#প্রণয়_রেখা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৮.
মোহনা লরিনকে ডিরেক্ট কল করে বসল। লরিন সেই কল রিসিভ করলে মোহনা তিক্ত সুরে বলল,
‘অরূপের কথা আপনি কী করে জানলেন?’
‘কী করে জেনেছি সেটা বড়ো কথা নয়, বড়ো কথা হলো এই অরূপটা কে সেটা জানা। Who is he?’
‘আমার বাবার বন্ধুর ছেলে।’
মোহনার সরাসরি জবাব। লরিন খানিকটা চুপ থেকে বলল,
‘ঠোমার বাবা আবার তার সাথে ঠোমার বিয়ে দিয়ে দিবে না তো?’
মোহনা গলার স্বর এবার চওড়া করে বলে,
‘আপনাকে কে বলেছে উনার সাথে বাবা আমায় বিয়ে দিবে? আর যদি দেয় ও তাতেই বা আপনার কী?’
লরিন চাপা সুরে বলল,
‘ঠোমার বিয়ে হয়ে গেলে আমার কী হবে?’
মোহনা বিরক্ত সুরে বলল,
‘আপনিও তখন আপনার দেশের কেউ একজনকে বিয়ে করে সুন্দর সংসার শুরু করবেন।’
লরিন বিষন্ন মনে বলল,
‘ইশ, যদি আমার ক্ষমতা থাকত তবে আমি অবশ্যই আমার মনকে কন্ট্রোল করতে পারতাম। কিন্তু আফসোস! আমার সেই ক্ষমতা নেই।’
‘চাইলেই পারবেন। মন আপনার, সেটাকে কন্ট্রোল করার ক্ষমতা আপনার থাকতে হবে। নয়তো সেই মন বারবার ভুল কাজ করে বসবে, পরে তো তার জন্য আপনাকেই পস্তাতে হবে তাই না? তাই আগে থেকেই মনকে কন্ট্রোল করতে শিখুন।’
লরিন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কিছু হারিয়ে ফেলার তীব্র যন্ত্রণা তাকে ভীষণ ভাবে আঘাত করছে। মোহনার প্রতি তার এক অন্তরীক্ষ মায়া। সেই মায়া কাটিয়ে উঠার মতো ক্ষমতা তার নেই। ভাবলেই তো বুক ধরফর করে, মন বিষিয়ে উঠে। সাধারণ একটা মেয়ের প্রতি এত কেন আকৃষ্ট তার, কেন এত মায়া। মায়ার এই তীব্রতা থেকে সে কীভাবে তার মনকে উদ্ধার করবে সেই উপায় তার আজও জানা নেই। তবুও যদি কোনোদিন মোহনা অন্যকারোর হয়ে যায়, তবে সে অবশ্যই খুব কষ্ট পাবে। বুক তার সেদিন নিশ্চয়ই তীব্র ব্যথায় কুঁকড়ে উঠবে।
লরিননের নিরবতা দেখে মোহনা বলল,
‘আর কিছু বলার আছে আপনার?’
লরিন কিছুটা সময় নিয়ে কম্পিত সুরে বলল,
‘ঠোমাকে হারিয়ে ফেলার কথা ভাবলে আমার বুকে ব্যাথা হয়, মোহনা।’
লরিনের এই সুরে বিষাদ স্পষ্ট। যেন মোহনাকে না পাওয়ার এক আক্ষেপ ছেলেটাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। কেমন যেন মোহনার মায়া হয় তার জন্য। ছেলেটার অমন মিইয়ে যাওয়া স্বর তার মনকে আটকে ফেলছে যেন। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সেই দীর্ঘশ্বাসের প্রতিধ্বনি লরিনও শুনতে পায়। হয়তো সেও বুঝতে পারে, মোহনা নিরুপায়। লরিন তাই মিহি সুরে বলে,
‘আমরা কি অন্তত বন্ধুও হতে পারিনা?’
