প্রেমানুরাগ পর্ব ২

0
854

#প্রেমানুরাগ❤️
#মাইশাতুল_মিহির
#পর্ব-২

স্বচ্ছ অম্বর। মাঝে সাদা কাদম্বরী ভাসছে। সবুজে ঘেরা পাহাড়ি গাছ-গাছালি। সদ্য ফোটা কচি পাতার ঘ্রাণ চারপাশ ছড়িয়ে আছে। মাটিতে ছোট ছোট গর্ত গুলোতে রয়েছে ঘাসফুল। সূর্য পশ্চিম আকাশে প্রায় হেলে পরেছে। তার হলুদ লালচে আভার রেশ পরিধিতে ছড়িয়ে রয়েছে। কিয়ৎক্ষণ পর সূর্য ডুবে যাবে। রবি হাত ঘড়িতে সময় প্রখর করে নেয় একবার। ঘড়ি থেকে চোখ সরিয়ে শশীর তাকায়। বেচারি এতোটা রাস্তা হাটতে হাটতে হাঁপিয়ে উঠেছে। হাটুতে দুই হাতের ভর ফেলে জোড়ে জোড়ে কয়েকবার নিশ্বাস নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। তারপর হাঁপাতে হাঁপাতে প্রশ্ন করলো, ‘কি এমন রাজপ্রাসাদ আছে শুনি যার জন্য এতো হাঁটা। আল্লাহ আমার দেহের অর্ধেক শক্তি গায়েব।’

রবি সব সময়ের মতো তার ত্যাড়া উত্তর দিল,’আমি তো বলি নি আমার সাথে এসো।’

শশী রবিকে ক্রস করে সামনে এগোতে এগোতে বললো, ‘হ্যা জানি জানি। একশো বার এই একি কথা বলতে হবে না। নেহাত ঠ্যাকায় পরে আসতে হয়েছে।’

ঝোপঝাড় পেরিয়ে খোলা আকাশের নিচে এলো দুজন। শশী আশেপাশে দেখতে দেখতে হঠাৎ একটা কুটিরে তার চোঁখ আটকে যায়। ‘ওয়াও’ বলে সে দিকে এগিয়ে এসে দেখতে থাকে। পাহাড়ের উপরে এক পাশে ছোট টিনের একটা ঘর। চারপাশ টিন আর বাঁশ দিয়ে বাধানো বেড়া। উপরে টিন আর বন মিশ্রিত তৈরি ছাউনি। ঘরটির একপাশে কাঠের দরজা। দরজার পাশে একটা ছোট জানালা। ঘর টি ঘুরে ঘুরে দেখে রবিকে প্রশ্ন করলো, ‘এটা কার ঘর? দেখতে অনেক সুন্দর। ইউনিক। আপনি এখানে থাকেন?’

রবি তার কাধের ট্রাভেল ব্যাগ নামিয়ে ঘরের দরজা খোঁলে ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বললো, ‘যেহেতু আমি এখানে থাকি সেহেতু আমারই ঘর হবে তাই না?’

শশী এখনো অবাক হয়ে মুগ্ধ চোখে দেখছে। রবির পিছু পিছু ঘরের ভিতর ঢুকে আরেক দফা অবাক হয় সে। ঘরে এক পাশে একটা সিঙ্গেল বিছানা সাদা চাদড়ে মোড়ানো। তার পাশে ছোট কেবিনেট। দুটো কফির মগ রাখা তাতে। এক পাশে মাটির চুলা। কিছুটা ভাঙ্গার মতো একটা আলমারি। রবি তার গলায় ঝুলানো ক্যামেরাটা বিছানার উপর রাখলো। তারপর নিজে ধপাস করে শুয়ে পরলো দুই হাত দুই দিকে মেলে। শশী এখনো ঘুড়ে ঘুড়ে দেখছে ঘরটা। ঘরের পশ্চিম পাশে একটা বড় জানালা। যা দিয়ে দূর দূরান্তের পাহাড় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এখান থেকে আকাশে সাদা মেঘ গুলো স্পষ্ট দৃশ্যমান। যেনো হাত বাড়ালেই তাদের ছুঁয়া। যেহেতু পাহাড়ি এলাকা সেহেতু এখানে বাতাসের বেগ বেশি। তাও আবার জানালার পাশে খোলা স্থান। দূর দূরান্ত থেকে বাতাস আসছে।প্রবল বাতাসে শশীর চুল গুলো উড়ছে। জালানা দিয়ে মুখ বাহিরে এনে চোখ বন্ধ করে উপলব্ধি করলো মুহূর্ত টা । তার মাঝে টানটান উত্তেজনা কাজ করছে। প্রফুল্লিত মনে রবির দিকে ঘুরে বলতে লাগলো, ‘সিরিয়াসলি বলছি এতো সুন্দর জায়গা আমি আগে দেখিনি। জাস্ট আমেজিং। আপনি এখানেই থাকেন? ওয়াও কত লাকি আপনি। ইশ এটা তো হিডেন হাউজের মতো লাগছে। আমি মুভি তে দেখেছি অনেক। এবার বাস্তবে দেখতে পারলাম। থ্যাংক ইউ সো মাচ।’

রবি বিছানা থেকে মাথা উঠিয়ে দেখলো শশীর চোখ মুখ খুশিতে চিকচিক করছে। অল্পতে এই মেয়ে এতো খুশি? অবাক লাগলো রবির। কিন্তু মুখে বললো, ‘এতো খুশি হওয়ার কিছু নেই। আজ রাতটার জন্য জায়গা দিয়েছি। কাল সকালেই আউট হবে এখান থেকে। গট ইট?’

