প্রেমানুরাগ পর্ব ৪

0
642

#প্রেমানুরাগ❤️
#মাইশাতুল_মিহির
#পর্ব-৪

অম্বরের রঙ ঘুটঘুটে কালো। ঝুম বৃষ্টি আঁচড়ে পরছে ধরনীতে। শীতল বাতাস প্রভাহমান চারপাশে। পাহাড়ের সবুজ পাতা গুলো বৃষ্টিতে ভিজে চুপসে আছে। ভেজা মাটির ভ্যাঁপসা ঘ্রাণ ভেসে আসছে নাকে। দক্ষিন পাশের জানালা দিয়ে এক হাত বাহিরে রেখে বৃষ্টি ছুঁয়ে দিচ্ছে শশীর। প্রফুল্লিত মনে ভাড়ি বর্ষণ দেখছে সে। চোখ তার খুশিতে চিকচিক করছে। বৃষ্টির পানির ছিটেফোঁটা এসে ভিজিয়ে দিয়েছে শশীর হাত, মুখ আর শরিরের অংশ। বিছানায় বসে বুকে দুইহাত গুঁজে শশীকে এক মনে দেখছে রবি। কেন শশীর দিকে তাকিয়ে আছে সে জানে না। জানতেও চায় না। হঠাৎ শশী হাতে পানি নিয়ে রবির দিকে ছিটকে দিলো। বিরক্তিতে মুখ ‘চ’ জাতিয় শব্দ করলো রবি। এক হাতে মুখ মুছে বলল, ‘ফারদার আমার সাথে একন ফাজ-লামি করবে না এসব আমি পছন্দ করি না।’

শশী গায়ে মাখলো না কথাটা। পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়লো, ‘আমি কেন এখানে আসছি সেটা বললাম। আপনি কিছু বললেন না। এখানে একা কি করছেন? এই ঘরটা কার? ঘরের আসবাবপত্র দেখেতে মনে হচ্ছে এখানে প্রায় মানুষের যাতায়াত হয়।’

রবি স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিলো, ‘হুম আমি বেশিরভাগ সময় এখানে একা আসি।’

‘কাউকে সাথে আনেন না কেন? ভয় লাগে না?’

‘একা আসি কারণ আমি একা সময় কাটাতে কমফোর্টেবল ফিল করি।’

শশী আবার প্রশ্ন করতে যাবে তার আগেই তাকে থামিয়ে রবি বলল, ‘আমি আর আমার ফ্রেন্ড সাকিব এই ঘরটা বানিয়েছিলাম। আগে এখানে আসলে সাকিব আসতো আমার সাথে। এই ঘরের খোঁজ আমি আর সাকিব ছাড়া কেউ জানে না। এখন তুমি।’

শশী জানালার পাশে হেলান দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘তাহলে আপনার সেই ফ্রেন্ডকে নিয়ে আসেন কি কেন?’

‘কারণ সাকিব গত তিন বছর আগে রোড এক্সিডেন্টে মা’রা গেছে।’

রবির সহজ সরল স্বীকারোক্তি। অবাক হয়ে যায় শশী। খারাপ লাগলো তার। অপরাধী ন্যায় তাকিয়ে বললো, ‘আই’ম সরি। এভাবে বলতে চাইনি।’

রবি ঘাড় নাচিয়ে বললো, ‘আমি কিছু মনে করিনি।’ নিরবতা নেমে এলো দুজনের মাঝে। শশী বাহিরে তাকিয়ে বৃষ্টি উপভোগ করছে। বৃষ্টির ছিটেফোঁটা এসে ঘর কিছুটা ভিজিয়ে দিচ্ছে। সাথে হাল্কা ভিজচ্ছে শশীও। কুর্তির সামনের অংশবিশেষ ভিজে গেছে প্রায়। বাহিরে আকাশ কালো মেঘে ঢেকে আছে একদম। আকাশ আলোকিত করে বিদুৎ চমকাচ্ছে। বাতাসে গাছের পাতারা নড়বড়ে। বৃষ্টির পানি চুঁইয়ে চুঁইয়ে পরছে পাতা থেকে। বৃষ্টি ভিজার প্রবল ইচ্ছা পোষণ করলো তার মন। এক পর্যায়ে নিজেকে দমিয়ে রাখতে না পেরে দৌড়ে বেরিয়ে আসে বাহিরে। রবি সবেমাত্র চোখ বন্ধ করে ছিলো। শশীর দৌড়ানোর আওয়াজে চোখ খুলে তাকায়। তাকে বাধা দিতে উঠে এসে দরজায় দাঁড়ালো। কিন্তু ততোক্ষণে শশী একদম কাক ভেঁজা হয়ে গেছে। প্রচণ্ড রকমের বিরক্তি এলো রবির মাঝে। মাত্রারিক্ত ক্রোধের কারনে শরির তার মৃদু কাঁপছে। ঘর থেকেই হাক ছাড়লো, ‘এই মেয়ে ভিতরে আসো বলছি।’

