বেলা_অবেলা- ৩য় পর্ব

0
1236

#বেলা_অবেলা- ৩য় পর্ব
©শাহরিয়ার

আমি কি পারবো সমাজের এ মানুষদের সব কথা সহ্য করে আমার মেয়েটাকে মানুষের মত মানুষ করতে? আমার নিজের সারাটা জীবন কষ্টে কেটেছে যখনি ভেবেছি হয়তো একটু সুখে থাকবো ঠিক তখনি আবির আরেকটা বিয়ে করে ঘরে বউ নিয়ে এসেছে। আবিরের চোখের সামনে একটি বারের জন্যও কি আমার মুখটা কিংবা রাইসার মুখটা ভেসে উঠলো না? সেতো সব জানতো আমি কতটা কষ্ট করে বড় হয়েছি, তারপরেও কি করে সে পারলো এমন জগন্য একটা কাজ করতে? কত কত প্রশ্ন অথচ এই প্রশ্নের উত্তর দেবার মত মানুষ নেই। আবির আজ অন্য নারীতে আসক্ত। তার হৃদয়ে কোথাও আমাদের জায়গা নেই, তার মন প্রাণ সমস্ত জুড়ে তার নতুন স্ত্রী। সে তাকে নিয়েই সুখে থাকুক। ভাবতে ভাবতে দু’চোখের পাতা বার বার এক হয়ে আসছে। আজ কতগুলো দিন ঠিক মত ঘুম নেই, কি যে যন্ত্রনায় দিন কাটাচ্ছি তা আমি ছাড়া আর কেউ বুঝবে না। একটা সময় আর চোখ মেলে থাকা সম্ভব হলো না ক্লান্তির কাছে হেরে গেলাম। দু’চোখের পাতা এক হয়ে গেলো। ফজরের আজানে ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠলাম। ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম ওযু করার উদ্দেশ্যে ততক্ষণে মামাও উঠে পরেছে। মামা আমার আগে ওযু করে জালটা হাতে নিয়ে বের হতে হতে বললো মেলা দিন নদীতে যাই না। তোরা আসছিস, নামাজ পড়ে নদীতে যেয়ে দেখি চারটা মাছ পাই কিনা। আমি কিছু বলার আগেই মামা হনহন করে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলো। আমি ওযু করে নামাজ পড়ে নিলাম। নামাজ শেষ করে বিছানায় রাইসার পাশে শুয়ে পরলাম। বিয়ের পর পর অনেক সকাল হয়েছে এমন আমি নামাজ শেষ করে আবিরের পাশ দিয়ে হাঁচা চলা করছি হঠাৎ করে আবির আমার হাত ধরে টান দিয়ে তার বুকে মাথাটা নিয়ে গেছে। আমি যখন প্রশ্ন করতাম কি তুমি ঘুমাওনি? তখন সে মিষ্টি করে হেসে বলতো তুমি পাশে না থাকলে কি আর দু’চোখে ঘুম আসে?
মনে একটুও শান্তি পাইনা তুমি পাশে না থাকলে। সেই মানুষটাই দিব্বি হয়তো ঘুমিয়ে আছে তার নতুন বউকে নিয়ে। হয়তো তাকেও এই একই কথা বলে। কথা গুলো ভাবতে ভাবতে রান্না ঘর থেকে মামীর গলার শব্দ ভেসে আসলো। মামী খুব উচ্চ স্বরেই বলছে, নবাবের বেটির মত ঘুমালে চলবে নাকি? সংসারে কি আর কোন কাজ নেই নাকি? এখানে থাকতে হলে সংসারের কাজকর্ম করেই থাকতে হবে। আমি বুঝতে পারলাম আর শুয়ে থাকা সম্ভব নয়। অথচ একটা সময় গেছে আমি বিছানা ছেড়ে উঠে আসার চেষ্টা করেছি আবির আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখে বলেছে আর একটু পরে উঠলে কিছুই হবে না। আর যখন ক্লান্ত শরীরটা একটু বিশ্রাম চায়, তখন আর শুয়ে থাকার মত অবস্থা নেই। দ্রুত বিছানা থেকে নেমে রওনা হলাম রান্না ঘরের দিকে। রান্না ঘরের। দরজার সামনে আমাকে দেখেই মামী মুখ ভেংচি কাটলেন, আমি নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করলাম উনি এমন কেন? কিন্তু কোন উত্তর খুঁজে পেলাম না। মামী আমার দিকে তাকিয়ে বললো রান্নায় সাহায্য করার জন। আমি কোন রকম কথা না বাড়িয়ে তাকে রান্নায় সাহায্য করতে শুরু করলাম। মামী আমাকে রান্নার দায়িত্ব দিয়ে সেখান থেকে বের হয়ে আসলেন। আমি রান্না করে চলেছি, তবে খুব যে বেশী মনোযোগ আছে রান্নাতে তাও নেই। মনে মনে ভাবছি যদি রাইসা না থাকতো তবে এ সমাজের কাউকেই মুখ দেখাতাম না। হয় গলায় দড়ি দিতাম। না হয় বিষ খেয়ে মারা যেতাম। এই পৃথিবীর মানুষ গুলো কেউ আমার আপন নেই। