বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ পর্ব ২

0
1409

বৃষ্টিশেষে_প্রেমছন্দ
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন

০২.
বাতাসে মৃদুমন্দ কাঁপন। ঝড়ো হাওয়ায় ঝাপটে আসছে বৃষ্টির ছন্দ সাথে দুজন তরুণীর মস্তিষ্কের উত্থাপিত চিন্তার দ্বন্ধ। শনশন বাতাসে উড়ছে অবিরাম টিকলির কোমড় ছাড়িয়ে লম্বা কালো ঘন রেশমির ন্যায় চুলগুলো। নখ কামড়াতে কামড়াতে নিজের বিশাল বড় ঘরটার এ মাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত সে পায়চারি করে চলেছে আধ ঘণ্টা যাবৎ। তার ওই এক দোষ, নখ কামড়ানো! চিন্তায় থাকলেই সে নখ কামড়ায়।
বৃষ্টির ছিটায় মেঝে হয়ে গেছে চিপচিপে। অসর্তকতাবশত কেউ সেখানে পা ফেললেই ধপাস করে পরে যাবে তা নিশ্চিত। টিকলি চোখের চশমাটা ঠিক করে কাচের জানালাটা বন্ধ করে দিলো। কপালে সূক্ষ্ম কিছু ভাঁজ ফেলে নখ কামড়াতে কামড়াতেই বলল,

‘আচ্ছা টায়রা, ওই লোকটা কি বাবাকে সব বলে দিবে রে?’

টায়রা! টিকলির এক বছরের একটামাত্র ছোটো বোন। পিঠাপিঠি বোন হওয়ায় তারা একই ক্লাসে পড়ে এসেছে। একই সঙ্গে থেকে এসেছে সবসময়।

টায়রা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বিছানায় আরাম করে শুলো। ওর আবার চিন্তাভাবনা কম কাজ বেশি। কাজ মানে বাদরামো। বড় করে একটা হাই তুলে সে বলল,

‘আমি জানি নাকি? আর এতো নখ খাস কেন? নখ খেলে জামাই ফকির হয়ে যায়।’

‘বিয়েই করতে চাইতাছি না আর তুই জামাই ফকির হয়ে যায় নিয়াইছস?’ টিকলি বলল বিরক্ত গলায়।

‘প্ল্যান কি কাজে দিছে? রিপোর্ট দেখতে চাইছিলো? কি কি বলছোস?’

টিকলি চিন্তিত মুখে বলল, ‘কাজে দিছে কিন্তু সমস্যা হলো আমি বলছি যে আমি পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট। ‘

টিকলির কথাটা শুনামাত্র টায়রা ঝট করে লাফিয়ে শুয়া থেকে উঠে বসলো। এরপর তার ফাটাবাঁশের মতোন গলায় চেঁচিয়ে বলে উঠলো, ‘হোয়াট? মানে গর্দভেরও তো একটা লিমিট থাকে ভাই। তুই কোন লেভেলের গর্দভ?’

ফুসে উঠে টিকলি বলল, ‘একটা চর খাবি। আমি তোর থেকে এক বছরের বড় মনে রাখিস।’ টায়রা চুল হাওয়ায় উড়িয়ে দেওয়ার মতো কথাটাও উড়িয়ে দেয়। টিকলি এবার একটু অসহায় গলায় বলে, ‘আমি কি করবো বল তো? আমি এতো নার্ভাস ছিলাম যে আমার হাত পা ঠকঠক করে কাঁপতাছিলো। যার কারনে ফট করে বলে দিছি আমি পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট। ‘

‘ভালো করছো। উদ্ধার করছো। এবার ছেলেটা বাবাকে ফোন দিয়ে বলুক আপনার মেয়ে পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট। আর পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট মেয়েকে বিয়ে করে তো আমি জাতির অপমান করতে পারিনা। নো, নেভার, কাবি নেহি। এটলিস্ট দুই তিনমাস হলে মানা যেতো। জাতির সামনে অন্তত মুখটা দেখাতে পারতাম।’

‘ফাইজলামি করবি তো কানের গোড়ায় খাবি।’

টায়রা রাগে গজগজ করে বলল, ‘কোন কুক্ষণে যে আমার চেয়ে একটা বছর বড় হতে গেলি তুই টিকলি? মাঝে মাঝে মনে হয় আমি তোর বড় হইলে তোরে এক ঘন্টা রোদে দাড় করায়ে তেঁতুল গাছের ডাল দিয়ে অনবরত পিটাতাম।’

‘টায়রার বাচ্চা….’

