এ শহরে তুমি নেমে এসো পর্ব ২১

0
1590

#এ_শহরে_তুমি_নেমে_এসো 💚
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ২১

অপূর্ব ভাইয়ের হুংকার শুনে আশেপাশে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে তিস্তা আপুকে খোঁজার চেষ্টা করলাম। তিস্তা আপুর ছায়াটিও অনুপস্থিত। কোথায় সে? ভীত গলায় বললাম, “তিস্তা আপু কোথায়?

“সেটা তুই আমার কাছে জিজ্ঞেস করছিস? ওকে তো তুই নিয়ে গিয়েছিলিস। তুই ‘বাবা মায়ের কাছে’ না-কি কখনো মিথ্যা বলিস নি। তাহলে এটা কী?” অপূর্ব ভাইয়ের কথা কান্না পেয়ে গেল। মাথানত করে নিলাম। অপূর্ব ভাইয়ের হুংকার থেকে আজ মামি আমাকে রক্ষা করছে না। বরং দূর থেকে দাঁড়িয়ে আছে অশ্রুসিক্ত চোখে। একদিকে পরিবারের সম্মান অন্যদিকে ভাগ্নি। মামি বিচলিত হয়ে বলে, “আরু, তুই যদি কিছু জানিস তাহলে বলে দে।”

“স্যরি তিস্তা আপু। তুমি এটা আমার সাথে একদম ঠিক করলে না। আমার কিছু করার নেই। স্যরি।” মনে মনে বাক্যগুলো আওড়ালাম। অতঃপর নম্র গলায় বললাম, “তিস্তা আপু সুজন ভাইয়ের সাথে দেখা করতে গিয়েছে। যাওয়ার সময় আমাকে এসে বলে, শেষবারের জন্য সুজন ভাইয়ের সাথে দেখা করবে। আমরা খালপাড়ে গিয়েছিলাম। আমি পুলের এই পাড়ে ছিলাম। তিস্তা আপু আমাকে ‘একটু থাকতে’ বলে চলে গেলেন। রাত পেরিয়ে সকাল হয়েছে কিন্তু তিনি এলেন না। বাড়িতে এসে জানতে পারি, আপু আসেনি।”

মামা চেয়ারে বসে ছিলেন। আমার কথা থামতেই উঠে দাঁড়ালেন। নানা ভাই থমথমে গলায় বলেন, “তারমানে সুজনের সাথে তিস্তার সম্পর্ক ছিল। তুই জানতি এই সম্পর্কের কথা?”

“হম।”

“কবে থেকে?” (বড়ো মামা গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলেন।

“যেদিন প্রয়াস ভাইয়ারা তিস্তা আপুকে দেখতে এসেছিলেন তার পরের দিন।” অপূর্ব ভাই ছুটে এলেন। স্বজোরে এক চড় গালে বসিয়ে দিয়ে হাঁসফাঁস করতে করতে বললেন, “আজ কেন বলছিস? আগে কোন বলিস নি।”

আমি জবাব হারিয়ে ফেললাম। পরিবেশ শান্ত হয়ে গেল। বড়ো মামা ফোন করলেন কাউকে। গম্ভীর গলায় বললেন, “এই মুহুর্তে আহসান বাড়ির ‘সাত ভাই চম্পায়’ আসতে হবে।” বলেই ফোন রেখে দিলেন। কেউ এক চুল নড়ল না। সেকেন্ড পেরিয়ে মিনিট। মিনিট পেরিয়ে ঘণ্টার কাছাকাছি পৌঁছে গেল। শোঁ, শোঁ করে তিনটা গাড়ি এসে থামল আহসান বাড়ির ‘সাত ভাই চম্পায়’। একের পর এক লোক বেরিয়ে এলো গাড়ি থেকে। দেখা গেল ইমদাদুল হোসেন মৃধা অরুপে করে আমার বাবাকে। বুকের ভেতরে ধুকপুক করে উঠল। বাবা এসে দাঁড়াতেই সামনের চেয়ারটা ছেড়ে দিলেন ছোটো মামা। বাবা বসলেন। আমার দিকে তাকালেন। কিছুটা রেগে বললেন, “আমার মেয়ে কাঁদছে কেন?”

বড়ো মামা গম্ভীর থেকে বললেন, “বাবাকে ছেড়ে থাকতে পারছে না, তাই। আরু আপনার সাথে যেতে চাইছে।”

সবাই চমকে গেল। আমিও চমকে তাকালাম। বড়ো মামি এগিয়ে এসে বলেন, “কী বলছ, কী তুমি। আরু আমাদের ছেড়ে.. মামা হাতের ইশারায় মামিকে থামিয়ে দিলেন। মামা কথা বলার সময় অন্যদের করা বলা নিষেধ। শেফালী ও তুরকে উদ্দেশ্য করে বলে, “শেফু, তুর। তাড়াতাড়ি যা। আরুর সমস্ত জামা কাপড় ও প্রয়োজনীয় জিনিস গুছিয়ে দে। আরু আজ থেকে ওর নিজের বাড়িতে থাকবে। আমি গোবরে ফোঁটা পদ্মফুলকে গোলাপ ভেবে ঘরে সাজিয়ে রেখেছিলাম। ভুলে গেছিলাম, গোলাপের কাঁটা থাকে। গোলাপের কাঁটায় জর্জরিত হওয়ার পর বুঝতে পেরেছি গোবরে আমার ঘর নষ্ট হয়ে গেছে।”

