বিদীর্ণ_দর্পণে_মুখ পর্ব_৫

0
792

বিদীর্ণ_দর্পণে_মুখ
পর্ব_৫
রাতে খাবার সময় হেমন্ত ভাইয়ের চোখে মুখে এক অদ্ভুত উজ্জ্বলতা লক্ষ্য করা গেলো, আজ মনে হয় হেমন্ত ভাইয়ের দিনটা খুবই ভালো,আব্বা হেমন্ত ভাইকে পাশের চেয়ারে নিয়ে বসেছেন।খাবার টেবিলে সবাইকে একসাথে দেখে কি যে ভালো লাগছে!আমি খাবার সামনে নিয়ে বসে আছি,আমার হঠাৎ করেই চোখ ভিজে উঠলো নিজেকে মনে হলো এই পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান মানব!বুবু আমার ঘাড়ের কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলেন মাথায় হাত রাখতেই আমার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো।বুবু মিষ্টি করে হেসে আমার সামনে থেকে খাবার প্লেট টা নিয়ে ভাত মাখিয়ে খাইয়ে দিলো।বুবু যদি জানতো আমি কতটা ভালো বুবুকে বাসি!
—ছেলে মানুষের এত সহজে কাদতে হয় না সাহিত্য, তুমি কাদছ কেন?
আম্মা ব্যাকুল হয়ে বলল,
—কি হলো বাবু কাদছ কেন! তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে!ও স্বাধীনের বাবা তোমার আর খেতে হবে না তুমি ডাক্তার ডাকো।
আমরা সবাই হেসে ফেললাম কেবল বুবু আড়চোখে আম্মার দিকে তাকালেন আম্মা চুপ হয়ে গেলো। দাদাই হেমন্ত ভাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,
—হেমন্ত তুই কি পুষ্পের কথা বাসায়…
—আমি বাসায় সবাইকে বলেছি স্বাধীন বাবাই রাজি আছে কেবল…
—আন্টি কি অমত করছে?
হেমন্ত ভাই আড়চোখে বুবুর দিকে তাকিয়ে বলল
—আম্মু আমার সব কথা রাখেন।
বুবু প্লেটে হাত ধুয়ে স্বাভাবিক ভাবে উঠতে উঠতে বলল,
—বৃতি তোকে এত ক্লান্ত দেখাচ্ছে কেন? তোর কি শরীর খারাপ?আম্মা কি তোকে চোখে দেখেন না?
বৃতি চমকে উঠে বলল,
—না না বুবু আসলে আজ তুলন আপাকে দেখতে এসেছিলো তো আমি তাই একটু কান্নাকাটি করেছি এজন্য, আমি চমকে উঠলাম! তুলনকে দেখতে এসেছিলো নাকি!
বুবু আমার দিকে একটু খানিক তাকিয়ে বলল,
—তুলন কে দেখতে এসেছিল মানে? ওর কতটুকু বয়স যে বিয়ের কথা তুলছে?
—তুলন আপার মন টা খুব খারাপ।
দাদাই হাত ধুয়ে উঠে যেতে যেতে বলল,
—হেমন্ত ছাদে যাবি?চল।
—তুই যা আমি আসছি।
বুবু দাদাই কে থামিয়ে বৃতিকে বলল,
—আচ্ছা বেশ আমি কথা বলবো আন্টির সাথে এত মন খারাপ করতে হবে না।দাদাই চা খাবে?
আম্মা ব্যাকুল হয়ে বলল,
—এই রাতে চা খাবি!
আপা শান্ত চোখে আম্মার দিকে চাইতেই আম্মা বলল,
—মানে আমি বলতে চাইছি এত রাতে চা খেলে ঘুম হবে?
দাদাই ঘুরে আম্মাকে পেছন থেকে জড়িয়ে বলল,
—এত চিন্তা কেন করো বলো তো আম্মা?তোমার ছেলে মেয়েরা তো বড় হয়েছে নাকি?তুমি চুপচাপ খেতে বসো তো।পুষ্প তুই খেয়েছিস?
—এখন খেতে ইচ্ছে করছে না আমি নিজের জন্য চা বানাবো একটু, খুব মাথা ব্যাথা করছে