‘বাচ্চা হয়নাই তো। বিয়েই হইলো না এখনো আর বাচ্চা? এ জীবনে আর আমার বাচ্চা কাচ্চা হবে বলে মনে হয় নারে। কিভাবে হবে বল? মেশিন সরবরাহ করছে না বাবা মা। তাই প্রডাকশনও প্রডাক্ট দিতে চায় না।’ টায়রা বলল দুঃখী গলায়। টিকলি লজ্জায় চোখ মুখ কুচকে ফেলল। টায়রা টিকলির পাশে গিয়ে কাছে বসে আবার বলল, ‘যাই হোক, আচ্ছা ছেলে কেমন দেখতে ছিলো রে?’

‘আমি কি জানি?’ টিকলির বিরক্তিকর উত্তর।

টায়রা ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে, ‘তুই কি জানিস মানে?’

‘মাস্ক পরা ছিলো। মুখ দেখি নাই। আর দেখার ইচ্ছাও হয় নাই। লোকটা সেই লেভেলের ফাজিলের ঘরে ফাজিল।’

‘নাম কিরে?’

‘আমি কীভাবে জানবো? আমি কি আর নামের ধান্দায় ছিলাম? বিয়ে ক্যানসেল কীভাবে করবো এই চিন্তায় বাঁচি না আর তো নাম্বার!’

‘চিন্তা করে দুনিয়া উল্টায় ফেলছো একবারে। সেই তো আমারই মাথা খাটায়ে প্ল্যান বের করতে হইলো।’

‘কিন্তু ভাগ্যিস রিপোর্ট দেখে নাই। কারন ওটা তো আর রিপোর্ট ছিলো না, ছিলো এক পেত্নীর আজেবাজে আর্ট। আই এম সিউর রিপোর্ট দেখার উদ্দেশ্যে ফাইলটা খুলে এসব পেত্নীমার্কা আর্ট দেখলে লোকটা সেখানেই অক্কা পেতো।’

‘তুই আমাকে ইনসাল্ট করতাছোস? নিমকহারাম, বিশ্বাসঘাতক, প্রতারক, ছলানাময়ী।’

টায়রার এত্তো এত্তো অভিযোগের মাঝেই জামিলুর রেজার ভরাট গলায় ডাক পরলো। টিকলি টপাস করে দাঁড়িয়ে গেলো। বার দুয়েক হেচকি তুলে ঢোক গিলল। টায়রার হাত ধরে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘বাবা ডাকছে? ‘

‘তো আমি কি করতে পারি?’

টিকলি কাদো কাদো হয়ে বলল, ‘তুই আমার বোন না শত্রু?’
‘ভিলেন।’
‘তুই আসলেই একটা খারাপের বাচ্চা।’
‘দাড়া আমি এখনি গিয়ে আব্বুরে বলতাছি তুই আব্বুরে খারাপ বলছোস।’

টায়রা উঠে যেতে ধরে বাবার কাছে নালিশ ঠুকার জন্য। টিকলি তার বিচ্ছু বোনকে পড়িমরি করে আটকিয়ে অসহায় গলায় বলল, ‘বইন তুই এরম কেন?’

টায়রা দাঁত কেলিয়ে উত্তর দেয়, ‘তোর বইন যে।’

জামিলুর রেজা ঘরে পা রাখতেই দুই বোন থেমে একদম চুপ করে যায়। এদিকে টিকলির হৃদস্পন্দন ও থেমে যায়। দমকা ঠান্ডা বাতাস যেনো মুহুর্তে উত্তাপ আর গরমে পরিনত হয়। কি শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি! টিকলি শ্বাস ফেলতেও ভয় পাচ্ছে। যেনো নিঃশ্বাসের সাথে আজকের সব গোপন তথ্য ফাঁস হয়ে যাবে বাবা নামক ভয়ংকর মানুষটার সামনে। জামিলুর রেজার পেছন পেছন ঘরে ঢুকলেন শায়লা আক্তার। এতোক্ষনের আটকানো নিঃশ্বাস টা ছেড়ে দিয়ে টিকলি তোতলানো স্বরে বলে উঠলো,

‘মা বাবা? তোমরা? বসো না বসো।’

জামিলুর রেজা আর শায়লা আক্তার গিয়ে বসলেন। জামিলুর রেজা কিছুক্ষন দুই মেয়ের দিকে সূক্ষ্মভাবে তাকিয়ে থাকলেন। পর্যবেক্ষণ করলেন। তার দুই মেয়ে। আজই প্রথম বড় মেয়েকে পাঠিয়েছিলেন একটা ছেলের সাথে দেখা করতে। ইচ্ছে ছিলো বড় মেয়ের পরপর ই ছোট মেয়ের জন্যেও পাত্র খুঁজবেন। কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেলো!

টিকলি টায়রা দুজন দুজনের হাত খামচে ধরে তখন টেনশনে মুচড়া-মুচড়ি করছিলো। জামিলুর রেজার থমথমে মুখ দেখে টায়রা ঢোক গিলে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি হয়েছে বাবা?’

