#প্রেমানুরাগ❤️
#মাইশাতুল_মিহির
#পর্ব-১১
জীবন চলমান। সময়ের গতির সাথে চলন্ত ট্রেনের মতো স্টেশন ছেড়ে নতুন পথের অনুসন্ধানে সামনে এগুতে হয়। সময়ের সাথে বর্তমানের মুহূর্ত গুলো অতীতের স্মৃতির পাতা হিসেবে আখ্যাত হয়। পাহাড়ে কাটানো মুহূর্ত গুলো যেন দুজনের জীবনের সবচেয়ে প্রিয় ছিলো। দুজন একি শহরে থেকেও আলাদা পরিচ্ছেদে বসবাসরত। দূর-প্রান্তে থেকেও একে অপরকে খুঁজার প্রচেষ্টা চালিয়েছে। বেশ কয়েকবার শশী ঢাবির ক্যাম্পাসের আশেপাশে ঘুরেছে। ‘শাহরিয়ার চৌধুরী রবি’ নামে খোঁজ নিয়েছে। যেহেতু রবি ট্রাভেল প্রেমি ছিলো সেহেতু ভার্সিটিতে তার খুব কমই যাওয়া আসা হতো। সেই সুবাদে কাছের বন্ধু বাদে কেউ তেমন চিনে না। প্রতিবার বুক ভরা আশা নিয়ে আসলেও বিষন্ন মনে ফিরতে হয়েছে শশীর। অপর দিকে রবিরও একই অবস্থা। মস্তিষ্ক জুড়ে কেবল শশীর অস্তিত্ব। বেশ কয়েকটা ভার্সিটিতে গিয়ে ‘শশী ইমতিয়াজ’ কে খুঁজেছে। ফলাফল শশীর মতোই শূন্য। হতাশ হলো রবি। নিজের চুল টানতে ইচ্ছে করছে তার। অসয্য গরমে ভ্যাঁপসা ঘামের গন্ধ গা থেকে ভেসে আসছে। মাথার উপর উল্কাপিণ্ড সূর্যের মাত্রারিক্ত উত্তাপে হাহাকার চারপাশ। অতিরিক্ত গরমে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এলো। কফি হাউজের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলো রবি, রাজিব আর বাবু। মুহূর্তেই শরিরে এসির ঠান্ডা শীতল স্রোত ভয়ে গেলো। বাবু চেয়ার টেনে ধপাস করে বসে গা এলিয়ে দিলো তাতে। তার পাশে ও সামনের চেয়ারে রবি রাজিব বসলো। বাবু হাক ছেড়ে ওয়েটার কে ডেকে কোলড্রিংক অর্ডার দিলো। রবি চুপচাপ তাদের পাশে নির্বিকার ভাবে বসে আছে। রাজিব দুই হাতে এলোমেলো চুল গুলো পিছে ঠেলে বললো, ‘শা:লা এই জন্মে আর শশী রে পাবি না। হুদাই রোদের মধ্যে ঘুরাঘুরি কইরা কালা হইয়া লাভ নাই। পরে দেখা যাবে হইছোস কালা একজনের লাইগা। কিন্তু বিয়ার পিরিতে তারে তো পাবি না সাথে অন্য কেউ তোরে পাত্তা দিবো না।’
রবি প্রতিত্তুর করলো না। মন তার বিষন্নতায় ছেয়ে আছে। বাবু সোজা হয়ে বসে বললো, ‘তুই যেমন বলদা, কামডাও করলি বলদামির মতো। ভাই একটা মাইয়ার লগে তিন দিন কাটাইয়াও তার এড্রেস তো দূরে থাকা নাম্বার চাইতে পারলি না? তোর ভাগ্য ভালা। এমন লাউরা হইয়াও আমাদের বেষ্টফ্রেন্ড হইছোস। নাইলে তোরে দুনিয়ার কেউ বেষ্টফ্রেন্ড রুপে নিতো না।’
হেসে ফেললো রাজিব। ত্যাঁছড়া চোখে তাকালো রবি। বললো, ‘ভাই জানি বোকামি করছি। তাই বলে ঢাক ঢোল পেটাতে হবে?’