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ করেই গরম তেল আমার হাতে ছিটকে এসে পরলো। অসহ্য যন্ত্রনায় আমি চিৎকার করে উঠলাম। আমার চিৎকারে মামী বাহির থেকে দৌঁড়ে রান্না ঘরে চলে আসলেন। মামী হাতে পানি দিতে দিতে বড় বড় চোখ করে বলতে শুরু করলেন এতোদিন সংসার করেও যে মেয়ে রান্না শিখতে পারেনি সে মেয়েকে সংসারে কেনই বা রাখবে স্বামী? মামীর কথায় আমি প্রতিবাদ করলাম না, গরম তেলে হাতের যে যে অংশে লেগেছে সেখানেই জ্বলে পুড়ে চামড়া উঠে মুহুর্তেই সাদা হয়ে গেছে। প্রচণ্ড যন্ত্রনা হচ্ছে হাতে, দু’চোখ বেয়ে পানি পরছে। আমি চিন্তা করতে শুরু করলাম এই সামন্য গরম তেলেই এতো কষ্ট তাহলে গলায় দড়ি কিংবা বিষ খেয়ে যদি মারা যেতাম তাহলে কতটা কষ্টই না হতো। না এসব ফালতু চিন্তা আর মাথায় নিয়ে আসা যাবে না আমাকে বাঁচতে হবে। মামী আমাকে বকা দিতে দিতে বললো রান্না ঘর থেকে বের হয়ে যেতে সেখানে থাকলে জ্বালা পোড়া আরও বাড়বে। আমি সেখান থেকে বের হয়ে আসলাম, রাইসার পাশে বসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি আর ভাবছি। বিয়ের পর আমার দিন গুলো কত ভালো ছিলো, আমি রান্না করতে পারতাম না। আম্মা আমাকে নিজের পাশে আদর করে বসিয়ে রান্না করা শিখিয়েছেন। কিভাবে কি করতে হয়, কিভাবে চুলায় আগুন জ্বালাতে হয়। ঠিক নিজের মেয়ের মত করে। একদিন বৃষ্টিতে বাড়ির উঠান পিচ্ছিল হয়ে গিয়েছিলো, আমি সেখানে পা পিচ্ছলে পরে যাই। কোমরে কিছুটা ব্যথা পেয়ে চিৎকার করি। আবির চিৎকার শুনে দৌঁড়ে এসে আমিকে কোলে তু্লে নিয়ে ঘরে যায়। আমি বলি কি করছো মা দেখবে, সে হাসে আর বলে দেখলে কি সমস্যা আমি আমার স্ত্রীকে ঘরে নিয়ে যাচ্ছি অন্য কোন নারীকেতো নিয়ে যাচ্ছি না। ঘরে বিছানায় শুয়িয়ে প্রথমে যেয়ে পানি গরম করে নিয়ে এসে তা দিয়ে আমার কোমরে ছ্যাঁকা দিতে শুরু করলো। অনেক সময় এমন করার পর একটা সময় নিজের দু’হাত দিয়ে কোমর টিপে দিতে শুরু করলো। একটা সময় আমার ব্যথা কমে আসলো। সেই সাথে কখন যে দু’চোখ বুঝে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম তাও বলতো পারবো না। যখন দু’চোখ মেলে তাকিয়ে ছিলাম তখন গভীর রাত ছিলো চোখ মেলে নিজেকে আবিষ্কার করেছিলাম আবিরের বাহুডোরে। কি যে সুখকর অনুভুতি ছিলো সে সময়, সে দিন গুলোয়। আমিও আবিরের গলা জড়িয়ে বুকের মাঝে মাথা রেখে ঘুমিয়ে যেতাম। আজ হাতে এতো যন্ত্রনা হচ্ছে অথচ দেখার মত মানুষ নেই। একটু মলম লাগিয়ে দেবার মত আপন কেউ নেই, পরম মমতায় বলার মত কেউ নেই খুব কি জ্বলছে? জীবনটা কেমন করে জানি পরিবর্তন হয়ে গেলো। আজ একজন আপন মানুষের বড্ড বেশী অভাব অনুভব করছি জীবনে।

