প্রেমানুরাগ পর্ব ৭

0
601

#প্রেমানুরাগ❤️
#মাইশাতুল_মিহির
#পর্ব-৭

পাহাড়ের উপর উড়ন্ত সাদা মেঘ উড়ে ভেড়াচ্ছে। দূর দূরান্ত থেকে ভেসে আসছে প্রবল বাতাস। শীতল হাওয়ায় মন উজাতন।আগুন জ্বলছে পাহাড়ের উপর। তারপাশে বসে আছে রবি ও শশী। দুজন প্রাণখোলে হাসছে কিছুক্ষণ আগের ঘটনায়। পানিতে দুজন ইচ্ছে মতো জমিয়ে ফুর্তি করে কয়েকটা মাছ ধরেছিলো। এইগুলো দিয়ে আপাতত দুপুরের খাবারের চাহিদা মিটবে। রবি পাহাড়ের উপরের আশেপাশে থেকে শুকনো কাঠ আর পাতা কুড়িয়ে আনে। মাছ পুড়ানো হয়ে গেলে দুজন তৃপ্তি সহকারে খেয়ে নেয়। সূর্য মাথার উপর থেকে হেলে পরেছে পশ্চিম আকাশে। বিকেলের সময় ছুঁই ছুই প্রায়। শশী মাচার উপর বসে দূরের পাহাড় দেখছে। রবি ঘরের দরজাতে হেলান দিয়ে শশীর দিকে তাকিয়ে রইলো। এই মেয়ে মাঝে লুকায়িত কিছু আছে। মানতে হবে বস! এগিয়ে শশীর পাশে বসলে শশী মুচকি হেসে তাকায়। সেই হাসিতে আবার আটকে পরে রবি। এমনিতেই বাকা দাতের হাসি আবার গালে লম্বা টুল। আরেহ প্রেমে পরে যাবার মতো উপক্রম।

শশী উল্লাসিত কন্ঠে বললো, ‘ট্রাস্ট মি। এর আগে কখনো এতো সুন্দর মুহূর্ত উপভোগ করিনি আমি। ঢাকার বড়বড় ইট-দালান দেখতে দেখতে এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করা হয়ে উঠেনি। আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ মিঃ শনি রবি সোমবার।’

অসন্তুষ্টি চোখে তাকালো রবি। সিরিয়াস কথার মাঝেও এই মেয়ে ফাজলামি করে। প্রথম কথা গুলো ভালো লাগলেও শেষে নামটা বিকৃতি করায় বিরক্ত লাগলো তার। যতো দুষ তার বাবা মায়ের। রবি ছাড়া দুনিয়াতে আর নাম ছিলো না? এতোই নামের অভাব ছিলো? যদি অভাবই থাকতো তাহলে আমিই নাহয় বড় হয়ে নিজের নাম রাখতাম। মনে মনে যখন এইসব কথা আওড়াচ্ছিল তখন শশীর ডাকে ধ্যান ভাঙ্গে তার।

‘ঢাকা ফিরবেন কবে?’

রবি শান্ত ভাবে উত্তর দিলো, ‘কাল চলে যাবো!’

ক্ষুন্ন হলো শশীর মন। ইশ আরো কয়েকটা দিন থেকে গেলে কেমন হতো? এতো সুন্দর জায়গা ছাড়তে ইচ্ছে করছে না তার। রবি শশীর মন খারাপের কারণ বুঝতে পারলো। কিন্তু কিছু বললো না। এমনিতেই সাত দিনের সময় নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে সে। আজ ছয় দিন। কাল ঢাকা ফিরতেই হবে। ফুঁশ করে নিশ্বাস নিলো রবি। দৃষ্টি রাখলো পাহাড়ে উড়ন্ত মেঘের উপর।
___________________

দীর্ঘ ৯ ঘন্টা জার্নির পর বান্দরবনে এসে পৌঁছালো সোহরাব আর ইকবাল। আগে থেকেই রিসোর্টে রুম নিয়ে রাখায় কষ্ট করতে হয়নি। রুমে এসে দুজন ফ্রেশ হয়ে নিলো প্রথমে। সোহরাব ফ্রেশ হয়ে বিছানায় অধম:রা হয়ে শুয়ে পরলো। ইকবাল বললো, ‘দোস্ত তুই এখানে খাবি? নাকি বাহিরে গিয়ে?’

সোহরাব চোখ বন্ধ রেখেই বললো, ‘ভালো লাগছে না আমার। শশীকে এনে দে।’

‘শশীর খোঁজ পেয়েছি আমরা। কিন্তু আপাতত খেয়ে নিতে হবে। সেই ভোরে এক কাপ কফি আর হাল্কা নাস্তা করে বেড়িয়েছি। তোর খালি পেটে থাকা রিক্স। আয় খেয়ে নে। নাকি আমি রুমে খাবার প্যাক করে নিয়ে আসবো?’

