প্রেমানুরাগ শেষ পর্ব

0
898

#প্রেমানুরাগ❤️
#মাইশাতুল_মিহির
#অন্তিম_পর্ব

সময়ের সাথে ভালোবাসা যেন আরো নিবিড় হয়। দীর্ঘদিন একসাথে থাকার ফলে প্রেম বেড়ে আকাশ-চুম্বী হয়ে উঠে। সম্পর্কে বারবার ঝগড়ার পরেও বিচ্ছেদ নেই। সম্পর্ক বাঁচিয়ে রাখার জন্য দরকার দু-টো প্রনয়ের সমান প্রচেষ্টা। এক পাক্ষিক কোনো কিছু কখনো সম্ভব নয়। রবি শশীর পরিচয় আজ দীর্ঘ ছয় মাস যাবত। শত ঝগড়া, মান-অভিমান হওয়া শত্বেও কেউ কখনো কারোর থেকে আলাদা হয়নি। অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে প্রথম দেখা পাহাড়ের এক ঘন জঙ্গলের মাঝে। সেখান থেকে তাদের প্রেমের যাত্রা শুরু। তারপর চার দিন পাশাপাশি একটা ছোট্ট কুঁড়েঘরে থেকে একে অপরের প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। ছোট একটা ভুলের কারনে আবার কিছুসময় দুজন একি শহরে থেকেও আলাদা পরিচ্ছেদে হারিয়ে যায়। যোগাযোগ নেই কারোর মাঝে। পাহাড়ে ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার মতো আবারো শপিংমলে দেখা। তারপর থেকে শুরু নতুন ভাবে পথচলা। ভালোবাসা নামক এক নিবিড় সম্পর্কে আবদ্ধ হয় দুজন। আর এখন? এতো দিনের পরিচয়, এতো দিনের সম্পর্ক আজ পূর্ণতা পাবে। চার হাত এক হয়ে পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হবে।

কোলাহলপূর্ণ পুরো কমিনিটি সেন্টার। চারপাশে ফুলের সুভাশে মু-মু করছে। ছোট ছোট রঙ-বেরঙের বাতি গুলো জ্বলে চিকচিক করছে। স্টেজ থেকে নেমে দরজা পর্যন্ত গাঁদাফুল আর গোলাপ ফুলের পাপড়ি বিছানো। যার উপর দিয়ে ভাড়ি লাল লেহেঙ্গায় ব্রাইডাল সাজে এগিয়ে আসছে শশী। চোখে-মুখে তার প্রাণবন্ত হাসি। স্টেজের মাঝে গোল্ডেন রেড কালার স্টোনের বিয়ের শেওরানি পরে দাঁড়িয়ে আছে রবি। চেয়ারায় তার স্পষ্ট পরিতৃপ্তির হাসি। শশী এগিয়ে স্টেজের কাছা-কাছি আসতে রবি এক হাত বাড়িয়ে দিলো। শশী তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে মেহেদি রাঙ্গা লাল হাত বারিয়ে রবির হাত ধরে স্টেজে উঠলো। চারপাশের সবাই উল্লাসিত হয়ে হাত তালি দিলো। মেহমানদের কোলাহলে চারপাশ মুখরিত হলো। ক্যামেরাম্যান এসে তাদের ছবি তুলছে। কাজিন, ফ্রেন্ড, রিলেটিভ সবাই এসে তাদের শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। পাশা-পাশি দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে। হৈহোল্লুর হলো। নাচ-গান হলো। আনন্দ করতে লাগলো সবাই।

পাশাপাশি বসে গল্পগুজব করছে রবি, রাজিব আর বাবু। রবির পাশে শশী বউ সাজে বসে আছে। চোখে মুখে তার খুশির ঝিলিক।

রাজিব গলা ঝেড়ে বলে উঠলো, ‘বাহ্ ভাই বাহ্! কলেজ লাইফ থেকে আমরা তিনজন সব কিছুতে এক সাথে ছিলাম। কেউ কাউকে ছেড়ে কিছু করিনি। আমাদের বন্ধুত্বের মাঝে অবশেষে তুই আমাদের ফেলে বিয়ে করে নিচ্ছিস? এতো বড় হারামি তুই? ‘

বাবু টাই হাল্কা ঢিলের করার ভঙ্গিতে আফসোস স্বরে বললো, ‘বিয়ে করছিস ভালো কথা দুই-একটা শালি দেখে করবি না? বন্ধুদের তো একটা হক আছে ভাই। এটা বড় অন্যায়। অন্যায় করলি তুই আমাদের সাথে।’

উচ্চস্বরে হাসলো রবি। অতঃপর ফিশফিশ গলায় রাজিব আর বাবুকে বললো, ‘ফিকার নট ব্রাদারস। শশীর কাজিন গুলা কিন্তু কিউট আছে। ট্রাই করতে পারিস।’

বাবু কিছু বলতে যাবে তার আগেই তাকে থামিয়ে শশী নিচু গলায় দাত চিবিয়ে বলে, ‘কি বললে তুমি?’

