প্রেমানুরাগ পর্ব ৮

0
558

#প্রেমানুরাগ❤️
#মাইশাতুল_মিহির
#পর্ব-৮

সন্ধ্যায় গোধূলি আবিরে রাঙ্গানো পরিবেশ। সূর্য তার হলুদ লালচে আভা চারপাশ ছড়িয়ে মুখরিত করেছে রেখেছে। পশ্চিম আকাশে সূর্যের লাল রঙ্গের রেশ স্পষ্ট ভাস্যমান। শশী গায়ে পাতলা চাদড় পেঁচিয়ে গাছের খুঁটির উপর বসে আছে। তার ঠিক সামনে রবি বসে বসে কাঠ, শুকনো পাতা দিয়ে আগুন ধরাচ্ছে। দুজনের হাতে কফির কাপ। শশী নিরবে কফির কাপে ছোট ছোট চুমুক বসাচ্ছে আর রবিকে পর্যবেক্ষণ করছে। আগুনের লাল আভা রবির মুখে পরে মোহনীয় লাগছে তাকে। এই মুহূর্তে শ্যামবর্ণের অধিকারি রবিকে পৃথিবীর সব চেয়ে সুদর্শন পুরুষ লাগছে তার কাছে। আনমনে হাসলো শশী। রবি আগুন থেকে চোখ সরিয়ে শশীর দিকে তাকাতেই দেখে শশী তারই দিকে তাকিয়ে আছে। রবির চোখে চোখ পরতেই শশী সেই মুগ্ধকর হাসি দিলো একটা। রবি নেশাক্ত চোখে তাকিয়ে রইলো শশীর দিকে। শশী হাত থেকে কফির কাপ মাটিতে রেখে বললো, ‘গান পারেন?’

রবি আগের মতোই তাকিয়ে থেকে বললো, ‘হুম!’

একটা গান শুনানোর জন্য জোড় করলো শশী। রবি প্রথমে নাঃকোচ করলেও পরবর্তীরে রাজি হয়। শশী অধিক আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে রইলো গান শুনার জন্য। রবি আগুনে একটা শুকনো লাঠি দিয়ে গাইতে শুরু করলো…

‘কখনও জানতে চাসনি তোকে কত খুঁজেছি যে কিভাবে
কখনও ডুবুরির বেশে, রাঙ্গা মাটি পথ শেষে, কত কিভাবে
কখনও বুঝতে চাসনি আমি বলতে চেয়েছি যেভাবে
তোর নরম হাতের বোনা শীতের চাদরে ঘুমকাতুরে।

তুই বললে কথা শীতের রোদহীন দুপুর
রোদ জ্যোৎস্নায় মেখে রুপো হয়ে যেতো, হয়ে যেতো
তুই বললে কথা অমাবস্যা রাতও
আকাশের কালো চিরে আলো জ্বেলে দিতো, জ্বেলে দিতো।

তুই বললে কথা শীতের রোদহীন দুপুর
রোদ জ্যোৎস্নায় মেখে রুপো হয়ে যেতো, হয়ে যেতো
তুই বললে কথা অমাবস্যা রাতও
আকাশের কালো চিরে আলো জ্বেলে দিতো, জ্বেলে দিতো।

তুই বললে, তুই বললে, তুই বললে
তুই বললে, তুই বললে, তুই বললে।

[বাকি গানটুকু নিজ দায়িত্বে শুনেন নিবেন]

গানটা শেষ করে রবি চমৎকার একটা হাসি দিয়ে তাকালো। শশী ঠোঁটে ঠোঁট চেপে মুচকি হাসলো। মনের আনাচে কানাচে ভালোলাগা দোল খাচ্ছে তার। রবিকে নিয়ে তার মনের সুপ্ত কোনে নতুন অনুভূতি তৈরি হয়েছে। তার মনে হচ্ছে এই গানটা রবি তাকে ডেডিকেটেড করে গেয়েছে। মুখে হাসি রেখেই বললো, ‘অসাধারন গেয়েছেন।’

