#প্রণয়_রেখা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৯.
প্রথম ক্লাস শেষ করেই মোহনা এশাকে নিয়ে মাঠে গেল। এশা মোহনার ব্যবহারে কেন যেন খুব অবাক হচ্ছে। মেয়েটা সকাল থেকেই তার সাথে খুব অদ্ভুত ব্যবহার করছে। ভার্সিটিতে আসার পর থেকেই কেমন চুপচাপ। তার সাথেও খুব একটা কথা বলেনি। এখন আবার তাকে এভাবে মাঠে নিয়ে এল, এসব কিছুর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো গুরুতর কারণ আছে।
মাঠের এক কোণে যেখানে মানুষের আনাগোনা কম সেই জায়গাটাই মোহনা এশাকে নিয়ে দাঁড়াল। রাফাতও তাদের পেছন পেছন এসেছে। সেও ধরতে পারছে না ব্যাপারটা কী। এশা এবার কপালে ভাঁজ ফেলল। গম্ভীর সুরে বলল,
‘কী হয়েছে তোর?’
মোহনা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। বেশি বনিতা না করে সরাসরিই বলল,
‘তুই’ই কি লরিনকে সাহায্য করছিস?’
প্রশ্ন শুনে এশা থমকে গেল। তার চোখে মুখে উপচে পড়ছে বিস্ময়। কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। মোহনার চোখ মুখের কঠোরতা দেখে আরো বেশি এশা হতভম্ব হচ্ছে। রাফাতও সমান তালে চমকেছে। মোহনা ঢোক গিলল। আবারও সে এশাকে একই প্রশ্ন করল,
‘চুপ করে আছিস কেন, এশা? বল, তুই কি লরিনকে সাহায্য করছিস?’
এশা রাফাতের দিকে চাইল। সেও আশ্চর্য। বোকা বোকা চোখে মোহনার দিকে চেয়ে বলল,
‘কী বলছিস এসব? এশা কেন লরিনকে সাহায্য করতে যাবে?’
মোহনা কাঠকাঠ গলায় জবাব দিল,
‘কেন সাহায্য করছে সেটা ঐ ভালো বলতে পারবে। এশা, চুপ করে না থেকে জবাব দে। দয়া করে আর কিছু লুকাস না।’
এশা এদিক ওদিক চেয়ে নিজেকে যথেষ্ট শান্ত রাখার চেষ্টা করছে। ফাঁকা মস্তিষ্ক নিয়ে কিছুক্ষণ আবার মোহনার দিকে চেয়ে রইল। জবাব দেওয়ার মতো কোনো শব্দ সে খুঁজে পাচ্ছে না। হৃৎস্পন্দনের ঢিপঢিপ শব্দ সে টের পাচ্ছে। মিথ্যে বললে বুকে ভয় জন্মে। তারও জন্মাচ্ছে। তাও সত্য বলার সাহস পাচ্ছে না।
মোহনার শক্ত কঠিন চোখজোড়ার দিকে বেশিক্ষণ সে চেয়ে থাকতে পারল না। কেন যে কষ্ট পাচ্ছে। সে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে জোরে নিশ্বাস নিল। গলার স্বর তো আটকে আছে, কথা বলবে কী করে? মোহনা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘কথা বল, এশা।’
এশা টলমল চোখে কম্পিত সুরে বলল,
‘হ্যাঁ, আমিই এতদিন লরিনকে সাহায্য করেছিলাম।’
মোহনা চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেল। মস্তিষ্কের রক্ত সঞ্চালন যেন হুট করে মারাত্মক রকম ভাবে বেড়ে গেল তার। সে চোখ বুজে বোঝার চেষ্টা করল, সে ঠিক শুনেছে তো? না, হয়তো ভুল শুনেছে। তার এশা তার সাথে এমন করবে না, সে নিশ্চয়ই তাকে এত এত মিথ্যে বলবে না। এটা সম্ভবই না। মোহনা জোরে জোরে নিশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘তুই মিথ্যে বলছিস, না? তুই এমন করিসনি, মজা করছিস তাই তো?’