ভরকে গেলো রবি তার কথা শুনে। তারই পাশে যে শশী বসে আছে সে বেমালুম ভুলেই গেছে। এবার বুঝতে পারলো ভুল জায়গায় ভুল কথা বলে ফেলেছে সে। যদি এখন রেগে গিয়ে কেলেঙ্কারি বাধিয়ে ফেলে তো? ইজ্জর সব ভাটা শাক হয়ে যাবে। শুকনো ঢুক গিলে বললো, ‘আরেহ্ ওদের কেবল শান্তনা দিচ্ছি। আমি তো তোমার কাজিনদের চিনি না। একদম জানি না কাউকে।’

কটমট চোখে তাকালো শশী। প্রতিত্তুর করলো না আর। নিজে নিজে বিড়বিড় করতে লাগলো, ‘এইই দিন দেখার বাকি ছিল? শেষে কিনা একটা লুচু প্রকৃতির ছেলের সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে আমার?’

আস্তে বললেও সম্পূর্ণ কথা রবির কান অব্ধি গেল। বিস্ময়ে সামনে তাকিয়ে আছে সে। শেষ পর্যন্ত কিনা তাকে লুচু বানিয়ে দিলো? এটা কোনো কথা? আজ পর্যন্ত শশী ছাড়া কোনো মেয়ের পিছে ঘুরে নাই সে। অথচ তারই বউ তাকে লুচু বলছে। বাহ বাহ!

অবশেষে কাঙ্ক্ষিত সময় এলো। কাজি এসে দুজনের থেকে কাবিননামায় সই করিয়ে নিলো। কবুল বলিয়ে বিয়ে সম্পন্ন করলো। আবদ্ধ হলো দুজন বিয়ে নামক প্রবিত্র বন্ধনে। পূর্ণতা পেলো দুটি প্রনয়ের। এক হলো ভালোবাসার চারটি হাত।

দীর্ঘসময় ধরে ফটোশুট করে বিদায়ের সময় এলো এবার। বিষন্নতায় ছেঁয়ে এলো সকলের মন। চেহারায় মলিনতা স্পষ্ট ভাস্যমান। শশীর মন ক্ষুন্ন হলো। ফুঁপিয়ে কাঁদার উপক্রম হলো সে। আর অন্যদিকে রবি আকুপাকু করছে তার শ্বশুরের কাহিনী দেখার জন্য। নিশ্চয় এখন মেয়ে বিদায় দেওয়ার উছিলায় কেঁদে-কেটে দুনিয়া ভাসিয়ে দিবে??

শশী এগিয়ে সোহরাবের কাছে গেল। সোহরাবের মন ভালো নেই। কান্না পাচ্ছে তার। সেই ছোট্ট শশী আজ কত বড় হয়ে গেলো। এই তো কিছুদিন আগেই বোধহয় হাতে ধরে হাটা শিখিয়েছিল সে। আর আজ? আজ বিদায় নিয়ে নিজের সংসার সাজাতে চলে যাবে। চোখ জুড়া লাল হয়ে এলো তার। ইকবাল সোহরাবের কাধে এক হাত রেখে চোখের ইশারায় আশ্বাস দিল। সোহরাব ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে এগিয়ে এসে শশীকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। ফুঁপিয়ে উঠলো শশী। তার মাথায় হাত বুলিয়ে বুঝাতে লাগলো, ‘কান্না করো না। তোমার কান্না আমার সয্য হয় না আম্মু আমার। সাবধানে থাকবে। সবাইকে নিজের মনে করে আগলে রেখো। সুখি হও জীবনে দোয়া করি।’

বেশ কিছুক্ষন ফুঁপিয়ে কাঁদলো শশী। কাঁদে নি সোহরাব। কিন্তু চোখ তার লাল হয়ে আছে। অবাক হলো রবি। তার ধারনা ছিল সোহরাব এখন ভিলেনের মতো কাহিনী করবে। বলবে ‘তার মেয়েকে নিয়ে যাওয়ার কথা বললে মে’রে ফেলবে। এমনি চিন্তা করেছিল সে আর সেই চিন্তা অনুযায়ী নিজেকে প্রস্তুতও করেছিলো। কিন্তু তার ধারনা ভুল প্রমান করে সোহরাব একদমই কাঁদেনি। বাবা মেয়ের কান্নার মাঝে সে কেবল নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে।

ইকবাল আর সোহরাব মিলে শশীকে শান্ত করে গাড়িয়ে উঠিয়ে দিলো । সোহরাব রবির উদ্দেশ্যে কাঁপাকাঁপা গলায় বললো, ‘আমার মেয়েকে ভালো রেখো রবি। তোমার উপর ভরশা করে ওকে তোমার হাতে তুলে দিয়েছি। আমার ভরশার মান রেখো রবি। আমার মেয়েকে কষ্ট দিলে মে’রে ফেলবো একদম।’

প্রথম কথায় সৌজন্যমূলক হাসি দিলেও শেষের কথায় ভরকে গেল রবি। সরাসরি থ্রে’ট! বাহ বাহ ভাগ্য করে একখান শ্বশুর পেয়েছে বলতে হবে। মনে মনে এসব আওড়ালেও উপরে আশ্বাস দিয়ে বললো, ‘চিন্তা করবেন না। শশীকে আমি সবসময় ভালো রাখবো।’

