বিন্দু থেকে বৃত্ত পর্ব ৩৮

0
1729

#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_৩৮
জাওয়াদ জামী

কুহুর পরীক্ষা শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে চারটা পরীক্ষা হয়েছে। এবং সব-কয়টা পরীক্ষাই কুহুর খুব ভালো হয়েছে। কুহুর পরীক্ষার কেন্দ্র অনেকটা দূরে, তাই ওকে দুইদিন পৌঁছে দিয়েছে তাহমিদ আর দুইদিন গিয়েছে তাহমিনা আক্তার। সিক্তার সাথে যান আফরোজা নাজনীন সিক্তার পরীক্ষার কেন্দ্র আরও দূরে।

কুহু আর সিক্তা মনযোগ দিয়ে পড়ছে। এমন সময় রুমে তাহমিদের আগমন । কুহু তাহমিদকে দেখেও চুপচাপ পড়তে থাকে।

” কি রে, বুঁচি পড়াশোনা কেমন চলছে? ভালো করে পড়। রেজাল্ট ভালো না হলে মহাখালীর কোন বাদামওয়ালার গলায় ঝুলিয়ে দিব, বুঝলি? ” সিক্তার মাথায় চা’টি মে’রে বলল তাহমিদ৷ এরপর পা ঝুলিয়ে বসল সিক্তার খাটে।
” সত্যি করে বলতো, ভাইয়া। তুমি কি আমার পড়াশোনা সম্পর্কে জানতে এসেছ, নাকি কুহুরটা জানতে এসেছ? কুহুর বিষয়ে জানতে চাইলে আমার সাথে কথা বলে সময় নষ্ট না করে ওকেই জিজ্ঞেস কর। ” সিক্তা কাটকাট জবাব দেয়। সিক্তার জবাব শুনে তাহমিদ মাথা চুলকে হাসে।
” কুহু রে, আমাদের রুমে মেহমান এসেছে। তাকে কি দিয়ে আপ্যায়ন করি বলতো? এ আবার যে সে মেহমান নয়। ডাক্তারী পড়ুয়া মেহমান। তারউপর আবার তোর হবু জামাই। ”
” সত্যিই কিছু খাওয়াবি! তাহলে এক কাজ কর, রান্নাঘরে ট্রে-তে নুডলস রাখা আছে, নিয়ে আয়। চটজলদি যা, নইলে ঠান্ডা হয়ে যাবে। ”
তাহমিদের কথা শুনে সিক্তার মুখ হা হয়ে গেছে।
” রান্নাঘরে নুডলস রাখা আছে, তা তুমি জানো, সেটা তুমি না নিয়ে এসে আমাকে আনতে বলছ! ”
” ঐ যে বললি, আমি মেহমান। মেহমান কি নিজের খাবার নিজেই বয়ে নিয়ে আসবে? বোনের হবু জামাইকে সম্মানের এই নমুনা! ”
সিক্তা তাহমিদের কথার সাথে পেরে না উঠে দুপদাপ পা ফেলে নিচে যায়।
সিক্তা চলে যেতেই তাহমিদ খাট থেকে নেমে আসে কুহুর কাছে।
” রাতে আমি ছাদে অপেক্ষা করব। ঘুমানোর আগে একবার এস। আর হ্যাঁ এতটুকু সময় মনযোগ দিয়ে পড়বা বুঝলে। জামাই ছাদে ডেকেছে বলেই উতলা হতে হবেনা। ”
” আমি ঘুমাবো রাত একটার পর। আপনি তখন ছাদে থাকবেন! ”
” সেই চিন্তা তোমার করতে হবেনা। তুমি শুধু ছাদে আসবা। ব্যাস। ” তাহমিদ কথা বলতে বলতে দরজার দিকে এগিয়ে যায়।
” আর হ্যাঁ, সিক্তা নুডলস আনলে খেয়ে নিও। জীবনে প্রথমবার বানিয়েছি, খারাপ লাগলেও কষ্ট করে খেয়ে নিও। ” কথাটা বলেই রুম থেকে বেরিয়ে যায় তাহমিদ।
কুহু তাহমিদের যাওয়ার পানে প্রেমময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়। ওর কতটা খেয়াল রাখে মানুষটা! যাকে তার মা, বড়মা এখনও মুখে তুলে খাইয়ে দেয়, সেই মানুষই আজ ওর জন্য নুডলস বানিয়েছে! এত ভালোবাসা যে ওর ভাগ্যে ছিল, তা ভাবতেই কুহুর দু-চোখ বেয়ে অশ্রুধারা বইছে।