এশা কেঁদে ফেলে। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে,
‘না, আমিই এসব করেছি। লরিনকে প্রথম থেকে আমিই সাহায্য করেছি। তোর বাড়ির ঠিকানা, তোর ফোন নাম্বার ইনফেক্ট তোর সমস্ত ইনফরমেশন আমিই ওকে দিয়েছি।’
রাফাতও বাকরুদ্ধ। সে নির্বাক হয়ে চেয়ে এশাকে দেখছে। যেন নিজের চোখকে সে বিশ্বাস করতে পারছে না। এশা কেন এমন করবে? ও তো মোহনাকে তার নিজের বোনের মতো ভালোবাসে, তাহলে?
মোহনা নিজেকে খুব শান্ত রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। মাথা কাজ করছে না তার। তার বন্ধু তার সাথে কেন এমন করল। সে না তাকে ভালোবাসতো? তাহলে সে তাদের বন্ধুত্বকে কেন অপমান করল?
মোহনা শক্ত গলায় বলল,
‘কেন করেছিস এসব?’
এশা কাঁদছে। কান্না থামিয়ে ঢোক গিলে বলল,
‘ও তোকে ভালোবাসে।’
মোহনা আর নিজেকে আটকে রাখতে না পেরে চেঁচিয়ে উঠল।
‘ও আমায় ভালোবাসে? আর তুই আমায় ভালোবাসতি না? এতদিন যাবত নিজের চোখে তুই দেখেছিস, আমি কতটা ডিপ্রেসড ছিলাম। এই একটা বিষয় নিয়ে আমি কতটা দুশ্চিন্তা করেছি। কত কিছু করে গেছি সেই মানুষটাকে ধরার জন্য যে লরিনকে এত সব ইনফরমেশন দিয়েছে। এইসব কিছু নিজের চোখে দেখেও তুই এতদিন কী করে চুপ করে ছিলি? একটুও তোর বিবেকে আটকাল না এসব করতে? কে হয় ঐ ছেলে, যে ওর ভালোবাসার কথা চিন্তা করতে গিয়ে তুই তোর বেস্ট ফ্রেন্ডের সাথে এমন করেছিস? বল, ঐ ছেলে তোর কে হয়?’
এশা হাত দিয়ে মুখ ঢেকে কেঁদেই চলছে। মোহনা ওর দুই হাত চেপে ধরে বলল,
‘নাটক বন্ধ কর, এশা। এতদিন তুই অনেক নাটক করেছিস, এখন আর তোর এসব নাটকে আমি ভুলব না। তাকা আমার দিকে, তাকিয়ে সত্যি কথা বল। লরিন তোর কে হয়? কেন এসব করেছিস তুই? জবাব দে, এশা।’
এশা নাক টেনে রাফাতের দিকে চাইল। রাফাতের চোখ মুখেও রাগ স্পষ্ট। এবার আরো বেশি কষ্ট হচ্ছে তার। এমন একটা দিন যে একদিন আসবে সেটা সে আগেই জানত। সত্যকে সে কতদিন লুকিয়ে রাখবে? একদিন না একদিন সেটা ঠিকই সামনে আসবে।
এশা নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ করে অবশেষে বলতে আরম্ভ করে,
‘লরিন আমার কাজিন হয়। ওর বাবা সম্পর্কে আমার বড়ো মামা। মামা বিদেশ গিয়ে একজন বিদেশি মেয়েকে বিয়ে করেন। তবে উনার সেই সম্পর্ক আমার নানা নানু কেউই কোনোদিন মেনে নেননি। তাই মামাও উনার বউ নিয়ে কখনো দেশে আসেননি। তবে আমার মা বাবার সাথে মামার খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। সবসময় মা বাবার সাথে মামার কথা হতো। একদিন নানা নানুকে না জানিয়ে আমাদের বাড়িতে এসে ঘুরেও গিয়েছিল। তখন লরিন নাকি খুব ছোট। আর আমার তখনও জন্মও হয়নি। সেই ছোট্ট লরিনের একটা ছবি আমার মা বাবার কাছে ছিল। সেটা দেখেই আমি প্রথম জেনেছিলাম, আমার একটা বিদেশি মামাতো ভাই আছে। তারপর আস্তে আস্তে যখন আরো বড়ো হলাম তখন একদিন শুনলাম, আমার মামা মামি নাকি