রাজিব হেসে প্রতিত্তুর করলো, ‘আজকালকার দিনে ঢোল ব্যবহার হয় না। মাইক কিংবা সাউন্ড বক্সে লাগাতে পারি।’
রবি লম্বা দম ফেললো। নিচু গলায় বললো, ‘ভালো লাগছে না ইয়ার। কেমন খাপছাড়া লাগছে নিজেকে।’
বাবু বললো, ‘ভাবা যায়? তিন দিনের মধ্যে একটা মেয়ের প্রেমে পরে রবি হাবুডুবু খাচ্ছে? ভাবা যায় এগ্লা?’
রবি প্রতিত্তুরে হাসলো। অতঃপর ঠান্ডা কোলড্রিংকে চুমুক বসিয়ে ঠান্ডা হলো তিন বন্ধু। নেক্সট টাইম কোথায় কোথায় খুঁজবে তার প্ল্যান করতে লাগলো।
______________
রিপোর্টের কাগজে হাতে নিয়ে তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শশী। অনুভূতির কৌটা তার শূন্য। বুক চিড়ে কেবলমাত্র দীর্ঘশ্বাস আসছে। কোনো মেয়েই বোধহয় তার বাবার অসুস্থতা মেনে নিতে পারে না। সে নিজেও পারছে না। সে চায় তার বাবা অন্যান্য বাবাদের মতো সুস্থ থাকুক। তপ্তশ্বাস ফেলে তার পাশে বসা ইকবালের দিকে তাকালো। তারপর জুরপূর্বক শুকনো ঢুক গিলে সামনে তাকালো। ঠোঁট টেনে নিচু আওয়াজে প্রশ্ন করলো, ‘পাপা ঠিক হবে না আঙ্কেল?’
শশীর বিপরীত পাশে বসা ব্যক্তিটি নিরবে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। গায়ে তার সম্মানধানী এপ্রোন। হাতের কলম টেবিলে রাখলো। দুই হাত ভাজ করে টেবিলের উপর রেখে হাল্কা ঝুকে বসলো। তারপর অত্যন্ত চিন্তিত কন্ঠে বললো, ‘প্রত্যেক মানুষই কোনো ব্যাপারে অতিরিক্ত ভয় পায়। সেটার সাথে যদি অতীতের কোনো কিছুর সাথে যুগসূত্র থাকে তাহলে তা ভয় থেকে একপ্রকার মানসিক যন্ত্রনার সৃষ্টি হয়। তোমার মায়ের অকাল মৃ’ত্যু তোমার বাবা সহজে মেনে নিতে পারেনি। এই অতীতকে আঁকড়ে ধরে সোহরাব এখন আতঙ্কিত। আর সেটা তুমি। তার ধারনা মনে তুমিও শিশিরের মতো তাকে ছেড়ে যাবে। এই ধরনের ভয়, আতঙ্ককে সাধারনত ফোবিয়া বলে। আর তোমার বাবা মানে সোহরাব এই ফোবিয়াতে আক্রান্ত।’
হতবাক হয়ে গেলো শশী। একরাশ ভয় হানা দিলো তার মাঝে। ভয়ার্ত চোখে ডক্টরের দিকে তাকালো। ইকবাল এক হাতে শশীর হাত ধরে চোখের ইশারায় আশ্বাস দিলো। শশী সে দিকে তাকিয়ে কিছুটা আতঙ্ক মুক্ত হলেও বুক চিড়ে চাপা আর্তনাদ ভাসছে তার। হতাশ হয়ে প্রশ্ন করলো, ‘মানে বাবা তাহলে??’
‘দেখো শশী। তোমার বাবা ম্যান্টলটি সিক। তার মাঝে হারানোর ভয়টা বিদ্যমান। এই ধরনের ফোভিয়া যাদের থাকে তারা খুব সেন্সেটিভ হয়। ম্যান্টলটি ডিসেপয়েন্ট হয়ে থাকে।’
শশী কিছু বললো না। চুপচাপ শুনছে সব কথা। তখন ইকবাল সমাধান জানতে চেয়ে প্রশ্ন করলো, ‘সোহরাব কে সুস্থ করার উপায়?’
