বেলা_অবেলা- ১ম পর্ব

0
1705

অনেক কষ্টে নিজের চোখের পানি লুকিয়ে আবিরকে বললাম তোমরা দু’জন দাঁড়াও, আমি ঘরটা ঠিক করে দিচ্ছি। আবির মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। আমি আর এক মুহুর্তও সেখানে দাঁড়াতে পারলাম না। দ্রুত ঘরের ভিতর ঢুকে পরলাম। মাথাটা ভনভন করে ঘুরছে, দাঁড়িয়ে থাকতে প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে। কোন রকমে নিজের এতো দিনের ঘরটা গুছিয়ে দিয়ে বাহিরে এসে বললাম আপনারা ভিতরে যেতে পারেন। কথাটা বলে আর এক মুহুর্ত দেরী না করে রাইসাকে কোলে নিয়ে পাশের রুমে যেয়ে শুয়ে পড়লাম। চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পরছে। রাইসার গালে পানির ফোটা পরতেই রাইসা আমার দিকে চেয়ে প্রশ্ন করলো আম্মু তুমি কাঁদছো কেন? আমি চার বছরের রাইসার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলাম না। বরং ওকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করলাম। কান্না করতে করতে মেয়েকে বুকে নিয়ে এক সময় ঘুমিয়ে পরলাম। ফজরের আযানে চোখ মেলে তাকাতেই হৃদয়টা কেঁপে উঠলো বিয়ের পর এই প্রথম কোন দিন ঘুম থেকে জেগে আমি আবিরের মুখ দেখতে পেলাম না। সে আজ আমাকে বলবে না আর একটু সময় আমার বুকে শুয়ে থাকো। সমস্ত শরীর যেন অবস হয়ে আসছে আমার কথা গুলো ভাবতেই। অথচ পাশের রুমে আজ আবির নতুন কাউকে নিয়ে শুয়ে আছে। আজ আবিরের বুকে অন্য নারী মাথা রেখে শুয়ে আছে। যে বুকে দীর্ঘ সাতটা বছর আমি মাথা রেখেছি। আজ সে বুকে অন্য কারো স্থান হয়েছে। কথা গুলো ভাবতে ভাবতে দরজা খুলে বের হয়ে আসলাম বাহিরে কল অযু করতে হবে। তখনো দেখলাম ওদের রুমের দরজা লাগানো। তাড়াতাড়ি ওযু করে আবারও রুমে চলে আসলাম। নামাজ শেষে আল্লাহর দরবারে দু’হাত তুলে কান্না করে দিলাম। জানি না কোন অপরাধে আল্লাহ আমাকে এমন শাস্তি দিয়েছেন। সেই ছোট বেলা থেকেই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে আসছি। কারো মনে কখনো কষ্ট দেইনি নিজের জানা মতে। তবুও আল্লাহ আমাকে কেন এতো কঠিন শাস্তি দিলো এটাই আমি ভেবে পাচ্ছি না। নামাজ শেষ করে রুম থেকে বের হয়ে রান্না বসিয়ে দিলাম, আবির কিছুক্ষণ পরেই হয়তো খেয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবে কাজের জন্য। একটু পরেই শাশুড়ি আম্মা নিজের ঘর থেকে বের হয়ে আসলেন। রান্না ঘরে আমার পাশে বসে ভাঙা হৃদয় নিয়ে বলতে শুরু করলেন, বুঝলিরে মা সবই কপাল। কি করমু বল একটা মাত্র ছেলে তার মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতেও পারি না। ছেলেটা যে এমন কাণ্ড করে বসবে তা কোন দিনও আমি ভাবতে পারি নাই। আমি শাশুরির দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে সত্যিই মা সবই আমার কপালের দোষ। আম্মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে, মারে দেখিস এই মেয়ের জন্য একদিন আমার ছেলের অনেক কষ্ট পেতে হবে। আমি আম্মাকে বললাম এসব বলবেন না। সে আপনার সন্তান। আম্মা হাউমাও করে কেঁদে দিলেন আমার সামনে। আমাকে জড়িয়ে ধরে আমাকে তুই ক্ষমা করে দিস রুকাইয়া, অনেক সখ করে তোকে এ বাড়ির বউ বানিয়ে নিয়ে এসেছিলাম। নিজের কোন মেয়ে নেই, তোকেই নিজের মেয়ের মত দেখেছি। ও যে কিসের আশায় কোন লোভে এমনটা করলো আল্লাহ জানে। আম্মাকে খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আপনি কাঁদবেন না আম্মা আমার খুব কষ্ট হয় আপনার চোখের পানি দেখলে। ছোট বেলায় মা বাবা হারিয়ে এতিম হয়েছিলাম। আপনাকে পেয়ে বুঝেছি মায়ের আদর কেমন হয়। ততক্ষণে আবিরের রুমের দরজা খুলে গিয়েছে, আবির রান্না ঘরের দিকে আসতেই শাশুড়ি রুম থেকে বের হতে হতে বলতে শুরু করলেন আমি মা হয়ে বলতাছি ঐ মেয়েকে নিয়ে তুই কোন দিনও সুখে থাকতে পারবি না। মা চলে যেতেই আবির আমার হাত চেঁপে ধরে, আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও রুকাইয়া, কিভাবে কি হয়ে গেলো আমি বুঝতে পারিনি। যে হাতের স্পর্শে আমি ভালোবাসা খুঁজে পেতাম আজ সে হাতের স্পর্শে বড্ড ঘৃণা লাগছে। তাই তার হাত থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিয়ে মুখে মিথ্যা হাসি ফুটিয়ে বলতে শুরু করলাম ফ্রেস হয়ে আসুন আমি আপনার জন্য খাবার বেড়ে দিচ্ছি। আবির খুশি মনেই চলে গেলো ফ্রেস হবার জন্য। রান্না শেষ করে টেবিলে খাবার বেড়ে দিয়ে আমি চলে আসলাম রাইসার কাছে। রাইসার কপালে চুমু দিয়ে বুকে জড়িয়ে শুয়ে রইলাম। জানি না মেয়েটার কপালে কি আছে। আবির চলে যাবার অনেকটা সময় পর নতুন বউ ঘুম থেকে উঠলো। তাকে দেখে আম্মা চেঁচামেচি করতে শুরু করলো। আমি যেয়ে আম্মাকে শান্ত করে ঘরে নিয়ে রাখলাম। আম্মা কেঁদেই চলছে। আমি জানি এ কান্না আমার কষ্টের কারণে। আমি আম্মাকে শান্তনা দেবার কোন ভাষাই খুঁজে পাচ্ছি না। আম্মা কোন ভাবেই নতুন বউকে মেনে নিতে পারছে না।