রবিও প্রতিত্তুরে মৃদু হাসলো। বললো, ‘গানটার গভীরতা অনেক।’

‘হুম। আপনার কোনো গার্লফ্রেন্ড আছে? না মানে এমনি জিজ্ঞেস করেছি।’ এমন একটা প্রশ্ন করে শশী নিজেই বেক্কল বনে গেলো। রবি নিরবে উত্তর দিলো, ‘না। ট্রাভেল করতে করতে গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ভাবার সময় হয়নি।’

সন্তুষ্ট হলো শশী। কিছু বললো না। হঠাৎ ঝিরিঝিরি কোয়াশার ন্যায় বৃষ্টি ঝরতে লাগলো। শশী আর রবি আগুন নিভিয়ে ঘরে চলে আসে। এখন দুজন পশ্চিম পাশের জানালার কাছে পাশাপাশি বসে আছে। পরিবেশে মাঝে রয়েছে পিনপিন নিরবতা বিরাজমান। মৃদু বাতাস চারপাশে প্রভাহমান। বিশাল আকাশে থালা ন্যায় চাঁদ টা অসাধারন লাগছে। জ্যোৎস্নার রাত টা মোহনীয়। শশী তার কথার ঝুলি খোলে বসে আছে। সেই কখন থেকে একা একা এটা সেটা বলছে। রবিও মুগ্ধতার সাথে শুনছে সবটা। আষ্টর্যের ব্যাপার হলো প্রথম দিনের মতো বিরক্ত হচ্ছে না সে। বরং খুব মনোযোগীর সাথে শুনছে সব। রাত গভীর হতে লাগলো। রাতের খাবারের জন্য রবি নুডুলস বের করলে শশী অসহায় কন্ঠে বললো, ‘আবার নুডুলস?!’

রবি হাসলো। উত্তর দিলো, ‘এখুনি শেষবার। কাল সকাল সকাল বেরিয়ে যাবো। তখন হোটেলে খেয়ে নিবো কিছু।’

প্রসন্ন হওয়ার বদলে শশীর মন ক্ষুন্ন হলো। এতো তাড়াতাড়ি দিন কেটে গেলো কিভাবে? আরো কয়েকদিন থেকে গেলে কি হতো? রবি নুডুলস করা শেষে শশীর পাশাপাশি বসলো। খাওয়ার সময় দুজনের একজনও কথা বলেনি। রবি খাওয়ার পর ব্যাগ পত্র সব গুছিয়ে নিলো। শশী বিছানায় বসে বিষন্ন মনে দেখছে সব। রবি শশীর মন খারাপের কারন বুঝতে পেরেছে ঠিকই। কিন্তু সে আর কি বা বলবে?

সব কিছু গুছানো শেষ হলে রবি শশীকে ঘুমাতে বলে বাহিরে পা বাঁড়ায়। বাহিরে মাচার উপর বসলো সে। দূর আকাশের চাঁদের দিকে এক মনে তাকিয়ে আছে। আচ্ছা শশীর সাথেই কি এটাই শেষ পথচলা? দেখা হবে না আর? আমি কি শশীর জন্য কিছু অনুভব করছি? তাহলে সেটার নাম কি? কেবল মুগ্ধতা নাকি ভালোবাসা? কিছুক্ষণ ভাবলো। ভাবনার মাঝে নিজের প্রশ্নের উত্তর নিজেই খোঁজে নিলো। কিছুসময় পর শশী এসে তার পাশে বসলো। তারপর বললো, ‘আর কিছু দিন থেকে গেলে হয় না?’