শশী প্রতিত্তুর করলো না। বললেই হলো কাল চলে যেতে। এতো সুন্দর একটা জায়গা ফেলে যেতে চাইবে কে? শশী? জীবনেও না। একবার যেহেতু আসতে পেরেছে সেহেতু যতো দিন না তার তৃপ্তি মিটছে ততো দিন কোথাও যাবে না। জানালা দিকে ঘুরে আকাশ দেখতে লাগলো। দূরে সূর্যের হলুল লাল সংমিশ্রনের রঙ আকাশে স্পষ্ট। সূর্য ডোবার মুহূর্ত টা অসাধারন। শশী এই মুহূর্ত টাই উপভোগ করছে। রবির কিছু একটা মনে পরতেই উঠে দাঁড়ায়। শশী তাৎক্ষনাৎ প্রশ্ন ছুঁড়ে, ‘কোথায় যাচ্ছেন?’

রবি বিছানার পাশে থাকা মাটির কলস হাতে নিয়ে শশীকে বড় দের মতো শাসনের কন্ঠে বললো, ‘সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ভুলেও বাহিরে বের হবে না। আমি পানি নিয়ে আসছি।’

শশী বাধ্য মেয়ের মতো মাথা দুলিয়ে ‘হ্যা’ সম্মতি দিলো। আশ্বাস পেয়ে রবি দরজা হাল্কা ভিড়িয়ে চলে যায় ঝর্নার কাছে। এখান থেকে প্রায় মিনিট পাঁচেক দূরত্বে একটা ছোট ঝর্না আছে। পানি স্বচ্ছ। রবি সেখান থেকে এক কলস পানি নিয়ে নেয় খুব সাবধানতার সাথে। অতঃপর নিজের সেই ছোট্ট কুঁড়েঘরের দিকে পা বাঁড়ায়। দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে দেখে শশী পুরো বিছানায় নিয়ে ঘুমিয়ে আছে। কপালে ভাজ পরে রবির। আসতে আসতে তার মাত্র দশ মিনিটের মতো লেগেছে। এইটুকু সময়ে ঘুমিয়ে গেলো মেয়েটি? সে তো সারারাত এ-কাত ও-কাত হয়েও ঘুমাতে পারে না। আর এই মেয়ে দেখো কি শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে। রবি বিছানার পাশে কলসটা রাখে। আলমারি থেকে একটা ব্ল্যাক টি-শার্ট বের করে পরে নেয়। বারবার চোখ ঘুরিয়ে শশীর দিকে তাকাচ্ছে। মেয়েটা নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে কিভাবে? এতো সহজে তাকে কেনই বা বিশ্বাস করলো? যদি সে খারাপ কিছু করে তো? তারই জায়গায় অন্য কেউ থাকলে নির্ঘাত খারাপ কিছু করে ফেলতো এই সুযোগে। তপ্ত শ্বাস ফেললো রবি। নিশব্দে দরজা হালকা ভিড়িয়ে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে।

রাতের স্বচ্ছ আকাশ.
শুকিয়ে যাওয়া কাঠ, গোলপাতা দিয়ে জ্বালানো আগুন দাউদাউ করে জ্বলছে। দূরের পাহাড় থেকে দৃশ্যটি স্পষ্টমান। রবি একটা গোলপাতা হাতে নিয়ে আগুনের মাঝে দিলো। মুহূর্তেই শুকনো পাতার চারপাশ আগুনে ছাই হয়ে গেলো। এক হাতে থাকা কফি মগে ছোট ছোট করে চুমুক বসাচ্ছে রবি। গায়ে তার পাতলা টি-শার্ট। পরনে থ্রি-কোয়াটার প্যান্ট। সিল্কি চুল গুলো বাতাসে উঁড়ছে। শশী নিশব্দে রবির থেকে তিন হাত দূরত্ব রেখে বসলো। রবি আপন মনে কফি খাচ্ছে আর আগুনে শুকনো কাঠ আর পাতা দিচ্ছে। সে নির্বিকার যেনো আশেপাশে আর কেউ নেই। শশী ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে তাকে। অতঃপর বলে উঠে, ‘কয়টা বাজে?’

রবি হাতের সময় মাপার যান্ত্রিক যন্ত্রের দিকে চোখ বুলিয়ে শুধাল, ‘৭:২৩.’

