বিন্দু থেকে বৃত্ত পর্ব ৫০

0
2103

#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_৫০
জাওয়াদ জামী

দৃষ্টির লিখা চিঠি পড়ে সবাই স্তব্ধ। মেয়েটা কত কষ্ট মনে পুষে রেখেছিল!অথচ চলে যাবার আগে
নিজের দ্বায়িত্ব পালন করতে ভোলেনি। পরিবারের সবার জন্য চিন্তা করেছে মৃ’ত্যু’র আগ পর্যন্ত।

শিউলির কোন হুঁশ নেই। সে একবার হাসছে তো আরেকবার কাঁদছে। কুহু তার কাছে গেলে, সে দৃষ্টি ভেবে কুহুকে জড়িয়ে ধরছে।

কায়েসের চাচাতো ভাই এসে। যিনি এসপি পদে কর্মরত। তিনি সানাউল রাশেদিনের সাথে কথা বলছেন। সানাউল রাশেদিন তার এসপি বন্ধুকে ফোন করে কথা বলেছেন। তিনি জানিয়েছেন, সবুজ লাপাত্তা। পুলিশ ফোর্স তাকে খুঁজে চলেছে।
কায়েসের চাচাতো ভাই থানায় গিয়ে কথা বলে এসেছেন।

তাহমিদ ও আনান চিন্তায় অস্থির, এত তারাতারি সবুজ কোথায় গেল! ওরা দুজন আলোচনা করছে, এখন কি করা যায়।
ভেতর থেকে আফরোজা নাজনীন তাহমিদকে ডাকলে, তাহমিদ ভেতরে যায়
কুহু কেঁদেই চলেছে।
তাহমিদ ভেতরে আসলে আফরোজা নাজনীন ওর হাত ধরে কুহুর কাছে নিয়ে আসেন।

” বাপ, মেয়েটা কিছুতেই থামছেনা। এখন পর্যন্ত ওকে খাওয়াতে পারিনি। তুই একটু চেষ্টা করে দেখ, খাওয়াতে পারিস কি-না। ”

” খাবার নিয়ে আস। আমি খাইয়ে দিচ্ছি। বড়মা, তোমরা সবাই খেয়েছ? ”

” সবাইকে খাওয়ানো শেষ। এখন কুহু খেলেই তবে আমি আর নাজমা খাব। ”

” তারাতারি খাবার নিয়ে আস। দুপুর হতে চলল, এখনও তুমি খাওনি! এভাবে চললে তোমার অসুখ বাঁধতে সময় নিবেনা। ”

আফরোজা নাজনীন একটু হেসে খাবার আনতে যায়।
তাহমিদ এসে কুহুর পাশে বসে। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।

” বউ, এভাবে ভেঙে পরলে চলবে। আমি জানতাম তুমি অনেক সাহসী মেয়ে। নিজেকে কোন অবস্থায়ই দুর্বল করোনি। আজ কেন তুমি ভেঙে পরছ! এখন যখন তোমাকে সবার পাশে থাকতে হবে, তখনই তুমি এমন অবুঝের মত করছ! এবার ওঠ, আমার সাথে চল, ফ্রেশ হবে। এরপর আমি তোমাকে খাইয়ে দিব। ”

” আমার এখন খেতে ইচ্ছে করছেনা। আপনি খেয়েছেন? আমি আপনার খেয়াল রাখতে পারছিনা। ”

” তোমার এখন কিছুই করতে হবেনা। তুমি এখন উঠে ফ্রেশ হয়ে আসবে, চল। ” তাহমিদ জোর করে কুহুকে বিছানা থেকে নামিয়ে, কলপাড়ে নিয়ে যায়। ওকে ফ্রেশ করিয়ে ঘরে নিয়ে আসে।

আফরোজা নাজনীন প্লেটে করে খাবার নিয়ে আসলে, তাহমিদ কুহুকে জোর করে খাইয়ে দেয়।
এরপর কুহুকে নিয়ে কায়েসের কাছে যায়। বাবার কাছে মেয়েকে বসিয়ে দিয়ে বাইরে চলে যায়। ও চাচ্ছে তারা বাবা-মেয়ে কিছুক্ষন একসাথে কথা বলুক। এতে তারা কিছুটা হালকাবোধ করবে।