আমি উত্তেজিত হয়ে বললাম
—বুবু মাইগ্রেনের ব্যাথাটা নাকি!
হেমন্ত ভাইও উদগ্রীব হয়ে বলল,
—তোমার এই ব্যাথা তো একবার শুরু হলে সহজে যায় না!
আব্বা ছোট করে বললেন,
—তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে পুষ্প?
দাদাই কিছু বলবে তার আগেই বুবু হাতের ইশারায় থামিয়ে বলল,
—এত চিন্তা সবাইকে করতে হবে না, আমার এখন আর কষ্ট হয় না কিছুতেই সব অভ্যেস হয়ে গেছে।
দাদাই বুবুর হাত ধরে, কাছে টেনে বলল,
—তোর সাহস তো কম না তুই আমায় থামিয়ে দিস, তোর তো শাস্তি হওয়া উচিত কঠিন শাস্তি
বুবু সুন্দর করে হেসে বাচ্চাদের মতো দুই হাত দাদাই এর গালে রেখে চোখমুখ কাচুমাচু করে বলল,
—কি শাস্তি দাদা ভাই?
দাদাই থেমে গেলো বুবু যখন আহ্লাদী হয় তখন দাদাই কে দাদা ভাই বলে,দাদাই কে এমন ভ্যাবাচ্যাকা খেতে দেখে বুবু খিলখিল করে হেসে ফেলল হাসতে হাসতে চোখে পানি এসে গেলো,দাদা কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে বুবুর দিকে তাকিয়ে রইলো আমি খেয়াল করলাম একই মুগ্ধতা নিয়ে আব্বা আর হেমন্ত ভাই ও তাকিয়ে আছে,বুবু খুশি থাকলে সবাই কেমন নিজের কষ্ট ভুলে যায়! বুবুর জীবনের প্রতিটি পুরুষ বুবুকে কত ভালোবাসে!তবুও কেন বুবু এমন করে!প্রান্ত ভাইকে কি বুবু এতটাই ভালোবেসেছিলো!যে তার প্রত্যাখ্যান বুবুকে এরকম পাষাণী করে দিয়েছে!
দাদাই বুবুর মাথায় হাত রেখে বলল,
—তুই হাসলে কত্ত ভালো দেখায় তুই কি জানিস পুষ্প!আমাদের পুরো বাড়ি হেসে ওঠে!
—ওহ তাই তাহলে কি শাস্তি মওকুফ?
—খুব চালাক হয়েছিস?এক্ষুনি আমাদের সবার জন্যে চা বানিয়ে নিয়ে ছাদে আয়।
বুবু বাকা চোখে আব্বার দিকে তাকিয়ে বলল,
—আজ আমি বাড়ির সবার জন্যে চা বানাবো, আমার আজ কোনো মন খারাপ নেই,যাও আসছি।
আব্বার মুখ ঝলমল করে উঠলো খুশিতে,বৃতি হুট করে উঠে গেলো নিশ্চয়ই রাগ করেছে, মেয়েটা এমনই, বুবু রান্না ঘরের দিকে যেতে যেতে দাদাই কে বলল,
—তুমি আর সাহিত্য বৃতির রাগ ভাঙিয়ে উপরে যাও আমি আসছি চা নিয়ে…
অনেক কসরতের পর হাতে পায়ে ধরে বৃতির রাগ ভাঙালাম, দাদাই আর হেমন্ত ভাই আগেই ছাদে চলে গেলেন আমি বৃতিকে নিয়ে বুবুর কাছে গেলাম,বুবু দেখলাম শাড়ি পালটে একটা হালকা হলুদ সুতির শাড়ি পড়েছে,এই কাপড়েও বুবুকে কি চমৎকার লাগছে!তবে আমি আর বৃতির সামনে বুবুর প্রশংসা করলাম না,অনেক্ষণ এই মেয়ের পায়ে ধরে বসে থাকতে হয়েছে আর পারব না। বুবু আব্বা আম্মাকে চা দিয়ে আমাদের সাথে উপরে উঠল,দাদাই আর হেমন্ত ভাই সিগারেট ধরিয়ে রেলিং ধরে রাস্তার দিকে মুখ করে আছে দাদাই আকাশের দিকে মুখ করে সিগারেটের ধোয়া ছাড়ছে উদাস গলায় হয়তো হেমন্ত ভাই কে কিছু বলছিলো আমার মেরুদণ্ড বেয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেলো বুবু কি এখন রেগে যাবে!বুবু দেখলাম তেমন কিছু না বলে, আমায় বলল,