দেখতে দেখতে তিনটা দিন কেটে গেলো। এদিকে কান্নাকাটি করতে করতে আম্মা খুবি অসুস্থ হয়ে পরলো। সেদিকে আবিরের বিন্দু পরিমাণ খেয়াল নেই। অথচ আবির ছোট থাকতে আমার শ্বশুড় মারা যায়। তখন থেকে মা বাবা দু’জনের দায়িত্ব পালন করে আসছিলো আমার শাশুড়ি। বিয়ের পর দেখেছি আম্মা একটু অসুস্থ হলে আবির কতটা অস্থির হয়ে যেতো। কেমন করে এই মানুষটা বদলে গেলো আমি বুঝতে পারছি না। মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি আবিরের অবহেলা ভুলে থাকার চেষ্টা করি। কিন্তু চাইলেও কি সব ভুলে থাকা যায়? যায় না যে মানুষটার সাথে এতোদিন ধরে সংসার করছি সে মানুষটাকে কি করে ভুলে থাকবো? যে ঘরটা আমার ছিলো সে ঘরটা আমার নাই। ভাবতেই বুকের ভিতরে এক অদ্ভুত রকমের ব্যথা অনুভুত হয়। এতোদিনের সাজানো সংসার কেমন করে তছনছ হয়ে গেলো। যে মানুষটা আমাকে ছাড়া কিছু বুঝতো না সে মানুষটা আজ অন্য নারীতে আসক্ত। দিব্বি হেসে খেলে দিন পার করে দিচ্ছে তার সাথে। অথচ এই মানুষটাই আমাকে কথা দিয়েছিলো সুখে দুঃখে সারাটা জীবন আমার পাশে থাকবে। আমাদের দু’জনের মাঝে হাজার কষ্টেও ভালোবাসার কমতি হবে না কোন দিন। সেই মানুষটা কেমন করে বদলে গেলো? এতোটা স্বার্থপর কেমন করে হলো। আমি তো কখনোই তাকে ভালোবাসতে কমতি রাখিনি। সব রকম সুখ আমি তাকে দেবার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি সে দৈহিক হোক আর ভালোবাসার হোক। সব রকম খেয়াল রেখেছি সেই মানুষটা আমার থেকেও আর আমার রইলো না।

