#প্রেমানুরাগ❤️
#মাইশাতুল_মিহির
#পর্ব-৩
ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে চিন্তিত মুখে বসে আছে ডঃ সোহরাব। এক হাতে তার সিগারেট। যা থেকে ভ্যাঁপসা গন্ধ ভাসছে। সামনে তার ছোট টি-টেবিলের উপর ম-দের বোতল রাখা। একের পর এক পেগ গিলছে আর সিগারেটে টান দিচ্ছে। তার পাশে বেতের মোড়ায় বসে আছে ইন্সপেক্টর ইকবাল। মনের মাঝে তার অস্থিরতা বিরাজ-মান। সোহরাবের সাথে তার কলেজে পরিচয় হয়। সেই থেকে আজ অব্ধি তাদের পথচলা। জীবনের সুখ সুঃখ একে অপরের সাথে ভাগাভাগি করে নিয়েছে দুজন। ভার্সিটিতে শিশিরের সাথে পরিচয় তাদের। শিশির যখন ব্রেইন স্টোক করে মা-রা গিয়েছিল তখন সোহরাব অনেক ভেঙ্গে পরে গিয়েছিলো। এক হাতে সে সোহরাব আর ছোট্ট ছয় মাসের শিশু শশীকে আগলে রেখেছিলো। বহু কষ্টে বন্ধুকে শক্ত করেছিলো। আর আজ আবার শশীর নিখোঁজে সোহরাব ভেঙ্গে পরেছে। সোহরাব আবার এক পেগ গিলতে গ্লাস হাতে নিতে গেলে ইকবাল হাত ধরে থামিয়ে কপাট রাগ দেখিয়ে বলে, ‘থামবি তুই? এমন ভান ধরছিস যেন একশো একটা ছ্যাঁকা খেয়ে বসে আছিস।’
সোহরাব ইকবালের হাত সরিয়ে বললো, ‘তুই বুঝতে পারছিস না আমার কলিজার টুকরা শশী আমার পাশে নেই। খোঁজে পাচ্ছি না তাকে।’
ইকবার বললো, ‘ভাই গার্ড দের কাছ থেকে যা শুনলাম শশী ওদের বোকা বানিয়ে ইচ্ছে করে পালিয়েছে। এই বয়সে মেয়েরা স্বাধীনতা চায়। একা নিজের ইচ্ছেমত ঘোরাঘুরি করতে চায়। আমার মনে হয় শশী তাদের ফ্রেন্ডের সাথে ট্রিপে গেছে। দেখবি দুই দিন পর ট্রাভেল শেষ হলে চলে আসবে।’
রেগে গেলো সোহরাব। চেঁচিয়ে বললো, ‘ট্রিপে গেছে মানে কি? আমাকে বললে আমি নিয়ে যেতাম না? একা গেলো কেন? যদি কোনো ক্ষতি হয়ে যায় তো।’
‘এটাই তো তোর সমস্যা। তুই নিয়ে গেলে সাথে এই তিন হাম্বাকে ওর সাথে লাগিয়ে দিবি। শশী এসব পছন্দ করে না। তুই কেন বডিগার্ড রাখিস বল তো?’
‘ভয় হয় আমার। শিশিরও ছেড়ে চলে গেছে। এখন আমার জীবনে তুই আর শশী। তোদের হারাতে পারবো না আমি।’
নিভলো ইকবাল। সোহরাব কে বুঝিয়ে লাভ নেই। সে কিছুতেই বুঝতে চাইবে না। ফুঁশ করে তপ্ত শ্বাস ফেলে টেবিল থেকে মতের বোতল, গ্লাস আর সিগারেটের প্যাকেট সরিয়ে ফেললো। তারপর সোহরাব কে ধরে সামলানোর চেষ্টা চালালো।
__________________
স্নিগ্ধ কুসুম কোমল সকাল.