– ভাবনায় ছেদ পরলো মামার ডাকে, কখন যে সকাল গড়াতে গড়াতে বেলা বেড়ে এগাড়েটা বেজে গেছে সেদিকে আমার কোন খেয়াল নেই। আমি রাইসাকে ডেকে ফ্রেস করে মামার পাশে যেয়ে বসলাম। মামী ভাত বেড়ে দিলে আমি রাইসার মুখে তুলে খায়িয়ে দিলাম। রাইসার খুব খুদা লেগেছে বুঝতে পারলাম ওর খাওয়া দেখে। আবিরের সংসারে আর যাই হোক আমার মেয়ের খাবার কোন কষ্ট হয়নি। ঘরে ওর জন্য কিছু না কিছু কিনে এনে রাখতো আবির। আর এখানে মামী একবার যা দেয় তা দু’জনে চুপচাপ খেয়ে নেই, দ্বিতীয় বার আর মামীর কাছে ভাত চাওয়ার মত সাহস হয়না। এমনিতেই মামার ঘাড়ে বসে খাচ্ছি, যদি দ্বিতীয়বার খাবার চাওয়াতে মামী মুখের উপর কিছু বলে দেয়, সে লজ্জায় চাইতে পারি না। মামীও আর দ্বিতীয় বার খাবার নিতে বলে না। খাওয়া শেষ হতেই মামা বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলেন। আমি রাইসাকে ঘরে নিয়ে যেয়ে রেখে আবার ফিরে আসলাম রান্না ঘরে। থালা বাসুন গুলো নিয়ে বের হয়ে গেলাম ধুয়ে রাখার জন্য। দেখতে দেখতে এভাবেই তিনটা দিন কেটে গেলো। মনের ভিতর কোন রকম শান্তিই পাচ্ছি না। বরং ভিতর ভিতর আরও অনেক বেশী জ্বলে পুড়ে ছাঁই হয়ে যাচ্ছি। মেয়েটাকেও ঠিক মত খাওয়াতে পারছি না। নিজেকে বড্ড বেশী অসহায় মনে হচ্ছে নিজের কাছে। মা হয়ে নিজের মেয়ের মুখে দুইবেলা ঠিক মত খাবার তুলে দিতে পারছি না। এর চেয়ে অসহনীয় আর কি বা হতে পারে? তেমন কোন কিছুই আমি জানি না। যে বাহিরে যেয়ে কিছু একটা করবো। এদিকে গ্রামে মেয়েদের করার মতও কিছু নেই। মাথার ভিতর যখন হাজার রকম চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে ঠিক তখনি বাহির থেকে মামীর ভাইয়ের ছেলের কণ্ঠ সুর ভেসে আসলো। এই লোকটা প্রচণ্ড বাজে চরিত্রের, স্কুল কলেজে যাবার সময় দেখতাম নেশা করে রাস্তার ভিতর মেয়েদের সাথে বাজে ব্যবহার করতো। মাঝে মাঝে মেয়েদের উড়না ধরে টানাটানি করতো। এমন কি কখনো কখনো তাদের শরীরেও হাত দিতো। ছোট বেলা থেকেই এই লোকটাকে আমি প্রচণ্ড রকমের ভয় পাই। আগে যখন লোকটা আমাদের বাড়িতে আসতো আমি কোন না কোন বাহানা দেখিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতাম। এ লোকটার চাহনী খুবি বাজে।

– মামী বাহির থেকে ডাকতে শুরু করলো আমাকে রুকাইয়া কই গো বাহিরে আসো মেহমান আসছে।

— আমি মামীকে বলে দিলাম আমার শরীরটা ভালো লাগছে না আমি বের হবো না।

– মামী কিছু সময় একা একাই বকবক করলো। এমন সময় তার ভাইপো জব্বার বলে উঠলো ফুপু থামোতো, তোমার ভাগ্নীতো রঙ্গীলা রূপবান, সে কি পর পর পুরুষের সামনে আসবে?

– মামী সাথে সাথেই বলে উঠলো ওমন রূপ থেকে লাভ কি? যে রূপে স্বামীকে বেঁধে রাখতে পারেনি, স্বামীকে আরেকটা বিয়ে করতে হয়েছে? আমারতো মনে হয় নিশ্চই কোন সমস্যা আছে না হলে ওর স্বামী কেন আবার বিয়ে করবে?

– মামীর মুখে এমন বাজে কথা শুনবো আগে কখনোই ভাবিনি। চোখ দিয়ে টপটপ করে বৃষ্টির মত পানি পরতে শুরু করলো আমি একদম স্তব্ধ হয়ে গেলাম।

#চলবে…
আগের পর্বের লিংক
https://www.facebook.com/groups/2401232686772136/permalink/3139015306327200/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here