একটা রোড এক্সিডেন্টে মারা গিয়েছেন। আর উনাদের ছেলে লরিন এখন নাকি লরিনের আংকেলের কাছে আছে। মা বাবা তখন চেষ্টা করেছিলেন লরিনকে দেশে আনার জন্য। কিন্তু লরিন তখন আমাদের কাউকে ভালো করে চিনতই না। ওর মা বাবার সুবাদে যতটুকুই আগে চিনত তবে মা বাবা মারা যাওয়ার পর একেবারেই ভুলে যায়। তাই ওর সাথে আমরা আর কোনো যোগাযোগ করতে পারেনি। তবে ওর খোঁজ মা বাবা ওর আংকেলের কাছ থেকে সবসময়ই নিতেন। আর তখনই কোনো একদিন ওর আংকেলের কাছ থেকে ওর ফেইসবুক আইডিটা আমি নিয়েছিলাম। আর ও যেহেতু দেশে আসতে চায়না তাই ওকে দেশের আনার জন্যই আমি তোর ডেয়ারের সময় তোকে ওর আইডি টা দিয়েছিলাম। কিন্তু আমি নিজেও ভাবতে পারেনি যে ও সত্যি সত্যিই তোর জন্য দেশে চলে আসবে। আর ওর দেশে আসার খবর তোর আগেই আমি ওর আংকেলের কাছ থেকে পেয়ে যাই। তাই ওর সাথে আমি আগে আগেই দেখা করি। তবে আমি যে ওর বোন হই সেই পরিচয় আমি এখনও ওকে দেইনি। ও আমার সাথে প্রথমে কথা বলতে চায়নি তাই আমি তোর ঠিকানা আর পরিচয় দেওয়ার শর্তে ওর সাথে কথা বলেছিলাম। ও বাংলা ভাষা শিখেছিল ওর বাবার কাছ থেকে আর বাকিটা এখানে আসার পর আমি ওকে শিখিয়েছিলাম। তবে জানিস তো ও তোকে নিয়ে সত্যিই খুব সিরিয়াস। তাই আমি ওকে তোর কথা বলে বলে আমাদের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলাম। প্রথম বারের মতো ও ওর বাবার বাড়িতে পা রেখেছিল। ওর দাদা দাদুকে দেখেছিল। তবে ও তাদের চিনতে পারেনি। বুঝতেও পারেনি এই মানুষগুলো তার কত আপন। এখন ও কেবল এই দেশে পড়ে আছে তোর জন্য। নয়তো এই দেশে ও কখনোই থাকত না। ওর এই দেশের প্রতি কোনো মায়া নেই। স্বাভাবিক ভাবেই ওর জন্ম কর্ম সব ঐদেশেই, তাই ওর এখানে মন টিকছে না। এখন ওকে এখানে শুধু তোর মায়াই আটকে রেখেছে। আর আমার নানা নানু এখন চান, ও যাতে এখানেই থাকে। উনাদের ছোট ছেলের শেষ চিহ্ন যেন উনাদের সাথেই থাকে। ছেলে হারিয়ে বৃদ্ধ মা বাবার এই একটাই দাবি। ছেলেকে দূরে সরিয়ে দিলেও ছেলের শেষ সম্পদটুকু নিজেদের কাছে আগলে রাখতে চান। আর তাই আমি লরিনকে তোর কথা বলে বলে এখানে রাখছি। না হয় ও আরো অনেক আগেই চলে যেত। আমি এইসব কিছু করেছি শুধুমাত্র আমার অসুস্থ নানা নানুর কথা ভেবে। আমি ভুল করেছি, অন্যায় করেছি জানি। যদি পারিস, ক্ষমা করে দিস।’
কথা শেষ করেই এশা দৌড়ে ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে গেল। মোহনা এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল তার সেই যাওয়ার পথের পানে। তার আঁড়ালে এতসব কিছু হয়ে গিয়েছে, অথচ সে কিছুই জানে না। এখন সবকিছু শুনে মাথা ঝিমঝিম করছে। এই জটিল সমস্যা সমাধান যে এত জটিল হবে সেটা সে ভাবেনি। ভেবেছিল অন্যকিছু। রহস্যময় লরিন যেন তার রহস্যের মায়াজালে তাকে আরো নিখুঁতভাবে আটকে ফেলছে। অথচ সে পথ পেয়েও বেরিয়ে আসতে পারছে না।
চলবে…