বাতাসে চারপাশ হাস্যউজ্জল করে রেখেছে। সূর্য পূর্ব আকাশে উঁকি দিয়ে রোদ চারপাশে ছড়িয়ে আলোকিত করে রেখেছে ধরনী। পিটপিট করে তাকালো শশী। পশ্চিম পাশের জালানা খোলা রেখেছিলো রাতে। যদিও প্রথমে ভয়ে ছিলো পরোক্ষনে রাত্রির সুন্দর চাঁদ দেখে ভয়ের রেশ একদম কেটে গেছে তার। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে মন ভরে চোখ বন্ধ করে নিশ্বাস নিলো। দূর দূরান্তের ছোট বড় পাহাড় গুলো এখান থেকে পিপিলীকার ন্যায়। এলোমেলো চুল গুলো পশ্চিমা বাতাসে উড়ছে। দরজা খোলে আশেপাশে তাকিয়ে রবিকে খোঁজতে লাগলো। না কোথাও পেলো না। শশী বেশি পাত্তা না দিয়ে কলস থেকে পানি নিয়ে চোখমুখ ধুয়ে নিলো। উত্তর পাশে থাকা বাঁশের মাঁচার উপর গিয়ে বসলো। পকৃতি দেখতে দেখতে কখন যে সময় পেরিয়ে গেলো তা বুঝতে পারেনি। রবি এসে শশীর পাশে বসলো। শশী প্রশ্ন ছুঁড়লো, ‘কোথায় গিয়েছিলেন?’
রবি ফল কাটার ছুড়ি দিয়ে আপেল কাটতে কাটতে জবাব দিলো, ‘একটা গর্ত খুড়ে এলাম। তোমাকে মে-রে সেখানে পুঁতে দিয়ে আসবো।’
উচ্চস্বরে হেসে ফেললো শশী। হাসি যেনো তার থামছেই না। রবি দেখতে লাগলো তাকে। হাসলে দু-গালে ছোট করে লম্বা টুল পরে। হাসি দিলে বা পাশের উপরের একটা গেঁজ দাত স্পষ্ট ভেসে উঠে। রবি চোখ সরিয়ে নিলো। শশী হাসিতে মুখ খিঁচে বলল, ‘ভালো মজা জানেন আপনি। এই আপনার নাম টাই তো জানা হলো না। কি নাম আপনার?’
রবি এক পিস আপেল শশীকে দিলো। তারপর নিজে মুখে নিয়ে বললো, ‘শাহরিয়ার চৌধুরী রবি!’
শশী আপেলে কামড় বসিয়ে বলল, ‘রবি? সোম, মঙ্গল, বুধ, শনি রাখে নি কেন? এরা কি দুষ করেছিলো?’
দাতে দাত পিষে তাকালো রবি। কপাট রাগ দেখিয়ে বললো, ‘রবি মানে সূর্য। এই নামটা কোনো বার না।’
শশী হেসে মজা করে বলল, ‘সমস্যা নেই আমি ডাকবো নে। আজ কি বার? বৃহঃস্পতিবার? তাহলে আজ আমি বৃহঃস্পতি বলে ডাকবো। নাম টা জুশ।’
ধমকে উঠলো রবি, ‘খবরদার এইসব নামে আমাকে ডাকবে না। চুপচাপ খাও।’
ঠোঁটে ঠোঁট টিপে হাসলো শশী। চুপচাপ আপেলে কামড় বসিয়ে চিবুচ্ছে। বাতাস প্রভাহ মান। শশীর পিঠ বরাবর চুল গুলো বাতাসে উড়ছে। রবি আপেল খেয়ে শশীর হাতে শেষ টুকরো টা ধরিয়ে দিয়ে বললো, ‘আমি নুডুলস করে আনছি। বসো।’
তাৎক্ষণাৎ শশী বলে উঠলো, ‘এখন আবার নুডুলস?’
রবি উঠে চলে যাবার জন্য পা বাঁড়াতেই দাঁড়িয়ে গেলো। ভ্রুঁ কুঁচকে প্রশ্ন করলো, ‘তাহলে কি খাবে?’
