বিদীর্ণ_দর্পণে_মুখ শেষ

0
1367

বিদীর্ণ_দর্পণে_মুখ
শেষ

টেক্সাস থেকে ফিরেছি কালকে সন্ধ্যে নাগাদ, এখন বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যে ধরধর।আম্মা যে এর মধ্যে তের বার আমার ঘরে উকি দিয়েছে সেটা মাত্র জানতে পারলাম তুলনের কাছে। তুলন নিজের দায়িত্বে আমার ঘরে এসে লাগেজ খোলা শুরু করে দিয়েছে তার লিস্ট অনুযায়ী সব আনা হয়েছে কি না সে মিলিয়ে মিলিয়ে দেখছি আমি চোখে চশমা টা পড়ে নিয়ে বললাম,
—তুমি এখনো বাচ্চাদের মতো করো কেন তুলন, কেউ বলবে কয়েকদিন বাদে তুমি বাচ্চার মা হবে।
—তোমার লজ্জা করে না বড় ভাইয়ের বউকে নাম ধরে ডাকতে?
—না কারণ এখনো তুমি মাঝে মাঝে দাদাই কে স্বাধীন ভাইয়া ডেকে ফেলো তাই আমার লজ্জা করে না।
—সে তো যখন তার সাথে প্রেম করতাম তখনও ডাকতে হতো
—সত্যি তোমরা যে এত বছর প্রেম করেছো অন্য সবাই তো বাদই থাক আমি নিজেও কোনোদিন একবারের জন্যেও টের পাই নি!
—তোমার দাদাই খুব খারাপ মানুষ, আমাকে খুব কষ্ট দিয়েছে কোনোদিন আমাকে শান্তি মত ভালোবাসতে দেয় নি,সব সময় আড়াল করে গেছে, আমি তো ভেবেছিলাম ওই লোকটা আমার বিয়ে হয়ে গেলেও মনে হয় চুপ করেই থাকবে
—খবরদার আমার দাদাই নিয়ে কোনো কথা বলবে না,
—এহ! আইছে লাটসাহেব, কি ওনার দাদাই রে!
—এত অভিযোগ কেন তোমার হুম? শেষ সময়ে তো ঠিকই দাদাই তোমার বিয়ের দিন কেমন হাত ধরে সবার সামনে থেকে নিয়ে এলো, আসে নি?

