বিদীর্ণ_দর্পণে_মুখ পর্ব_৮

0
1002

বিদীর্ণ_দর্পণে_মুখ
পর্ব_৮

আব্বা মারা যাওয়ার মাস ছয়েকের মাথায় আমাদের বাড়ির আবার সব কিছু খুব স্বাভাভিক ভাবে চলতে লাগলো, আমি খেয়াল করলাম বাড়িঘরে একটা আমূল পরিবর্তন চলে এসেছে আব্বা থাকতে সবার মধ্যে যে জড়তা ছিলো এখন তা অনেকটাই কেটে উঠেছে, সবার চালচলনে একটা চঞ্চলতা দেখা যায়।শুধু বৃতি একটু গুটিয়ে থাকে নয় মাসের ওর পেট টা অনেকটা ফুলে উঠেছে পারতপক্ষে দাদাভাইয়ের সামনে যায় না, অনেকসময় আমার ঘরের সামনে যখন এসে অসহায় মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকে তখন খুব কষ্ট লাগে, সে সময় ওকে ডেকে গল্প করি আগে তো সবসময় মুখ চলতো কেউ কথা না বললেও ও নিজেই একা একা খুব বকতো এখন সেই বৃতি কতটা চুপ হয়ে গেছে! তুলন আসে মাঝে মাঝে বৃতির সাথে গল্প করে এখন বুবুর সাথে আর কড়া কথা বলে না।মাঝে মাঝেই নাকি ওকে ছেলেপক্ষ দেখতে আসে তখন সারাদিন এসে আমাদের বাড়ি মন খারাপ করে পড়ে থাকে তারপর কি ট্রিক খাটিয়ে তাদের বিদেয় করে কে জানে!
আমি সবচেয়ে বড় পরিবর্তন দেখেছি আম্মার মধ্যে আমার আম্মা নিজে যে এত শৌখিন এত চঞ্চল একজন মানুষ তা আমি আগে কখনো বুঝতে পারি নি, আম্মা ইদানীং একটা বাগান করে ফেলেছেন, দিব্যি রোজ বিভিন্ন খাবার রান্না করেন, গুনগুন করে গান করেন, আম্মার এই রূপ এতদিন কোথায় লুকিয়ে ছিল কে জানে!দাদাই ও রেগুলার অফিস যায় নিজের মত একটা ব্যাবসা ও দাড় করিয়েছে হেমন্ত ভাইয়ের সাথে,দাদাইয়ের নিজের একটা ব্যাবসা করার ইচ্ছে অনেক আগে থেকেই ছিলো কিন্ত সে ভালো চাকরি করে এজন্য আব্বার অনুমতি ছিলো না বলে করতে পারে নি। বুবুর ডাক্তারি পড়া নিয়ে সে খুব ব্যস্ত, হেমন্ত ভাই এর বাবা তার মাকে রাজি করিয়ে নিয়ে এসেছিলেন আমাদের বাড়ি বুবুর সাথে কথা বলতে হেমন্ত ভাইয়ের বাবার সাথে বুবু আলাদা কিছু কথা বলেছেন আর হেমন্ত ভাইকে বিয়েও করবে জানিয়েছে তবে বুবু বলেছে বৃতির বাবু না হওয়া পর্যন্ত তিনি কোথাও যাবেন না।হেমন্ত ভাইয়ের খুশি কে দেখে কেমন যে এক অদ্ভুত প্রশান্তি সবসময় তার মুখে দেখা যায়!আগের মত সেই বিষন্নতা আর কোথাও নেই। তবে এর মাঝে বুবুকে দেখা যায় মাঝরাতে ড্রয়িং রুমের সাথে লাগোয়া বেলকনিটাতে থাকা আব্বার ইজি চেয়ারটাতে অনেক্ষণ সময় নিয়ে বসে থাকে মাঝে মাঝে তার রাত সেখানেই পাড় হয়ে যায় সে ভোর হতে দেখে,আপা যতক্ষণ বসে থাকে আমিও রান্নাঘরের দরজার সামনে হ্যালান দিয়ে বোঝার চেষ্টা করি আসলে বুবু কি ভাবে!?এরমধ্যে একদিন হেমন্ত ভাই এসে আমাদের বাসায় ছিলেন দাদাইয়ের সাথে, সেদিনও বুবু বাবার ইজি চেয়ারটাতে বসেছিলো আনমনে, হেমন্ত ভাই বুবুর পাশে গিয়ে দাড়ালেন,তারপর আস্তে করে বললেন
—আঙ্কেল বেচে থাকতে কখনো তোমায় তার সাথে ঠিক করে কথা বলতে দেখি নি, অথচ এখন এবাড়িতে সবাই দিব্যি আঙ্কেলকে ভুলে গেলেও আমি খেয়াল করে দেখেছি তুমিই তাকে সবচেয়ে বেশি মনে করো, তুমি এমন কেন পুষ্প?
আমি মনে মনে হাসলাম হেমন্ত ভাই কি সুন্দর বুবুকে বোঝেন, খেয়াল রাখেন!
বুবু উঠে পাশে রাখা বেতের চেয়ারের একটাতে বসতে বসতে বলল,
—বসো কিছু কথা বলি
আমি ভাবলাম আজ বরং চলে যাই,আমি ড্রয়িং রুম পাড় হতে গিয়ে শুনলাম বুবু বলছে,
—আমাকে নিয়ে সবার বরাবরের খুব আগ্রহ কেন আমি সবসময় এমন কঠিন হয়ে থাকি সে কথাগুলো তোমায় বলতে চাই শুনবে?
আমি সেখানেই থমকে গেলাম চাইলেও আর চলে যেতে পারলাম না,আমার বুবু কেন এত কষ্টে থাকে আমিও জানতে চাই।হেমন্ত ভাই চুপ করেই রইলেন যখন বুবু কথা বলে হেমন্ত ভাই শুধু চুপ করে শোনেন তখন তিনি কোনো কথা বলেন না,বুবু কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