অন্ধকার রাস্তা চিড়ে গাড়ি চলছে। উদ্দেশ্যে হচ্ছে রবিদের বাড়ি। দীর্ঘসময় গাড়ি চলার পর নিদিষ্ট গন্তব্যে এসে বড় গেইট পেরিয়ে থামলো গাড়ি। সদর দরজার সামনেই রোজিনা চৌধুরী তার পুত্রবধূ কে বরন করার জন্য অপেক্ষা করছে। রবি শশী এগিয়ে আসলে রোজিনা সহ অন্যান্য আত্মীয়রা ব্যস্ত হয়ে পরলো শশীকে নিয়ে। ড্রয়িংরুমে এসে একে একে সকলে পরিচিত হয়ে আলাপ জমালো বেশ। সবার সাথে পরিচিত হয়ে ভালো লাগলো শশীর। তবে একদিক দিয়ে বেশ অস্বস্তিতে পরেছে সে। চোখ ঘুরিয়ে এদিক সেদিক তাকিয়ে রবিকে খুঁজেছে। এতো ভারী সাজ, ভারী লেহেঙ্গা সামাল দেওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে পরেছে তার জন্য। রোজিনা বোধহয় তার অস্বস্তি বুঝতে পেরে তাকে রুমে পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন।

রাত্রীর প্রায় একটা ছুঁই ছুঁই। বাহিরে কোলাহলে ভরপুর। ঘুটঘুটে অন্ধকারে আলোকিত চাঁদটা ভাস্যমান। শশী বিছানার উপর বড় ঘোমটা টেনে বসে আছে। রবির কাজিনরা তাকে রেখে কিছুক্ষন আগে বেড়িয়ে গেছে। পুরো রুমে চোখ বুলিয়ে নিলো শশী। পছন্দ হলো তার। হঠাৎ দরজা খুলার আওয়াজে চমকে উঠলো। রবি এসেছে! তার চেহারায় ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। শশীর মুখখানা দেখে সকল ক্লান্তি মুছে মুখে পরিতৃপ্তির হাসি এলো। বুকের বা-পাশে হাত রেখে বলে উঠলো,

‘কত যুগ অপেক্ষার প্রহর শেষে
তোমায় পেয়েছি আমার বধু বেসে।’

লজ্জা পেলো শশী। গাল লাল হয়ে এলো তার। ঘুটিয়ে গেলো আরো। রবি এগিয়ে তার পাশে বসলো। একটা আংটি বের করে শশীকে পরিয়ে দিল। শশী আংটিটা ভালো করে দেখে বললো, ‘অনেক সুন্দর তো। এটা তুমি পছন্দ করে কিনেছো?’

‘হুম! এটা আমার নিজের টাকায় কেনা।’

খুশি হলো শশী। প্রশান্তির হাসি দিলো। তার বাকা দাতের হাসি দেখে রবি বললো, ‘তোমার হাসিতে আমি বারংবার মুগ্ধ হই। আর এই মুগ্ধতা আমি আমার ভাবনার মাঝে রাখতে চাই।’

‘ভাবনা কে?’

শশীর রাগও গলা শুনে ভ্যাবাচেকা খেলো রবি। আহাম্মকের মতো তাকিয়ে রইলো সে। শশী দাত চিবিয়ে রবিকে ধাক্কা দিয়ে বিছানা থেকে নামিয়ে দিলো। কটমট করে বলে উঠলো, ‘ওই অফিসের মাইয়া টার পর এখন আবার ভাবনা? এই তোমার লজ্জা করে না বিয়ে করা বউয়ের সামনে অন্য মেয়ের নাম বলতে?’

তারপর একটা বালিশ রবির দিকে ছুঁড়ে মেরে আবারো বলে উঠলো, ‘খবরদার বিছানায় আসবা না। নাহলে কেলেঙ্কারি বাধিয়ে ফেলবো!’

লাইট অফ করে ধপাস করে শুয়ে পরলো শশী। রবি এখনো আহাম্মকের মতো বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। হায়! এ কাকে নিয়ে পরলো সে? বিয়ের প্রথম রাতে বউ তাকে বিছানায় যেতে নিষেধ করেছে। কি লজ্জা! কি লজ্জা!! আফসোস হলো তার। অসহায় মুখে সোফায় এসে শুয়ে পরলো। ভাবলো! শ্বশুর মশাই তো ভালোই থ্রে’ট দিছে। তার হয়ে কে থ্রে’ট দিবে? সে কার কাছে বিচার দিবে? কাকে?????

পরিশেষ্টঃ বাঙ্গালী রিলেশনশিপ কখনো শান্তিপূর্ণ হয় না। সারাজীবন ঝগড়া লেগেই থাকবে। আবার মিলও হবে রবি শশীও তাই। ওকে টাটা বাই!

~ সমাপ্ত ~

নোট : সবাই তো হ্যাপি এন্ডিং দেয়। আমিও দিলাম তবে একটু ডিফারেন্ট টাইপ! ? হ্যাপি রিডিং ❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here