সিক্তা রুমে এসে দেখল কুহু পড়ছে, কিন্তু তাহমিদ সেখানে নেই।

” কুহু, ভাইয়া কই রে? ”
” সে তো চলে গেছে। ”
” কি! আমাকে নুডলস আনতে বলে সে হাওয়া! ”
কুহু লক্ষ্য করল ট্রে-তে তিনটা বাটিতে নুডলস রাখা আছে।
” সিক্ত, এক কাজ কর, তোর ভাইয়াকে তার রুমে গিয়ে তার ভাগেরটা দিয়ে আয়। ”
” বাপরে প্রেম! আমার ভাইয়ের জন্য কত চিন্তা করিস তুই, কুহু। তোদের প্রেম দেখছি যাকে বলে মাখোমাখো সেরকম। ”
কুহু বেশ জানে, এখন সিক্তার কথার উত্তর দিলেই সিক্তা আরও খোঁচাবে। তাই সে চুপ থাকার সিদ্ধান্ত নেয়।
সিক্তাও হেসে ট্রে-তে করে একটা বাটি নিয়ে তাহমিদের রুমের দিকে যায়।

কুহু নুডলসের একটা বাটি নিজের কাছে এগিয়ে নেয়। ওর ঠোঁটে প্রাপ্তির হাসি। ওর জন্য তাহমিদ কষ্ট করে নুডলস রান্না করেছে ভাবলেই বুকের ভিতর হাজারও প্রজাপতি ডানা মেলে উড়ছে।
কাঁটা চামচে নুডলস পেঁচিয়ে নিয়ে মুখে দেয় কুহু।
স্বাদটা নেহাৎ মন্দ লাগছেনা। খুব একটা ঝাল দেয়নি। আচ্ছা মানুষটা কি জানে আমি ঝাল খেতে পারিনা?

রাত বারোটা পঞ্চান্ন মিনিটে কুহু ছাদে আসে। আলোকিত ছাদে পা দিতেই দেখল, তাহমিদ হাসনাহেনা গাছের পাশে একটা চেয়ারে বসে পড়ছে। সামনে রাখা আরেকটা চেয়ারে পা তুলে রেখেছে। কুহুর পায়ের শব্দ পেয়ে তাহমিদ পেছনে তাকায়। কুহুকে দেখে চেয়ার থেকে পা নামায়। কুহু তাহমিদের কাছে না গিয়ে, রেলিঙের ধারে গিয়ে দাঁড়ায়। তাহমিদও মুচকি হেসে সেদিকে পা বাড়ায়।

” ভবিষ্যতের বউ, তুমি যে বলেছিলে একটার পর ঘুমাবা? এখনও তো একটা বাজেনি। তবে কি আমাকে না দেখে থাকতে পারছিলেনা! ” তাহমিদের নেশা জড়ানো গলা শুনে কুহুর বুক ঢিপঢিপ করছে। হাজারও কথা ঠোঁটের আগায় এসে আটকে গেছে। জিহবা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে কিছু বলতে গেলেই, তাহমিদ পুনরায় বলে উঠে,
” এভাবে বারবার আমার সামনে ঠোঁট ভিজাবানা। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে কষ্ট হয়। নাকি ইচ্ছে করেই এমনটা কর? আমাকে আরও কাছে টানতে! ”
” ছিহ্ কিসব অশ্লীল কথাবার্তা বলছেন। একটুও লজ্জা নেই আপনার! বেশরম মানুষ একটা। ”
” তোমার কাছে কিসের লজ্জা! তুমি কি আমার পাশের বাড়ির ভাবি! নাকি বউয়ের বড় বোন! তুমি হলে আমার একটামাত্র বউ। তোমার সাথে লজ্জার কোন সম্পর্ক আমার নেই। তাই একটুআধটু অশ্লীল কথাবার্তা বলতেই পারি। ” তাহমিদের অকপট জবাব শুনে থ হয়ে যায় কুহু৷