শশী বৃষ্টির পানিতে নাচতে নাচতে উত্তর দিলো, ‘আমার শশী। এই মেয়ে বলে ডাকা বন্ধ করেন। আরেকটু পরে আসি। ভালো লাগছে অনেক।’

রবি দেখলো শশীকে। ভিজে আছে একদম। চুল গুলো গালে – ঘাড়ের সাথে লেপ্টে আছে। দুইহাত দু-দিকে মেলে আকাশের দিকে মুখ করে চোখ বন্ধ করে দাঁড়ালো শশী। এই মুহূর্তটা ক্যামেরা ফ্রেমে বন্ধি করে নিলো রবি। পরোক্ষনে বাহিরে এসে শশীকে খিচঁকে টান দিয়ে ঘরে নিয়ে এলো। কটমট চোখে তাকিয়ে ধমকে উঠলো।

‘ফা’জিল, বেয়া’দব মেয়ে কোথাকার। বারন করা শত্বেও বৃষ্টি ভিজলে কেন? থা-প্রা-ইয়া গাল লাল করে ফেলবো শ’য়’তা’ন মেয়ে। জ্বর আসলে ডক্টর শহর থেকে জঙ্গলে উড়ে আসবে? লাফিয়ে যে বৃষ্টি ভিজলে এখন পরবে কি? ভেজা কাপড় পরে থাকবে? নামি কাপড় ছাড়া?’

রবির কথায় প্রথমে অপমানবোধ করলেও শেষের কথায় লজ্জা পেলো শশী। গাল লাল হয়ে এলো। কান গরম হলো তার। আসলে এতোটা বোকা কেন সে? এখন কি পরবে? এমনিতেই বৃষ্টির পানি ঠান্ডা ছিলো। এখন শীত করছে। ভিজে কাপড় পরে থাকা সম্ভব নয়। তাহলে?

রবি এবার ভয়ানক রেগে আছে। এই মুহূর্তে তার ইচ্ছে করছে এই মেয়েকে থা:প্রা:তে। মাত্র সাত দিন একা সময় কাটাতে এখানে এসেছে। তাও আবার এই উটকো ঝামেলা এসে হাজির। এখন জ্বর বাধালে এই জঙ্গলে কি করবে সে? ইডিয়ট মেয়ে। এগিয়ে আলমারি থেকে একটা টি-শার্ট আর টাওজার বের করে দিলো। বললো, ‘ফা’জিল মেয়ে। এটা পরে আমাকে উদ্ধার করো। অকেজো আমড়া কোথাকার।’

শশীকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রবি বেরিয়ে যায়। শশী মুখ হা করে আহাম্মকের মতো তাকিয়ে আছে। কি বলে গেলো একটু আগে? অকেজো আমড়া? অপমানিত বোধ করলো সে। রাগে গিজগিজ করতে করতে দরজা লাগিয়ে জামা পালটে নিলো। ঘরের মাঝে রশি আগে থেকেই টানা ছিলো। সেখানে কাপড় গুলো মেলে বিছানায় বসলো। ঢিলেঢালা টি-শার্ট পরে অভ্যেস আছে। কিন্তু টাওজার একটু বড়। তাই পায়ের অংশবিশেষ ভাজ করে নিলো। হঠাৎ খেয়াল হলো রবি তো বাহিরে। মুষলধারের বৃষ্টি কমলেও ঝিরিঝিরি বৃষ্টি আছে। ভিজে গেলো না তো আবার? দরজার পাশের ছোট জানালা খুলে মাথা বের করে ডাক দিলো, ‘হ্যালো শনি রবি সোমবার আসতে পারেন।’

রবি দক্ষিণ দিকে মাঁচার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো। শশীর ডাকে ফিরে আসে। মাথার উপর তার বড় কচুপাতার ডাল। এটা দিয়ে ঝিরিঝিরি বৃষ্টির পানি থেকে বাঁচার চেষ্টা করেছিলো। ঘরে ঢুকে কোনো প্রকার টুঁশব্দ করেনি অব্ধি। এমন কি এই ঘরে যে সে ছাড়া আরো একজন রমনী উপস্থিত সেদিকে তার কোনো প্রকার হেলদুল নেই। নিজের মতো ঘরে থাকা শুকনো পাতা আর লাড়কি দিয়ে আগুন ধরালো। অতঃপর দুই কাপ চা বানিয়ে এক কাপ শশীকে দিলো। চুলার পাশে বসেই রবি চা খাচ্ছে। শশী বিছানায় বসে খাচ্ছে। নিরবতা ভেঙ্গে বললো শশী, ‘কত দিনের জন্য এসেছেন?’