শশী একটু ভেবে বলল, ‘চিকেন স্যান্ডউইচ হলে ভালো হবে।’
মুহূর্তেই মাথায় আগুন দাউ করে জ্বলে উঠলো রবির। রেগে কটমট করে বললো, ‘এখানে তো মহারানী আপনার জন্য রেস্টুরেন্ট খোলে বসে আছে মানুষ তাই না? আর কি কি খাবেন বলেন। আমি আমার মাথা থেকে নিয়ে আসি।’
অপমানে মুখটা একটুখানি হয়ে গেলো শশীর। সে এতো গাদা কিভাবে হলো? এখানে এইসব ফাস্টফুড খাওয়ার কথা চিন্তা করা তো নেহাত বোকামো ছাড়া কিছুই না। নিজেকে নিজেই একশো গালি দিয়ে মুখে হাসি টেনে বললো, ‘আমি তো মজা করছিলাম। হেহে। আমি নুডুলস খেতে পারি। নিয়ে আসুন।’
দাতে দাত চিবিয়ে তাকালো রবি। এই মুহূর্তে ইচ্ছে করছে মেয়েটার গালে গুনে গুনে দশ টা চ:ড় লাগাতে। চুপচাপ স্থান প্রত্যাখ্যান করলো। এখানে থাকলে নির্ঘাত সে আসলেই চাড় লাগিয়ে বসবে।
খাওয়া শেষে দুজন পাশাপাশি মাচার মধ্যে বসে আছে। শশীর প্রফুল্লিত মনে গুনগুন করছে আর পা নাচাচ্ছে। চুল তার বাতাসে ভাস্যমান। গুনগুন করা গান রবির কানে স্পষ্ট ভাবে আসছে।
‘অসময়ি এ বৃষ্টিতে আমি,
অসময়ি এ বৃষ্টিতে তুমি,
কিছু না বলা কথা দিলাম ভাসিয়ে,
ধুয়ে যাক না এ মন অভিমানী।
মেঘলা আকাশ, হাল্কা হাওয়া,
যাই ফিরে আর নিজেকে ফিরে পাওয়া।
আধ খোলা কাচ, বৃষ্টির ছোঁয়াচ,
তোমার নামে মেঘের খামে চিঠি দিলাম আজ।
আধ ভেজা প্রহর, আধ ভেজা শহর,
আধ ভেজা তুমিও আর আধ ভেজা আমার সফর!’
রবি বুকে হাত গুঁজে নিরবে শশীকে দেখছে। এই মেয়ের মাঝে কিছু একটা আছে। কিন্তু কি? তার তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে কেন? না চাইতেও চোখ বারবার তারই দিকে যাচ্ছে। বিরক্ত হলো নিজের উপর। দূরের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমার মাঝে বাড়ি যাবার উত্তেজনা দেখছি না। পালিয়ে টালিয়ে এসেছো নাকি?’
অবাক চোখে তাকায় শশী। বললো, ‘আপনি কিভাবে জানেন?’ রবি চোখ ছোট ছোট করে তাকাল। সে এমনি এমনি কথাটা বলেছে। আর এ দেখছি সত্যি হয়ে গেছে। বিস্ফোরিত ভিতরে দমিয়ে রেখে বলল, ‘পালালে কেন?’