কুহু কিছু বলার আগেই নিচে বসে পরে তাহমিদ। কুহুর ডান পায়ের সালোয়ার একটু উঁচু করে, কুহুকে ইশারা করে ধরতে। কুহু স্তম্ভিত বদনে সালোয়ার উঁচু করে ধরে।
কুহু বুঝতে পারছে তাহমিদ ওর পায়ে কিছু একটা পরিয়ে দিচ্ছে। একটু ঝুঁকে তাকাতেই বুঝতে পারল, নুপুর পরিয়েছে মানুষটা। তাহমিদের এমন কাজে স্বলাজ হাসিতে উদ্ভাসিত হয় কুহর মুখাবয়ব। ততক্ষণে বাম পায়ে নুপুর পরাতে শুরু করেছে তাহমিদ।

” এই যে, লজ্জাবতী। এবার চোখ খুলে চাও দেখি। তুমি কি সিদ্ধান্ত নিয়ে এসেছ, তোমার হাজার রূপে আমাকে ঘা’য়ে’ল করবার! তুমি জানোনা তোমাকে যেই রূপেই দেখি, তাতেই আমার হৃদয় ব্যাকুল হয়ে যায়। তোমাকে কাছে পেতে বড্ড ইচ্ছে করে। ”
” আপনি এভাবে বললে, আমি আর কখনোই ছাদে আসবনা বলে দিলাম। শুধু আমাকে অস্বস্তিতে ফেলেন। ”
” এই যে কানে ধরলাম। আর কখনোই তোমাকে আমার আবেগের কথা বলবনা। তবুও ছাদে আসতে না করোনা প্লিজ। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম একটা রোবটকে ভালোবেসেছি। ”
” আপনার বানানো নুডলস খুব টেষ্টি হয়েছিল। ধন্যবাদ এত মজার নুডলসের জন্য। ”
” সত্যিই তোমার ভালো লেগেছে! নাকি নেক্সটে আমার বানানো নুডলস খাওয়ার ধান্দা করছ? সেজন্য ধন্যবাদ দিচ্ছ? তবে এখন আর নুডলস বানিয়ে খাওয়াতে পারবনা। আমার পরীক্ষা কয়েকদিন পর থেকে। একবারে বিয়ের পর আবার আমার বানানো নুডলস খেতে পারবে। ”
তাহমিদের কথা শুনে কুহুর কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে। এই ব’দ ছেলেকে প্রশংসা করলেও উল্টা বুঝে।
” এমন ভাব করছেন যেন, আপনার বানানো নুডলসের জন্য আমি হা হুতাশ করছি! আর কিছু বলবেন? আমি ঘুমাতে যাব। ” গাল ফুলিয়ে বলে কুহু।
তাহমিদ কুহুর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে মেয়েটা রে’গে গেছে। আচমকাই তাহমিদ কুহুর হাত ধরে টান দিয়ে ওকে নিজের সাথে জড়িয়ে নেয়।
” রা’গ করলে আমার বউকে দেখি আরও এট্রাকটিভ লাগে! আমি নিষেধ করেছি না আমার সামনে এসব রূপ দেখাবানা। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনা। ”
তাহমিদের এরূপ কাজে কুহু চুড়ান্তমাত্রায় চমকে গেছে। মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছেনা, শুধু বড়বড় চোখে তাকিয়ে আছে।

তাহমিদ অনুভব করল কুহু বেশ কাঁ’প’ছে। মেয়েটার চোখমুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। ও ঝটপট হাতের বাঁধন আলগা করে। কুহুকে ছেড়ে দিতেই মেয়েটা শরীরের নিয়ন্ত্রণ হারায়। হুড়মুড়িয়ে পরে যেতে লাগলে তাহমিদ ওকে ধরে নেয়।

” রিল্যাক্স, আমি শুধু তোমাকে জড়িয়েই ধরেছি। আর কিছুই করিনি। তুমি না চাইলে তোমার কয়েক হাতের মধ্যে আমি আসবনা। তবুও এভাবে ভয় পেওনা। ” তাহমিদও একটু ভয় পেয়েছে। সামান্য জড়িয়ে ধরতেই এই অবস্থা!