চোখজোড়া মুহুর্তে ছলছলিয়ে উঠল। ঘরে থাকা ময়না পাখি ছুটে এসেছে। ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে আমার কাঁধে এসে বসল। মামিরা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কেউ কিছু বলবে না, বলার সাহস নেই। একমাত্র নানা ভাই পারে মামার সিদ্ধান্ত টলাতে। শেফু নানা ভাইকে বলে, “নানা ভাই।”‌ নানা ভাই শুনেও না শোনার ভান ধরলেন। নিজেকে অসহায় লাগল।

তুর ছুটে গেল অপূর্ব ভাইয়ের নিকটে। অপূর্ব ভাইয়ের হাতটা ধরে বলে, “ভাইয়া, আরুকে কি ফুফা নিয়ে যাবেন? আমরা আরুকে ছাড়া থাকতে পারব না। আপনি আরুকে আটকাতে পারেন। বাবাকে একবার বোঝান।”

অপূর্ব ভাই আলগোছে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিলেন। আমি ঠোঁট কামড়ে অন্যদিকে তাকালাম। শুনতে পেলাম অপূর্ব ভাইয়ের গলা, “যে আমার পরিবারের, আমার বংশের, আমার বোনের মুখে চুনকালি লাগিয়েছে। সে আহসান বাড়িতে না থাকুক, এটাই আমি চাই।”

ধীর পায়ে মামার কাছে ছুটে গেলাম। পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লাম। দু’হাতে পা জড়িয়ে ধরে বললাম, “আমি ভুল করেছি মামা। প্রথমবার তোমার কাছে মিথ্যা বলেছি। আমাকে প্রথমবার ও শেষবারের মতো ক্ষমা করে দাও। ফাঁ/সি/র আ/সা/মী/র শেষ কথাটাও শোনা হয়, আমার হবে না?”

মামা তাকালেন না। আমি সৌজন্য হাসলাম। বাবা চেয়ার ছেড়ে উঠে এলেন। আমার কাঁধে হাত রেখে বলেন, “আপন মানুষ হয় না এই নি/ষ্ঠু/র পৃথিবীতে। ভালো রাখবে বলে আমার থেকে তোদের এনেছিল। এখন আমি আমার জিনিস ফিরিয়ে নিলাম। মনে রাখিস, শক্ত মাটির চেয়ে নরম মাটিতে মানুষ বেশি গাড়ে।”

সেদিন বাবার সাথে একটা কথাও বলি নি। ঘরে চলে গিয়েছিলাম। মামা বুঝে গিয়েছিলেন আমার উত্তর। আজ কেন বুঝেন না? জামা কাপড়ের ব্যাগগুলো নিয়ে এসেছে শেফালী। বাবা ব্যাগগুলো নিতে দিলেন না। উৎফুল্লিত হয়ে বলেন, “আজ থেকে আমার মেয়ে আমার কাছে থাকবে। তার সব চাওয়া আমি মেটাবো। পিতৃত্বের স্বাদ নিবো। তার পোশাকের কোনো কমতি রাখব না। চল।” বাবা আমার হাতটা ধরে এগিয়ে গেলেন। ময়না পাখি কাঁধ থেকে নেমে আমার পিছু পিছু উড়ে আসছে। হঠাৎ করেই তার ডানা ঝাপটানোর শব্দ মিলিয়ে গেল। আমি ঘাড় কাত করে তাকালাম। ময়নাকে খুঁজতে লাগলাম। মামা ময়নাকে ধরে রেখেছে। মামিকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “ময়না পাখি যাতে বাড়ির বাইরে না যায়। খাঁচায় বন্দী করে রাখবে। আর এই পোশাকগুলো আ/গু/নে পুড়িয়ে ফেলবে।” বলেই মামা ঘরে চলে গেলেন। শেফালীর হাতে ময়না পাখিটা দিয়েছেন। ময়না আমাকে দেখছে।

গাড়িতে উঠে বসলাম। কাঁচটা তুলে দেওয়ার আগ পর্যন্ত নিস্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম সবার দিকে। কেউ তাকিয়ে নেই। মুখ ভার করে রয়েছে। গাড়িটা চলতে শুরু করল। কবরের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় দু সেকেন্ডে জন্য কাঁচটা নামিয়ে দিল। চোখ ভরে শেষ বারের মতো কবরটাকে দেখে নিলাম। মা অভিমান করে আছে, তার ভাইয়ের কথা শুনি নি হয়তো তাই।

‘মা। তোমার চার ভাই আমাকে আগলে রাখল না। তুমি নেই, তাই আমার প্রতি কারো কদর নেই। এটাই আমার প্রাপ্য ছিল।’
__

চারদিকে গাছপালা সারিবদ্ধভাবে লাগানো। গাছের নিম্ন অংশ চুন দিয়ে সাদা করা। পাক্কা রাস্তা ইট দিয়ে বাঁধানো। সবুজ দিয়ে ঘেরা। গাড়ি এসে থামল বড়ো একটা বাড়ির সামনে। যেন রাজপ্রাসাদ। বাবা আমার হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গেলেন। যৌথ পরিবার। আমাকে দেখিয়ে বাবা বলেন, “এই আমার মেয়ে আরশি মৃধা। আরু। এখন থেকে আমাদের সাথে থাকবে। (আমাকে উদ্দেশ্য করে) আরু দোতলার ঐ ঘরটাতে যা। পরে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিবো।”

আমি মাথা নেড়ে সেদিকে গেলাম। সিঁড়ি পেরিয়ে ঘরে গেলাম। দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম।

[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here