রবি শশীর চোখে চোখ রাখলো। প্রতিত্তুর করলো না। তারও ইচ্ছে করছে থাকতে। শশীর সাথে সময় কাটাতে। কিন্তু সেটা সম্ভব না। শশীর বাবার কাছে তাকে পৌছে দিতে হবে। নিজেকেও বাড়ি ফিরতে হবে। কিছুক্ষণ নিরব থেকে শশী বললো, ‘আপনি জানেন আমার জীবনের সব থেকে বেশি সুন্দর মুহূর্ত গুলো আপনার সাথে কাটিয়েছি। যদিও পাপার সাথে কাটিয়েছি তবে এখানে দুজনের ব্যাপার সম্পূর্ণ আলাদা। বিশ্বাস করুন আমার এই জায়গা টা ছেড়ে, আপনাকে ছেড়ে যেতে একটুও ইচ্ছে করছে না।

এতটুকু বলে থামলো শশী। রবির দৃষ্টি সামনে। নিরবে শুনছে তার কথা। শশী একটু ঘুরে রবির দিকে ফিরে বসলো। তারপর বলতে লাগলো, ‘আমার ইচ্ছে করছে আপনার সাথে আরো কিছুসময় এখানে থেকে যেতে। কেন বলুন তো?’

রবি শশীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো, ‘আমার সাথে যদি অনেকটা পথ একসাথে হাঁটো, তাহলে বাকি পথ তুমি একা যেতে চাইবে না।’

শশী প্রফুল্লিত নয়নে বললো, ‘তাহলে বাকি পথটুকু নাহয় পাশাপাশি হাটি?’

রবি তাকালো শশীর দিকে। চোখে চোখ রেখে গভীরে ডুবে গেলো। শশী তার অনুভূতি প্রকাশ করছে তার কাছে। বুঝতে বাকি নেই রবির। সে একটু এগিয়ে শশীর একদম কাছে বসলো। তারপর চোখে চোখ রেখে বললো, ‘অল্প সময়ের পরিচয় আমাদের। গন্তব্য এখানেই সমাপ্তি। সব কিছুর গুরুত্ব দিতে নেই। সময়ের সাথে ধুলো ভেবে মুছে ফেলো অনুভূতি।’

আহত হলো শশী। নরম কন্ঠে বললো, ‘কিন্তু আমি ভুলতে চাইনা। এই সুন্দর মুহূর্ত গুলো আমি সারাজীবন আগলে রাখতে চাই।’

রবি এক হাত শশীর ডান গালে রেখে মোলায়েম কন্ঠে বললো, ‘সুন্দর মুহূর্ত গুলো স্মৃতির পাতা থেকে কখনো মুছে যায় না। আজীবন সঙ্গি হয়ে থেকে যায়। আমিও তোমার সাথে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত স্মৃতিতে ধরে রাখতে চাই।’

প্রসন্ন হলো শশী। চেহারায় তার সন্তুষ্টির ভাব এলো। ঠোঁট টেনে প্রসারিত করে হাসলো। রবিও মৃদু হেসে শশীর কপালে নিজের কপাল ঠেকালো। শশী রবির হাতের উপর নিজের হাত রেখে চোখ বন্ধ করলো। রবি শশীর বন্ধ চোখে তাকিয়ে বলল,

‘তোমার সাথে পথচলা বাকি। ভালোবাসি বলা এখনো বাকি। বুকের মাঝে আগলে রেখে সারাটা জীবন কাটিয়ে দেওয়া বাকি।’

শশী চোখ খোলে রবির দিকে তাকালো। রবি মুচকি হেসে শশীর ডান গালে টুশ করে একটা চুমু খেয়ে নিলো। শশী চোখ ছানাবড়া করে রবির দিকে তাকালো। দুই হাত রবির বক্ষস্থলে হাল্কা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। ‘অসভ্য’ বলে তাৎক্ষনাৎ উঠে ঘরে চলে আসে। লজ্জা লাগছে তার। ইশ রবি এটা কিভাবে করলো? হ্যাঁ দুজন মনের অনভূতি প্রকাশ করেছে। কিন্তু রবি ডিরেক্ট চুমু বসিয়ে দিলো? তার মানে রবি আমাকে ভালোবাসে??

