বেলা_অবেলা-৫ম পর্ব ©শাহরিয়ার

0
2231

বেলা_অবেলা-৫ম পর্ব
©শাহরিয়ার

আমার প্রচণ্ড রাগ উঠছিলো ইচ্ছে করছিলো সব ছুড়ে ফেলে দেই, কিন্তু তা পারলাম না। নিজের মনকে শান্ত রেখে চুপচাপ রান্না ঘরের ভিতর ঢুকে পরলাম। মামী আর আমি দু’জন মিলে খুব ভালো ভাবে সেই মাছ ভেজে রান্না করলাম। রান্না শেষ হতেই জব্বার মিয়া হাজির হলো। খাবার খেতে বসে বার বার আমার দিকে আড় চোখে তাকাচ্ছিলো। মামীর দিকে তাকিয়ে জব্বার মিয়া বললো রান্নাটা খুব মজা হয়েছে। অনেক দিন পর সে ভালো মন্দ খাচ্ছে বউটা চলে যাবার পর অনেক দিন বাড়িতে ভালো মন্দ রান্না হয়না। মামী বলে উঠলেন তাড়াতাড়ি আরেকটা বিয়ে করতে। মে লাজুক হাসি হেসে বললো ফুপু কি যে বলো না। আজ কাল ভালো মেয়ে পাওয়া যায় কই। মামা বললো সবই কপাল, তোর বউটা চলে গেছে আর দেখ রুকাইয়ার স্বামীটা আরেকটা বিয়ে করে নিছে। এতো ভালো লক্ষ্মী একটা মেয়ে ওর স্বামী এমনটা করবে ভাবা যায়? আমার খুব বিরক্ত লাগছিলো এসব কথা শুনতে। আমি মামাকে বললাম এসব কথা বাদ দাও। আমার এসব কথা শুনতে ভালো লাগছে না। মামী প্লেটে আরেক পিছ মাছ দিতে দিতে বললো তা ভালো লাগবে কেন? খাচ্ছিসতো মামার হোটেলে কথা শুনতে কি ভালো লাগবে? মামীর কথায় মামা কিছুটা রেগে গেলো, সে সাথে সাথে প্রতিবাদ করে বললো এসব কি বলছো তুমি? আমাদের কোন সন্তান নেই রুকাইয়া যদি আমার মেয়ে হতো আমি ফেলে দিতাম? মামা প্রতিবাদ করলেও মামীর মুখ থেকে খাবারের খোঁটা শোনার পর আর একটা দানাও পেটে যেতে চাচ্ছিলো না। কোন রকমে প্লেটের ভাত গুলো রাইসাকে খায়িয়ে দিচ্ছিলাম। রাইসার খাওয়া শেষ হতেই আমি রাইসাকে নিয়ে সেখান থেকে উঠে চলে আসি। আমার পর পর মামাও খাওয়া শেষ করে চলে আসে। আমি রাইসাকে বুকে নিয়ে শুয়ে পরি। একটু পর মামা দরজার সামনে এসে ডাক দিয়ে জিজ্ঞাসা করে ঘুমিয়ে পরেছি কিনা। আমি মামাকে বলি না মামা ভিতরে আসেন।

– মামা ভিতরে ঢুকে খাটের এক কোনায় বসে বললো তোর মামীর কথায় কিছু মনে করিস না, তুইতো সবই জানিস তোর মামী এরকমই।

– আমি না মামা আমি কিছু মনে করিনি।

– মামা মারে জানি তুই কষ্টে আছিস, তার উপর তোর মামীর কথা বার্তাও ভালো না। জানি সে তোকে আরও কষ্ট দিয়ে কথা বলে। আমার সামনেই এমন করে আমি না থাকলে না জানি আরও কত কি বলে।

– কথা গুলো বলে মামা আমার দিকে অসহায়ের মত তাকালো। আমার প্রচণ্ড কষ্ট লাগছিলো মামার দিকে তাকাতে, আমি মাথা নিচু করে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললাম। মামা কি যে বলো না তুমি আমার কোন রকম কষ্ট হচ্ছে না। আর ছোট বেলা থেকেই মামীর মুখের কথা শুনতে শুনতে বড় হয়েছি, এসব এখন আমার সহ্য হয়ে গেছে।