তুলনের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেলো মুখে কপট রাগ দেখিয়ে সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো,আমি তুলনের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম, মানুষের জীবন কত বিচিত্র ভাবতে লাগলাম যেই মেয়ে সামনে এলে আমার প্রতিটি রক্তকণায় অদ্ভুত বিচ্ছুরন হতে সেই মেয়েই আমার চোখের সামনে ঘুরে বেড়াবে অথচ সে আমার নয়! অদ্ভুত! আমার আড়ালে কেমন করে সব কিছু ঘটে যায়! একই সাথে আমি তুলনের সাথে পড়তে বসে কোনোদিন বুঝতে পারি নি যে দাদাই আর তুলন চোখে চোখে অন্যকথা বলতো!তুলন এক নাগাড়ে দাদাই এর দিকে তাকিয়ে থাকলে দাদাই যে শাসন করতো তার মধ্যে এক অন্যরকম অধিকার থাকতো!
তুলন আবার ফিরে এসে বললো,
—আম্মা কিন্তু এবার অস্থির হয়ে যাচ্ছে শিগগির এসো, আর তাও যদি আলসেমি করো তাহলে শোনো তোমার বুবু এসেছে
—বুবু এসেছে!কখন!
—সকালে
—ডাকো নি কেন আমায়!
—ওমা! কি মিথ্যুক কত বার তো ডাকলাম
—আরে বলবে তো বুবু এসেছে!
তুলন মুখ বাকিয়ে চলে গেলো,
আমি মুচকি হেসে বিছানা ছেড়ে নামলাম, আম্মার আমাকে এত ভালোবেসে কি লাভ? আজও তো আমি আম্মার আগে বুবুর কথা মানি।আমি হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে দেখলাম, বুবু গুনগুনকে খাওয়াচ্ছে আর অসহায়ের মত হেমন্ত ভাই পাশে দাঁড়িয়ে, মনে হচ্ছে দুজনেই ধমক খেয়ে আছে, আমি হাসলাম এখনো কি বুবুকে হেমন্ত ভাই আগের মতো ভয় পায়? বুবু খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকালো, যেন আমি এখানেই ছিলাম এই ঘুম থেকে উঠে আমার ঘর থেকে বের হলাম অথচ প্রায় ৫ বছর পর আজ আমি আমার বুবুকে দেখছি!আমার খুব ইচ্ছে হলো দৌড়ে গিয়ে বুবুকে জড়িয়ে ধরি, আমার ভাবার আগেই আম্মা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কেদে ফেললেন।
—একটুও ভালোবাসো না বাবু তুমি আমায়,
আমি হাসলাম,
—আম্মা এই কথা আপনি বলতে পারলেন
—অবশ্যই পারলাম পাচ বছর পর তুমি বাড়ি এসেছো কালকে আর তুমি ঘর থেকে এখন বের হলে,বদলে গেছে আমার বাবু!
আমি আম্মাকে জড়িয়ে ধরে বললাম
—আপনিই কিন্ত আমায় অনুমতি দিয়েছিলেন বাইরে পড়তে যাওয়ার জন্যে
—মোটেই না পুষ্প জোর করে তোমায় পাঠিয়েছে,
—আম্মা চুপ করো, এত কান্নাকাটির কি আছে বুঝলাম না, সাহিত্য তো এখন এসেই গেছে এখন কাদছো কোন দুঃখে,
আমি গুনগুনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে অদ্ভুত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে,হেমন্ত ভাই আমাকে দেখে বলল,
—দুঃখিত ছোট শালা, আমার পুতুল এখন বিপদে আছে তাকে রেখে তোমার কাছে যেতে পারছি না।
আমি হাসলাম হেমন্ত ভাই গুনগুনকে পুতুল বলে ডাকে,হেমন্ত ভাইয়ের বাড়ির সবাইও তাই ডাকে শুধু এবাড়িতে ওকে ডাকা হয় গুনগুন এইটা বুবুর ডিশিসন। গুনগুন ভয়ে ভয়ে বুবুর দিকে তাকিয়ে বলল,
—মাম্মাম বাবাই পচা কথা!
বুবু আড়চোখে হেমন্ত ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
—হ্যা তাই তো দেখছি তুমি খাওয়া শেষ করো বাবাইকে বকা দেবো,