দুপুরে খাওয়ার পর আনান আর তাহমিদ কুহুর কাছে বসে এটাসেটা গল্প করছে।

” ভাই, আমি চারদিকে খোঁজ লাগিয়েছি, কিন্তু সবুজের কোন পাত্তা নেই। আমি ভাবতেই পারছিনা, রাতারাতি একটা মানুষ কিভাবে হাওয়ায় মিলাতে পারে! ঐ শা’লা না আছে নিজের বাড়িতে, না আছে বন্ধুর বাড়িতে আর না আছে কোন আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে। কোথায় যেতে পারে জা’নো’য়া’র’টা! ”

” ওর এমন কোন আত্মীয় কিংবা বন্ধু আছে যারা এই বিভাগের বাইরে থাকে? যারা ওকে আড়াল থেকে সাহায্য করছে? আচ্ছা এমন হয়নিতো যে ও বর্ডার ক্রস করে ইন্ডিয়া পালিয়ে গেছে? কিংবা যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে? ” তাহমিদ একসাথে বেশ কয়েকটি প্রশ্ন করে।
তাহমিদের কথা শুনে কুহুর কিছু একটা মনে পরে। ও চঞ্চল চোখে তাহমিদের দিকে তাকায়। এবং অস্থিরভাবে বলে উঠে,

” গতবার আমি এখানে এসে দৃষ্টির সাথে অনেক গল্প করেছি। ও কথায় কথায় একবার সবুজের এক বন্ধুর কথা বলেছিল। যার বাড়ি হিলি। সবুজ নাকি প্রায়শই সেখানে যায়। আর তার বন্ধুর সাথে চুরি করে ইন্ডিয়াও গেছে। দৃষ্টিকে নাকি সে বলেছিল, হিলি বেড়াতে নিয়ে যাবে। ”
কুহুর কথা শুনে আনান ও তাহমিদ সোজা হয়ে বসে।

” কুহু, তুই জানিস সবুজের সেই বন্ধুর নাম কি? দৃষ্টি তোকে সেই বন্ধুর নাম বলেছিল? কিংবা আর কিছু বলেছিল? ”

” নাম তো জানিনা, ভাইয়া। তবে দৃষ্টি বলেছিল সেই ছেলের বাবা নাকি সেখানকার ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার। ”

” আনান, এবার আমাদের কাজ হবে সবুজের এখানকার বন্ধুদের ধরে, তাদের থেকে জেনে নেয়া, তার হিলির বন্ধুটি কে। তুই তোর ছেলেদের ফোন দে। সবুজের ঘনিষ্ঠ বন্ধু রাকিব, ওকে ধরতে হবে। তারপর বাকিটা আমি দেখছি। এরপর আমাদের সেখানে যেতে হবে। ”

আনান তাহমিদের কথা শুনে ফোন নিয়ে বাগানে চলে যায়। যেখানে গিয়ে ও কথা বললে কেউ শুনতে পাবেনা।

তাহমিদও কারো সাথে কথা বলে। কুহু শুধু অবাক হয়ে দেখছে, যে ছেলেটার কয়দিন পর পরীক্ষা, সে আজ পড়াশোনা ছেড়ে এখানে পরে আছে।

” আপনি আর কয়দিন এখানে থাকবেন ? পড়াশোনা তো কিছুই হচ্ছেনা। এভাবে চলতে থাকলে পাশ করতে পারবেন? আপনি বরং ঢাকায় ফিরে যান। ” কুহু মোটেও চাচ্ছেনা তাহমিদ এসবের মধ্যে জড়াক।

” যদি মনে কর, তুমি বললেই আমি ফিরে যাব, তবে তুমি ভুল করবে। যে ছেলের জন্য দৃষ্টি সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেল, যে ছেলে তোমার সাথে খারাপ কিছু করতে চেয়েছে, তাকে আমি ছেড়ে দিব, এটা তুমি কি করে ভাবলে? ”

” তাকে ধরে পুলিশের কাছে দিয়েন। নিজেরা কিছু করতে যাবেননা, প্লিজ। আইন নিজের হাতে নিবেননা। আমাকে কথা দিন। ”

” আমরা কি করব না করব, সেটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবেনা। তোমার একটাই কাজ, সেটা হল বাবাকে দেখে রাখা। আর আমরা কোথায় যাচ্ছি, কি করছি এসব কাউকে জানাবেনা। তুমি কোন চিন্তা করবেনা। ”

” আপনারা সেখানে যাবেন? আমার ভিষণ ভয় করছে। সবুজ খুব খারাপ ছেলে, ও যদি আপনাদের কোন ক্ষতি করে? ”