ঠোঁট কামড়ে মাথা হালকা ঝাঁকালো ডক্টর। তারপর আবারো বলতে লাগলো, ‘ফোবিয়া সাধারনত এক ধরনের মানুষিক রোগ। আর এর অন্যতম চিকিৎসা হলো সাইকোথেরাপি। অর্থাৎ বিহেভিয়ার থেরাপি। এই থেরাপিতে আক্রান্ত ব্যক্তির অস্বাভাবিক আচরনকে ধীরে সুস্থে স্বাভাবিক আচরনে পরিবর্তন করা হয়।’
শশী বললো, ‘পাপা যখন হাইপার হয়ে যায় তখন তার অতিরিক্ত মাথা ব্যাথা করে। আর প্রচুর ঘেমে যায়।’
‘হুম। মানসিক ভাবে অসুস্থ থাকলে অতিরিক্ত দুশ্চিন্তার কারণেও মাত্রারিক্ত মাথা ব্যাথা হয়ে যায়। আর এই শারীরিক ও মানসিক উপসর্গ কমাতে মেডিসিন নিতে হয়। আমি মেডিসিন দিয়ে দিবো। আর তোমাদের কিছু ব্যাপার খুব সাবধানতার সাথে পালন করতে হবে।’
ইকবাল আগ্রহ নিয়ে কন্ঠস্বর বিষন্ন করে বললো, ‘যা যা করতে বলবেন সব করবো। বিনিময়ে আমার বন্ধু যেনো সুস্থ হয়ে যায় স্যার।’
বিস্মিত চোখে তাকালো ডক্টর। তার পঞ্চান্ন বৎসর বয়সে এমন মানুষ খুব কমই দেখেছে। বিপদের সময় আপন ভাই যেখানে পাশে থাকে না। সেখানে ইকবাল তার কিশোর কালের বন্ধুর জন্য কত মরিয়া। সোহরাবের চিকিৎসার ব্যাপার টা প্রথমে তিনি দেখেছিলেন। তার ধরন তিনি খুব কাছ থেকে সোহরাব আর ইকবালকে চিনে। এই কয়েকবছর ইকবাল আর সোহরাবের এমন বন্ধুত্ব দেখে প্রসন্ন হলো তার মন। মনে মনে দো’য়া করলো সোহরাব যেন সুস্থ হয়ে যায়।
________________
রাত্রী প্রায় দুইটা ছুঁই ছুঁই.
অন্যান্য দিনের মতো রবি চুপিচুপি পায়ে বাড়ির সদর দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলো। খুব সাবধানতার সাথে দরজা লাগিয়ে পিটপিট পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলো। রোজিনার রুম পেরিয়ে তার রুম। যাবার আগে মায়ের রুমের লাইট অফ দেখে ভাবলো ঘুমিয়ে আছে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো রবি। রোজিনার ভাস্যমতে রবি এখন তার রুমে ঘুমাচ্ছে। কারন রাতের খাবার এক সাথে খেয়েছে তারা সবাই। রবি অন্যান্য দিনের মতোই রাতের খাবার খেয়ে রুমে এসে শুয়ে পরেছিলো। রোজিনাও তাই জানে। রাত যখন প্রায় ১১ টা তখন রবি চুপিচুপি পায়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গিয়েছিলো। এখন রাত দুইটা ছুঁই ছুঁই। রাতে এতোক্ষণ বাহিরে ছিলো রবি ভাবতেই কেমন কেমন লাগছে তার। একবার মা জানলে আর রেহাই নেই। এতো সহজে কাজ শেষ করলো অথচ কেউ টের পায়নি ভেবেই নিজেকে বাহ্ বাহ্ দিচ্ছে সে। আস্তে করে রুমের দরজা লাগিয়ে ভাব নিয়ে জ্যাকেটের কলার ঠিক করলো। রুমের লাইট অন করে পিছে ফিরতেই তার চোখ চড়ক গাছ প্রায়। চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে শুকনো ঢুক গিললো। কারণ রোজিনা তার বিছানায় শুয়ে ছিলো। লাইট অন হওয়ায় চোখ খুলে তাকালো। মাত্রারিক্ত রেগে আছ সে। এমন বে’য়া’দব ছেলে যে রাত বিরাত বাহিরে কাটায় সেই ছেলেকে চ’ড়ি’য়ে কান লাল করে দিতে ইচ্ছে করছে। শুয়া উঠে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে শক্ত গলায় প্রশ্ন ছুঁড়লো, ‘কোথায় ছিলে?’