ফুঁশ করে নিশ্বাস ফেললো শশী। গলার স্বর নামিয়ে বললো, ‘আসলে আমি শুধু ক্যাফেতে ফ্রেন্ডের সাথে ফুচকা খেতে যাবো বলে প্ল্যান করেছিলাম। পাপা বাহিরের খাবার পছন্দ করে না। তাই আমাকেও খেতে দেয় না। ক্যাফেতে গেলে আমার সাথে পাঠানো গার্ড গুলো পাপা কে জানিয়ে দিবে। তাই ওদের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম। ক্যাফের ভিতরে ফ্রেন্ডরা অপেক্ষা করছিলো। যেই আমি ক্যাফে যাবো তখন কেউ মুখে রুমাল দিয়ে ধরে। যখন জ্ঞান ফিরে একটা বন্ধ ঘরে নিজেকে পেলাম। সেখান থেকে বের হয়ে দেখি এই গহীন জঙ্গল। দৌড়নোর সময় একটা গাছে মাথা ঠুকে আবারো জ্ঞান হারালাম। বাকি কাহিনী তো জানেন।’
রবি নিরবে চুপচাপ মনোযোগ সহকারে শুনলো শশীর কথা। তারপর বললো, ‘তোমার বাবা দেখছি তোমার ব্যাপারে খুব সিরিয়াস।’
শশী অসন্তুষ্টি এনে বলে উঠলো, ‘হ্যা এতো টাই সিরিয়াস যে ভার্সিটি পড়ুয়া মেয়ের পিছনে তিনটা হাম্বার মতো গার্ড লাগিয়েছে। এসব আমার ভালো লাগে না। আমি অন্যদের মতো নরমাল লাইফ লিড করতে চাই। নিজের মতো স্বাভাবিক ভাবে বাঁচতে চাই। পাপা কেন আমাকে নিয়ে এমন করে বুঝি না।’
রবি প্রতিত্তুরে কিছু বলল না। কারন সে নিজেও এই ভোগে ভোগান্তি। চুপচাপ বসে রইলো। কিছুসময় পর আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেলো। চারপাশে শীতল বাতাস জানান দিলো কিয়ৎক্ষণ পর বৃষ্টি নামবে। তিমিরাচ্ছন্ন পরিবেশে বসে শশী অনেক প্রফুল্লিত। প্রসন্ন মনে বসে দূর আকাশের কাদম্বরী দেখতে লাগলো। আকাশ কাপিয়ে তীব্র বর্জপাতের ধ্বনি ভাসছে। রবি উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘চলে আসো বৃষ্টি নামবে।’
শশী দাঁড়িয়ে প্রসন্ন মনে হাস্যউজ্জল চেহারায় বলল, ‘আমি কখনো বৃষ্টিতে ভিজতে পারিনি পাপার জন্য। আজকে ভিজি? অনেক ইচ্ছে করছে।’
শশীর আবদার রবির কাছে বাচ্চা বাচ্চা লাগছে। এই মেয়ে নাকি ভার্সিটিতে পড়ে? মনে মনে হাসলো রবি। পরোক্ষনে মাথায় আসলো বৃষ্টিতে ভিজার অভ্যেস না থাকলে নির্ঘাত জ্বর আসবে। এখানে কিভাবে কি করবে সে?? তাই বারণ করে বলল, ‘একদম না। বৃষ্টি ভিজতে হলে বাড়ি গিয়ে ভিজো। এখানে না। জ্বর আসবে পরে।’
শশী অনুনয় স্বরে বললো, ‘প্লিজ আজকেই ভিজবো। প্রমিস জ্বর আসবে না।’
ধমকে উঠলো রবি, ‘না মানে না। এখুনি ঘরে আসো।’
ক্ষুন্ন হলো শসীর মন। হাস্যউজ্জল চেহারা গায়েব হয়ে বিষন্নতায় ছেঁয়ে গেলো। বিষন্ন মনে ঘরের দিকে পা বাড়ালো। রবি চুপচাপ দেখলো। ইশ এভাবে বলা একদম উচিত হয়নি। সে তো কোনো মেয়ের সাথে এভাবে কথা বলে না। আচ্ছা মেয়েটা কি কষ্ট পেয়েছে? চোখ বন্ধ করে মাথা ঝামটা মেরে আবারো চোখ খুললো। কষ্ট পেলে পাক। খুশির ঠ্যালায় ভিজে পরে জ্বর উঠলে এখানে কিছুই করা সম্ভব না। ভাবতে ভাবতেই আকাশ কাপিয়ে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হলো। রবি দ্রুত পা চালিয়ে ঘরে চলে আসলো।
চলবে??
নোট : ভুলত্রুটি মার্জনীয়। কার্টেসি ছাড়া কপি নিষিদ্ধ।