—সাহিত্য মাদুর পাতো।
দুজনেই চমকে উঠলো, দাদাই কখনও বুবুর সামনে সিগারেট খায় না।হেমন্ত ভাইয়ের মুখ শুকনো হয়ে গেলো,দুজনেই অসাড় হয়ে দাড়িয়ে রইলো,
—সাহিত্য, তোমার হেমন্ত ভাইকে বলো সিগারেট শেষ করে আসতে ফেলে দিতে হবে না।আর দাদাই এর হাত থেকে সিগারেট টা নিয়ে আসো তো দেখি কেমন স্বাদ
আমি আহাম্মকের মত দাড়িয়ে রইলাম, বৃতি খুব মজা পেলো,উৎফুল্ল হয়ে বলল,
—বুবু আমি যাই?তুমি খেলে কিন্তু আমিও খাবো।
আমি ভাবলাম এবার আর কে বৃতি কে বাচায়,অদ্ভুতভাবে বুবু বলল
—আচ্ছা যা…
হেমন্ত ভাই সাথে সাথেই দাদাই এর হাত থেকে সিগারেট টা নিয়ে দুটোই একসাথে ফেলে আগুন নিভিয়ে মাদুরে গিয়ে মাথা নিচু করে বসলো, দাদাই খুব লজ্জা পেয়েছে বুবু গিয়ে হাত ধরে টেনে নিয়ে দাদাইকে বসালো তারপর সবাইকে চা দিলো বৃতি মুখ ভার করে বলল,
—হেমন্ত ভাই আপনার জন্যে আমার সিগারেট খাওয়া হলো না
দাদাই বৃতির মাথায় মেরে বলল
—চুপ থাক তুই….
হেমন্ত ভাই সেই যে মাথা নিচু করেছে আর তুলছে না।বুবু হেমন্ত ভাইয়ের হাতে চা তুলে দিতে দিতে বলল,
—একটা গান গাও তো সাহিত্য
আমি খুব খুশি হয়ে গেলাম, আমাদের বাড়িতে গানের প্রতি কারো তেমন কোনো ঝোক নেই ছোট বেলা থেকেই দেখতাম আমাকে গান শেখানোর ব্যাপারে বুবুর খুব আগ্রহ, তবে আমার মনে আছে সব কাজ বুবু নিজের খেয়াল মত করলেও আমায় গান শেখানোর জন্যে বুবু মায়ের অনুমতি নিয়েছিলো,আমি গান গাইব তার আগেই আমাকে থামিয়ে দিয়ে বুবু বলল,
—তুলন নাকি ওখানে?
আমারা সবাই তুলনদের ছাদের দিকে তাকালাম, হ্যা তুলনই তো ও কি সন্ধ্যে থেকেই ছাদে নাকি কেবলই এলো, তুলনদের ছাদ আর আমাদের ছাদের মাঝে এক হাতের একটা গ্যাপ,
—যাও তো সাহিত্য তুলনকে নিয়ে এসো ও বসুক আমাদের সাথে চা দিই ওকেও
ছোট বেলা থেকে এক ক্লাসে পড়ায় তুলনের সাথে আমার আলাদা ভাব, আবার দাদাই আমাদের পড়া দেখিয়ে দিতো বলে তুলন যখন তখন আমাদের বাড়িতে আসা যাওয়া করত আমাদের দুই পরিবারের মধ্যেও খুব ভাব।
তুলন এসে বৃতির পাশে চুপচাপ বসলো, দাদাই তুলনকে পড়াতো বলে এখনো দাদাই তুলনকে ধমক দেয় ওর শুকনো মুখ দেখে ধমকে বলল,
—এরকম মুখ করে থাকার কি আছে তুলন?আমি তো বুঝতে পারছি না
—পুষ্পের বাইরে আপনাদের বাড়িতে কেউ কিছু বোঝে নাকি!বুঝিয়ে তো লাভ নেই
—তুলন!
হেমন্ত ভাই দাদার হাত চেপে বলল,
—স্বাধীন, তুই অতিরিক্ত রিয়েক্ট করছিস শান্ত হ।
এই মেয়েটা খুব ঠোঁট কাটা স্বভাবের কেন যে বুবুর ওপর ওর এত রাগ আমি কিছুতেই বুঝে উঠি না।