মোহনা দ্বিধাহীন সুরে বলল,
‘যদি বন্ধুত্বের খাতিরে সম্পর্কের গভীরতা বাড়ে তখন আপনার সাথে সাথে আমারও কষ্ট হবে, লরিন।’
লরিন হতাশ হয়ে পড়ল। অনেক ভেবে বলল,
‘তেমন কিছু হবে না। আমি কখনো আমাদের বন্ধুত্বের সীমা লঙ্ঘন করব না। যেমন সম্পর্ক ঠোমার রাফাত আর এশার সাথে তেমন সম্পর্কই ঠোমার আমার সাথে থাকবে।’
মোহনা স্পষ্ট স্বরে বলল,
‘তাহলে আমার বিয়ে হয়ে গেলেও আপনি কষ্ট পাবেন না, বরং এশা আর রাফাত আমার বিয়েতে যেভাবে আনন্দ করবে আপনাকেও ঠিক সেইভাবেই আনন্দ করতে হবে।’
লরিন আবার উত্তেজিত হয়ে পড়ে। বিচলিত সুরে বলে,
‘তাহলে কি ঠোমার সত্যি সত্যিই অরূপের সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে? ঠুমি সত্যিই ওকে বিয়ে করে ফেলবে, মোহনা?’
মোহনা চোখ বুজে নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ করে বলল,
‘এই তো বিয়ের কথা শুনে অস্থির হয়ে পড়লেন। এবার আপনিই বলুন, আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব কী করে সম্ভব? আপনি পারবেন একজন বন্ধু হিসেবে আমার বিয়েটা হাসি মুখে মেনে নিতে? যদি বলেন পারবেন, তবে আমিও আপনার বন্ধু হতে রাজি।’
লরিন দুটানায় পড়ে গেল। এর আগে কখনো এমন কঠিন মুহুর্তে সে পড়েনি। কী সিদ্ধান্ত নিবে? কী বলবে? মোহনাকে হারালে যেমন কষ্ট হবে তেমনি বন্ধু হিসেবে তার বিয়ে দেখাটাও কষ্ট হবে। এত জটিল কেন সবকিছু? এত এত প্যাঁচে তার মাথা এখন আর কাজ করছে না। লরিন শুকনো মুখে বলল,
‘আচ্ছা এখন রাখি। পরে বলব।’
লরিন কল কেটে দিল। মোহনা তার ফোনটা পাশে রেখে মনে মনে ভাবতে লাগল, “ইশ, যদি ভাগ্য লরিনের সহায় হতো, তবে কতই না ভালো হতো।”
.
রাত আট’টা,
মোহনা তার টেবিলে বই খুলে বসে আছে। পড়ায় মনোযোগ দিতে পারছে না। কিছু একটা নিয়ে সে খুব অস্থির। মাহিয়া অন্য টেবিলে গলা ছেড়ে পড়ে যাচ্ছে। পর্যায় সারণির মৌলগুলো তার টুটস্থ মুখস্ত, তাও কেন এই মেয়ে বারবার রসায়ন বই খুলে এই একটা জিনিসই চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে পড়ে কে জানে। মোহনা গালে হাত দিয়ে বোনের দিকে ফিরে তাকায়। বোন তার চোখ বন্ধ করে পড়ে যাচ্ছে। বাহ, মেয়েটা নির্ঘাত এ প্লাস পাবে। ওর বয়সে মোহনাও এত পড়েনি, আর তার জন্যই হয়তো অল্প কিছু পয়েন্টের জন্য তার এ প্লাস ছুটে গিয়েছিল। যাক, সেসব নিয়ে সে আর ভাবতে চায় না। আপাতত তার মন আর মস্তিষ্ক অন্য কথা ভাবছে। সে মাহিয়াকে ডেকে থামতে বলল। মাহিয়া পড়া থামিয়ে অদ্ভুত চোখে বোনের দিকে চেয়ে বলল,
‘কী হয়েছে?’
মোহনা কিছুক্ষণ থ মেরে বসে থেকে বলল,
‘আমার না এবার এশা কে সন্দেহ হচ্ছে।’
মাহিয়ার ফর্সা ললাটে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। সে বলল,
‘কী নিয়ে?’