– রাইসা মা ও মা আমার খুব খুদা লেগেছে।

রাইসার কথায় চোখের পানি মুছে রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম। মেয়ের জন্য খাবার বেড়ে নিয়ে আবারও ঘরে চলে আসলাম। মেয়েকে খাইয়াতে খাওয়াতেই আম্মার ঘর থেকে চিৎকারের শব্দ কানে ভেসে আসলো। দৌঁড়ে চলে গেলাম সেখানে। আম্মা মাটিতে পরে কান্নাকাটি করছে আর আমাকে ডাকছে। আম্মাকে ধরে বিছানায় তুলতে যাবো। আম্মা আমার হাত শক্ত করে চেঁপে ধরে, রুকাইয়া আমার সময় শেষ হয়ে আসছে, আমাকে এক গ্লাস পানি খাওয়াবি আমি তোর হাতে শেষ বারের মত পানি খেয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে চাই। আমি চিৎকার করে রাইসার আব্বুকে ডাকছি অথচ সে শব্দ তার কান অব্দি পৌঁছালো না। সে নতুন বউ নিয়ে বেশ আনন্দে ঘরের দরজা বন্ধ করে শুয়ে রইলো। আম্মার মুখে পানি তুলে দেবার পর আম্মা শুধু আমার মাথায় হাত রাখলো। আর কোন কথা বললো না। আমি হাউমাউ করে কান্না করতে থাকলাম আর আবিরকে ডাকতে থাকলাম। এক সময় আবির দরজা খুলে আম্মুর ঘরে আসলো। আমি তার দিকে তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো চোখেই বললাম বড্ড দেরী করে ফেলছেন আসতে। আম্মা আর নেই। এতো বার ডাকলাম একটা বার ও কি আমার কণ্ঠ আপনার কান অব্দি পৌঁছায়নি? আপনি কেমন যেন হয়ে গেছেন রাইসার আব্বু।

– আবির আমাকে কিছুটা রাগান্নিত হয়েই বললো বয়স হয়েছে মারা গেছে। যার যখন সময় হবে তখন সে চলে যাবে এটাই নিয়ম। এতো নেকা কান্নার কিছু নেই।

আমি বাকহীন হয়ে গেলাম আবিরের এতোটা পরিবর্তন দেখে। নিজের মায়ের মৃতুতেও তার হৃদয়ে এক বিন্দু পরিমাণ আঘাত লাগেনি। এই মানুষটা কি করে এমন হলো আমিতো ভেবেই পাচ্ছি না। মানুষটা আর মানুষ নেই সে পাথর হয়ে গেছে। নাকি তাকে অমানুষ বলবো তাও আমি ভেবে পাইনা। আমার দু’চোখ বেয়ে শুধু পানিই পরছে। এ বাড়িতে যে আর আপন বলতে কেউ রইলো না। দেখতে দেখতে মানুষজন দিয়ে বাড়ি ভরে গেলো। নানান জন নানান কথা বলছে। একটা সময় সাদা কাফনের কাপড়ে জড়িয়ে মাকে নিয়ে রওনা হলো সকলে। আমি চিৎকার করছি আর বলছি আমাে আম্মাকে রেখে যান। আম্মা ছাড়া যে আমার আর কেউ নাই। সে কথা কেউ শুনলো না। আশে পাশের মহিলারা আমাকে শক্ত করে ধরে রেখেছে। একটা সময় আমার দু’চোখ অন্ধকার হয়ে এলো। তারপর আর কিছুই আমার মনে নেই। আমার সেন্সলেস হয়ে পরে গেলাম। যখন জ্ঞান ফিরলো তখন নিজেকে আবিষ্কার করলাম নিজের রুমে। পাশেই শুয়ে ঘুমাচ্ছে রাইসা। তখন গভীর রাত, আম্মা আর নেই কথাটা মনে পড়তেই আমি আবার কান্না করতে শুরু করলাম। আবির হয়তো তখন তার নতুন বউকে বুকে জড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। এটা ভাবতেই আমার হৃদয়টা ফেটে যাচ্ছিলো।

#চলবে…

বেলা_অবেলা- ১ম পর্ব
©শাহরিয়ার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here