—আপনি কাকে শান্ত হতে বলছেন হেমন্ত ভাই? আপনি নিজেও তো পুষ্প পুষ্প করে জিকির করেন সারাদিন আমি বুঝি না! একটা নেয়ে আপনাকে যে পাত্তাই দেয় না গত দেড় বছর যাবত আপনাকে ঘোরাচ্ছে কখনো ভালো করে একটা কথা বলে না তার জন্য আপনার এত কিসের ভালোবাসা! অদ্ভুত! এই মেয়ে কি ভালোবাসা বোঝে?শুধু সবার ওপর নিজের কর্তৃত্ব ফলাতে চায়,ওদের বাসায় সবাই আহ্লাদ দিতে দিতে পুরোটাই একটা বদমেজাজি করে গড়ে তুলেছে যে সবাইকে কষ্ট দেয়,নিজের বাবা মা কে, আপনাকে সবাইকে আর সবাই ওর গুণগান গেয়ে বেড়ায়!আশ্চর্য!
আমার কি হলো আমি জানিনা আমি ঠাস করে তুলন কে চড় বসিয়ে দিলাম। এবং সাথে সাথে বুবু আমাকে একটা চড় মারলো,
—তোমার তো সাহস কম না সাহিত্য! আমার সামনে তুমি একটা মেয়ের গায়ে হাত তোলো! কথা হচ্ছে মুখে মুখে তুমি কেন ওকে থাপ্পড় মারলে?বলো?
আমি স্পষ্ট চাদের আলোয় তুলনের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম ওর গালের এক পাশ ফুলে উঠেছে চোখ ছলছল করছে, ও উঠে যাবে এমন সময় বুবু খপ করে ওর হাত ধরে টেনে একপাশে তুলন কে আর একপাশে আমাকে নিয়ে বসালো।তারপর বুবু দেখলাম পরম যত্নে তুলনের গালে হাত বুলিয়ে বলল,
—তুমি খুব ভালো একটা মেয়ে তুলন তুমি কি জানো তুমি আমার কত পছন্দের?আর তুমি যেমন ঠিক এমন ভাবেই আমার পছন্দ।
তুলন এবার শব্দ করে কেদে ফেললো, বুবু তুলনের চোখের পানি মুছিয়ে ওর হাতে এক কাপ চা ধরিয়ে দিয়ে বলল,
—দেখো তো আমার বানানো চা খেতে কেমন স্বাদ,নাকি আমার মতো পানসে?
হেমন্ত ভাই অপলক চোখে বুবুর দিকে তাকিয়ে রইলো,আমি বুবুর দিকে তাকানোর সাহস পেলাম না। কিছুই হয় নি এমন ভাব করে বুবুও আমার দিকে না তাকিয়েই বললো,
—গান গাইতে বললাম তো সাহিত্য চুপ করে আছো কেন?
সবাই অবাক হয়ে বুবুর দিকে তাকালো, মেয়েটা এমনই অদ্ভুত।
আমার হঠাৎ খুব অপরাধবোধ হলো আড়চোখে একবার তুলন কে দেখে নিলাম, তারপর ওর প্রিয় একটা গান ধরলাম..

আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে।

ঢেকে রাখে যেমন কুসুম,
পাপড়ির আবডালে ফসলের ঘুম
তেমনি তোমার নিবিড় চলা
মরমের মূল পথ ধরে।

পুষে রাখে যেমন ঝিনুক,
খোলসের আবরনে মুক্তোর সুখ
তেমনি তোমার গভীর ছোঁয়া
ভিতরের নীল বন্দরে।

ভালো আছি, ভালো থেকো,
আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো
দিও তোমার মালাখানি,
বাউলের এই মনটা রে।

আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে।

বেশ কিছুক্ষণ নিরবতায় কাটার পর আমি তুলনের দিকে চোখ তুলে তাকালাম ও আমার দিকে তাকিয়েই একটা মুখ ভেঙচি দিয়ে অন্যদিকে তাকালো ওমনি সবাই হেসে ফেলল…।পরিবেশ আবার স্বাভাবিক হতে লাগলো।

চলবে…
সামিয়া খান মায়া

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here