” আমি তোমাকে চিন্তা করতে নিষেধ করেছি না?
বউ, তুমি নিশ্চিন্তে থাক। আমি কাজ শেষ করে তোমার কাছে ফিরে আসব৷ ” কুহুর কপালে ভালোবাসার পরশ আঁকে তাহমিদ।

কিছুক্ষণ পর তাহমিদ আর আনান মিলে কোথাও বের হয়ে যায়। সবাই জিজ্ঞেস করলেও কাউকে কিছু জানায়না।

একটা রাইস মিলের আবদ্ধ ঘরে হাত-পা, মুখ বাঁধা অবস্থায় পরে আছে রাকিব। পাশে লা’ঠি হাতে কয়েকজন ছেলে।
তাহমিদ ধীরেসুস্থে রাকিবের কাছে যেয়ে বসে।
চুলের মু’ঠি ধরে উঁচু করে রাকিবকে।

” শোন রাকিব, আমি তোকে কয়েকটা প্রশ্ন করব। যদি সেগুলোর সঠিক উত্তর দিস, তবে তুই বেঁচে থাকবি এটা আমি হলফ করে বলতে পারি। কিন্তু তুই যদি একটাও মিথ্যা কথা বলিস, তবে তোকে মে’রে টুকরো টুকরো করে কে’টে, সারাদেশে ছড়িয়ে দিব। আই সয়্যার, কেউ তোর কোন খোঁজ পাবেনা। ” তাহমিদ রাকিবের মুখের বাঁধন খুলে দেয়।

রাকিবের শরীরে একবিন্দু শক্তি অবশিষ্ট নেই। ওকে বেদম পি’টি’য়ে’ছে তাহমিদ আর আনানের ছেলেরা।

” আমাকে ছেড়ে দেন, ভাই। আমি যা জানি সব বলব। বর্ডারেই সবুজের বন্ধু সিরাজের বাড়ি। ওর বাবার নাম জামাল বেগ। সবুজ এখন সেখানেই আছে। কাল বিকেলেই সে বর্ডার পাড় হবে। আমাকে সবুজ গতকাল ফোন করেছিল। তখনই এসব বলেছে। ” রাকিব হাঁপাচ্ছে।

” শোন, তোকে যে আমরা এখানে এনেছি, তোকে জামাই আদর করেছি, এসব কথা তুই কি কাউকে বলবি? যদি কখনো তোর কাছে পুলিশ আসে, কিছু জিজ্ঞেস করে, তাদেরকে কিছু বলবি? ”

” না, ভাই, আমি মরে গেলেও কাউকে কিছু বলবনা। আমাকে ছেড়ে দেন, ভাই। তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাচ্ছে। ”

” এই তোমরা ওকে পানি দাও। আর আমরা সবুজকে খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত ওকে এখানে রাখ। ওর ফোন অন করে রাখ। সবুজ ফোন দিলে, একে কথা বলতে দিবে। কিন্তু দেখবে এ যেন কিচ্ছু না বলে।
কিরে, সবুজ ফোন করলে, তুই আমাদের কথা বলবি? যদি বলিস, সাথে সাথেই তোকে জবাই করবে আমার ছেলেরা।
শোন, রাকিব, সবুজের ফোন তুই রিসিভ করবি। কিন্তু কিছুই বুঝতে দিবিনা। আগামী তিনদিন তুই এখানে থাক। আমরা এই তিনদিনে সবুজের ব্যবস্থা করে এসে তোকে ছেড়ে দিব। এই কয়দিন সুবোধ বালকের ন্যায় থাকবি, বুঝেছিস? ”

রাকিব তাহমিদের কথায় সায় দেয়।

তাহমিদ, আনান আর সাতজন ছেলে মিলে রওনা দেয় হিলির দিকে।

রাকিবের দেয়া ঠিকানা অনুযায়ী ওরা পৌঁছায় সিরাজের গ্রামে।
ওদের সাথের একজন ছেলের ফুপাতো বোনের বাড়ি সেই গ্রামে। ওরা ছেলেটার বোনের বাড়িতে ওঠে।
তাহমিদ সেই বাড়িতে যাওয়ার আগে অনেক কিছু কিনে। কারন ওর জানা নেই তাদের পারিবারিক অবস্থা কেমন। তাই খালি হাতে একটা নতুন বাড়িতে যেতে তার খারাপ লাগছিল৷ সেজন্য আনানকে সাথে নিয়ে কাঁচা বাজার থেকে শুরু করে ফলমূল অনেক কিছু কিনে।
কারন ওদের এখানে একটা দিন থাকতেই হবে। আগে সবুজের খোঁজ নিতে হবে। এরপর সুযোগ বুঝে ওকে তুলে নিতে হবে।