মোহনা হাঁসফাঁস করছে। এশাকে সন্দেহ করা মোটেও ঠিক হচ্ছে না। তবে তার অযাচিত মন সেই কথাই মানতে নারাজ। সে বারংবার কেবল বলে যাচ্ছে, “এশা’ই সে, যে লরিনকে সাহায্য করছে”। তবে এই অদ্ভুত সন্দেহের কোনো যুক্তি এখনও মোহনা তলিয়ে পাচ্ছে না। যুক্তিহীন কোনো বিষয় নিয়ে এশাকে সন্দেহ করা অবাঞ্ছনীয়। তবে একেবারে সন্দেহ না করেও থাকতে পারছে না।
মাহিয়া যেন বোনের এমন নিরবতায় খুব বিরক্ত হলো। তার পড়া থামিয়ে এভাবে ঘাপটি মেরে বসে থাকার কোনো মানে হয়না। সে আবারও তাই পড়তে আরম্ভ করল। এবার মোহনা চেতে গেল। রূঢ় সুরে বলল,
‘আশ্চর্য, একদিনেই সব পড়ে শেষ করে ফেলবি নাকি?’
‘তো কী করব? পড়া বন্ধ করে তোমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছি কিন্তু, তুমি তো কিছু বলছো’ই না।’
মোহনা নিশ্বাস নিল। বলল,
‘বলতে চাইছি আবার চাইছিও না। আসলে আমার এখন মনে হচ্ছে এশা’ই হয়তো লরিনকে সাহায্য করছে।’
‘কী? মাথা খারাপ তোমার? এশাপু কেন লরিনকে সাহায্য করবে? ও তো তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড, ও তোমার সাথে কখনোই এমন করবে না।’
মোহনা অসহায় গলায় বলল,
‘হ্যাঁ, সেটাই তো। আমিও তাই ভাবছি। কিন্তু এশার কিছু ব্যবহারে আমার ওকে সন্দেহ হচ্ছে। আমি বুঝতে পারছি না কী করব। ঐ ব্যক্তিটাকেও খুঁজে পাচ্ছি না। তবে আমি শিউর ওদের কারো মধ্যেই এসব কেউ করছে। দিশার উপর থেকে আপাতত আমার সন্দেহ উঠে গিয়েছে। আর বাকি রাফাত, ওর উপর আমার সন্দেহ হচ্ছে না। কারণ ওর আমার ব্যাপারে কোনো ইন্টারেস্টই নেই। ও সারাক্ষণ এশা এশা’ই করে। তো এখন সবশেষে সন্দেহ বার বার এশার উপরই পড়ছে। তারও অবশ্য কারণ আছে। আজ সকালে আমি এশাকে অরূপের কথা বলেছিলাম। রাফাতও কিন্তু অরূপের ব্যাপারে জানে না, জানে শুধু এশা। ওমা, বিকেলে দেখি লরিন আমাকে মেসেজ দিয়ে অরূপের কথা জানতে চাইছে। এখন তুই’ই বল, লরিন কী করে অরূপের কথা জানল? মানলাম, ও হয়তো আমাদের বাড়ির উপর নজর রাখে সেই সুবাদে আমাদের বাড়িতে যে মেহমান এসেছে সেটা হয়তো ও দেখেছে; কিন্তু এখানে অরূপের নাম ও কী করে জানল? আমার তো মনে হচ্ছে এশা’ই ওকে অরূপের কথা বলেছে, আর তাছাড়া ওর জানার কোনো উপায়ও নেই।’
মোহানার কথা শুনে মাহিয়াও খুব চিন্তায় পড়ল। উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,
‘এখন তাহলে কী করবে? যদি সত্যি সত্যিই এশাপু এত কিছু করে থাকে, তখন?’
মোহনা শক্ত হয়ে বসল। বলল,
‘কাল আমি ওর সাথে সরাসরি কথা বলব। আর কত লুকোচুরি হবে? এবার যা হবে সামনা সামনি হবে।’
চলবে…