টিকলি সরে বসলো খাটের একদম কর্ণারে। তার নিঃশ্বাসের গতি স্থবির। আঙ্গুলে লাল উড়না অনবরত ঘুরে চলেছে চিন্তায়। পরিবেশে দমবন্ধের ছোঁয়া। জামিলুর রেজা টিকলির মাথায় হাত রাখলেন। এরপর তেজি গলায় বলা শুরু করলেন। তখনি যেনো আটকে গেলো টিকলির নিঃশ্বাস। রুদ্ধশ্বাসে সে শুনলো বাবার কথা।

‘কোথাও বিয়ে দিবো না আমার মেয়েকে। আমার এতো সুন্দর লক্ষী একটা মেয়ে।’

টিকলি চোখ বড় বড় করে তাকালো ঝট করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। আর একটু হলে সে মারা পরতো। কিন্তু একি শুনলো সে? কাহিনীর মধ্যে ভেজাল গল্প? জামিলুর রেজা আবার বললেন, ‘মারে ওই বাড়িতে তোকে বিয়ে দিবো না। বলি আমার মেয়ে কি আমার বাড়িতে বেশি হয়েছে নাকি হ্যাঁ?’

বাবাকে উত্তেজিত দেখে টায়রা বাবার পেছন থেকে আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি হয়েছে বাবা?’

‘আরে কি হয়নি সেটাই বল। বলে কিনা আমার মেয়ে প্রেগন্যান্ট। কত্ত বড় কথা! পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট মেয়েকে নাকি আমরা ঘুঁচিয়ে দিচ্ছিলাম তার বাড়িতে। মেয়ে কি আমার ঘরে বেশি হবে নাকি হ্যাঁ? ওমন বাড়িতে বিয়ে না দিলে কি আমরা না খেয়ে মরবো নাকি মেয়েকে আর বিয়ে দিতে পারবো না ?’ শায়লা আক্তার বললেন উঁচু গলায় হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে।

টায়রা উল্টো দিকে ঘুরে শব্দবিহীন ফিক করে হেসে দিলো। অন্যদিকে ঘুরে মুচকি হাসলো টিকলিও। টায়রা হাসি চেপে হায়হায় করে আগুনে ঘি ঢালার মতো বলল, ‘হায়হায় বলো কি! কি সাংঘাতিক কথা! আমার বোনকে পনেরো দিনের প্রেগন্যান্সির অপবাদ দেয়? এত্তো….বড় অপবাদ।’ টায়রা নেকামো ভঙ্গিতে হাত টাকে প্রসারিত করে দেখালো।

জামিলুর রেজা এবার জ্বলে উঠলেন, ‘ওদেরকে তো আমি দেখে নিবো। আমার মেয়ের নামে এতো বড় অপবাদ। পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট কেউ হয় নাকি? কেউ বুঝে নাকি?’

টায়রা বাবার কথায় সায় দিয়ে বলল, ‘ঠিক বলেছো বাবা। ডাক্তার দেখানো ছাড়া প্রেগন্যান্সি বুঝতে মিনিমাম এক মাস তো লাগবেই তাই না?’

টায়রা এমনি। লাগামহীন মেয়ে। কোথায় কি বলতে হয় তা জানে না। চঞ্চল, বেপরোয়া। সবার সাথেই এমন। টিকলিও চঞ্চল কিন্তু বিনয়ী। সে সবার সাথে চঞ্চলতা দেখায় না। ক্ষেত্রবিশেষে তার রূপ ধারন করে। এই মুহুর্তে টিকলি চিমটি কাটলো টায়রার হাতে। জামিলুর রেজা ভঙ্গি কাশি দিয়ে উঠে চলে গেলেন মেয়ের ঘর থেকে। শায়লা আক্তার যাওয়ার আগে চোখ পাঁকিয়ে বলে গেলেন, ‘টিকলির আগে তোর ই বিয়ে দিতে হবে দেখছি। পাকনা মেয়ে একটা।’

‘দেও না মা দেও। আর কতদিন জামাইয়ের মুখ দেখা ছাড়া থাকবো বলো তো? পরাণ যে জ্বলিয়া যায়। পরাণ যায় জ্বলিয়া রে…পরাণ যায় জ্বলিয়া রে।’ শেষের দু লাইন গান গেয়ে শুনিয়ে দিলো টায়রা। শায়লা আক্তার মেয়েকে বকতে বকতে চলে গেলেন।

সবশেষে টিকলি শব্দ করে হেসে দিলো। টায়রা উঠে ঝটপট জড়িয়ে ধরলো বোনকে। টুপ করে গালে একটা চুমু দিলো৷ টিকলি বোনের ফিরতি চুমু দিয়েও দিলো৷ এরপর একসাথে দুজনা হাসিতে মত্ত হলো।

এই হলো ওদের বোন-কেমিস্ট্রি! ঝগড়া, মারামারি, খোঁচাখোঁচি কিন্তু দুজন দুজনকে ছাড়া নো চলাচলি।

চলবে❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here