কুহু একটু স্বাভাবিক হলে ওকে নিচে পাঠিয়ে দেয় তাহমিদ।

পরদিন কুহু একটিবারও তাহমিদকে দেখেনি। সেই সকাল থেকেই তাহমিদকে দেখবার জন্য ওর ভেতরটা ছটফট করছে। বেশ কয়েকবার তাহমিদের রুমের সামনে যেয়ে উঁকিঝুঁকি মেরেছে। কিন্তু ভেতর থেকে তাহমিদের কোন সাড়া পায়নি। এদিকে কাউকে জিজ্ঞেসও করতে পারছেনা। কুহু ভেবেছে গতরাতের ঘটনায় তাহমিদ ওর ওপর রা’গ করেছে। এক পা দু পা করে কুহু দিদুনের রুমে আসে। এটাসেটা গল্প করতে করতে দিদুনকে তাহমিদের কথা জিজ্ঞেস করে। দিদুন জানায় আজ সকালেই তাহমিদের ক্লাস আছে। তাই সাতটার দিকে বাসা থেকে বের হয়েছে। আসতে আসতে অনেক রাত হবে। দিদুনের কথায় কুহু হাঁফ ছাড়ে।

রাতে তাহমিদ কখন এসেছে, তা কুহু বলতে পারেনা। সকালে ডাইনিং টেবিলে তাহমিদকে দেখে। সে মহাশয় আপনমনে খেয়ে চলছে। অবশ্য তার বাম হাতে একটা বই রয়েছে। সে পড়ছে আর খাচ্ছে। একবারের জন্যও সে কুহুর দিকে তাকায়না। এতে কুহুর মন বেশ খারাপ হয়।
কুহু চুপচাপ অর্ধেক পরোটা খেয়ে উঠে যায়। সোজা এসে দাঁড়ায় দোতলার ঝুল বারান্দায়। কুহু এখানে নানান রকম ফুল গাছ এনে রেখেছে তাহমিনা আক্তারের সাথে মিলে।
একটা টবে ফুটে আছে সুগন্ধিযুক্ত সাদা লিলিয়াম। ফুলের গন্ধে বারান্দা ম ম করছে। কিন্তু লিলিয়ামের সুবাস আপাতত কুহুর মনকে শান্ত করতে পারছেনা। ওর মনে ঘরে তাহমিদ ঘুরঘুর করছে। সে কি সত্যিই কুহুর উপর রাগ করেছে!

” না খেয়ে চলে আসলে যে? সিনিয়র রাশেদিনের টাকা বাঁচাচ্ছ নাকি! তাহলে ভুল করবে। সে ভদ্রলোক অনেক টাকার মালিক। তুমি প্রতিদিন একটা করে রুটি কম খেলে, বছর শেষে তার বিরাট অর্থের এক আনাও কমাতে পারবেনা। ”
কুহু তাহমিদের কথা শুনে হ্যাবলার মত তাকিয়ে থাকে।
তাহমিদ একটা প্লেটে করে দুইটা পরোটা, মাংস ভুনা আর সেমাই এনেছে।
” এদিকে এস। ”
কুহু বাধ্য মেয়ের মত তাহমিদের নিকট আসে।
” বস। ” নিজে একটা চেয়ারে বসে, কুহুকেও বসতে বলে।
কুহু চুপচাপ তাহমিদের নির্দেশমত কাজ করে।

” তুমি কি নিজের হাতে খাবে? নাকি আমাকে খাইয়ে দিতে হবে? ”
” আমার ক্ষুধা নেই। ” মলিন মুখে বলে কুহু।
” আমিতো জানি তোমার ক্ষুধা আছে কিনা। তারাতারি খেয়ে নাও সোনা পাখি। আমার ইম্পর্টেন্ট ক্লাস আছে। তুমি না খেলে আমি যেতে পারছিনা। ”
” আপনি আমার ওপর রা’গ করে নেই! ”
” কেন! তুমি কি চাও আমি তোমার সাথে রা’গ করি! হাহ্ রাতে যে খেল দেখিয়েছ, আমি রা’গ ভুলে পারলে ভয়ে মায়ের পেটে ঢুকে যাই। তবে গতরাতে তওবা করেছি, তোমার সাথে একান্তে কথা আর নয়। কখন যে আমাকে ক’ল’ঙ্কে’র সাগরে ডু’বি’য়ে মা’র’বে সেই ভয় হচ্ছে। ”
তাহমিদের কথা শুনে কুহু লজ্জায় মাথা নিচু করে।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here