—না মাম্মাম বাবাই কে বকা না,
আমরা সবাই হেসে ফেললাম,হেমন্ত ভাই এবার বুবুকে উপেক্ষা করেই গুনগুন কে কোলে তুলে নিলো, বুবু কপট রাগ করে বলল,
—আদিখ্যেতা করো না তো, দুপুরের খাবার খাচ্ছে এখন! তোমার জন্যেই ও আমার কোনো কথা শোনে না!
দাদাই বাইরে থেকে নাস্তা এনে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
—মিথ্যে বলিস না পুষ্প গুনগুন কেন ওর বাপের ও সাধ্যি নেই তোর কথার বাইরে যাওয়ার,
বুবু অযথা রাগ দেখিয়ে হাত ধুতে গেলো, সন্ধ্যে টা কাটলো আড্ডায় গল্পে স্মৃতিচারণে। মাঝ রাতের দিকে আমি কৌতূহল নিয়ে উঠলাম দেখতে, আমাকে অবাক করে দিয়ে বুবু আব্বার ইজি চেয়ারটায় বসে আছে বুবু একটুও বদলায় নি।এখানে ঠিক এই বারান্দা থেকেই আমি আমার জীবনের চরম সত্যি শব্দ গুলো ভেসে আসছিলো, সেদিন সবটা শুনে আমি কিন্তু আড়ালে চলে যাই নি।আমি বুবুর সামনে গিয়ে দাড়িয়েছিলাম বুবু আমাকে দেখে একটুও বিচলিত না হয়ে শুধু আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলো।হেমন্ত ভাই একটু সরে গিয়ে পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের দেখছিলো, আমার বুবু খুব চালাক সে জানে কখন কোথায় কেমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়, বুবু তখনই হেমন্ত ভাইকে জানায় আমার স্পেস প্রয়োজন, এই পরিবারের বাইরে গিয়ে আমার জানা প্রয়োজন এই পরিবার আমার কাছে কতখানি এখান থেকে বের হয়ে আমার যদি মনে হয় ফেরার দরকার নেই তবে আমি তাই করতে পারি, আমি যদিও এর কোনো প্রয়োজন দেখছিলাম না।হয়তো বুবুকে নাও করতাম সাহস করে কিন্তু তুলন আর দাদাই এর নাটকীয় বিয়ের পর বুবু আর একটুও দেরী করতে চায় নি, বুবু তো জানতো তুলনের প্রতি আমার অনুভূতি কি। সেই মুহূর্তে আমারো মনে হয়েছিলো দাদাই আর তুলনের জন্যে,আমার জন্যে বাইরে যাওয়াই ঠিক, বুবুর সিদ্ধান্ত সবসময়ই ঠিক।আমাকে বাইরে পাঠানোর জন্যে বুবুই সবাইকে বিশেষ করে রাজি করায়।আমি ঠিকই চলে এসেছিলাম তবে বৃতির বাবু হওয়ার জন্যে যাওয়াটা একটু পিছিয়ে গিয়েছিলো।একবার ভেবেছিলাম বুবুর লতা আন্টিকে খুজি তারপর ভাবলাম না থাক, আমার আম্মা এতে কষ্ট পাবেন তার বুকের ভেতর জ্যান্ত একটা ক্ষত থেকে রক্ত ঝরবে।আমার আম্মা আমাকে ভালোবাসেন খুব ভালোবাসেন আমি আমার মা কে কষ্ট দিতে পারি না।তাও হয়তো খুজতাম একবার দেখা করতাম যদি বুবুর কাছে জানতে না পারতাম যে আব্বা বিবাহিত এটা বুবুর লতা আন্টি জানতেন।তাও তিনি যথেষ্ট সম্মান পেয়েছেন বুবু তাকে দিয়েছেন, কিন্তু তার জন্যে আমার আম্মার যে কষ্ট পাওয়ার কথা ছিলো না তা তিনি পেয়েছেন, তার চোখের সামনে আমি ঘুরে বেড়ালে কি তার মনে হতো না জীবনে তার সাথে কতবড় বিশ্বাসঘাতকতা করেছে!পরে ভাবলাম না! আমি আমার আম্মার সন্তান তিনি আমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছেন এসব তুচ্ছ বিষয় দিয়ে তার ভালোবাসার পরিমাপ করা যায় না।এজন্যেই তো আমি ফিরে এসেছি আমার আম্মার জন্যে।আমার প্রিয় পুষ্প বুবুর জন্যে!