‘আসছি আমি। তুই যা।’

বেরিয়ে এলো ইকবাল। খাবার অর্ডার করে টেবিলে চেয়ার টেনে বসলো। মোবাইল বের করে জরুরী বিত্তিতে কল দিয়ে ব্যস্তভঙিতে কথা বলতে লাগলো। চিন্তায় কপালে তার সূক্ষ্ম ভাজ পরে। সোহরাব এসে তার পাশে বসতেই কল কেটে দেয়। খাবার আসার পর সোহরাব কে জোরপূর্বক খায়িয়ে দেয় ইকবাল। নিজেও খেয়ে নেয়। শশীর সম্পর্কে প্রশ্ন করতেই ইকবাল বললো, ‘ক্রি:মি:নাল দের আস্তানা পাহাড়ের পাদদেশে। যেখানে জনমানবশূন্য। সবাইকে আটক করেছে পুলিশ। তাদের থেকে জানা যায় শশীকে সেখানেই নিয়ে গিয়েছিলো পা’চা’র করে দিতে। কিন্তু শশী সেখান থেকে পালিয়ে যায়। আমার মনে হচ্ছে শশী এখন কোনো সেইভ জোনে আছে।’

তেঁতে উঠলো সোহরাব। বললো, ‘তুই এতো ইজিলি কিভাবে বলতে পারছিস শশী সেইভ আছে? সে এখনো নিখোঁজ। না পাওয়া অব্ধি আমি শান্তি পাচ্ছি না। এট এনি কস্ট, আমি আমার মেয়েকে চাই ইকবাল।’

ইকবাল মাথা দুলালো। তারপর সোহরাবকে শান্ত হতে বললো, ‘আমি খোঁজ নিচ্ছি ইনশাআল্লাহ পেয়ে যাবো।’

শান্ত হলো না সোহরাব। খাবারের প্লেট মৃদু ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। ইকবাক বললো, ‘ভাই আমার খেয়ে নে। তুই অসুস্থ হয়ে গেলে শশীকে কে খোঁজবে? আগে সুস্থতা জরুরী। খেয়ে নে। শশী শুনলে রাগ করবে।’

অসহায় চোখে তাকালো সোহরাব। চোখ তার লাল হয়ে আছে। মেয়ে রাগ করবে শুনে চোখের পানি টিস্যু দিয়ে মুছে খাবার চিবুতে লাগলো। গলায় দিয়ে খাবার নামছে না তার। তাও সে খাবে। মোট কথা শশীর রাগা চলবে না।
_______________

আকাশে মেঘ ডাকছে। কাঁপিয়ে উঠছে চারপাশ। পাহাড়ের উপরের পরিবেশ হওয়ায় সেখান কার বাতাসের বেগ তীব্র। শশী মাচার উপর বসে বসে পা দুলাচ্ছে। চুল গুলো বাতাসে উড়ছে। রবি ঝর্নার ধারে কলস দিয়ে পানি আনতে গিয়েছিলো। পানি নিয়ে আসার সময় সফেদা পেয়ে তিনটে সফেদা সাথে নিয়ে আসে। কলস ঘরের মধ্যে রেখে ছোট ফল কাটার ছু-রি নিয়ে শশীর পাশে বসে। শশী তাকে দেখে প্রফুল্লিত মনে হাসে। এই হাসিতে যেন রবি আবারো মুগ্ধ হলো। একটা সফেদা কেটে চার পিস করলো। অতঃপর দুজন এক সাথে খেতে খেতে আকাশে উড়ন্ত সাদা মেঘের ভেলা দেখতে লাগলো। শশী জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনি পালিয়ে এসেছেন কেন?’

রবি চোখ ঘুরিয়ে শশীর দিকে তাকালো। এতোক্ষনে দুজনের মাঝে বেশ ভালো সখ্যতা ও বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছে। রবি বললো, ‘আম্মু আমার ব্যাপারে একটু বেশি ডেস্পারেট। তার ভাষ্যমতে আমি বড় হয়েছি। এসব ছেলেমানুষি আমার দ্বারা মানায় না। আর সকল প্রোপার্টির দায় ভার আমার কাধে দিবে। কিন্তু আমি এখন ব্যস্ত লাইফ চাই না। আমি মুক্ত পাখির মতো ডানা ঝাপটে আকাশে উড়তে চাই। ট্রাভেল করা মম পছন্দ করে না। ভাবে ট্রাভেলে এসে যদি আমার কোনো ক্ষতি হয়ে যায়। তাই আমি প্রায় সময় দেয়াল টপকে পালিয়ে ট্রিপে চলে আসি।’

‘বাড়িতে যাবার পর আন্টি কিছু বলে না?’