—তোমরা হয়তো ভাবো প্রান্ত ভাইয়ের চলে যাবার পর আমি এমন হয়েছি আসলে কিন্তু তা না, আমি আগেও এমন ছিলাম বরং যতদিন প্রান্ত ভাই ছিলেন আমি লক্ষ্যবিহীন হয়ে গেছিলাম,তুমি তো ছোট থেকেই আমাকে দেখেছ। হেমন্ত?
—বলো শুনছি তো
—প্রান্ত ভাইয়ের কথা শুনলে কি তোমার আমার প্রতি রাগ হয়?
—মোটেই না, আমি তোমাকে পাবো বলে কোনোদিন ভালোবাসি নি, আমি তোমাকে শুধু ভালোবেসেছি।আর তোমার অনুভূতি আমি অনুভব করতে পারি বরং আমার কষ্ট হয় যে প্রান্তকে তুমি পাও নি।
বুবু একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,
—তোমার বাবার সাথে আমি কি কথা বললাম তোমার জানতে ইচ্ছে করে নি?
—মিথ্যে বলব না করেছে তবে তোমাকে আমি কোনো কিছুতেই জোর করি না,
—বাবা কে জিজ্ঞেস করো নি?
আমি একটু চমকালাম বুবু নিজে আব্বাকে কখনো আব্বা বলে ডাকে নি আর সে কি না প্রান্ত ভাইয়ের বাবা কে বাবা বলছে! প্রান্ত ভাইও একটু খানি ভড়কে গেলো মনে হয়,বুবু ছোট করে হেসে বলল,
—খুব ইচ্ছে করত বুকের ভেতর থেকে একটা ডাক আসুক আমি বাবা বলে কাউকে ডাকি,আমার বয়স যখন পনের তারপর থেকে একদিনও ওই লোকটাকে বাবা বলে ডাকি নি।
—পুষ্প?
—হুম বলো
—তুমি কাপছ কেন ঠিক আছো তুমি?
—আমি ঠিক আছি,তুমি শোনো আর কথার মধ্যে প্লিজ কথা বলবে না। খুব বিরক্ত লাগে।
—আচ্ছা বলব না,তুমি বলো।
—আমি লোকটাকে খুব ভালোবাসতাম জানো? কিন্তু লোকটা সারাজীবন নিজের মন মতো চলেছেন সারাজীবন নিজের কর্তৃত্ব খাটিয়েছেন শুধু আমার প্রতি জোর খাটাতেন না, তাছাড়া বাড়ির সবার প্রতি তার আলাদা রাজত্ব ছিলো।সব চেয়ে বড় কথা তিনি সারাজীবন আমার আম্মাকে ঠকিয়েছেন, সাহিত্যকে ঠকিয়েছেন, আরো একজন কে তিনি ঠকিয়েছেন।তিনি একজন মাকে একজন সন্তানের থেকে বঞ্চিত করেছেন।
—তুমি কি বলছ আমি বুঝতে পারছি না পুষ্প
—আমার যখন দু বছর বয়স তখন আম্মা আমাদের নিয়ে এখানে থাকতেন আর ওই লোকটার ট্রান্সফার ছিল সিলেটে,সেখানে তার কোয়াটার এর পাশে একটা নাট্যশালা ছিলো। সেখানে তার সাথে পরিচয় হয় লতা আন্টির,লতা আন্টি খুব ভালো গান গাইতেন, তার সাথে তার প্রেম হয় খুব তবে বিয়ে হয় না অথচ তাদের সুন্দর একটা ছেলে হয় ফুটফুটে একটা ছেলে কোকড়া চুল কি যে সুন্দর দেখতে! অথচ স্বীকৃতি না পাওয়ার ভয়ে তার সন্তানের দিকে আঙুল উঠবে এই ভয় দেখিয়ে তিনি লতা আন্টির কাছ থেকে বাবু টাকে নিয়ে আসেন। আমার আম্মা এতটাই বেহায়া তিনি এত কিছুর পরও লোকটার সাথে সংসার করেন,তার পরেও তার অন্য সন্তানের মা হন লোকটাকে অনুতপ্ত করতে তিনি একটা কৌশল করেন বাবু টাকে নিজের ছেলের চেয়েও বেশি ভালোবাসা দেন,আম্মা বাবুটাকে সত্যি ভালোবেসে ফেলেন, খুব শখ করে বাবুর নাম দেন আগুন। এসবের কিছুই আমরা ভাইবোনেরা জানতাম না একদিন লতা আন্টি আমাদের বাসায় বাবুটাকে দেখতে আসেন সেদিন ওই লোকটা আন্টিকে খুব অপমান করেন তাড়িয়ে দেন বলেন যাতে আর কখনো না আসতে। সেদিন দূর্ভাগ্যবশত আমি সব জেনে যাই পনেরো বছর বয়স যথেষ্ট ছিল সবটা বোঝার জন্যে। তারপর থেকে আমি কেমন কঠিন হয়ে গেলাম জানো? লোকটাও অনেকটা নরম হয়ে গেলো আমার চোখের দিকে তাকানোর সাহস হারিয়ে ফেললো, আমি লতা আন্টির সাথে যোগাযোগ রাখলাম বাবুটার প্রতিবামার ভালোবাসা হাজার গুণ বেড়ে গেলো, আমি জানতে পারলাম লতা আন্টি তার ছেলের নাম রাখতে চাইতেন সাহিত্য। আমি আগুণের নাম পালটে নাম রাখলাম সাহিত্য।

চলবে…
সামিয়া খান মায়া

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here