আমার ভাবনা ভাঙলো বুবুর ডাকে,
—ওখানে দাঁড়িয়ে ভাবনা শেষ হলে, এদিকে এসো সাহিত্য।
আমি এক প্রকার দৌড়ে বুবুর কাছে গেলাম,আমি মেঝেতে বসে বুবুর কোলে মাথা রেখে বললাম,
—তুমি এমন কেন বলোতো বুবু!
—কেমন?
—খুব ভালো,
—ইদানীং আমাদের সাহিত্য খুব কথা বলে,
আমি হাসলাম কিছুক্ষণ নিরবতায় কাটার পর বললাম
—বৃতিকে খুব মিস করি বুবু।
বুবু আমার মাথায় হাত রাখলো,

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম, গুনগুন কে জন্ম
দিতে গিয়ে সেদিনই বৃতি মারা যায় দু ঘন্টার মতো বেচে ছিলো,আহনাফকে দেখার জন্যে ওর চোখ দুটোতে কতটা অসহায় চাহনি ছিল! অথচ ওরা, ওদের বাড়ির কেউ এলো না!বুবুর হাতের মধ্যে হাত নিয়ে বৃতি কি সুন্দর করে বলছিলো
—বুবু আমার মেয়েটা কে তুই নিবি বুবু?
বুবু সবটা বুঝেও শান্ত চোখে তাকিয়ে ছিলো,শুধু সেদিন বৃতি কথা বলছিলো,
—এবার তো তোমরা সবাই খুশী হবে কেউ তোমাদের জ্বালাতন করবে না,আর কেউ কথা বলে কান ঝালাপালা করবে না,
আমরা সবাই কেদে ফেললাম, বৃতি বুবুর হাত ধরে বলল,
—তুই কিন্তু এখনো আমার মেয়েটাকে নিলি না,
তখন বুবু গুনগুন কে কোলে তুলে নিলো
—আমার মেয়েটার নাম গুনগুন রাখিস বুবু, তুই কিন্তু আমার সাথে শেষ কথা বললি না,
বুবু এই কথার উপর বৃতিকে জড়িয়ে কেদে ফেললো,আমরা সবাই স্তব্ধ হয়ে গেলাম, বুবুর কান্নায় যে এতটা কষ্ট আগে তো কখনো দেখি নি! বুবুর কান্না শুনে ছোট্ট গুনগুন কেদে উঠলো
তখন হেমন্ত ভাই গুনগুনকে কোলে নিয়ে বলেছিলো,
—এই পুতুলটা কে আমি নিলাম বৃতি
ওমনিই গুনগুনের কান্না থেমে গেলো।
বৃতি কান্নার মধ্যে হেসেই ফেললো! শেষ হাসি।

হেমন্ত ভাই পাশে এসে সেই আগের বারের মতো পকেটে হাত দিয়ে একটু দূরে দাড়ালো,ফিসফিস করে বলল,
—তোমার বুবু আসলেই খুব ভালো সাহিত্য, এই পৃথিবীর সব কঠিন দায়িত্বগুলো সে খুব সহজ ভাবে পালন করে।

এমন সময় রান্না ঘর থেকে শব্দ পাওয়া গেলো তুলনের নাকি মিল্কশেক খেতে ইচ্ছে করছে, দাদাই তাই বানাচ্ছে এখন আর স্বভাবসুলভ ধমক দিয়ে বলছে
—সবসময় জ্বালাতন করো তুলন তুমি অসহ্য
ঠিক আগের মতোই ভালোবাসা মিশে আছে দায়াই এর এই রাগ করার মধ্যে আজ বুঝতে পারলাম, তুলন কপট রাগ করে বলছে,
—তুমি একটুও ভালোবাসো না আমায়!

টেক্সাসে এদের খুব মিস করতাম, খুব ডিপ্রেস হয়ে যেতাম নিজের পরিচয় এর কথা মনে পড়লে বারবার মনে মনে আওড়াতাম

ফেলে আসা বন্ধনগুলো খুব করে চাইছি
আর একবার বাহুডোরে বাধুক,
অস্তিত্বজুড়ে পুরনো স্মৃতিগুলোই থাকুক
আজ এত যুগ পরে এ কেমন অসুখ?
সব খানেই ঘুরে ফিরে ভেসে উঠছে
অসহনীয় এক বিদীর্ণ দর্পনে মুখ।

আমি হালকা হাসলাম,এই বাড়িঘর ছেড়ে আমি কোথায় থাকবো?হেমন্ত ভাই, বৃতির ছায়া গুনগুন,আমার দাদাই,আমার আম্মা,আর এই যে বসে থাকা মেয়েটি! বরাবরে দায়িত্বশীল, সব কষ্ট সব গোপনীয়তা গিলে মাতৃহারা সাহিত্য, গুনগুন কে মমতায় আগলে রাখে যে মেয়েটি! আমার বুবু। আমার বুবু।।

শেষ।
সামিয়া খান মায়া

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here