রবি কাচুমুচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মিনমিনে গলায় উত্তর দিলো, ‘চন্দ্রিমা উদ্যানে ছিলাম ফ্রেন্ড দের সাথে।’
রোজিনা রাগি গলায় আবারো হেঁকিয়ে উঠলো, ‘এতো রাতে সেখানে কি প্রয়োজন ছিলো?’
রবি কিছুটা ভয় পেয়ে যায়। প্রতিত্তুর করতে যাবে তার আগেই রোজিনা তড়িঘড়ি করে এগিয়ে রবির হাত ধরে বলতে লাগলো, ‘তোমার গায়ে এই সাদা পাউডার কেন? এই গুলো কিসের?’
রোজিনা রবির বাহু, গাল, মুখ হাত ধরে দেখতে লাগলো। সন্দেহ হলো তার। বলতে লাগলো, ‘এই গুলো ড্রাগ? তুমি রাতে বাহিরে ড্রাগ নেও রবি? এই দিন দেখার বাকি ছিলো আমার?’
হতভম্ব হয়ে গেলো রবি। আহাম্মকের মতো ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইলো। বললো, ‘আরেহ্ আম্মু আমার কথা শুনো।’
রোজিনা রবির বাহু ঝামটা মেরে ছাড়লো। তারপর কড়া গলায় রেগে বলতে লাগলো, ‘মাঝ রাতে বাড়ির বাহিরে গিয়ে তুমি নেশা করো? এই শিক্ষা দিলাম তোমাকে?’
রবি গায়ের লেগে থাকা সাদা পাউডার গুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বললো, ‘আম্মু এইগুলা ময়দা। সিফাতের বার্থডে আজ তাই চন্দ্রিমা উদ্যানে গিয়েছিলাম। সিফাতকে ময়দা ডিম দিয়ে গোসল করিয়েছি। আর তুমি এই ময়দাকে ড্রাগ বানিয়ে ফেললে? আমার বিশ্বাস হচ্ছে না তুমি আমাকে নিয়ে এতো জগন্য চিন্তা করতে পারো।’
মনের অস্থিরতা নিভলো রোজিনার। লম্বা দম নিয়ে শুকনো ঢুক গিললো। রবি প্রথমে স্বাভাবিক থাকলেও এখন আর নেই। গায়ের লেদার জ্যাকেট খুলে মেঝেতে ছুড়ে মেরে কাটকাট গলায় বলে উঠলো, ‘আমি কলেজ পড়ুয়া কোনো বাচ্চা ছেলে না আম্মু। যথেষ্ট বড় হয়েছি আমি। আমাকে নিয়ে তোমার এইসব লেইম টেনশন গুলো জাস্ট বোরিং লাগে। একটু বেশি করো তুমি। আমাকে আমার মতো তো থাকতে দাও।’
রোজিনা প্রতিত্তুর করলো না। চুপচাপ নিরব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। রবি এক হাতে চুলে থাকা ময়দা গুলো ঝেরে ফেলে এগিয়ে রোজিনাকে বিছানায় বসালো। তার সামনে হাটু গেড়ে বসে দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বলতে লাগলো, ‘ট্রাস্ট মি আম্মু, আমি কখনো খারাপ কাজে লিপ্ত হবো না। ভয় পাও কেন তুমি? আমাকে বিশ্বাস করো না? আমি বলছি তো কিছুদিন পর বিজনেস সামলাবো। একটা ব্যাপারে একটু টেনশনে আছি। সেটা শেষ হলেই আমি অফিসে যাবো। প্রমিস আম্মু।’
প্রসন্ন হলো রোজিনা। ঠোঁটে ফুটে এলো স্মিত মিষ্টি হাসি। রবির গালে এক হাত রেখে বললো, ‘আমি বিশ্বাস করি তোমাকে। বড় হও তুমি। জীবনে সকল সাফল্য আসুক তোমার।’ রবি খুশি হলো। ‘উফফ মা’ বলে জড়িয়ে ধরলো রোজিনা কে।।
চলবে??