নিরব হলো শশী। এই মুহূর্তে তার পাশে বসে থাকা যুবকটিকে তার রহস্যময় লাগছে। পুরো দুনিয়া ছেড়ে এই লোক কিনা জঙ্গলে একটা ঝির্নঝার্ণ কুঁড়েঘরে থাকে? ট্রিপে গেলে তো মানুষ বিভিন্ন গ্রুপের সাথে যায়। তাহলে? কৌতুহল দমিয়ে রাখতে না পেরে শশী প্রশ্ন ছুঁড়লো, ‘আপনি এখানে একা থাকেন? কি করেন এখানে? ঘুরতে যদি আসেন তাহলে আপনার বন্ধুবান্ধব কোথায়? একা কেন? ভয় লাগে না? আর এই কুঁড়েঘর কার? এটাতে থাকেন আপনি? কিন্তু এই জনমানবহীন জঙ্গলে এই বাড়ি কে বানালো? তার চেয়ে বড় কথা এখানে এই কাঠ, টিন, বেড, আলমারি আনলো কিভাবে? হাউ?’

শশীর কৌতুহল দেখে নিরবে মনে মনে হাসলো রবি। ভাবলেশহীন ভাবে শুধালো, ‘কারণ ক্রি’মি’নালের সাথে কেউ থাকে না। কিন্তু তোমার কপাল খারাপ। এই মুহূর্তে তুমি ক্রি’মি’নালের সাথে বসে আছো।’

একটুও অবাক হলো না শশী। বরঞ্চ বললো,, ‘হাহ্ নাইস জোকস।’

বিস্ময়ের চোখে তাকালো রবি। এই মেয়ে তাকে বিশ্বাস করে বসলো কিভাবে? এতো টাই সহজ?

‘বিশ্বাস করলে আমায়?’

শশী নির্বিকার ভাবে বললো, ‘হুম। আপাতত এখানে আপনি ছাড়া কেউ নেই তাই বিশ্বাস টা এমনি এমনি চলে আসছে।’

হাসলো রবি। আগুনে একটা ছোট্ট কাঠ দিয়ে বললো, ‘দুনিয়াটা এতো সহজ না। তুমি এখন স্বপ্নের রাজ্যে আছো বিধায় বাস্তবতা চোখে পরেনি। এতো সহজে কাউকে বিশ্বাস করতে নেই। পৃথিবীর সবাই বিশ্বাসঘাতক, স্বার্থপর।’

কিছু বলল না শশী। হ্যা বাস্তবতা কখনো উপলব্ধি করে নি সে। তাই বলে মানুষ চিনতে কখনোই ভুল করবে না। রবিকে সে ঠিকই চিনতে পেরেছে। কথা বাড়ালো না। চুপচাপ রাতের মুহূর্তটা উপভোগ করতে লাগলো। আচ্ছা পাপা কেমন আছে? কি করছে এখন? নিশ্চয় তাকে না পেয়ে চিন্তা করছে? অস্থির হয়ে আছে। মন ক্ষুন্ন হলো তার। রবিকে বললো, ‘আপনার কাছে মোবাইল আছে? একটু দিবেন পাপার সাথে কথা বললো।’

ত্যাছড়া চোখে তাকালো রবি। শুধাল, ‘হ্যা তোমার জন্য এখানে নেটওয়ার্ক এসে বসে আছে।’

প্রতিত্তুর করলো না শশী। তপ্ত শ্বাস ফেললো। এই মুহূর্তে এমন দুশ্চিন্তা করে মুহূর্তটা নষ্ট না করাই ভালো। মাথা থেকে সকল প্রকার চিন্তা ঝেড়ে ফেলে মনোযোগ দিলো জ্বলন্ত আগুনে। রবি দুই প্যাকেট নুডুলস বের করে ছোট পাতিলে ঢেলে সিদ্ধ করলো। অতঃপর দুইটা বাটিতে ঢেলে দুজন তৃপ্তি সহকারে খেলো। রবি শশীকে ঘরে ঘুমাতে বললো। বাহিরে ঘরের পাশে পাহাড়ের শেষ প্রান্তে বাঁশের মাচার মাঝে সে রাত কাটাবে বলে ঠিক করলো। এমনিতেও খোলা আকাশের নিচে ঘুমিয়ে তার অভ্যেস আছে। শশী কিছু না বলে চুপচাপ ঘরের দরজা লাগিয়ে ঘুমিয়ে পরলো। রবি মাচার মাঝে শুয়ে পরলো। নীল আকাশের তারা গুলো দেখছে। মনে মনে গান বাজতেই কন্ঠস্বরে সুর নিয়ে আসলো।

‘একা বসে তুমি দেখছো কি একি আকাশ
দিন শেষে তার তারা গুলো দিবে দেখা
মেঘে ঢাকা তারার আলো দেখো তুমি দেখো ভালো
হয়তো তার মাঝেই খোঁজে পাবে আমায়!’

চলবে??

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here