বিদীর্ণ_দর্পণে_মুখ পর্ব_৪

0
600

বিদীর্ণ_দর্পণে_মুখ
পর্ব_৪
হেমন্ত ভাইয়ের আগমনটা পুষ্প বুবুর জীবনে খুবই ধীর গতিতে হয়,হেমন্ত ভাই দাদাই এর স্কুল-কলেজের বন্ধু, অনেক আগে থেকেই তার এই বাড়িতে অবাধ যাতায়াত ছিলো, কিন্তু এইচএসসি এর পর হেমন্ত ভাই বিদেশে চলে গেছিলেন পড়তে,দাদাই এর ও যাওয়ার কথা ছিলো কিন্তু শেষকালে আম্মার জন্যে যেতে পারেন নি।হেমন্ত ভাই দেশে আসলেই এ বাড়িতে আসবেন এই নিয়মের কোনো ভুল নেই, আমরা কেউ বুঝতেই পারিনি খুব ছোটো থেকে বুবুর প্রতি তার অন্যরকম টান। হয়তো বন্ধুত্ব নষ্ট হওয়ার ভয়ে,যোগ্যতার অভাবে কিংবা সঠিক সময়ের কারণে তিনি তা কখনো প্রকাশ করতে পারেননি।হেমন্ত ভাই নিজেও বুবুকে অনেকখানি ভয় পায় কিন্তু তার ভালোবাসার গভীরতা অনেক বেশি, আমার মনে আছে একদিন প্রায় মধ্যরাতে হেমন্ত ভাই এলেন ঘরে পড়ার স্যান্ডেল পায়ে ট্রাউজার সাথে টিশার্ট, দাদাই তো ঘর খুলে অবাক এত রাতে কিছু হলো কি না! হেমন্ত ভাই দাদাই এর হাত ধরে বলল,
—স্বাধীন তুই তো আমাকে চিনিস আমার ভালো খারাপ কিছুই তো তোর অজানা নয় তুই আমায় বিশ্বাস করিস তো?
দাদাই চুপ করে ছিলো,জবাব না পেয়ে হেমন্তভাই বললেন
—অনেকটা সাহস সঞ্চয় করে এসেছি,অনেক উথাল পাথাল ভাবনা জয় করে এখান থেকে হেরে গেলে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় হার হবে,সবচেয়ে বড় কথা আমি তোকে হারাতে চাই না।
দাদাই হেমন্ত ভাইয়ের হাত ধরে সোফায় নিয়ে বসালেন,আব্বা আম্মাও বসলেন, দাদাই আব্বা আম্মার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে হেমন্ত ভাই কে বললেন
—তুই কি ভাবিস বল তো আমি কি বোকা?কিছুই বুঝি না?তোকে তোর চেয়ে বেশি আমি চিনি,তুই ভাবতে পারিস তোর এত বছরের অনুভূতি তুই লুকিয়ে রেখেছিস কিন্তু তা আমার ছয় বছর আগেই পড়া হয়ে গেছে।
বুবু হেমন্ত ভাই এর সামনে পানির গ্লাস ধরে বলল
—আপনি এসির মধ্যেও দরদর করে ঘামছেন কেন হেমন্ত ভাই?
বুবুর থেকে পানি নিয়ে হেমন্ত ভাই ঢকঢক করে গিললেন।দাদাই বুবুকে সেখানেই বসতে বললেন বুবু ভাবলেশহীন ভাবে বসে পড়লো।
—হেমন্ত,তুই তো জানিস পুষ্প কেমন শুধু ওর জীবনে নয় এ বাড়িতেও পুষ্প যা বলে তাই হয়, তুই বুঝতে পারছিস তো আমি কি বলছি?
হেমন্ত ভাই আড়চোখে বুবুর দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে বলল
—বুঝতে পারছি
ধীরে উঠে বলল,
—আমি আসি স্বাধীন, মামনি আঙ্কেল এত রাতে আপনাদের বিরক্ত করার জন্য আমি খুবই দুঃখিত।