– মামা তাহলে তুই এখন ঘুমা আমি যাচ্ছি আমার খুব ঘুম চাপছে।

– মামা উঠে চলে গেলেন, আমি দরজা লাগাতে যেয়ে দেখি মামী আর জব্বার মিয়া তখনো রান্না ঘরে ফিসফিস করে কথা বলেই চলেছে। আমি খুব ভালো ভাবে দরজা লাগিয়ে দিয়ে এসে শুয়ে পরলাম। এই লোকটার কোন বিশ্বাস নেই, নিশ্চই মামীর সাথে বসে কোন রকম খারাপ কিছুর ফন্দি করছে। ঘরের লাইট নিভিয়ে দিয়ে চুপ করে শুয়ে রইলাম। কিন্তু চিন্তায় কোন ভাবে দু’চোখের পাতা এক হচ্ছিলো না। মনের ভিতর অজানা এক ভয় কাজ করছিলো। নানান রকম চিন্তা করতে করতে রাত গভীর থেকে গভীর হতে থাকলো কিন্তু দু’চোখের পাতা এক করতে পার ছিলাম না। বাহিরে যে উঁকি মেরে দেখবো সে উপায় ও নেই। যদি জব্বার মিয়া বাহিরেই থাকে। যেমনটা করতো কলেজে যাবার পথে খপ করে মেয়েদের শরীরে হাত দিয়ে বসতো। যদি দরজা খুললে আমার সাথে খারাপ কিছু করে? সে ভয়ে দরজার সামনে যাবার সাহস হলো না। আর যাই হোক কারো কাছে নিজের সতীত্ব বিলিয়ে দিতে পারবো না। যে করেই হোক যত লড়াই করেই হোক না কেন, নিজের মান সম্মান আমি ঠিকই অক্ষুণ্ণ রাখবো। রাত শেষে ভোরের দিকে মসজিদ থেকে ভেসে আসলো ফজরের আজানের সুর অল্প কিছুক্ষণ পর মামা উঠে পরলেন। বের হয়ে আসলেন অযু করার জন্য মনে সাহস পেলাম। আমিও উঠে দরজা খুলে বের হলাম। যে ভয়ে যার ভয়ে সারা রাত পার করেছি সে নেই। হয়তো রাতেই চলে গিয়েছে। মামী একা রুমে ঘুমাচ্ছে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছি মামার অযু করা শেষ হলে মামা বাড়ির বাহিরে চলে গেলো। আমি যেয়ে ওযু করে নিজের রুমে এসে দরজা লাগিয়ে জায়নামাজে বসে পরলাম। নামাজ শেষে আল্লাহর কাছে দু’হাত তুলে মোনাজাতে বললাম। আল্লাহ আপনি হেফাজত কারি, আমাকে হেফাজত করুণ। আমার সন্তানটাকে মানুষের মত মানুষ করার মত ধৈর্য আর পথ দেখান আমাকে। নামাজ শেষে বিছানায় উঠে শুয়ে পরলাম। সারা রাত জেগে থাকায় শরীর খুব ক্লান্ত লাগছে। খুব বেশী সময় লাগলো না এবার দু’চোখের পাতা এক হয়ে যেতে। অল্প সময়ের ভিতর গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে পরলাম।

– ঘুম ভাঙলো প্রায় সাড়ে দশটার দিকে, বাহির থেকে মামীর ডাকে রাইসার ঘুম ভেঙে গেলে রাইসা আমাকে ডেকে তুলে। আমি রাইসাকে কোলে নিয়ে ঘরের দরজা খুলে বের হই। ফ্রেস হয়ে রান্না ঘরে যাই, ততক্ষণে মামাও চলে আসে। মামী সবাইকে খাবার বেড়ে দেন, রাইসাকে কয়েক গাল মুখে তুলে খায়িয়ে দিয়ে নিজে মুখে খাবার তুলতে যাবো এমন সময় মামী বলে উঠে।

– তুই আবিরকে ডিভোর্স দিয়ে দে।

– মামীর কথায় আমি অবাক হয়ে যাই কি বলছে এসব মামী?

– মামী আবারও বলতে শুরু করে যেহেতু তার সংসার ছেড়েই দিয়েছিস সেহেতু ঝুলিয়ে রেখে লাভ কি? আমি বলি ওকে ডিভোর্স দিয়ে তুই বিয়ে করে নতুন করে সংসার কর।

– মামা খেতে খেতেই মামীকে দমক দিয়ে বললো চুপ করো একদম চুপ। তোমার কি জ্ঞান বুদ্ধি কিছুি হয়নি? বয়সতো কম হয়নি সব চুল পেঁকে গেছে অথচ কথা বলতে শিখতে পারলে না। ওকে কখনো কি নিজের মেয়ের মত ভাবছো তুমি?

– মামী ভাবছি বলেইতো বললাম, সারা জীবনতো আর এভাবে থাকতে পারবে না। পূর্ণ যৌবনা, বরই গাছ থাকলে যেমন ছেলে মেয়েরা ইট ছুড়ে মারে, ঠিক তেমনি বাড়িতে যুবতি মেয়ে মানুষ থাকলেও মানুষ নানা রকম ইঙ্গিত করে।

– মামা কে কি বললো কে কি করলো তা আমি দেখে নিবো।

– মামী চেঁচিয়ে বলে উঠলো আপনি কি দেখবেন হ্যাঁ দুনিয়ার কোন কিছুই আপনি বুঝেন না। আমি যা বললাম ও তাই করবে, আবিরকে ডিভোর্স দিয়ে দিবে তারপর আমরা ওকে জব্বারের সাথে বিয়ে দিয়ে দিবো। জব্বারের কম আছে নাকি।