দুইদিন পর ওরা হিলির সেই গ্রাম থেকে বিদায় নেয়।

লা’ঠি’র বা’রি’র চোটে চিৎকার করছে সবুজ। চিৎকার যখন অধিক মাত্রায় শুরু করে, তখন আনান ওর মুখ বেঁধে দেয়।
তাহমিদ ওকে একাধারে মা’র’ছে।

” তোর জন্য দৃষ্টি আর দুনিয়ায় নেই। তুই ওর মায়ের প্রপার্টি নিজের নামে করেছিস, তুই কুহুকে খারাপ নজরে দেখেছিস। মেয়েটার ঘুম হারাম করেছিলিস তুই। এবার বল তোকে আমি কি করব? তুই কি মনে করেছিলি, লুকিয়ে থাকলেই রক্ষা পাবি? তুই হিলি কেন, পাতালে লুকালেও আমি তোকে ঠিকই খুঁজে বের করতাম। হয়তো কিছুদিন দেরি হত। কিন্তু তুই লুকিয়ে বাঁচতে পারতিনা। ” তাহমিদ আজ যেন হিং’স্র হয়ে গেছে। একের পর এক আ’ঘা’ত করছে সবুজের শরীরে।
আনান তাহমিদের এমন রূপ দেখে ভয় পেয়ে যায়। জোড় করে তাহমিদের হাত থেকে লাঠি কেড়ে নেয়। ওকে টেনে দূরে নিয়ে আসে।

” ভাই, এভাবে মারলে কু’ত্তা’টা ম’রে যাবে। ওকে আর মেরোনা। ওকে আমরা যথেষ্ট কেলিয়েছি। এবার ওকে পুলিশে দেই। ঘটনাকে আর বেশি দূর গড়াতে দেয়া যাবেনা। একে একবার পুলিশে দিলে বড় খালু যা ব্যবস্থা করার করবে। ”

” আমার ইচ্ছে করছে একে এখানেই পুঁতে দিতে। একে পুলিশে দিলে বড়জোর কয়েক বছর জেল হবে। পরে জামিনে ঠিকই বেরিয়ে আসবে। আবার নতুন করে শুরু করবে মেয়েদের জীবন নিয়ে খেলা। এটা কিছুতেই হতে দেয়া যায়না। ”

” ভাই, বুঝতে চেষ্টা কর। প্রশাসন যদি জানতে পারে, তুমি একে মে’রে দিয়েছ, তখন কি হবে বুঝতে পারছ? কুহুর জীবন তোমার সাথে জড়িয়ে আছে। মেয়েটা এমনিতেই অনেক কষ্ট সহ্য করেছে, এখন যদি তোমার কিছু হয়, মেয়েটাকে সামাল দিব কেমন করে? ওর দিকে তাকিয়ে হলেও একে পুলিশে দাও। ”
তাহমিদ এক পলক আনানের দিকে তাকায়।

” ঠিকাছে, একে পুলিশেই দিব। তবে আজ নয়। কয়েকদিন পর। আগে এর থেকে সকল এর সকল কুকর্মের স্বীকারোক্তি নিয়ে, তবেই একে পুলিশে দিব। যাতে কেউ একে কখনো জেল থেকে বের করার সাহস না করে। তার আগে একে ইচ্ছামত বানাব। এর হাত-পা ভেঙ্গে প’ঙ্গু বানাব। আর ঘটনা এমনভাবে সাজাব যাতে সবাই ভাবে এই হা’রা’মি অ্যাকসিডেন্ট করেছে। ”

” ঠিক আছে, ভাই। তুমি যা বলছ তাই হবে। তবে এখন বাসায় চল। গত তিনদিন আমরা বাড়ি ছাড়া। সবাই চিন্তা করছে। ”

তাহমিদ আর কথা বাড়ায়না। আনানের সাথে সোজা বেরিয়ে আসে।

বিঃদ্রঃ রোজা রেখে ইবাদত, সংসারের কাজকর্ম করার পর গল্প লিখার সময় হচ্ছেনা। অনেকেই জিজ্ঞেস করছেন গল্প দিচ্ছিনা কেন। আমি বলব আমি চেষ্টা করছি নিয়মিত দিতে। কিন্তু সংসার নামক মায়াজালে আবদ্ধ থেকে সময় বের করা সত্যিই কঠিন।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here