রাত্রীর মধ্যভাগ সময় প্রায়। অন্ধকার ধরনী চাঁদের আলোতে আলোকিত হয়ে আছে। শশী বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে। চোখ তার একদম নিদ্রাহীন। ভাবছে রবির বলা প্রত্যেকটা কথা। এভাবে অল্প সময়ে কেউ তার প্রয়ণের জায়গা নিয়ে নিবে ভাবতে পারেনি সে। আপন মনে ভেবে মুচকি হাসছে শুধু। কিছুসময় পর রবির পায়ের আওয়াজে চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর নাটক করে। রবি ঘরে এসে দেখে শশী ঘুমিয়ে আছে। স্বস্থির নিশ্বাস ফেললো। তখনের ঘটনার জন্য বেশ ইতস্ততবোধ করছিলো সে। আপাতত এসব ঝেড়ে ঘুমানো যাক। গতকাল রাতে যা বুঝলো শশী একবার ঘুমিয়ে গেলে একদম সকালে উঠে। মাঝ রাতে ঘুম ভাঙ্গে না আর নড়াচড়া করে না একদমই। সুতরাং অনায়াসে এখন চুপটি করে তার পাশে ঘুমিয়ে যেতে পারবে। আস্তে আস্তে এগিয়ে বিছানার ধারের কাছে যেতেই শশী ঘুরে ভৌ…. করে উঠলো। হঠাৎ আকস্মিক ঘটনায় রবি ভরকে যায়। তাকে ভয় পেতে দেখে শশী উচ্চস্বরে হেসে ফেললো। মুখে হাসি রেখেই বললো, ‘বাহ্ ঘন জঙ্গলে ঘুড়ে বেড়ানো ব্যক্তিটা অল্পতে ভয় পেয়ে গেছে। স্ট্রেঞ্জ।’

রবি বুকে হাত রেখে জোরে শ্বাস ফেলে বললো, ‘ঘুমাও নি?’

শশী বিছানার এক পাশে আসনপেতে বসে রবি কে ইশারায় বসতে বলে। রবি বসলে বলে উঠে, ‘আসুন একটা গেমস খেলি। একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকবো। যে আগে চোখের পলক ফেলবে সে হারবে। ওকে?’

রবি মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানায়। অতঃপর শশী তিন পর্যন্ত কাউন্ট করে একে অপরের দিকে তাকায়। কেটে যায় কয়েক মিনিট। ইতিমধ্যে শশীর চোখে পানি জমে গেছে। জ্বালাপালা করছে। অথচ রবি পলকহীন ভাবে শশীর দিকে তাকিয়ে আছে। শশী আর থাকতে না পেরে রবির চোখে এক আঙ্গুলে হাল্কা টোকা দেয়। রবি চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেললে শশী বলে উঠে, ‘ইয়ে আমি উইন।’

রবি চোখ কঁচলাতে কঁচলাতে বললো, ‘তুমি চিটিং করেছো। নাহলে আমি উইন হতাম।’ হাসলো শশী। বলল, ‘আমি তুমি একই কথা।’

পশ্চিম পাশের জালানার দিকে ঘুরে বসলো দুজন। শশী রবির পাশে বসে তার কাধে মাথা রাখলো বিনা সংকোচে। রবি প্রথমে অবাক হলেও কিছু বলেনি। শশী মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে বলল, ‘এখানটায় আমি আমার ভরশা, শান্তি, ভালোবাসার জায়গা বানাতে চাই। দিবেন কি?’

‘আমার মনটাকে তো বিনা অনুমতিতে তোমার করে নিলে। তাহলে এখন অনুমতি চাচ্ছো কেন?’

শশী প্রতিত্তুর করলো না। রবির এক হাতের বাহু জড়িয়ে ঘুমিয়ে পরলো। এটাই তার শান্তির জায়গা। রবি এক হাতে আগলে নিলো শশীকে।

চলবে???

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here