হেসে ফেললো রবি। বললো, ‘প্রথম কয়দিন রাগ করে থাকে। কথা বলে না। আমি সামনে থাকা শত্বেও চোখে দেখে না এমন ভাব নিয়ে থাকে।’

শশী আবারো প্রশ্ন করলো, ‘রাগ ভাঙ্গান কিভাবে?’

‘ওইযে প্রথম কয়দিন আম্মুর আচল ধরে ঘুরি। আম্মুর পছন্দের খাবার রান্না করি। যতোক্ষন না কথা বলে ততোক্ষণ পিছু ছাড়ি না। এমনিতেই রাগ ভেঙ্গে যায়।’

হাসলো শশী। আনমনে বলে উঠলো, ‘বাহ আপনি খুব লাকি।’

রবি প্রতিত্তুরে হাসলো শুধু। শশী আবারো আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করলো, ‘আপনি ট্রাভেল প্রেমী?’

রবি খুব সাবলীল ভাবে উত্তর দিলো, ‘হ্যা। ছোট বেলা থেকেই প্রকৃতির প্রতি আমার এক অদ্ভুত টান ছিলো। প্রকৃতির এই সৌন্দর্য বারংবার আমাকে মুগ্ধ করে। আমি প্রকৃতির মাঝেই হারিয়ে যেতে চাই। ভেজা মাটির ঘ্রাণ, সদ্য ফোটা কচি পাতার খুঁশবু, পাখির ডাক সব কিছুই আমার প্রিয়। ছোট বেলায় তো আমাকে ঘরে ধরে বেধেও রাখতে পারতো না। একবার গ্রামে দাদু বাড়িতে আম্মু আমাকে ঘরে বন্ধি করে রাখে যেন বাহিরে যেতে না পারি। কিন্তু আমি তো আমিই। জানালার গ্রিল ভেঙ্গে পালিয়ে গেছি। হাহা!’

হাসলো রবি। সাথে শশীও। রবি হাসতে হাসতে আবার বলতে লাগলো, ‘পরে যখন বাড়ি ফিরলাম সে কি মা:ইর দিলো। তারপর স্কুল কলেজে থাকাকালীন আম্মুকে না জানিয়ে বন্ধুদের সাথে পিকনিকে চলে যেতাম। ভার্সিটিতে উঠার পর সাপ্তাহ খানেকের জন্য পালাতাম। তবে কোনো সময়ই সাত দিনের বেশি বাড়ির বাহিরের থাকি নি।’

‘বাড়িতে ফেরার পর কিছু বলে না?’

‘বলে না মানে? তুমি বিশ্বাস করবে আমি ভার্সিটিতে পড়েও আম্মুর হাতে বেতের মা’র খেয়েছি শুধু মাত্র পালিয়ে যাবার কারনে।’

উচ্চস্বরে হেসে ফেললো শশী। হাসতে হাসতে বললো, ‘এবার বাড়ি ফিরলে নিশ্চয় বেতের মা’র খাবেন।”

রবি চোখ ঘুরিয়ে এক মনে শশীর দিকে তাকালো। এক প্রকার ভালোলাগা কাজ করছে তার মনে। শশীর গালের টুল, বাঁকা দাঁতে বারবার মুগ্ধ হচ্ছে সে। পলকহীনভাবে তাকিয়ে থেকে আনমনে বলে উঠলো, ‘তোমার হাসিটা খুব সুন্দর শশী।’

হাসি থামিয়ে রবির দিকে তাকালো শশী। প্রতিত্তুরে মুচকি হেসে বললো, ‘সবাই বলে। কিন্তু আমার ভালো লাগে না বাকা দাঁতের জন্য।’

রবি যেন একটা ঘোরের মধ্যে আছে। এক হাত এগিয়ে শশীর কপালে পরে থাকা চুল গুলো কানের পিছনে গুঁজে বলে উঠে, ‘সত্যি। বাঁকা দাতের এই সুন্দর হাসিতে বারবার প্রেমে পরতে বাধ্য।’

রবির চোখে চোখ রাখলো শশী। তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। রবি এক দৃষ্টিতে শশীর দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ মেঘের তীব্র ডাকে দুইজনের ধ্যান ভাঙ্গে। লজ্জা পায় শশী। গাল হয়ে আসে তার। কোনো রকমে নিজেকে সামলে ‘আমি ঘরে যাচ্ছি’ বলে উঠে দাঁড়ায়। দ্রুততার সাথে পায়ের কদম ফেলে ঘরে চলে আসে। শশীর লজ্জামাখা মুখ দেখে রবি আনমনে হাসলো। বুকের বা পাশে হাত রেখে বললো,

‘বা-পাশের জায়গাটা তোমার উপর মুগ্ধ হয়েছে মেঘের রানী।’

চলবে??

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here