বুবু বিরক্ত হয়ে বলল,
—আপনি দুঃখিত বললেই তো হয়ে গেলো না,কাল সকালে আমার পরীক্ষা সেই পড়ালেখা বাদ দিয়ে আপনি যে এতক্ষণ নকশা করলেন আমি তো কিছুই বুঝলাম না
হেমন্ত ভাই বুবুর সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো,বুবু উঠে চলে যেতে গেলেই হেমন্ত ভাই বলে উঠলো
—আমাকে বিয়ে করবে পুষ্প?
বুবু খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে পেছনে ঘুরে বলল,
—এই কথা বলতে এসেছিলেন?
হেমন্ত ভাই শুকনো গলায় ঢোক গিলে বলল,
—ফিরিয়ে দিও না পুষ্প প্লিজ
—মনে প্রাণে আমি একজনকে ভালোবাসতাম, পাগলের মত, আমার একবার বিয়ে ঠিক হয়েছিলো ঠিক বিয়ের দিন বিয়ে ভেঙে যায়,আমি মানুষ হিসেবেও ওতো ভালো না,রান্না করতেও পারি না,আহামরি সুন্দরী ও নই আমায় আপনি বিয়ে করতে চান?
—চাই।
বাসার সবার দিকে চোখ বুলিয়ে বুবু বলল তোমরা কি চাও?
সবার সম্মতি স্পষ্ট বুঝে,বুবু ছোট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
—আপনি চাইলেই তো হবে না আমাকেও চাইতে হবে যদি আমার কোনোদিন মনে হয় আমিও চাই তাহলে অবশ্যই বিয়ে করব।তবে আমি বলব অযথা সময় নষ্ট করবেন না আমার অনুভূতি ছোট্ট থেকে আঘাত পেতে পেতে একদম ভোতা হয়ে গেছে আপনি শুধু কষ্টই পাবেন।
সেই থেকে হেমন্ত ভাই বুবুর চাওয়ার ধৈর্য ধরে আছে।কিন্তু বুবুর ইচ্ছে আমি কিছুই বুঝতে পারি না।বড় করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছাদ থেকে নেমে আসব তখনই দেখলাম বৃতি পানির ট্যাংকির পাশটায় হাটুর ওপর মাথা দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে, ও কি ঘুমিয়া গেছে নাকি! আমি কাছে গিয়ে ডাকতে গেলেই দেখলাম ওর চোখ মুখ শুকনো ও কি কেদেছে নাকি?
—বৃতি, ওই বৃতি
বেশ কিছুক্ষণ ডাকাডাকির পর চোখ খুলে আমায় দেখে ঘাবড়ে গেলো
—ছোট ভাইয়া তুই এখানে?
—এই ভর সন্ধ্যায় তুই এখানে কি করিস, তোর কি মন খারাপ?
বৃতি তড়িঘড়ি করে উঠতে উঠতে বললো
—না তো সন্ধ্যা হয়ে গেছে! আম্মা আমাকে খুব বকবে
বলেই ও দৌড় লাগালো কিছুই তো বুঝলাম না বৃতি যে মেয়ে সে তো এরকম চুপচাপ থাকে না তবে বেশ কয়েকদিন ধরে ও অনেকটাই চুপচাপ। হঠাৎ পাশের ছাদে আমার চোখ আটকে গেলো সন্ধ্যার আবছা আলোয় স্পষ্ট এক রমনীর অবয়ব দেখে থমকে গেলাম ওটা কি তুলন?
আমি নিশ্চিত হতে ডাকলাম
—তুলন?
আড়ষ্ট ভেঙে অবয়ব নড়ে উঠলো তুলন কি কাদছে?
—হ্যা সাহিত্য বলো?
তুলন কে দেখলেই আমার কেমন অন্যরকম লাগে ভার্সিটি তে ওই আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু আমি যতটা চুপচাপ তুলনের বকবকানি তত বেশি দিনের অনেকটা সময় ওর সাথে কাটানোর পরও ওর সাথে থাকতে ইচ্ছে করে।
—তোমার কি মন খারাপ?
—কই না তো!
—সকালে জিজ্ঞেস করা হয় নি, ভার্সিটিতেও তো দেখলাম না কাল, আজ অবশ্য আমি নিজেই যাই নি।
—হ্যা আমি একটু ব্যস্ত ছিলাম, আজ তো দেখলাম হেমন্ত ভাই এসেছে মনে হয়।
—হ্যা, বুবু আর হেমন্ত ভাই বাইরে গেছে তুমি শাড়ি পড়েছ কেন তুলন? আজ তো তোমার জন্মদিন নয়।জানো আজ বুবুও শাড়ি পড়েছে কি যে সুন্দর লাগছে বুবুকে!
—ওসব তুমি বোঝো সাহিত্য? বুবুর বাইরে তুমি আর কিছু দেখো নাকি?
আমি কি বলব ঠিক বুঝলাম না, তুলন কে আজ হঠাৎ অন্যরকম লাগছে, তুলনও বৃতির মত খুব চঞ্চল। আজ হয়েছে টা কি সবার?
আমি তুলনের সাথে বেশি কথা না বাড়িয়ে নিচে নেমে এলাম আম্মাকে খুব খুশি লাগছে তিনি রাতের খাবারের আয়োজন করছেন, বৃতি শুকনো মুখে আম্মাকে সাহায্য করছে। আমি আব্বার পাশে বসতেই আব্বা স্বভাব সুলভ আমার দিকে এক নজর তাকিয়েই চোখ আবার খবরের কাগজে নিবদ্ধ করলেন। আব্বা খুবই গম্ভীর আমি মাঝে মাঝে ভাবি আম্মা কিভাবে এই মানুষটার সাথে সংসার করলেন সারাজীবন, সারা বাড়িতে আব্বার সাথেই আমার সবচেয়ে বেশি দূরত্ব মাঝে মাঝে আমি ভাবি আসলেই কি আব্বা অদ্ভুত নাকি বুবু আব্বাকে পছন্দ করেন না বলে আমিও দূরত্ব বজায় রেখে চলি?আব্বা তো খারাপ না তিনি সংসার টা খুব সুন্দর ভাবে পরিচালনা করছেন সবসময় পরিশ্রম করে আমাদের সুখের কথা ভাবছেন কি সুন্দর ভাবে পরিবারের সবার ওপর আধিপত্য খাটাচ্ছেন! আম্মার আব্বার প্রতি শ্রদ্ধা দেখে আমি নিজেও মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যাই! আব্বা শুধু পারেন না বুবুকে ভাঙতে,কিছুতেই বুবুর সাথে তার সখ্যতা হয় না! কিন্ত কেন?আমাদের পরিবার টা এত অদ্ভুত কেন!

চলবে…
সামিয়া খান মায়া

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here