড় চমক অপেক্ষা করছিলো তা আমি ভাবতেও পারিনি। বাড়িতে ঢুকার পর মামা আমাকে দেখে অনেকটা সময় নিরব দাঁড়িয়ে রইলো, তারপর হাউমাউ করে কান্না করতে করতে বললো তোর মামীতো আর বেঁচে নেই। মৃত্যুর আগে তোকে অনেকবার দেখতে চেয়েছিলো। তোর কাছে মাফ চাইবে বলে।

– আমার প্রচণ্ড খারাপ লাগলো, বললাম আল্লাহ মামীর ভালো করবে। মামাকে বললাম জমির কাগজপত্র গুলো দেবার জন্য। আমি সব কিছু তার নামে লেখে দিতে চাই।

– মামা হাসতে হাসতে কাগজ পত্র গুলো নিয়ে এসে আমার হাতে দিতে দিতে বললো। মারে মানুষের আসল জমি সাড়ে তিন হাত মাটি। আমারও তাই লাগবে এসব আমার চাইনা।

– দুপুরের পর পর আমি রওনা হয়ে গেলাম আবিরকে খোঁজার উদ্দেশ্যে, খুব বেশী সময় খোঁজার প্রয়োজন হয়নি, কবরস্থানের সামনে যেতেই তাকে দেখতে পাই, বড় বড় চুল মুখ ভরা দাঁড়ি। মানুষটা আমাকে দেখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো।

– আমার বড্ড মায়া হলো তার জন্য, ফেলে রেখে চলে আসতে পারলাম না। সঙ্গে করে নিয়ে রওনা হলাম ঢাকার পথে। ঢাকায় নিয়ে এসে ভালো ডাক্তার দেখাতে শুরু করলাম। সেই সাথে নিজের ব্যবসা কি ভাবে বড় করা যায় সে দিক নিয়ে দিন রাত সকলে পরিশ্রম করতে শুরু করলাম।

– এভাবেই কেটে গেলো জীবন থেকে আরও কুড়ি বছর। আর এইতো আমি এখন আপনাদের সামনে একজন পরিচিত মুখ একজন আইডল। তবে এখানে আসতে আমাকে কম পরিশ্রম কম ত্যাগ স্বিকার করতে হয়নি।

– ভীরের ভিতর থেকে একজন মহিলা সাংবাদিক বলে উঠলো, আপনার স্বামীকে এতো সহজে মেনে নিলেন কি করে?

– একটু হেসে জবাব দিলাম, আমাদেরতো বিচ্ছেদ হয়নি, আর আমি প্রায় সাড়ে তিন বছর একা থেকে বুঝেছি, এ সমাজে একজন স্বামী ছাড়া নারীর অবস্থান কোথায়। অল্প বয়সী থেকে বুড়ো কেউ ছাড় দিতে চায় না। শরীরের সাথে না পারলে চোখ দিয়ে গিলে খেতে চায়। আর আবির ইচ্ছে করে এমন করেনি, দেশে এখনো অনেকেই আছেন নানান রকম কূফরি করেন। আবির তার শিকার হয়েছিলো। যখন আবির সুস্থ হয় তখন আমরা সব জানতে পারি।

– আর একজন বলে উঠলো আপনার স্বামী আর মেয়ে কোথায়?

– অল্প কিছু সময়ের ভিতর চলে আসবে, মেয়েদের জন্যইতে আজ এতো আয়োজন। আমার একটা মেয়ে নয় তিনটা মেয়ে আর তিনজনই ডাক্তার হয়ে আজ বাংলাদেশে আসছে, আবির আর পারুল আপা ওদের নিয়ে সোজা এখানে চলে আসবে। তারপরই এই হাসপাতালের উদ্বোধন করবো আমরা আর এটা সেই জায়গা যা আমার মামা মারা যাবার আগে দিয়ে গেছেন। আমার মায়ের সম্পত্তি। যেখানে আমার তিন মায়ের নামে এ হাসপাতাল নির্মিত হচ্ছে।

– আপনি সত্যিই মহান, জীবনে এতো ত্যাগ স্বিকার করার পরেও সবাইকে কত আপন করে নিয়েছেন।
আমরা সকলে আপনার কাছে কৃতজ্ঞ।

– আমি মহান নই, পুরো নারী জাতীই মহান, আমরা হাজারটা ত্যাগ হাসি মুখে স্বিকার করে নেই। এই যে আপনারা পরিবার প্রিয়জনদের মুখে হাসি ফুটানোর জন্য এই পেশাকে বেছে নিয়েছেন। আপনারা মহান। প্রতিটা মা মহান, প্রতিটা মেয়ে মহান। এক কথায় প্রতিটা নারীই মহান। আমরা স্বার্থহীনন ভাবে ভালোবেসে যেতে পারি। সৃষ্টিকর্তা মহান বলেই আমাদের মাঝে এতো ধৈর্য ধরার মত তৌফিক দান করেছেন। আল্লাহ ধৈর্যশীলদের পছন্দ করেন।

– কথা বলতে বলতে আবির আর পারুল বাচ্চাদের নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে আসলো। আজ চার বছর পর তিন মেয়েকে এক সাথে পেয়ে আনন্দে বুকে জড়িয়ে নিলো। এতো গুলো বছর পর কে বলবে এই রুকাইয়া একটা জীবনে এই সমাজের সাথে, সমাজের মানুষ গুলোর সাথে লড়াই করেছে। আনন্দে পরিপূর্ণ আজ তার পরিবার।

– সবার চোখের আড়ালে আবির এসে রোকাইয়ার হাতটা চেপে ধরে বললো তোমাকে পেয়ে আমার জীবনটা সত্যিই পরিপূর্ণ। রুকাইয়া আবিরের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে মনে মনে বললো আমি যে আপনাতেই পরিপূর্ণ। জানি না কোন বেলায় তোমায় পেয়েছি, বেলা অবেলার হিসেব যে রাখিনি।

#সমাপ্ত

[ভুলত্রুটি গুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন সকলে, গল্পে আমি একজন নারীর চরিত্র ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি। সমাজে এমন হাজারো নারী আছেন। সেই সাথে চোখ দিয়ে গিলে খাবার মত অসংখ্য পুরুষও আছেন। তবে সবাই এক রকম নয়]

সারা জীবনতো মেয়েরা ছেলেদের বুকে মাথা নেখে ঘুমায়। আজ না হয় সে নিয়ম ভেঙে আমি তোমার বুকে মাথা রেখে ঘুমাবো?

– বাসর ঘরে আবিরের মুখে এমন কথা শুনে কিছুটা চমকে উঠে রুকাইয়া, সেই সাথে লজ্জায় রুকাইয়া ফর্সা গাল লাল বেনারসি শাড়িটার চেয়ে বেশী লাল হয়ে যায়।

রুকাইয়া কিছু বলছে না দেখে আবির হাসতে হাসতে আবার বলতে শুরু করলো, কি ব্যাপার এতো চুপ হয়ে আছো কেন? আর লজ্জায় তোমার গাল দু’টো একদম লাল টকটকে হয়ে গেছি দেখছি। তোমরা মেয়েরা বাসর ঘরে এমন ভাব করো যেন তোমাদের জীবনে কোন পুরুষ আগে কখনো আসেনি।

#গল্প_বন্দিনি শিগ্রই পোষ্ট করা হবে।

আগের পর্বের লিংক
https://m.facebook.com/groups/2401232686772136/permalink/3142285556000175/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here