– মামা শান্ত গলায় বললেন তোমার মাথা কি ঠিক আছে? কোথায় জব্বার আর কোথায় আমাদের রুকাইয়া।

– আমার বুঝতে বাকি রইলো না গত রাতে মামী আর জব্বারের কি নিয়ে কথা হইছে। মামা আর মামী তর্ক করছে আমি আর সেখানে বসে খেতে পারলাম না। হাত ধুয়ে সেখান থেকে উঠে বের হয়ে আসলাম। ঘরে ঢুকে আমার আর রাইসার জামা কাপড় গুলো গুছিয়ে ব্যাগে ভরে নিলাম। জানি এখানে থাকলে মামী একটা অঘটন ঘটিয়েই ছাড়বে। আমার পুরো জীবনটা সেই সাথে আমার মেয়ের জীবনটাও নষ্ট করে দিবে। যেখানে ওকে সৎ মায়ের ভয়ে রাখিনি সেখানে আমি বিয়ে করবো তা কল্পনারও বাহিরে। এক মুহুর্তও আর দেরী না করে রুম থেকে বের হয়ে আসলাম, বের হতেই মামা দৌঁড়ে আসলেন। অপরাধীর মত আমার দিকে তাকিয়ে বললো মারে কই যাবি তুই? এখানেই থেকে যা।

– মামী চেঁচিয়ে বলে উঠলো যে মেয়ে স্বামীর সংসার ফেলে চলে আসে সে মেয়ের এখানেও থাকার কোন দরকার নেই।

– আমি মামাকে জড়িয়ে ধরে খুব করে কাঁদলাম। তার পর চোখের পানি মুছে মামাকে বললাম ভয় নাই মামা। এই বাড়ি সম্পত্তির ভাগতো কখনো চাইনি আর কোন দিন চাইবোও না। তুমি বরং একটা কাজ কইরো সব কিছু তোমার আর মামীর নামে লেখে একটা দলিল করে রেখো। যদি বেঁচে থাকি আবার কখনো তোমাদের এখানে আসি আমি সেগুলোতে সাইন করে দিবো। আর আল্লাহর দুনিয়াটা অনেক বড় কোথাও না কোথাও মাথা গোঁজার জন্য নিশ্চই একটু জায়গা মিলে যাবে। মামার চোখে পানি ছলছল করছে। আমি আর এক মুহুর্তও দাঁড়াতে পারলাম না সেখানে, এক হাতে রাইসার হাত শক্ত করে ধরে অন্য হাতে ব্যাগ নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে হাঁটা শুরু করলাম। হাঁটতে হাঁটতে অনেক চিন্তা করে দেখলাম এখানে আর নয় আমাকে ঢাকা যেতে হবে। কিন্তু আমার কাছে কোন টাকা পয়সা নেই। কিভাবে যাবো। বাজারে এসে পরিচিত স্বর্ণ কারের দোকানে গেলাম। আমাকে এতোদিন পরে দেখেও চাচা চিনতে পারলেন। আমি শাশুড়ি আম্মার দেয়া বালা দু’টো খুলে চাচাকে দিয়ে বললাম এগুলা রেখে আমাকে কিছু টাকা দেন। চাচা অবাক হয়ে গেলেন। কি সমস্যা জানতে চাইলেন। আমি বলতে না চাইলেও সে জোড়াজোড়ি করাতে তাকে সব খুলে বললাম। সেও তার চোখের পানি ধরে রাখতে পারলো না। টিসু দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে আমার বালা দু’টো আমাকে ফিরিয়ে দিয়ে বললো। তোমার বালা লাগবে না, আমি তোমাকে কিছু টাকা দিচ্ছি। আমি বললাম না চাচা আপনি এই দু’টো রেখেই টাকা দিন। যদি উপকার করতে চান তবে এই বালা দু’টো বিক্রি করবেন না। আমি শহরে যেয়ে কিছু একটা করে এই দু’টো নিয়ে যাবো। চাচা বললো আমি যতদিন বেঁচে আছি এ বালা বিক্রি করবো না। তুমি যখন পারবে এসে নিয়ে যাবে। আমি চাচার কাছ থেকে টাকা নিয়ে বাসে উঠে রওনা হলাম অচেনা শহর ঢাকার উদ্দেশ্যে। শুনেছি ঢাকা শহর নাকি মানুষের ভাগ্য বদল করে দেয়। আমার মত অভাগির কপালে কি আছে তাতো শুধু আল্লাহ জানে। ভাবতে ভাবতে একটা সময় বাসের সিটে ঘুমিয়ে গেলাম।

#চলবে…

আগের পর্বের লিংক

https://www.facebook.com/groups/2401232686772136/permalink/3140664636162267/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here