রবি কাপে চুমুক দিয়ে ছোট করে উত্তর দিলো, ‘সাত দিন।’

‘আর কত দিন থাকবেন?’

‘তিন দিন।’

ক্ষুন্ন হলো শশীর মন। আর মাত্র তিন দিন? ইশ এখানে যদি সারাজীবনের জন্য থাকা যেতো তাহলে কতোই না ভালো হতো।
__________________

‘আপা? রবি আগের মতো পাহাড়ে গেছে। এখন সেখানেই আছে। আমরা কি যাবো তাকে আনার জন্য?’

‘দরকার নেই। রবি নিজেই আসবে।’

গম্ভীর কন্ঠে বললো রোজিনা চৌধুরী। বারান্দার চেয়ারে বসে পায়ের উপর পা তুলে ব্যস্ততার সাথে পত্রিকার প্রথম আলো পড়ছে। গায়ে তার আকাশী রঙ্গের সুতি জামদানি শাড়ি। থ্রি কোয়াটার ব্লাউজের হাতা। খুব সাবলীল ভাবে শরিরের সম্পূর্ণ অংশ ঢেকে শাড়ি পরেছে সে। দুইহাতের পাঁচটি আঙ্গুলে স্বর্ণের মাঝে ডায়ামন্ট বসানো রিং। কানে গলায় নাকে সেম ডিজাইনের ডায়ামন্ট জুয়েলারি। শৌখিনতায় ভরপুর রোজিনা। বাড়ির অন্য সকল আসবাবপত্র দেখলে স্পষ্ট ভাস্যমান হবে সবার কাছে। টি-টেবিলের উপর থেকে কফির কাপে হাতে ছোট চুমুক বসিয়ে আবার টেবিলে রাখলো। বিশ্বস্ত সেক্রেটারি মোর্শেদ বললো, ‘আপা রবিকে’…..

সম্পূর্ণ কথা বলার আগে তাকে থামিয়ে রোজিনা বলে উঠলো, ‘আমি শুধু রবি কোথায় আছে জানতে চেয়েছিলাম। আমার ধারনাই ঠিক হলো। তুমি যেতে পারো।’

‘আরো দুইটা পেইন্ডিং মিটিং আছে আপা। সেগুলো শিডিউল কিভাবে করবো?’

‘আমি দেখে নিবো। তুমি আপাতত বিকেলের পেইন্ডিং মিটিং টার জন্য ফাইল গুলো আবার রিচেক দাও। কোথাও যেন কোনো প্রকার ভুল না পাই আমি। সব কাজে নির্ভুল চাই আমার।’

মোর্শেদ মাথা দুলিয়ে ‘হ্যা’ সম্মতি দিয়ে স্থান প্রত্যাখ্যান করলো। রোজিনা পত্রিকা ভাজ করে টেবিলে রাখলো। কফির কাপ হাতে নিয়ে ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো। ছোট করে কাপে চুমুক বসিয়ে গম্ভীর মুখে ভাবতে লাগলো। রবিকে নিয়ে সে আর পারে না। ছেলেটা দিন দিন হাতের বাহিরে চলে যাচ্ছে। বড্ড অবাধ্য হচ্ছে। এমন বাউণ্ডুলের মতো উড়নচণ্ডী স্বভাবের হলে ভবিষ্যতের কি হবে? দিন দিন এমন ভাবে চললে তো ভবিষ্যৎ অন্ধকার হবে রবির। সে তো শুধু মাত্র তার কথায় চিন্তা করে। সেই বা একা হাতে আর কত দিন এই প্রোপার্টি সামলাবে? এবার দায়িত্ব ছেলের হাতে দিয়ে নিজেও তো শেষ বয়সে একটু শান্তিতে থাকুক। আপন জনের স্মৃতি আগলে নিজের মতো বাঁচুক শেষ সময়টা। রবি কি তার মায়ের কষ্ট টা বুঝবে না? কবে? কবে বুঝবে এই ছেলে?

চলবে??

নোট : ভুলত্রুটি মার্জনীয়। কার্টেসি ছাড়া কপি নিষিদ্ধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here